১। আমি কম্পিউটার সিটির রায়ানস থেকেই ডিভিডি বেশি কিনি। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর কল্যানে কিছু ফাও আয় হয়। কিছু বাড়তি অর্থ পকেটে আসে আর আমি ছুটে যাই রায়ানস-এ। নতুন ছবির চেয়ে আমি বেশি খুঁজি পুরোনো ছবিগুলো। একদিন যেয়ে দেখি অনেক পুরোনো একটা ছবি, জাজমেন্ট অ্যাট নুরেমবার্গ। কিনতে এক সেকেন্ডও ব্যয় হয়নি আমার।
মনে আছে একসময় বিটিভিতে সাটারডে নাইট মুভিতে অনেক ভাল ভাল ছবি দেখাতো। এখন আর সেসব দেখি না। আমার মনে আছে অনেক ভাল ছবি দেখেছিলাম বিটিভির কল্যানে। এখন ডিভিডিই ভরসা। সে সময় এই ছবিটা বা এই নামেই একটা সিরিয়াল দেখিয়েছিল এইটুকুই মনে আছে। বিস্তারিত আর কিছু মনে নাই । মুভিটা কিনে আমি আবার দেখলাম, বলা যায় গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখলাম।
ছবিতে দেখানো হয়েছে জার্মান বিচারকদের ট্রায়াল, যারা বিচারের নামে বিরুদ্ধবাদিদের বিভিন্ন ক্যাম্পে পাঠাতো। নুরেমবার্গে সত্যিই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছিল। তবে মুভিটায় যে বিচারটি দেখায় তা সত্যি হলেও চরিত্রগুলো কাল্পনিক।
২. ১৯৪৩ সালের শেষ দিকে তেহরানে বসেছিল ত্রিপক্ষীয় নৈশ ভোজ সভা। ছিলেন স্টালিন, রুজভেল্ট আর চার্চিল। ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ জার্মান অফিসারকে বিচার করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন স্টালিন। আপত্তি জানান চার্চিল। তার কথা ছিল যে সব সৈন্য তার নিজ দেশের পক্ষে যুদ্ধ করেছে তাদের ঠান্ডা মাথায় ফাঁসিতে ঝুলানো ঠিক হবে না। এর পরিবর্তে যুদ্ধের জন্য যারা দায়ী তাদের বিচার করার প্রস্তাব দেন তিনি।
এরপরই ইউএস ট্রেজারি সেক্রেটারি হেনরি মর্গেনথাউ জুনিয়রের পরিকল্পনা অনুযায়ী বিচার বসে জার্মানিরই নুরেমবার্গে। বলা হয়েছিল যেখানে অপরাধ ঘটেছে সেখানেই বিচার হতে হবে। ১৯৪৫ এর ২০ নভেম্বর বিচার শুরু হয়। প্রায় ২শ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হয়েছিল। ১৯৪৯ পর্যন্ত তা চলে।
৩। মুভিটা ৩ ঘন্টার। দেখতে বসলে কখন শেষ হবে টেরই পাওয়া যায় না। ছবির শুরুটা মার্কিন জাজ ডান হাওয়ার্ডের নুরেমবার্গ পৌছানোর মধ্য দিয়ে। এই চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন স্পেনসার ট্রেসি। যুদ্ধাপরাধী চার বিচারকের একজন ড. আর্নস্ট জেনিং (বার্ট লানকাসটার)। জুডি গারল্যান্ড ও মন্টোগোমারি কিফট ছোট্র দুই চরিত্রে অভিনয় করলেও তাদের অসাধারণ অভিনয়ের রেশ সহজে যায় না। আর আছে জার্মান অভিনেতা, অভিযুক্তদের পক্ষের আইনজীবী হান্স রোলফ (ম্যাক্সিমিলিয়ান স্কেল), সেরা অভিনেতার অস্কার পেয়েছিলেন।
ড. জেনিং এর চরিত্রটি এমন ভাবে তৈরি তাতে প্রায় শেষ পর্যন্ত অভিযুক্ত হলেও সহানুভূতি তার দিকেই যায়। বিচার হয়েছিল মূলত দুটি ঘটনা নিয়ে। ঘটনা দুটি সত্যি। একটি হলো একজন হিটলার বিরোধীকে (মন্টোগোমারি কিফট) নপুংশক করা এবং আরেকটি হলো একজন ইহুদির সঙ্গে সম্পর্ক রাখায় জুডি গারল্যান্ডকে শাস্তি দেওয়া নিয়ে।
গল্পটা বলে মজা নষ্ট করতে চাই না। যারা দেখেননি জলদি দেখেন। শেষটা তো অসাধারণ, চমকে দিবে। জেনিং এর প্রতি আগের সহানুভুতি কোথায় রাখবেন সেটাই তখন প্রশ্ন হয়ে দেখা দেবে।
জেনিং যখন স্বীকার করে নেয় যে সে অপরাধী, বিচার করে তাদের পাঠনোদের ক্যাম্পে কি করা হতো তা তাদের জানার কথা নয় বলে দায় এরাতে পারেন না। অভিযুক্তদের আইনজীবি তখন বলেছিলেন, জেনিং অপরাধ স্বীকার করে নেওয়ায় বাকি তিন বিচারকও দোষী হয়ে পড়বেন। দোষী যদি তারা হন, তাহলে হিটলারের সঙ্গে চুক্তি করায় রাশিয়াও দোষী, চার্চিল হিটলারকে এক সময় প্রশংসা করায় চার্চিলও দায়ী, আর দায়ী মার্কিণ পুজিবাদিরা, যারা হিটলারকে অস্ত্র বিক্রি করে লাভবান হয়েছিলেন। বিচার করলে সবাইকে করতে হবে। ছবিতে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের একটা ডকুমেন্টারি বিচার কার্যের সময় দেখানো হয়।
