খেরোখাতা – কোথায় আছো, কেমন আছো, মা?

মেয়েরা কি মায়ের মত ভালোবাসা দিতে পারে?

আমায় প্রশ্ন করলে ছোট্ট করে উত্তর দিবঃ না, পারে না।

স্নেহ অধঃগামী, আমার মা আমাকে তাঁর বাবার চেয়ে বেশী ভালোবাসতেন, আমি আমার মেয়েকে বেশি ভালোবাসি আমার মায়ের চেয়ে, আর আমার মেয়ে, তার সন্তানকে বেশী ভালোবাসবে, যতটুকু ভালোবাসবে তাঁর এই বাবাকে।

এটাই বাস্তব, মন মানুক আর নাই মানুক। এইই হবে।

মায়ের সংগে আমার কখনই আদর-সোহাগ ভরা কথা হয়নি। কখনই না। আমার মা যে চাইতেন না তা নয়, তিনি বেশ ভালো করেই চাইতেন, আমি বুঝতে পারতাম। কিন্তু আমার কখনো বলা হয়ে উঠেনি আমার মাকে “ আমি তোমাকে ভালোবাসি মা, খুব খুব ভালোবাসি”। অথচ আমার মা আমাকে প্রায় প্রতিদিনই তাঁর ভালোবাসার কথা শুনাতেন। এর মধ্যে অন্য কোন চাওয়া-পাওয়া ছিল না । অথবা ছিল না অন্য চাহিদা কোনকিছুর।

বাবার চাহিদা ছিল অনেক, পরীক্ষায় ভালো করতে হবে, আদর্শ ছাত্র হতে হবে, ক্যাডেটে চান্স পেতে হবে, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে হবে, খেলায় প্রাইজ পেতে হবে, অ—নে—ক। হয়ত সবগুলোই আমার ভালোর জন্যই চাইতেন তিনি। হয়তোবা। কিন্তু, কিন্তু ছোট্ট আমি যে দম হারিয়ে ফেলতাম তাঁর চাহিদা পূরন করতে গিয়ে।

আর মা?

না, তাঁর এমন কোন চাহিদা ছিল না। অংকে সর্বোচ্চ নাম্বার পেলেও তিনি স্কুল থেকে ফেরা এই আমার মুখে মমতায় ভরা দু’মুঠো খাবার যেভাবে তুলে দিতেন, ইংরেজীতে ফেল করলেও সেই মমতা মাখা হাতে ভালোবাসার কমতি দেখিনি কোনদিন। বেশীর থেকে বেশী হয়ত বলতেন, আমার ব্যর্থতায় তিনি দূঃখ পেয়েছেন। ব্যস, এটুকুই।

সারাজীবন আপ্রান চেস্টা করে গেছেন, যাতে আমার প্রাপ্য সমস্ত ঝড় তাঁর উপর দিয়েই যায়, সেই ঝড় যেইদিক থেকেই আসুক না কেন, বাবা, স্কুল, পরীক্ষা, খেলাধূলা, চাকুরী, অসূস্থতা, সব, সব এমনকি সওওওওওব।

সিএমএইচে অনেকদিন এডমিট ছিলাম, প্রতিদিন তিনি আমাকে দেখতে আসতেন, রিক্সা করে। ফেরার সময় রিক্সা পেতেন না, হেঁটে যেতে হত অনেকটা পথ, দুপুরের রোদ্রের মধ্যে। এমনকি একদিন রাস্তায় পড়েও গিয়েছিলেন হোঁচট খেয়ে। কিন্তু হাসিমাখা ঐ মুখ কোনদিন বলেনি “তুমি তো সূস্থ হয়ে গেছ, আমি এখন থেকে একদিন পর পর আসবো তোমাকে দেখত।” কোনদিন না।

বাবা কি আসতেন এমন করে আমাকে দেখতে?

