দুধ কাহিনী, খাঁটি vs পাউডার

যতদূর মনে পরে, আম্মার সঙ্গে প্রথম দ্বন্দ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ি দুধ খাওয়া নিয়ে। তিনি আমাকে পেল্লায় সাইজের একটা কাঁসার মগে করে প্রায় এক পোয়া দুধ সামনে রেখে খান্ডারনীর মত থাকিয়ে থাকতেন, যতক্ষন পর্যন্ত তা শেষ না হবে। এমন কি বিকালে খেলতে যাওয়ার মত নিস্পাপ চাহিদার সংগে “দুধ খেয়ে তারপর যাও” এর মত কঠিন শাস্তি জুড়ে দিতেন।

ছোট বেলায় অক্ষরিক অর্থেই ওজনে কম ছিলাম। ডাক্তারী ভাষায় “হি ইজ আন্ডার-ওয়েট”। আমি আবার দশ ভাই-বোনের মাঝে সবচেয়ে ছোট, আমার জন্মের আগেই আমার দাদাজান ইন্তেকাল করেছেন, আর আমার বাবা আমার জন্মের পর থেকেই আমার মাঝে তার প্রয়াত বাপজান কে খুঁজে পেয়েছেন। “আরেএ এর নাক তো বাপজানের মত”, “দেখছ ভুরু কুচঁকানি, পুরাই বাপজান”, আমার নাম হয়ে গেল “হাজ্বী-সাহেব”, আমার দাদাকে এলাকার লোকজন যে নামে ডাকতেন। তো তার এহেন প্রিয় “হাজ্বী-সাহেব” আন্ডার-ওয়েট থাকবে এটা মেনে নিতে বড়ই কষ্ট হচ্ছিল তার। তাই শুরু হল আমার কষ্টের পালা। “এ টেষ্ট, সে টেষ্ট, কত যে আধুনিক যন্ত্রপাতি” এর পালা শেষ করে ডাক্তাররা রায় দিলেন “কোন রোগ নেই”। কৃমি আছে নাকি, না তাও নেই। তাহলে এখন উপায়?

উপায় একটা বের হল, ভিটামিন ইঞ্জেকশন সকাল বিকাল দুইবেলা, আর ডিম, দুধ। টানা তিনমাস ইঞ্জেকশন দিলাম, শেষে এমন অবস্থা হল, গোসলের পর হাতে কতগুলো ইঞ্জেকশনের ফুটো আছে গুনে বলে দেয়া যেত, কিন্তু ওজন বাড়ল না। বাবার আড়ালে হাসাহাসি শুরু করে দিল পিঠাপিঠি বড় দুই ভাই, বলে “বরকত নাই হে তোর, আব্বা তোকে বেশি দেয়, তাও তোর কিছু নাই, এই দেখ আমাদের” বলে পেশি ফুলায়। এই দুইজনের একজন আবার তখন, যাকে বলে “রানিং ফৌজিয়ান”।

তখন তিন ধরনের গুড়া খাবার পাওয়া যেত, আম-জনতার পছন্দের প্রথমে ছিল হরলিক্স, ছিল ভিভা, সাইজে হরলিক্সের কৌটার চেয়ে একটু বড় আর দামেও একটু কম, আর ছিল মাইলো, চকলেট ফ্লেভার। অচিরেই আম্মা বের করে ফেললেন শুধু দুধ দিলে আমি যদি পনেরবার চিল্লাই, হরলিক্স মিশানো দুধে চিল্লাই দশবার, আর মাইলো মিশানো দুধে এটা নেমে আসে পাচ থেকে ছয়ে। আর নামবেই না কেন, মাইলোর কৌটার গায়ে এক বিশাল “শক্তিমানের” ছবি আছে, যে আবার হার্ডলসের উপর দিয়ে লাফও দিচ্ছে, আমাকে ওর মত তো হতে হবে, ভাইয়া সারাক্ষন মাসল দেখায়, আমার ইজ্জতে লাগে।

