১৯৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে আমার নিরাপরাধ দুই চাচা নিহত হলেন। বাবা তার প্রিন্টিং প্রেস ব্যবসা হারালেন এবং যুদ্ধে তার দুই ভাইকে হারিয়ে মানসিক ভাবে দুর্বল হয়ে পড়লেন। বিশেষ করে যখন জানলেন যে তার এক ভাইকে মিলিটারীরা অন্যদের সাথে নদীর ধারে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মেরেছে এবং অন্য ভাইকে স্থানীয় বিহারীরা তাকে ঘরের মধ্যে রেখে বাইরে থেকে দরজায় শিকল তুলে দিয়ে বাড়ীতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে জীবন্ত পুড়িয়ে মেরেছে।
সারা জীবনের সঞ্চয় ব্যায় করে আমার বাবা-মা তাদের শেষ জীবনে যশোরে তৈরী করেছিলেন তাদের স্বপ্ন-কুঠীর (DREAM-DALE) এবং জীবনের বাকীটা সময় সেখানেই কাটাবেন বলে আশা করেছিলেন। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, আর হয় আর এক। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ তাদের সে স্বপ্নকে ছিন্ন ভিন্ন করে দিলো। এর পর আমার বাবার হার্ট এ্যাটাক ও প্রায় ষ্ট্রোক হবার পর আমি আমার বাবা-মাকে ঢাকায় আমার সাথে থাকার জন্যে নিয়ে আসি। দেশ সবে স্বাধীন হয়েছে। আমি তখন ধানমণ্ডিতে এক বিঘা প্লটের মোটামুটি বড় একটা বাড়ীতে থাকি। বাবা-মার জন্যে সেখানে আলাদা ঘরে থাকার ব্যবস্থা করতে অসুবিধা হলো না। বাড়ীতে চাকর, দারোয়ান, বাবুর্চি সবই ছিলো তাঁদের খেদমতে – কিন্তু সব চাইতে বেশী তাঁরা যা চাইতেন, ঘাটতি ছিলো সেখানেই। তাঁরা চাইতেন আমার সঙ্গ, চাইতেন তাঁদের জীবনের আভিজ্ঞতার গল্প আমাকে শুনাতে আর আমার জীবনের এক অংশ হতে। কিন্তু আমি ছিলাম তখন দৃষ্টিহীন ও বধির – তাঁদের জন্যে সময় ছিলো না আমার।
আমি সকালে উঠে ঢাকা ক্লাবে যেতাম স্কোয়াশ খেলতে। সেখান থেকে ফিরে গোসল করে তাড়াতাড়ি মুখে কিছু খাবার গুজে যেতাম অফিসে। বেক্সিমকোর শুরু থেকে কাজ করছিলাম আমি সেখানে। বেক্সিমকো তখন বাংলাদেশের প্রাইভেট সেক্টরে সর্ববৃহৎ প্রতিষ্ঠান এবং ক্রমেই আরও বড় হয়ে চলেছে। আমি তখন প্রজেক্টস ডিভিশনের প্রধান এবং কোম্পানীর এক জন সিনিয়ার ভাইস-প্রেসিডেন্ট – সব সময় নানা কাজে ব্যস্ত। সন্ধ্যা গুলো ব্যস্ত থাকতো বিভিন্ন সামাজিকতায়। হয়তো বন্ধুদের বাসায় বেড়াতে যাচ্ছি অথবা পার্টিতে। যখন দেরীতে বাসায় ফিরতাম – কখনো কখনো দেখতাম যে মা অপেক্ষা করছেন আমার সাথে কথা বলার জন্যে। কথা বলতে যেয়ে পাছে আমার মুখ থেকে এ্যালকোহলের গন্ধ পেয়ে যান, তাই মাকে বলতাম পরে কথা হবে। সেই সময় আর সাধারণত হয়ে উঠতো না।
