আমার আরও কিছু সময় বাকী আছে

জন্মস্থানের সোঁদা গন্ধ পেরিয়ে আমি আরও দক্ষিনে এগিয়ে যাই। সোনালী রোদ্দুরেরা এবার আমায় ঘিরে ফেলে।

আমি সাঁতার শিখি, সোনালী মাছের পাখনায়, আমি দূর্বার ঘ্রান নেই, প্রজাপতির ডানায় চড়ে ভেসে বেড়াই পুরোটা আকাশ, রোদের সংগে ছায়ার লুকোচুরি খেলি। গোপন কুঠুরি থেকে বের করে আনি দূর্লভ চিলের ছানা, উড়িয়ে দেই আকাশে। রাজকন্যার দল আমাকে ঝর্ণার পানিতে খেলতে ডাকে। পাখির সংগে ডালে ডালে উড়ে বেড়াই, দু-চোখ মেলে দেখি বাতাসে শিশিরের মিলিয়ে যাওয়া। ঘুড়ি হয়ে নীলকে ছুঁই, আংগুলের মাথায় এসে বসে ঘাস ফড়িং। একসময় তারা আমাকে বেঁধে ফেলতে চায়, আমার বড্ড বিরক্ত লাগে তখন, নিজেকে বড় বড় মনে হয়। সব বন্ধন ছিড়ে আমি এগিয়ে যেতে চাই আরও দক্ষিনে।

কিছুদূর এগুতেই সুরেলা কন্ঠ আমার কানে আসে। খোঁপায় বাধানো চন্দ্রমল্লিকারা আমাকে খুব করে কাছে টানে, যদিও আমার মাথায় তখন লাল কাপড় বাঁধা, তর্জনীতে লাল পতাকা। আমি চিৎকার করে শোষন আর বঞ্চনার বিরুদ্ধে রুখে দাড়াই, আমার গলার রগ ফুলে ফুলে উঠে, হাতের পেশী মুষ্টিবদ্ধ হয়ে যায়, বন্ধুর লাল রক্তে ভিজে ভিজে যায় রাজপথ। রাজপথ, অলি-গলি ভিজে ভিজে লাল হয়ে যায়। আমি লাল-সবুজ পতাকা খুঁজি সবখানে। রমনীয় ঘ্রানে আমার রোম পুলকিত হয়, আমি মঞ্চে নামি, আমি কবিতা লিখি, আমি আবৃত্তি করি, আমি মিছিলে মিছিলে দিন কাটিয়ে দেই। আমি আমাকে খুঁজি, আমি আমাকে অনবরত বদলাই।

আমি বিচ্ছিন হতে চাই, বিদীর্ণ হতে চাই। বাস্তবতা আমাকে টেনে আনে মাটিতে, আমি ঘাম মুছি, কিংবা আমি ঘামের ঘ্রান মুছি। ধূলো মাখা ধূসর সন্ধ্যা আমাকে বিরক্ত করে, কোলাহলে আমি ক্লান্ত হই, ক্লান্ত হতে হতে আমি ঘুমিয়ে পড়ি, কিংবা জেগে উঠি, এবং আমি আবার আমার ক্লেদান্ত ক্লান্তিতে ক্লান্ত হই। আমার সবুজ পাতায় লাল নীল সোনালী রংগের ছাপ পড়ে। আমি গোছানোর দেশে যাই, তাদের কৃত্রিমতায় ব্যথিত হই, সাজানো শো-কেসের পৌনপুনিকতায় বিভ্রান্ত হই, কৃত্রিম হাসির আড়ষ্টতা আমাকে বিষন্ন করে তোলে। আমি ভীড়ের মাঝে ক্লান্ত হয়ে নির্জণতার কাছে যাই, নির্জণতার বিষন্ন সুরে ক্লান্ত হয়ে আবার কোলাহলে আসার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ি। আমি আশ্চর্য এক গোলকধাধায় আটকে যাই। আমি বুঝতে পারি, আমি এ রকম অসংখ্য গোলকধাধা নিয়েই সারা জীবন কাটিয়ে দিতে পারব। কারন এটাই নিয়ম। আমি নিয়ম ভাংতে চাই, আমার ক্লান্তি লাগে। অতৃপ্তির ঘুণপোকা আমাকে ঝাঁঝরা করে, অথবা আমি নিজেই ঝাঁঝরা করি নিজেকে। আমি হারিয়ে ফেলি আমাকে।