তো এই করতে করতে ক্যাডেট কলেজ পদার্পণ, প্রথম মিল্ক-টাইমে যখন যাই, আবছা মনে আছে, দুধ খেতে হবে শুনে খুব কষ্ট লেগেছিল। খাব না, এটাই ফাইনাল, কিন্তু গাইড ভাইয়া যখন কাপে দুধ ঢেলে খেতে বললেন, “উম্মা এইটা কি খেলাম আমি” অবস্থা। ভাইয়া পরম মমতায় আরও খাব কিনা জানতে চায়, আমি প্রবল ভাবে মাথা নাড়ি দুইপাশে, ওরে বাবারে বাবা, এইটা কি জিনিস। সপ্তাহের মাথায় বুঝে ফেললাম, এই দুধ ক্লাস সেভেন আর এইট ছাড়া কেউ খায় না। আমিও ছাড়লাম এই দুধ খাওয়া, ট্রেডিশন ফলো করতে হবে তো, খেয়ে ফেললে ট্রেডিশন ব্রেক, ক্লাস নাইন থেকে এই দুধ খায় না। যে খায় সে একটা বিরাট “মফিজ” তাই এইটা করা যাবে না। আম্মা অবশ্য ব্যাগের চিপায় প্রতিবার একটা মাইলো গুজে দেন, প্যারেন্টস ডে সঙ্গে নিয়ে আসেন একটা, কিন্তু ততদিন বুঝে গেছি আমি, “মাইলো খেতে দুধ লাগে না, ওটা এমনি এমনি খাওয়া যায়”।

টেন অথবা ইলেভেনে, নতুন একটা ডিনার আইটেম যোগ হল মেনুতে।
“ইংলিশ ডিনার”। বড় বাহারী মেনু তার, মুরগীর রোষ্ট, পাউরুটি, বাটার/জেলী, কলা আর সূপ্য। খুব আগ্রহ নিয়ে খেতে বসলাম, রোষ্টটা ফাটাফাটি, পাউরুটি, বাটার কলা চলে। আর সূপ্য, ওরে বাবা, খেলার সময় হঠাৎ করে কাদাপানি মুখে ঢুকে গেলে যেই টেষ্ট লাগে, তার কাছাকাছি স্বাদের। কে খাবে এইটা? তখন ডাইনিং হলের চার্জে ফিজিক্সের হাশেম স্যার, ওনার সবকিছু ধরে-বুঝে উঠতে একটু বেশিই সময় লাগে, তৃতীয় অথবা চতুর্থ সপ্তাহে তিনি টের পেলেন “ক্যাডেটরা সুপ্য খাচ্ছে না”। বিরাট সমস্যা। প্রিন্সিপাল জেনে গেলে কেলেঙ্কারীর এক শেষ। কেলেঙ্কারী বাচাতে অস্থির হয়ে তিনি এই টেবিল, সেই টেবিল ছুটাছুটি করা শুরু করলেন “এই বাবারা তোমরা সুউপ খাচ্ছ না কেন? সুউপ খাও”। ট্রেডিশন চালু হয়ে গেছে সুপ্য না খাওয়ার, ক্যাডেটরা কাপে সুপ্য ঢেলে রাখে, স্যার টেবিলের কাছাকাছি আসলে কাপ মুখের কাছে ধরে রাখে, স্যার চলে গেলে নামিয়ে রাখে। কেউ কি স্বেচ্ছায় আর কাদাপানি খায় নাকি? দুধ আর সুপ্য হয়ে গেল দুনিয়ার সবথেকে বিস্বাদ পানীয়।

দুধ যে মজার হতে পারে টের পেলাম প্রথম ইন্টার কলেজ স্পোর্টস মিটে, ঝিনাইদহে গিয়ে। প্রথম মিল্ক ব্রেকে দেখি দুধ খুবই মজার। “কিরে কেস কি? দুধ মজা লাগে ক্যান এত?”