আমার বোনেরা ব্যাপারটা খেয়াল করেছিলো, কিন্তু সরাসরি আমাকে এ ব্যাপারে বলার সাহস কারও ছিলো না। পরে তাদের এক জনের বাচ্চা হবার অজুহাতে মাকে সে তার বাসায় নিলো এবং বাবাও মার সাথে গেলেন। আমি বাধা দিলাম না, বরং মনে মনে খুশীই হলাম যে আবার আমাদের বাসায় আমরা ’ডে-পার্টি’ দিতে পারবো।
বছরগুলি দ্রুত পার হতে লাগলো। আমি তখন বিভিন্ন কাজে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যাতায়াত করে বেড়াচ্ছি। আমার বাবার মৃত্যুর পর আমরা কয়েক বছর বিলাতে থাকলাম। বোনের বাসায় মার থাকাটাতেই আমরা ততদিনে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। বিলেত থেকে ফিরে আমি বেক্সিমকো কম্পিউটার্স-এর ম্যানেজিং ডিরেক্টরের দায়িত্ব নিলাম। ইতিমধ্যে কম্পিউটারে প্রথম বাংলা শব্দলিপি – ”শহীদলিপি” করার কৃতিত্বের জন্যে বিবিসি টেলিভিশন ও রেডিও-তে আমার সাক্ষাৎকার প্রকাশ হবার পর বাংলাদেশ টেলিভিশনও আমাকে নিয়ে একটি নিয়মিত অনুষ্ঠান প্রচার শুরু করে দিলো। এ সব কিছু আমার গর্ব আরও বাড়িয়ে দিলো। আমি বেক্সিমকো থেকে আলাদা হয়ে আমার নিজের কম্পিউটার কোম্পানী শুরু করলাম। পরের বছরগুলি আরও তাড়াতাড়ি যেতে লাগলো।
আমার মা তখন পল্লবীতে আমার বোনের বাসায় থাকেন। আমি থাকতাম গুলশানে এবং আমার অফিস ছিলো ধানমন্ডিতে। তবুও সময় করে মাঝে মাঝে মাকে দেখতে যেতাম। সপ্তাহে কখনো এক বার, কখনো বা দুইবার – তবে আমার যাবার কোন নির্দ্দিষ্ট দিন ঠিক ছিলো না। তবুও আমার মা আমাকে দেখে সব সময়ই খুব খুশী হতেন। তিনি কখনো অনুযোগ করতেন না কেন আরও বেশী আসিনা বলে। ততদিনে তিনি শিখে গেছেন আমার সাথে বেশী কথা বলার চেষ্টা না করতে। মা শুধু আমার দিকে স্নেহভরা চোখে তাকিয়ে থাকতেন এবং সুযোগ পেলে হাতটা স্পর্শ করতেন। এর মধ্যে পড়ে গিয়ে তিনি তার পা ভেঙ্গে ফেলেছেন এবং অপারেশনের পর পায়ে স্থাপনকৃত স্টিল রডের জন্যে বেশীক্ষণ দাঁড়ালে কষ্ট পেতেন।
আমি একটা জিনিস লক্ষ্য করেছিলাম যে যখনি আমি বোনের বাসায় মাকে দেখার জন্যে যেতাম – সব সময় দেখতাম আমার প্রতীক্ষায় সামনের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। প্রতিবারই তাকে একই ভাবে আমার জন্যে দাঁড়িতে থাকতে দেখে অবাক হতাম আমি – বিশেষ করে যেহেতু আমার আসার কোন নির্দ্দিষ্ট দিন ঠিক ছিলো না। হয়তো তাঁর কোন বিশেষ সাইকিক ক্ষমতার বলে তিনি বুঝতে পারতেন যে আমি আসবো সেদিন। আমার কৌঁতুহল আর দমন করতে না পেরে একদিন বোনকে প্রশ্ন করলাম:
– আচ্ছা মা কি ভাবে বুঝতে পারেন যে আজ আমি আসবো? যখনি আমি আসি দেখি মা ঠিক ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছেন – যেন আমারই প্রতিক্ষায়। কি ভাবে বোঝেন তিনি কখন আসছি আমি?