(মনে আছে ওয়াশিংটনে আমি আর ডেইলি স্টারের ইনাম ভাই হলোকস্ট মিউজিয়ামে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছিলাম। যদিও প্যালেস্টাইন ঘটনায় ইহুদীদের প্রতি খুব বেশি সহাননুভূতি এখন আর অনুভব করি না)।
এই বিচারকরা আইন মেনে বিচার করেননি, বরং হিটলার কি চায় সে অনুযায়ী রায় দিতেন। (বাংলাদেশের সঙ্গে কিছু মিল খুঁজবেন না যেন)।
৪। ট্রায়াল রুমে প্রথমেই দেখায় বসে আছে অভিযুক্ত চার বিচারক। আমি ফ্যান্টাসিতে ঢুকে পড়লাম। আহা যদি এমন হতো বাংলাদেশে। ঐ চারজন যদি হতো গো আজম, নিজামী, সাইদী ও মুজাহিদ।
জার্মানীর চার বিচারক সরাসরি কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। তারপরেও তাদের যাবজ্জীবন হয়েছিল। অপরাধ -তারাই নিরাপরাধদের বিচারের নামে ক্যাম্পে পাঠাতেন আর সেখানে তাদের ভাগ্যে কি ঘটতো তা তো সবারই জানা।
গো-নিজামী-মুজাহিদদের অপরাধ তো সে তুলনায় হাজারগুন বেশি। তাহলে তাদের কেন বিচার হবে না?
বুদ্ধিজীবি হত্যা, সাধারণ মানুষগুলোকে নির্বিচারে হত্যা বা অসংখ্য মা-বোনের সম্ভ্রম হানি, কোনটার দায় এড়াতে পারবে এরা?
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সেই গণআদালতের একজন দর্শক ছিলাম আমি। মনে আছে সেই দিনটার কথা। আশা ছিল সরকার নিশ্চই যুদ্ধাপরাধীদের সত্যিকার বিচার করবেন। কিন্তু উল্টো নাগরিকত্ব পেয়ে গেল গো.আজম।
দিন এখনো শেষ হয়নি। অতীত ছাড়া বর্তমান হয়না, ভবিষ্যতেরও বিনির্মাণ হয় না। মুজাহিদ যদি বলতে পারে গত তারা এখনো মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবস্থান মূল্যায়ন করেনি, তাহলে আমরা কেন বলতো পারবো না ওদের বিচার হোউক। সরকার বলছে যে এবার বিচার হবেই। তবুও আমার সংশয় যায় না।
‘ওরা মানুষ হত্যা করেছে, আসুন আমরা জানোয়ার হত্যা করি’-আসুন আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করি।
* ছবির একটি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের, আরেকটি বাংলাদেশেরই একটি বধ্যভূমি। মৌলিক কি পার্থক্য আছে।
২৭ টি মন্তব্য : “যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও মুভি: জাজমেন্ট অ্যাট নুরেমবার্গ”
মন্তব্য করুন
🙂
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
:thumbup: :thumbup: :salute: :salute:
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
🙂
ভাইয়া পরের বার গেলে আওয়াজ দিয়ে যাইয়েন
কালকেই তো গেছিলাম। 🙂
judgement at nuremberg ইউটিউবে দেখতে পারেন এইখানে
যারা দেখেন নাই দ্যাখেন। ধন্যবাম মাস্ফু
মাথাঘুরানি ভালো হয় নাই। সাল্লুরে কয় মাস্ফু :grr:
পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না
আমার পিসিতে ফন্ট এতো ছোট যে পড়তে দূরবীন লাগে। ভুল হইছে ভাইয়া । মাফ কইরা দাও
=)) =)) :)) :))
😀 😀
ভার্টিগো কাটছে? না অহনো ঘোরের মইধ্যে আছো? :no: :no: :no:
"মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"
ভাল হইছিল। তয় একজনরে দেইখ্যা আমার ঘুরায় মনে হইতাছে।
বিখ্যাত নুরেমবার্গ ট্রায়াল নিয়ে ছবিটির খোজ দেয়ার জন্য শওকত ভাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ। রায়ানস এ গিয়ে ধরনা দিতে হবে শিগগিরই 🙂
সেটাকি 'নাইট এন্ড ফগ'?