প্রথম পর্যায়ের খেলার জন্য এসেছি এখানে, আমরা আর ঝিনাইদহ ছাড়াও আছে পাবনা, রাজশাহী আর বরিশাল। বাকীগুলো খেলতে গেছে মির্জাপুরে। পাবনা আর বরিশালের সংগে মিলে যেতে একটু টাইমও লাগলো না, রাজশাহী খেলা নিয়ে খুব সিরিয়াস, তার উপর আবার পুরান কলেজ, ভাবসাবই আলাদা। আর ঝিনাইদহ, এরা তো হোষ্ট কলেজ, এক নম্বর শত্রু, তাই সাইজ করতে হবে এই দুইটা কলেজকে। জুনিয়র কলেজের আমরা জোট পাকাই প্রথম দিনেই। দুধ কেন মজার এই রহস্যও বের করে ফেলে একজন, “আরে এর বড় ক্যাম্পাস, বুঝস না, এদের গরুর ফার্ম আছে, গরুর খাটি দুধ এইগুলা, পাউডার না।“ হতেও পারে, আবার নাও হতে পারে, কিন্তু দুধ মজার কোন সন্দেহ নাই।

গ্যাঞ্জাম লাগলো পরদিন ব্রেকফাষ্টে, অনেক অচেনা অজানা বন্ধু, ডাইনিং এ ধুমায় গল্প চলছে, স্যারেরাও আছেন। ঝিনাইদহের সিপি ডাইনিং এ ঢুকেই এক বিকট চিৎকার “বয়েজ, কিপ শাট”। আমরা বাকী কলেজ হতভম্ব, এইটা কি পাগল নাকি, ক্লাস টুয়েল্ভ কে শাউট করে। এইটারে পয়লা সাইজ করা দরকার, “হাতি ঘোড়া গেল তল, ঝিনাইদহের সিপি মিয়া কয় কত জল”। আরে বুঝস না, “এইটা হইল গিয়া গরুর খাটি দুধের ফজিলত”।

সিপি তল খুজে পেল পরদিন ব্রেকফাষ্টে। সবাই যথারীতি হাজির, কথা বার্তাও চলছে, সিপি ডাইনিং এ ঢুকে যথারীতি আবার শাউট। তিনি এবার অবশ্য রিটার্ন পেলেন, দেখলেন তার চেয়ে উচ্চস্বরে পাবনা, বরিশাল আর রংপুর বলছে “হো জা মাল হো”। সিপি বেচারা চুপ, ব্রেকফাষ্টের পর রুমে আসলেন আমাদের এডজুটেন্ট, জানালেন, এটা এদের ট্রেডিশন, আমরা কেন অপমান করলাম হোষ্ট কলেজের সিপি কে? “স্যার ব্যাপার কি, এরা গরুর খাটি দুধ খায়, আমরা খাই পাউডার, তাই ট্রেডিশনে একটু পার্থক্য হয়ে গেছে আরকি”। এডজুটেন্ট নিজেও এক্স-ক্যাডেট, প্রতিজ্ঞা করালেন ঝিনাইদহ কে হারাতে হবে, তাহলে মাফ হবে এইটার। আরে এইটা কোন ব্যাপার নাকি।

দুপুরের পরে রেষ্ট টাইমে সিপি মহোদয় আসলেন, ভূল বুঝাবুঝির অবসানের জন্য, ট্রেডিশনের গল্প শুনালেন আবার, আমরাও শুনিয়ে দিলাম দুধের গল্পটা আরেক বার।

“আরে ভাই এইটা আসলে খাটি আর পাউডারের পার্থক্য, তোমাদের বয়েজ কিপ শাট হচ্ছে খাটি, আর আমাদের হো জা মাল হো হচ্ছে পাউডার। ব্যাপার না। আমরা আমরাই তো”।

আহারে কই গেল সেই সোনা রঙ্গা দিন গুলো।

অফটপিক ১। সিপি বাকী দিন গুলো খুব ভালো ব্যবহার করেছে আমাদের সংগে।

অফটপিক ২। ভাই বৃক্ষপ্রজাতি, মাইন্ড খাইওনা প্লিজ।

৬,৯৪০ বার দেখা হয়েছে

১০৮ টি মন্তব্য : “দুধ কাহিনী, খাঁটি vs পাউডার”

  1. কামরুলতপু (৯৬-০২)