– ভাই, মা তো প্রত্যেকদিন দুপুরের খাবার পর থেকেই সারাক্ষণ এখানে এসে দাঁড়িয়ে থাকে যদি তুমি আসো এই আশায়।
১৭ বছর পার হয়ে গেছে মার মৃত্যুর পর। আমার ছেলেকে কোলে নিয়ে মা বসে আছেন – এমন একটা ফটো বড় করে বাঁধিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছি আমার বেড রুমে। ঠিক তার উপরে ঝুলছে আর একটি ছবি – যেখানে মা দাঁড়িয়ে আছেন এক বছরের আমাকে কোলে নিয়ে। এখন আমি প্রায়শ এই ছবির দিকে তাকাই আর ভাবি – কেন আমি আরও সময় মার সাথে ব্যয় করিনি যখন তিনি বেঁচে ছিলেন।
[আমাকে ক্ষমা করে দিও মা, আজ তোমার আদরের ছেলের জন্মদিন]
:clap:
ভাষা হারিয়ে ফেললাম । ভালো থাকুন ভাইয়া।
জন্মদিনের অনেক অনেক শুভেচ্ছা ভাইয়া.......... 🙂
লেখাটা পড়ে একই সাথে মন খারাপ হলো এবং আপনার বর্তমান অনুভুতি (নিজের ভুল বুঝতে পারাটা) দেখে ভাল লাগল। আপনি আপনার মায়ের জন্য বেশি করে দোয়া করবেন। শুনেছি, মৃত্যুর পরও নাকি সন্তানের দোয়া কাজে লাগে। যে ব্যক্তি এ দুনিয়ায় সুসন্তান রেখে গেল, সে পরকালের জন্য রোজগারের ব্যবস্থা করে রেখে গেল (কোরয়ান-হাদীসের উক্তি কিনা জানিনা, তবে আমি বিশ্বাস করি 🙂 )। দোয়া করি আপনার মা বেহেস্তবাসী হোক। :boss: :boss:
মা রা আসলেই বুঝতে পারেন, এটা সিক্সথ সেন্স টাইপ কোন ক্ষমতা বলে আমার বিশ্বাস। এ বিষয়ে আমার এই পোষ্ট পড়লে প্রমাণ পাবেনঃ মা
*কোরআন :bash:
আরে, উপরে আমার আগের কমেন্টটা গেল কোথায়? এত বড় একটা কমেন্ট করছিলাম, হাওয়া হইয়া গেল 🙁 । ব্যাপার না, আবার করিঃ
সাইফ/শহীদ ভাই, আপনার এই লেখাটা পড়ে একই সাথে মনটা খারাপ হয়ে গেল এবং আপনার বর্তমান অনুভুতি (নিজের ভুল বুঝতে পারাটা) দেখে ভাল লাগল। আপনি বেশি করে আপনার মায়ের জন্য দোয়া করবেন। শুনেছি, সন্তানের দোয়া নাকি মৃত্যুর পরেও কাজে লাগে। "যে ব্যক্তি দুনিয়াতে সুসন্তান রেখে গেল, সে তার আখেরাতের জন্য রোজগারের রাস্তা খুলে রেখে গেল" (কোরআন না হাদীস এর কথা, আমার ঠিক জানা নাই, তবে আমি এটা বিশ্বাস করি।
মা রা কিন্তু আসলেই বুঝতে পারে। এটা এক ধরনের সিক্সথ সেন্স যা কিনা সৃষ্টিকর্তা সব মায়েদের মধ্যেই কমবেশি দিয়েছেন। এ বিষয়ে আমার এই পোষ্টটা পড়লে প্রমাণ পাবেনঃ মা
দোয়া করি, আপনার মা জান্নাতবাসী হোক এবং আপনার সন্তানদের যেন ভবিষ্যতে আপনার মতো আক্ষেপ করতে না হয় :boss:
লেখাটা পড়ে সত্যিই চোখটা কেমন ঝাপসা হয়ে এলো।
শুভ জন্মদিন ভাইয়া।
সাতেও নাই, পাঁচেও নাই
ঐ
শুভ জন্মদিন ভাইয়া।
আপনার সংগে আপনার সন্তানের সম্পর্ক কেমন?
পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না
শুভ জন্মদিন ভাইয়া । মা'র কথা মনে করিয়ে দিলেন । এত দূরে থাকি যেতেও পারছিনা 🙁
শুভ জন্মদিন ভাইয়া...