ইন্টারের পরের এলোমেলো সময়টাতে একমাত্র আমার মা আমার উপর আস্থা রেখেছিলেন, আর কেউ না। এই আমি সাক্ষী দিলাম। আর কেউ না জানুক বা না জানুক, আমি জানি। এর পরে, আমাকে দিয়ে যত সফল কাজ হয়েছে, পারিবারিক ভাবে স্বীকৃত, তার সমস্ত কিছু হয়েছে একমাত্র আমার মায়ের জন্য। এই আমি সাক্ষী দিলাম। সেই সময় আমার মা পাশে না দাঁড়ালে, আমি হারিয়ে যেতাম অন্ধকারে, এই আমি আবারো সাক্ষী দিলাম।

জিহান জন্মের পরে আমাকে অনেকবার বলেছিলেন, “তোমার নতুন মা চলে এসেছে বাবা, এবার ছুটি আমার ।” আমি এসব কথার গুরুত্ব কখনই দেইনি। দেয়ার প্রয়োজন মনে হয়নি, হয়তো হাসতাম তাঁর কথায়। হয়তো ভাবতাম, মায়েরা এমন কথা তো বলেই, এ আর এমন কি।

কি বোকা আমি!?

একটা আফসোস ছিল জীবনে, আমার মাকে সবাই স্বপ্নে দেখে, ভাই-ভাবী-বউ তো বটেই এমনকি দুধওয়ালা, মাছওয়ালা পর্যন্ত। কিন্তু আমি দেখিনা। আজব।

যদি দেখতে পেতাম, কিভাবে দেখতাম তাঁকে? কেমন আছে আমার মা? কোথায় আছে সে?

প্রতিদিন অসংখ্যবার মেয়েকে বলি “আমি তোমাকে ভালোবাসি মা” “মা, আমি তোমাকে ভালোবাসি খুব” “ I love you, Mamony” “I miss you, mamony”.

আমার মাকে যদি, তাঁরা সারাটা জীবনে, মাত্র একটিবার এই কথাটা বলতে পারতাম!

২,৯৫৩ বার দেখা হয়েছে

৪৪ টি মন্তব্য : “খেরোখাতা – কোথায় আছো, কেমন আছো, মা?”

  1. সামিয়া (৯৯-০৫)

    🙁 আমার মা আমাকে খুবই যন্ত্রণা দেয়, বিশেষ করে খাওয়া দাওয়া আর ঘুম নিয়ে। আমিও কি আপনার মত বুড়া বয়সে আম্মা আম্মা বলে কাঁদব? অবশ্য আম্মাকে বলে রাখসি আমার পরে মরতে হবে তাকে, নাইলে খবরাসে।

    জবাব দিন
    • ফয়েজ (৮৭-৯৩)

      মেয়েদের আমি একটা কারনেই ঈর্ষা করি, কারন তাঁরা মা হতে পারে। ছেলেরা কি আর, বেশীর থেকে বেশী বাবাই হবে, এইতো।

      আমাকে বুড়া বললা, এইবার তো মাসুম ভাই ভীষণ লজ্জা পাবে। সানাউল্লাহ ভাইতো মুখই দেখাবে আর তোমাকে :grr:


      পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

      জবাব দিন
  2. আছিব (২০০০-২০০৬)

    কলেজের প্রথম পাবলিক স্পিকিং ক্লাসের টপিক ছিল ''আমার মা''। এই সম্পর্কে বলা শুরু করার মিনিটখানেকের মধ্যে যখন বেকুবের মত টপাটপ কানতে শুরু করলাম,তখন বুঝলাম আসলে মাকে আমি কতটা ভালোবাসি।

    খুব কাছের মানুষকে খুব দূরে থেকেই বেশি অনুভব করার যায়।

    বস :boss:

    জবাব দিন
  3. আয়েশা ( মগকক) আয়েশা

    আমাদের শৈশবে মাদেরকে ভালবাসার কথা বলা যেতনা।আমরা অভ্যস্ত নই বলেই বোধহয় বলতে পারিনা...মা' কে জড়িয়ে ধরা- চুমু খাওয়া, বেবি বলা ...এই পর্যন্ত-ই হয় শুধু।
    জানিনা কখনো বলতে পারব কিনা.... "ভালবাসি মা - খুব খু-উ-ব "
    ধন্যবাদ ফয়েজ ভাই এই লিখাটা দেবার জন্য।

    জবাব দিন
    • ফয়েজ (৮৭-৯৩)

      বাবার সংগে একটা দূরত্ব ছিল আমাদের, সামাজিক অবস্থাটাই ছিল তেমন। বাবাকে মনে হত বাইরের কেউ, যিনি বিকাল হলে বেড়াতে আসেন বাসায়, আবার সকাল হলেই চলে যান নিজের জায়গায়। সেই তুলনায় মা অনেক কাছাকাছি।

      কত কাছাকাছি ছিলাম, অথচ কত দূরে দূরে ছিল অনুভূতিগুলো 🙁


      পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

      জবাব দিন
  4. সামীউর (৯৭-০৩)

    বাসায় থাকলে আম্মা একটু পরে পরে এটা সেটা নিয়া বকাবকি করে। ঘর এলোমেলো কেন , এত রাত পর্যন্ত টিভি দেখো কেন...এইসব। আম্মু সিলেটে চলেগেলে দুই একদিন বাসাটা খুব শান্তি শান্তি লাগে। কিন্তু তারপর এতো ফাঁকা লাগে...

    জবাব দিন
  5. রেশাদ (১৯৯৩ -৯৯)

    মাকে সত্যি কোনদিন বলা হয়নি ভালবাসি মা, এবার হবে। আপনার এই লেখাটা আমার মাকে পড়তে দেব, পড়া শেষে মা জানবে আমি বলতে চাই 'ভালবাসি মা'

    দূরদেশে মন খারাপ করিয়ে দেয়ার পরও ধন্যবাদ ফয়েজ ভাই।

    জবাব দিন
  6. মইনুল (১৯৯২-১৯৯৮)

    স্নেহ ভালোবাসা জিনিসটা ভারী তরলের মতন জিনিস ফয়েজ ভাই। সবসময় নিচের দিকে নামে। ওপরের দিকে ওঠানো খুব কষ্টের কাজ। চেষ্টা করার চেষ্টা করলেই লজ্জা-সংকোচ টাইপের জিনিসগুলো মুখ চেপে ধরে।

    জবাব দিন
  7. রাব্বী (৯২-৯৮)

    কিছু একটা লিখতে চাইলাম। কিন্তু কি লেখা যায়! সবকিছু মুখে না বললেও চলে, ফয়েজ ভাই। আপনার মা নিশ্চই বুঝতেন আপনার এই অনুভূতি।


    আমার বন্ধুয়া বিহনে

    জবাব দিন
    • ফয়েজ (৮৭-৯৩)

      সাইফ ভাইয়ের পোস্টটা শুধুমাত্র তাঁর মাকে নিয়েই, তিনি সন্তানের প্রসংগ আনেননি। নিজের সন্তানকে নিয়ে লিখেছেন, অন্য পোস্টে, অন্য ব্লগে। আমি তাঁর কাছে জানতেও চেয়েছিলাম, তাঁর সংগে সন্তানের সম্পর্ক কেমন?

      বাবা-মা না হলে আসলে তাঁদের অনুভূতিগুলো বুঝা যায় না। আমি বাবা হবার পরে বুঝেছি আমার বাবা আসলে কত ডাইনামিক ছিলেন। শারমীন (আমার বউ) যেমন এখন প্রায়ই বলে, সে এখন বুঝতে পারছে তাঁর মাকে সে কত যন্ত্রনা দিয়েছে।

      এটা একটা সার্কেল, আলাদা করে রাখা যায়, তবে আলাদা করা মানে হল নিজেকেই ঠকানো, অন্যদের তো বটেই।


      পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

      জবাব দিন
  8. কিবরিয়া (২০০৩-২০০৯)

