তুমি ভাসবে হৃদয় মাঝে – ৬

[বি:দ্র: আমার কিন্তু এখনো সিরিজের মাঝে ফুকা দিয়া অন্য পোস্ট দেবার বাতিক সারেনাই; এর আগেরটা’র পরেও হেই কাম করসি, পরেরটা’র আগেও চান্স আছে। আগে থেকেই বইলা রাখলাম; পরে গাইল দিলে কিন্তু GAME OVER কইরা দিমু]

তুমি ভাসবে হৃদয়-মাঝে – ৫
তুমি ভাসবে হৃদয়-মাঝে – ৪
তুমি ভাসবে হৃদয়-মাঝে – ৩
তুমি ভাসবে হৃদয়-মাঝে – ২
তুমি ভাসবে হৃদয়-মাঝে – ১

কনফারেন্স রুমের এক কোণায় চুপচাপ বসে আছি। শরীর টা ভাল লাগছে না; মাথার ভেতর একটা চিনচিনে ব্যথা। রাতের বেলা ঘুম ভাল না হলে আমার এই জাতীয় উপসর্গ দেখা দেয়। খুব বিরক্তিকর। গাড়ি এখনো যে এল না, বেরোতে হবে। সকালের ক্লাস টা কোনোমতে করেছি; খুব খারাপ লাগছিল। এখন এসে কনফারেন্স টেবিলের উপর মাথা দিয়ে শুয়ে আছি, মানে বসে আছি (নাকি শুয়ে-ই আছি?!?)।

ঘরটা কি অল্প অল্প দুলছে? কেমন যেন লাগছে আমার! চারিদিকে শো শো আওয়াজ। ঘরে কেউ নেই এখন। জানালা দিয়ে বাইরে যা দেখা যাচ্ছিল এখন সেটা যাচ্ছে না। কেন যেন মনে হচ্ছে তারা আর জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই, ছুটে যাচ্ছে কোন একটা দিকে। মনে হতে লাগল হঠাৎ ঘর একটা ঝাকুনিও দিল। কি ব্যাপার কনফারেন্স রুম এরকম দোল খাবে কেন? দূরে একটা ভো করে হুইসেল ও শুনেছি যেন। আমি মাথা তুলে চারিদিক দেখতে লাগলাম। রুমটা অস্বাভাবিক ভাবে লম্বা হয়ে গেছে, সেই সাথে প্রস্থেও কমে গেছে। সিট গুলি কনফারেন্স হলের সিটের মত বিন্যাস্ত নেই, কেমন যেন বাসের সিটিং এ্যারেঞ্জমেন্ট যেমন হয় তেমন লাগছে। আমি কোথায় রে বাবা?? চারিদিকে শো শো আওয়াজ টাই বা কিসের?

মিষ্টি একটি শব্দ আমার কাছে এগিয়ে আসছে বেশ টের পাচ্ছি। মনে হচ্ছে কেউ যেন হেঁটে হেঁটে আসল, রিনরিনে শব্দটি মিলিয়ে যেতে না যেতে আমার থেকে কোণাকুনি দাঁড়িয়ে সে হঠাৎ বলে উঠলো “আমাকে কেমন লাগছে?”…

শো শো আওয়াজ, আজিব কিসিমের দুলুনি, জানালার বাইরের দৃশ্যের ছুটে যাওয়া, বাসের কম্পার্টমেন্টের মত করে সাজানো অস্বাভাবিক লম্বা আর ততোধিক চিপা ‘কনফারেন্স হল’ — সব একই সাথে ভেলকিবাজির মত নাই হয়ে গেল; নিজেকে আবার খুঁজে পেলাম সেই আগে যেখানে ছিলাম সেখানে। ঘোর লাগা দিবাস্বপ্নের কোন সেকশনের আওতাধীন করা যায় আমার আজকের এই ভ্রমকে, আমি ভেবে দেখার সুযোগ পেলাম না। বাস্তবের সাথে এভাবে একাকার হয়ে যাওয়া স্বপ্নের বিষয়টিকে এখন আর আমল দিতে ইচ্ছে হচ্ছেনা, কারণ স্বপ্নভঙ্গের পর সেই বাস্তবে আমার দিক থেকে একটু কোণাকুনি পজিশনে সুমি দাঁড়িয়ে আছে।

“কি ভাইয়া বলছেন না কেন আমাকে কেমন লাগছে আজ?”