অঃটঃ আপনার লিঙ্কে যেয়ে শহীদলিপির ইতিহাস পড়লাম, খুব ভালো লাগলো, পারলে একবার ওই সময়টা নিয়ে একটা ব্লগ দিয়েন।
শুভ জন্মদিন সাইফুদ্দাহার ভাই ......
শুভ জন্মদিন ভাইয়া।
এত্ত মন খারাপ করা অবস্থায় এর আগে কখনও জন্মদিনের উইশ করিনি। 🙁
চোখ থেকে বেশ কয়েক ফোটা পানি ঝরে পড়লো............শুভ জন্মদিন ভাইয়া............পরশুই চলে যাচ্ছি, মা'র সাথে ২/১ টা দিন পার করে দিতে......। :boss: :boss:
শুভ জন্মদিন ভাইয়া।
শহীদলিপির জন্য দেরীতে হলেও অভিনন্দন।
আপনার মাকে আল্লাহ ভালো রাখুন।
শুভ জন্মদিন সাইফ ভাই। আর সবার মতো, ঝাপসা চোখ নিয়ে আপনাকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।
"মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"
ভাইয়া আজ আপনার জন্মদিন আর আমি জানিনা-দুর্ভাগ্য আমার,আপনার জন্মদিনে নিজে একটা পোস্ট দিতে পারলামনা।আগামী বৎসর অবশ্যই হবে আশা করি।
শুভ জন্মদিন ভাই .......... কষ্টের রঙে........... সাহসী স্বীকারোক্তি ...... :salute: :salute:
শুভ জন্মদিন ভাই, মায়েরা সবসময়ই অসাধারণ হয়।
শুভ জন্মদিন।ভালো থাকুন।
শুভ জন্মদিন ভাইয়া।
একেবারেই বাকরুদ্ধ করে দিলেন। আপনার এই পোস্ট পড়ে কিছু সিদ্ধান্ত নিলাম ।
শুভ জন্মদিন ভাই
:party: ভাই,জন্মদিনটা ভালো কাটুক।দোয়া করি আপনার সন্তানেরা আপনার মত ভুল যেন না করে। 🙁
ভাই,আমাদের জন্যও দোয়া করবেন ,যেনো আমরাও এরকম ভুল না করি। :boss:
শুভ জন্মদিন ভাইয়া ...
সহমত আছিব ভাই 🙁
"Never think that you’re not supposed to be there. Cause you wouldn’t be there if you wasn’t supposed to be there."
- A Concerto Is a Conversation
শুভ জন্মদিন সাইফ ভাই।
“Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
― Mahatma Gandhi
মায়ের আত্মার জন্য শুভকামনা।
আর আপনাকে শুভ জন্মদিন।
শুভ জন্মদিন ভাইয়া... লেখাটা পড়তে পড়তে খুব কষ্ট হল, আমরা কি সবসময় এভাবে চিন্তা করি...???
শহীদ ভাই, আপনার আবেগঘন লেখাটা পড়লাম।
কিন্তু এ মুহূর্তে আপনাকে সময় ও ইতিহাসের প্রয়োজনে কম্পিউটারে বাংলা ভাষা ব্যবহার ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তথ্যবহুল একটা লেখা দাবি করছি সচলায়তন ব্লগে, অতিথি লেখক হিসেবেই।
নিশ্চয়ই খেয়াল করছেন, জনাব মোস্তফা জব্বার নিজেকে বাংলাভাষার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হিসেবে অন্যায় দাবি করে অভ্র নিয়ে যেসব আপত্তিকর কথাবার্তা সংবাদ মাধ্যমে বলছেন, এর প্রতিবাদ ও প্রতিবিধান জরুরি হয়ে পড়েছে বাংলাভাষার নিরাপত্তার প্রয়োজনেই। আমরা যতটুকু জানি, তাঁর আগে এ ক্ষেত্রে আপনার এবং আপনাদেরও অনেক অবদান রয়েছে। এসব প্রতিবাদের নমুনা হিসেবে এই পোস্টটা অন্তত দেখতে পারেন।
আপনাকে বিনীতভাবে অনুরোধ করছি, আপনি কি সময়ের ডাকে সাড়া দেবেন ?
ভালো থাকবেন। ধন্যবাদ।