    একটা লেখা দিলাম ভাবলাম আজকে তো কোন লেখা নাই আমিই বেষ্ট টার্ণ আউট হইয়া যামু কিন্তু ফয়েজ ভাই দিল গুবলেট পাকাইয়া।
    ভাইয়া বহুদিন পরে এখন আবার কলেজের লেখা আসতেছে সেইরকম ভাল লাগতাছে। আমার ও অনেক কিছু মনে পইড়া যাইতাছে কিন্তু আমি একদিনে দুইটা লেখা দেই না। আমারে কিন্তু রিকোয়েষ্ট কইরেন না।

    জবাব দিন
  2. ভাই চান্সে কলেজ ধইরা টিজ করছেন, ব্যাপারটা ভাল্লাগেনাই... আর এই অভ্যাস দেখি এখনো ছাড়েন নাই... ক্যাডেট হইলে কি এই টিজ করার অভ্যাস কোনদিন যায় না?? আপনে কলেজ ছাড়ছেন প্রায় বিশ বছর...হায় হায় : :bash: :bash: আমাগেরো এমন হইবো !!

    ভাই, যাই কন, আপনের লেখার ইশটাইল কিন্তুক ঝাক্কাস... মাইরি অসাধারণ টেশট... হি হি হি ঠিক ঐ দুধের মত... :goragori: :goragori:

    এই রকম জোসস একটা পোস্ট এর জন্য ধন্যবাদ...
    :salute: :salute:

    জবাব দিন
  3. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    x-( x-( x-( আমি সিউর এইটা সেই জাপান প্রবাসী গাছ সিপি(যার মাধ্যমে জেসিসির বৃখ নামের সূত্রপাত...পাঠক কামরুল ভাইয়ের ইফতারি সংক্রান্ত আমার পূর্বের ব্লগ দেখুন...)

    জবাব দিন
  4. রকিবুল ইসলাম (৯৯-০৫)
    ক্যাডেট হইলে কি এই টিজ করার অভ্যাস কোনদিন যায় না??

    যাইবো কেন?আমি টিজ ভালা পাই। 🙂

    অফটপিকঃ
    আমাদের আইসিসি ভিবিএম হইছিলো বরিশাল।তো সেই খানেও জেসিসির সিপি আমাগো শাউট করছিলো।পরে তারে একটু টিজ দিছিলাম।

    জবাব দিন
  5. শরিফ সাগর (৯৭-০৩)

    আমি কন্ডেন্সড মিল্করে খুব ভালা পাই। 😉
    কিন্তু আজকাল বাজারের যা অবস্থা। কন্ডেন্সড, পাউডার, তরল, নরম যে দুধের কথাই কন না ক্যান এত্তো দাম!!! হাত দেয়া যায় না ~x(

    জবাব দিন
  6. রাজীউর রহমান (১৯৯৯ - ২০০৫)

    আমরা কলেজ থেকে বাহির হওয়ার আগ পর্যন্ত সুপের সেই কাদামিশ্রিত স্বাদ বজায় ছিল ।

    আমরা মিল্ক ব্রেকে চা খেতাম । দুধ খাওয়ানোর চেষ্টা অথরিটি করেছিল। কোন লাভ হয় নাই।

    জবাব দিন
  7. সামি হক (৯০-৯৬)

    ফয়েজ ভাই আপনারা তিন ক্যাডেট কলেজ তো দেখি মহা খারাপ হোজামালহো এইটা আমি যতোদূর জানি ঝিনাইদহের আবিষ্কার আর আপনারা ওদের আবিষ্কার দিয়ে ওদের সিপি রে সাইজ দিলেন?

    ও রাজশাহীতে আমাদের কলেজের ফার্ম এর গরুর দুধ দিতো তাও আমরা ক্যান জিতলাম না এইটাতে মনে হয় একটা সূক্ষ কারচুপী আছে।

    জবাব দিন
    • ফয়েজ (৮৭-৯৩)

      হো জাল মাল হো কোথায় কখন কিভাবে আবিস্কার হয়েছে এটা মনে করতে পারছিনা। তবে রংপুর ক্যাডেটে এটা আমরা নিয়ে এসেছিলাম। আমার মনে আছে এটা আমরা এক্স-টেনে থাকার সময় ব্যাপক ব্যবহার করেছিলাম। তখন প্রেপ টাইমের প্রথম দশ মিনিট আমরা লাইট বন্ধ করে কোরাস করে এটা গাইতাম।


      পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

      জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।