আমি একটু ভাল করে তার দিকে তাকানোর চেষ্টা করলাম। বুঝে পেলাম না, সে সরাসরি আমাকে এসে এই প্রশ্নটাই কেন করল। আমি কি ঘুমাচ্ছিলাম না? তাহলে স্বপ্ন দেখলাম কি ভাবে? ভাবনাচিন্তার গতি আবার এলোমেলো হবার আগেই ওর চোখে মুখে হালকা অস্থিরতার আভাস পেলাম। আমার উত্তর আসতে স্বাভাবিক-এর চেয়ে দেরি-ই হচ্ছে মনে হয়। কি করব? ঘোর থেকে বের হতে একটু সময় লাগে তো! তবু আপাদমস্তক লক্ষ্য করলাম। আজ ক্রিম রঙের একটা পোষাকে এসেছে সে, সাথে সবুজাভ নীল, যাকে বলে সাগরের নীল, সেই রঙের ওড়না। ছোট্ট একটা মেক-আপ নিয়েছে, হালকা লিপস্টিকের প্রলেপ সেটা জানান দিচ্ছে; সেই সাথে চোখে কাজলের রেখা ঐ চেহারার আকর্ষণ করার ক্ষমতায় আরেকটা মাত্রা যোগ করেছে। ছেড়ে দেয়া চুলের ফাঁক দিয়ে ঝুমকা দু’টো একটু একটু উঁকি দিচ্ছে, তাদের সাথে ক্রমাগত শোরগোল করে যাচ্ছে ওড়নাতে লাগানো ছোট ছোট ঘুঙুরগুলো।

“ভাল, বেশ ভাল, সুন্দর লাগছে। কিন্তু হঠাৎ এই প্রশ্ন?” আমি পাল্টা ছুঁড়ে দিলাম।
“আপনি যেভাবে আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলেন…”
“আমি তাকিয়ে ছিলাম? কি জানি… কিন্তু তুমি আজ এত সেজে?”
“আজ আমাদের ডিপার্টমেন্টে নবীন বরণের প্রোগ্রাম, আপনি জানেন না?”

আয় হায়… ভুলেই গিয়েছিলাম যে আজ একটা প্রোগ্রাম ছিল। আমি সাধারনত মিস করি কম; যে কোন ডিপার্টমেন্টে প্রোগ্রাম হলে দেখতে যাই – সময় টা ভাল কাটে। আর ভার্সিটির ছেলেমেয়েরা যেসব প্রোগ্রাম এ্যারেঞ্জ করে সেগুলো বেশ চিত্তাকর্ষক। আজ যাওয়া হয়নি। রাতে ঘুমাইনি গতকাল; সারারাত জেগে এ্যাসাইনমেন্ট করেছি। আলসে কি না, শেষ মূহুর্তে দৌড়াতে দেখা যায় আমাকে। না ঘুমানোর কারণে আমার শরীর টা মনে হয় আসলেই খারাপ। মস্তিষ্কে ওলট-পালট সিগনাল গিয়ে উদ্ভট সব দৃশ্য দেখিয়ে নিল আমাকে দিয়ে একটু আগে! তাছাড়া এদের ডিপার্টমেন্টের ছেলেপেলে একটা অড্‌ টাইমে প্রোগ্রাম সেট করেছে; আমার শিডিউলটা পছন্দ হয়নি। হয়তো সে কারণেই মনে নেই।