আমি কাচা অপটু হাতে নির্জন প্রাসাদ বানাই। প্রচন্ড ঝড় উঠে, আমরা, একজন পুরুষ আর একজন নারী, সর্ব-শক্তি দিয়ে দেয়ালটাকে জড়িয়ে ধরি। ঝড় বাড়ে, আমার বন্ধন আরও দৃঢ় হয়। আমরা, মানব-মানবী হাতে হাত ধরে দেয়ালটাকে সামলে রাখি, মনে হয় অনন্তকাল সময়। এবং এক সময় ঝড় থেমে যায়। ক্লান্ত আমরা হাত ছেড়ে দেই, বাতাসে হাফ ছাড়ি। এরপর আমরা রঙ মাপি, রোদ মাপি, বাতাসে খয়েরি আবীর ছড়ানোর ফেরি করি। অপটু দেয়াল শক্ত হয়, দেয়ালের এখানে সেখানে নীল গোলাপের চারা বের হয়। আমরা সেলাই মেশিনে লেস আর চুমকি বসানো জামা বানাই, জামার ভিতর দিয়ে নতুন শরীরের জেগে উঠা দেখে একে অপরকে অভিনন্দন জানাই। স্বপ্ন গুলো ফেরী করি, ভালো দামে বিকিয়েও দেই। বাতাসে নাইট-কুইনের ঘ্রাণ ভেসে আসে, আর সেই ঘ্রানে ঘরে চলে আসে চন্দ্রবোড়া। আমি বিরক্ত হই, আমি আরও দক্ষিনে যেতে মনস্থ করি।

পালকের বিছানায় আমার ভালোবাসারা ঘুমিয়ে থাকে, তাদের উপরে মেঘ আর ঘন কুয়াশার চাদর বিছিয়ে আমি ব্যাগ নিয়ে পিছনের পাহাড়ের চূড়ায় রওয়ানা দেই। পাহাড়ের উচ্চতা আমাকে মাতাল আর নেশাতুর করে। সম্মোহিতের মত আমি পাহাড়ের চড়াই-উৎরাই পেরোই, ঘন ঝোপ পেরোই, নাম না জানা হিংস্র সরীসৃপের গা বাচিয়ে, পিষে ফেলে, আগুনে পুড়িয়ে আমি চূড়ায় পৌছাই। আমার অসম্ভব ভালো লাগে। নিজেকে নিয়ে ভীষন রকমের গর্ব হয় আমার। আমি আমার উচ্চতা মাপি। আমি উপর থেকে আকাশ দেখি, মাটি দেখি, পিপীলিকার ধেয়ে চলা দেখি। আমার হাসি আসে, আমি বিকারগ্রস্থের মত হাসি দিনের পর দিন। ধীরে ধীরে আমি আবার ক্লান্ত বোধ করি। ক্লান্তি আমাকে ঝিমুনিতে নিয়ে যায়, ক্লান্তি আমাকে পাহাড়ের অন্য পাশে গড়িয়ে ফেলে দেয়।

আমি সেই প্রথম সাগর দেখি। কতবড় হতে পারে এটা? আমি ভাবি, কিংবা ভাবতে বসি।

সাগর আমাকে মুগ্ধ করে, ঝিনুকের গতিময়তা আমাকে গতি চিনায়, গাংচিল আমাকে শিখায় স্বাধীনতা। আমার নিজেকে খুব ছোট মনে হয়, কারণ আমি চাঁদ ধরতে পারিনা, রোদ ধরতে পারিনা, বালুকনা গুলো এক বসায় গুনে শেষ করতে পারিনা। আমি সাগরে নামি, আমার পঙ্কিলতা ধুয়ে ফেলবো বলে, আমি পবিত্র হবো বলে, কিন্তু ঢেউ আমাকে ঠেলে নিয়ে আসে, আমি আবার নামি, আবার নামি, আমি বারংবার সাগরে নামি। যদি একবার, মাত্র একটি বার সে আমাকে টেনে নেয়। আমি প্রবাল দেখবো, আমি নীল দেখবো, আমি সাগর-আকাশে মিলন দেখবো, আমি গোল্ডফিশের সংগে মিতালী করবো।