অ্যালেইন রাসনেইস এর এই ডক্যুমেন্টারিটাকে শুধু ২য় বিশ্বযুদ্ধের উপরে করা ডক্যুমেন্টারি হিসেবে নয়, ডক্যুমেন্টারি ফিল্মের ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা ফিল্ম ধরা হয়। আগ্রহীরা দেখতে পারেন। শওকত ভাই পোস্টের সাথে গর্তের ভেতর বুলড্রজার মৃতদেহ ফেলার যে ইমেজটি দিয়েছেন এটি দেখে নাইট এন্ড ফগ'এর কথা মনে আসলো।
:salute: :salute:
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধীগুলোর ফাসি চাচ্ছি ।
সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!
ঐ ঐ ঐ
ঐ ঐ ঐ
এইটাই কিনা ঠিক বলতে পারবো না। তবে অ্যাড করার জন্য বিশাল থ্যাংকু :clap:
আবার কমেন্ত করতে হচ্ছে আগেরটা ছাপা হলোনা......।কেনো হলোনা সেই কথাটি কেও বলে দিলোনা। যাই হোক অসাধারন। আপনাকে ধন্নবাদ।
জানি না তো কি সমস্যা হইছে। আর তো কোনো মন্তব্য দেখলাম না।
ভাইয়া, হিচকক সাহেবের কি অবস্থা?
বিচার হইবো কিনা এই নিয়া পুরা টেনশিত আছি, লক্ষন পুরা আউলা-ঝাউলা হই আছে।
পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না
হিচকক হবে। আসলেই লক্ষ্মন আউলা ঝাউলা
বেশ ভালো লাগলো আপনার এই পোস্ট পড়ে। আমি মনে করি হলোকাস্ট নিয়ে আরও কিছু পোস্ট সিসিবিতে লেখা হওয়া উচিত। আপনি যেই ছবিটা দিয়েছেন এই ক্যাম্পের নাম বের্গেন-বেলসেন যা মুক্ত হয় ব্রিটিশ রয়াল আর্টিলারি দ্বারা ১৯৪৫ এর এপ্রিলে, দেখুন রয়াল আর্টিলারির কমান্ডিং অফিসারের বক্তব্য, যে বলছে তারা পায় ১৭,০০০ মৃতদেহ যার অর্ধেক তারা একটী গনকবরে কবর দিতে সফল হয়।
এছাড়াও দেখুন, অনেকগুলো নাতসী extermination camp এর উপর ভিত্তি করে একটি পুরোন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধত্তোর প্রামান্যচিত্র যা ৮ টি পর্বে বিভক্ত। আমি প্রথম পর্বটি এমবেড করছি। এখানেই পাবেন সর্ববৃহত ক্যাম্প আওসফিট্জ্ (auschwitz) যার কয়দী ছিলো অ্যানে ফ্র্যাঙ্ক।
অ্যাড করতে বলতে এসে দেখি কাজটা শুরু করে দিয়েছো। অসাধারণ একটা কাজ। পোস্টটা অনেক সমৃদ্ধ হচ্ছে।
বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হলে খুব ভাল লাগবে। তবে না হলে একটুও অবাক হবো না।
"জাজমেন্ট অ্যাট ন্যুরেমবার্গ" দেখতে হবে।
এই সিনেমার ডিরেক্টর দেখলাম স্ট্যানলি ক্র্যামার। গত মাসেই তার নাম শুনেছি। তার আরেকটা মুভি "ইনহেরিট দ্য উইন্ড" সম্পর্কে জেনে খুব ভাল লেগেছিল। বিবর্তনবাদের বিপক্ষে হওয়া এক মামলার ট্রায়াল নিয়ে করা এই সিনেমাটা তখন থেকেই খুঁজছি। এখন ক্র্যামারের আরেকটা মুভি লিস্টে যোগ হল। দুটাই জোগাড় করার ইচ্ছা আছে।
শওকত ভাই,আপনার যেমন দেখে কিনতে দেরি হয় নাই,আমারও আপনার লেখা পরে মুভিটা দেখতে দেরি হবেনা।দেখার পর ব্লগে লিখব।