১.
তাবুতে থাকলে “ক্যাম্পে”র কথা মনে পড়ে, নিঃশব্দে আওড়াই-
“এখানে বনের কাছে ক্যাম্প আমি ফেলিয়াছি;
সারারাত দখিনা বাতাসে
আকাশের চাঁদের আলোয়
এক ঘাইহরিণীর ডাক শুনি—
কাহারে সে ডাকে!”
আমাদের ক্যাম্প এক জলপাই বনে, নরসিংদীর এক বর্ধিষ্ণু গ্রামে। অদূরেই ভৈরব, আড়িয়াল খাঁ নদ, ব্রহ্মপুত্রের চর, মেঘনার শুরু। চারদিকে ধান ক্ষেত, যেখানে ”ধান কাটা হয়ে গেছে”। এর মধ্যে আমাদের ক্যাম্প, একটু লোকালয়ের চিহ্ন বাদ দিলে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো স্বাধীন।
২.
“বাংলার নদী মাঠ ভাঁটফুল ঘুঙুরের মতো তার কেঁদেছিল পায়…”
আমাদের দেশে যে কোনো ভূমিচিহ্নে বন্ধনীর মতো থাকে গুল্মের ঝোপ, মানে আমরা আগাছা বলি যাকে। আমাদের এখানেও ব্যতিক্রম নয়, রাস্তার ধারে ধারে ভাঁটফুল, গোবুরা, চাকুন্দা, বাবলা, বিচুটি। মাঝে মাঝে ছোট ছোট বাঁশ ঝাড়, স্থানে স্থানে প্যাঁচিয়ে থাকা স্বর্ণলতা।
৩.
যেদিন আমরা এখানে এসেছি তখন পৌষের শুরু, আকাশে জমাদিউল আওয়ালের ক্ষয়িষ্ণু পূর্ণিমা। জলপাই বনের ছাদের ফাকে এলুমিনিয়ামের থালার মতো উজ্জ্বল বড়ো চাঁদ। সূর্যাস্তের ঘন্টাখানেক পরে হঠাৎ ঝলমলিয়ে চাঁদ উঠলো, জলপাইয়ের কম্পমান পাতার ফাঁকে ফাঁকে, আমাদের সবুজ চত্তর তরল আলোতে ভাসান। কুয়াশার আবছা আলোয় তাবুর সামনে বসে শুনছি এই উয়ারী-বটেশ্বরের প্রাচীন নিরেট ভূমিতে ধাতুর আঘাতের আওয়াজ, ট্রেঞ্চ খোড়ার শব্দ।
৪.
”কে হায় হৃদয় খুড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!”
আমার নানিয়ারচরের কথা মনে পড়ে। সেই ক্ষারিক্ষ্যং ক্যাম্প, চারদিকে নীল দিয়ে ঘেরা কাপ্তাই হ্রদের মধ্যে এক অদ্ভুত সুন্দর ক্যাম্প। সেই চাঁদে ভাসান জোৎস্না, অন্ধকার স্তব্ধ রাত্রি, পশ্চিমে যদ্দুর চোখ যায় শুধু জল, আর দূরে-বহুদূরের নীল পাহাড়ের সারি। আধ রাত্রিতে দল বেঁধে ডেকে ওঠা শেয়াল আর মাঝরাত্রিতে শীতার্ত হরিণীর ডাক। পাহাড়ের পূর্বে বিকেলের ছায়ায় বসে বই পড়া দিন। বুড়িঘাট ক্যাম্পের সামনে একটা চাঁপা গাছ ছিলো। ঘিলাছড়ির সামনে অসম্ভব সুন্দর একটা হ্যালিপ্যাড, বৃষ্টিতে ভেজা,ঘুড়ি ওড়ানো দিন।
এইসব মনে পড়লে আরণ্যকের মতো বলতে ইচ্ছা করে, অবসর দিনের শেষে সন্ধ্যায় ঘুমের ঘোরে এক সৌন্দর্যভরা জগতের স্বপ্ন দেখিয়াছিলাম, পৃথিবীতে তেমন দেশ যেন কোথাও নাই।
৫.