কিন্তু সাগর আমাকে নিতে চায় না, প্রচন্ড পরিশ্রমে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়ি, প্রচন্ড পিপাসা লাগে আমার। একটু পানির বিনিময়ে নাকের উপরে জমে থাকা ঘামের এক কিশোরী আমার কাছে পুরো জীবনের দুইভাগ দাবী করে বসে। নিরুপায় আমি ছেড়ে দেই জীবনের দুইভাগ, পিপাসার্ত আমি পানি পান করি মাত্র একভাগের তৃষ্ণা মেটাতে।

আমার কাছে আরও কিছু সময় বাকী থাকে। সামনে সাগর, পিছনে পাহাড়ের চূড়া। পাহাড়ের চূড়া আমাকে ডাকে, আমার ক্লান্তি লাগে, আমার যেতে ইচ্ছে করে না সেখানে। আমি সাগরে যেতে চাই, কিন্তু সাগর আমাকে ফিরিয়ে দেয় বারবার। সময়ের স্রোতে আমার মেরুদন্ড ঝুঁকে পরে।

অতঃপর আমি ঢেউ গুনতে শুরু করি। সাগরের ঢেউ। আমার আরও কিছু সময় বাকী আছে।

৪১ টি মন্তব্য : “আমার আরও কিছু সময় বাকী আছে”

  1. তৌফিক (৯৬-০২)

    বুঝি নাই 🙁

    আন্দালিবরে ডাকতে হবে... 🙁

    তবে ফয়েজ ভাই যখন লিখছেন তখন তো নিশ্চয়ই ভালো হইছে। 🙂

    অটঃ সিসিবি থেকে কাটপিস মারা শুরু হয়ে গেছে, দেখছেন নাকি ফয়েজ ভাই?

    জবাব দিন
  2. তৌফিক (৯৬-০২)
    আমি গোছানোর দেশে যাই, তাদের কৃত্রিমতায় ব্যথিত হই, সাজানো শো-কেসের পৌনপুনিকতায় বিভ্রান্ত হই, কৃত্রিম হাসির আড়ষ্টতা আমাকে বিষন্ন করে তোলে।

    :thumbup: :thumbup: :thumbup:

    আরো দুইবার পড়লাম। এবং খুব ভালো লাগলো।

    ফয়েজ ভাই, আরো তিন দিক থাকতে দক্ষিণ কেন?

    জবাব দিন
  3. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    :no: :no: :no:

    তবে ফয়েজ ভাই যখন লিখছেন তখন তো নিশ্চয়ই ভালো হইছে

    :thumbup: :thumbup:


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  4. ভাইয়া কয়েকটা বানান চোখে লাগল। চেক করে কমেন্টটা মুছে দিয়েন প্লিজ...

    ঝর্নার পানিতে--> ঝর্ণার
    বিদীর্ন--> বিদীর্ণ
    ঢেউ গুনতে --> গুণতে
    নাইট-কুইনের ঘ্রান --> ঘ্রাণ
    কারন আমি চাদ ধরতে পারিনা --> কারণ, চাঁদ
    ঘুনপোকা আমাকে ঝাঝরা --> ঝাঁঝরা, ঘুণপোকা
    হিংস্র সরীস্রপের --> সরীসৃপ
    ভীষন --> ভীষণ
    নির্জতার বিষন্ন--> নির্জনতার বিষণ্ণ

    জবাব দিন
  5. এহসান (৮৯-৯৫)

    ফয়েজ ভাই,

    দৌড়ের উপর পড়লাম। আসলে আপনার পোষ্ট বলেই পড়া। কিন্তু বুঝি নাই। আপনে আজকাল কবিতা লিখেন ভালো কথা কিন্তু আন্দালিব দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যাচ্ছেন। এই গদ্য তো দেখি... যাক... এর কি কমু... আপনি খুব খারাপ।

    আর শুনেন আমার জন্য একটু দোয়া কইরেন তো।

    জবাব দিন
  6. ওবায়দুল্লাহ (১৯৮৮-১৯৯৪)

    ফয়েজ ভাই,

    খুব সুন্দর।
    খুব ভাল লাগলো।
    আপনি কবিতা বোঝনে না বলে দাবী করেছিলেন একবার।

    এটাতো রীতিমত কবিতা :clap:

    গাংচিল আমাকে শিখায় স্বাধীনতা।

    অসাধারন ।


    সৈয়দ সাফী

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।