    ফয়েজ ভাই, নেক্সট টাইমে রংপুরে আইলে আপ্নেরে "স্টার"এ খাওয়ামু।। 😀


    যেমন রক্তের মধ্যে জন্ম নেয় সোনালি অসুখ-তারপর ফুটে ওঠে ত্বকে মাংসে বীভৎস ক্ষরতা।
    জাতির শরীরে আজ তেম্নি দ্যাখো দুরারোগ্য ব্যাধি - ধর্মান্ধ পিশাচ আর পরকাল ব্যবসায়ি রূপে
    - রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ

    জবাব দিন
  9. কানিজ ফাতিমা সুমাইয়া (অতিথি)

    ফয়েজ ভাইয়া, লেখাটা কেমন হয়েছে জানি না,শুধু কিছুক্ষন পর পর কম্পিউটার এর স্ক্রীন টা ঝাপসা হয়ে আসছিল।আপনার মতো আমার ও হয়েছে একই দশা।সময় থাকতে বলা হয়ে ওঠে নি মা কে অনেক কথা।আর এখন শুধু কারনে অকারনে মা কে খুঁজি।হঠাত করেই এক দিন আবিস্কার করলাম আমার সব অন্যায় আবদার,নালিশ আর একান্ত কথা গুলো বলার মানুষ টা আর নায়।গত ১৭ ই রমজানে,০৯ আমি আমার জীবনের সব থেকে কাছের এই মানুষ টা কে হারিয়ে ফেলেছি।এখন ও গভীর রাতে ঘুম ভেংগে গেলে পাশে হাতরে মা কে খুঁজি,মোবাইল এর রিংটোন বেজে উঠলে মনে হয় এই বুঝি মার কন্ঠ শুনতে পাবো ঐ প্রান্তে।হায় আফসোস, মা আমার শুয়ে আছে আজ গহীন কবরে !আমার সময় চলে গেছে,কিন্তু যাদের সুযোগ আছে তারা প্লীজ আর দেরি না করে আজই গিয়ে মা কে বলুন, কত যে কত যে ভালবাসেন আপনি তা কে।
    অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া এমন একটি লেখা উপহার দেয়ার জন্য।

    জবাব দিন
    • ফয়েজ (৮৭-৯৩)
      আমার সময় চলে গেছে,কিন্তু যাদের সুযোগ আছে তারা প্লীজ আর দেরি না করে আজই গিয়ে মা কে বলুন, কত যে কত যে ভালবাসেন আপনি তা কে।

      ঠিকই বলেছো, আমাদের সময় চলে গেছে, কিন্তু অন্যরা যেন এই সুযোগ মিস না করে।


      পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

      জবাব দিন
  10. তাইফুর (৯২-৯৮)
    অংকে সর্বোচ্চ নাম্বার পেলেও তিনি স্কুল থেকে ফেরা এই আমার মুখে মমতায় ভরা দু’মুঠো খাবার যেভাবে তুলে দিতেন, ইংরেজীতে ফেল করলেও সেই মমতা মাখা হাতে ভালোবাসার কমতি দেখিনি কোনদিন। বেশীর থেকে বেশী হয়ত বলতেন, আমার ব্যর্থতায় তিনি দূঃখ পেয়েছেন। ব্যস, এটুকুই।
    কিন্তু হাসিমাখা ঐ মুখ কোনদিন বলেনি “তুমি তো সূস্থ হয়ে গেছ, আমি এখন থেকে একদিন পর পর আসবো তোমাকে দেখত।” কোনদিন না।

    ধুরো ফয়েজ ভাই,
    অফিসে ভেজা ভেজা চোখে বসে থাকি ক্যাম্নে ??
    ঝাপসা চোখে ৫ দাগায়ে গেলাম


    পথ ভাবে 'আমি দেব', রথ ভাবে 'আমি',
    মূর্তি ভাবে 'আমি দেব', হাসে অন্তর্যামী॥

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।