জীবনানন্দ পাঠের এই এক অদ্ভুত দিক, বয়সের সাথে সাথে অর্থ বদলায়, নতুন অর্থ স্থাপিত হয়।
কম বয়সে ক্যাম্পের আরজ খালি তাবু, বসন্তের হাওয়া, শিকারির বন্দুকের নল আর ঝাকে ঝাকে ছুটে আসা হরিনের দলের একটা দৃশ্যকল্পের মধ্যে আবদ্ধ ছিলো।নতুন পাঠে উপলব্ধি ভিন্ন। ঘাই হরিণীর অর্থ খুঁজি, শুনি প্রত্যাখ্যাত প্রেমিকের অদ্ভুত আঁধারের গল্প, জীবনানান্দিক বিপন্নতা।
”একে একে হরিণেরা আসিতেছে গভীর বনের পথ ছেড়ে,
সকল জলের শব্দ পিছে ফেলে অন্য এক আশ্বাসের খোঁজে
দাঁতের—নখের কথা ভূলে গিয়ে তাদের বোনের কাছে অই
সুন্দরী গাছের নীচে—জোছনায়!”
বনপথ ছেড়ে ঘাইমৃগীর সাথে মৈথুনে লিপ্ত হতে আসা মৃগের দল জলের শব্দ পিছে ফেলে আসে সুন্দরী গাছের নীচে। আমরা অনুভব করি না পাওয়ার বোধ, হারানো ক্ষতের যন্ত্রণা। যখন বুকের আরশিতে জমাট হয়ে থাকা রক্তধারার মত উৎসারিত প্রেম মিশে যায় ধুলোয়, মৃত মৃগদের মতন।
৬.
আমদের এই বনবাসের চারদিকে ধানক্ষেত। ধান কাটা হয়ে গেছে, চওড়া ক্ষেতের দুধারে ঘন বনের সারি বহুদূর পর্যন্ত চলে গেছে। শুধু বন আর ঝোপ, বাশঝাড় আর বেতঝোপ। মাঝে মাঝে বিকেল হলে হাটতে যেতে ইচ্ছা হয়, এখানের বিকেল সৈন্যদলের দৈনন্দিতায় মুখর, অথচ বাইরে তাকালে নির্জনতায় প্রশান্ত। সন্ধ্যা হলে, একটু হেটে গেলে হয়তো পাখির কূজন ছাড়া কিছুই আসবে না কানে, যেমন দেখেছি গাজীপুরের শালবনে, সূর্য নেমে গেলে এই শীতের বিলীয়মান সবুজ ক্রমশ গাঢ় হতে শুরু করে, ধীরে ধীরে রাত্রিতে মিশে যেতে থাকে। সেই নির্জন আকাশের নিচে একা দাঁড়িয়ে থাকা, যেন আর কিছু নেই পৃথিবীতে, শুধু মনের মধ্যে বাজতে থাকা গান ছাড়া, আমি ছাড়া, এই বনের ঘ্রাণ ছাড়া।
মনে হতে থাকে বিভূতিভূষণের কোনো দিনলিপির মধ্যে চলে এসেছি, বালকের সেই পথ, যে পথের শেষ হয়নি গ্রামের শেষেও। পথের দেবতা মূর্খ বালককে নিয়ে যায় দূরে, অপরাজিতর পথ বেয়ে যেখানে পথ এসে আকাশে মেশে, জাহাজে করে সেই ফিজিতে।
৭.
কবি লিখেছেন-
ধান কাটা হয়ে গেছে কবে যেন — ক্ষেত মাঠে পড়ে আছে খড়
পাতা কুটো ভাঙা ডিম — সাপের খোলস নীড় শীত।
এই সব উৎরায়ে ওইখানে মাঠের ভিতর
ঘুমাতেছে কয়েকটি পরিচিত লোক আজ — কেমন নিবিড়।
৮.
আমাদের ক্লান্ত পরিচিত লোকেরা ঘুমাচ্ছে।