ঘোর লাগা ভাব থেকে বেরিয়ে কিছুটা ধাতস্থ হবার পর জিজ্ঞেস করলাম “ওওও…… তা কি অবস্থা? প্রোগ্রামের?”
“শেষ তো! অনেক আগেই। ভাল ছিল।” … ক’টা বাজে এখন? My Gosh!! বিকাল ৩টা?? তার মানে সেই এগারোটা থেকে আমি ঘুম, এই কনফারেন্স হলের টেবিলের উপরে! কিন্তু ‘ঘুম’ বলার কি আর উপায় রাখল এই মেয়ে? আমি নাকি তাকিয়ে ছিলাম! তাকিয়ে তাকিয়ে ঘুমিয়েছি? আমি কি জলজ প্রাণী??
“আপনাকে আমি প্রোগ্রামে এক্সপেক্ট করেছিলাম।”
“কেন কেন?” আমার স্নায়ূগুলো তড়াক করে যেন দাঁড়িয়ে গেল। “আপনার সেদিনকার গান টা খুব-ই সুন্দর হয়েছিল। ভেবেছিলাম নবীন বরণের অনুষ্ঠানে আপনি কিছু শুনাবেন।”

আমার তো মনের ভেতরে বেহেশতি হাওয়া দিতে লাগল কথাগুলো শুনে। সে আমার মত এই অধমের গলা দিয়ে বেরুনো নিরেট চিৎকারস্বরুপ গানকে যে এভাবে মূল্যায়ন করবে আমি কখনও ভাবতেই পারিনি। ধন্যবাদ দেওয়া লাগে কিন্তু কিভাবে সুন্দর করে সেটি দেওয়া যায় তার উপায়-ই আমি বের করতে পারছি না। একটা বোকা বোকা হাসি টেনে বসে থাকলাম তার দিকে তাকিয়ে। “কি কথা বলেন না কেন? আপনি কেন গান গাননি?”
“না… মানে… আসলে ডিপার্টমেন্টের প্রোগ্রাম হলে হয়তো পারফর্ম করতাম। অন্য ডিপার্টমেন্টের প্রোগ্রাম; নিজে থেকে যাওয়া টা কেমন কেমন না?? এমনি দেখতে যাওয়া হয়… আর আমি তো আসলে বাজে পারফর্মার, কোনো জাতেই পড়িনা।”
“আপনি কনফিডেন্ট না কেন? Less confident মানুষ আমার পছন্দ না” — কপট রাগের সাথে বলল সে; “আপনি জানেনই না যে আপনার গান কতটা ভাল হয়। কোনদিন রেকর্ড করেছেন?”
আমাকে স্বীকার করতে হল যে আমি কখনো এত কেরিক্যাচার করে দেখিনি। মিউজিকের প্রতি আগ্রহ আছে, কিন্তু এত এক্সপেরিমেন্টের সুযোগ নেই। তাছাড়া আমাকে প্রেইজ করার কোন মানুষ তো এখন পর্যন্ত পাইনি (‘এর আগ পর্যন্ত’ আর কি)। একটু হেসে বললামঃ “তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। এবার বল কেমন আছ?”
“ভাল… ওহ সরি আপনাকে এই প্রশ্নটা করতেই ভুলে গিয়েছিলাম; আরো আগে করা উচিত ছিল।” কিঞ্চিত লাল হল সে।
“আরে ব্যাপার না। এত ফর্মালিটি করার কোনো প্রয়োজন নেই; আমার সাথে সহজ ভাবে কথা বলতে পারো।” … একটু বিরতি দিয়ে ওর কন্ট্যাক্ট নম্বর টা চাইবার একটা এক্সকিউজ উপস্থাপন করতে যাব, এমন সময় তার ফোন বেজে উঠল। ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে একটু কথা বলে নিয়ে আমাকে বলল, “ভাইয়া আমার যে এখন যেতে হয়। বাসা থেকে ফোন এসেছে।”
“তোমার বাসা কোথায়?” আমি জিজ্ঞেস করলাম, একটু সংকোচ নিয়ে। আমাকে নিরাশ না করে সে উত্তর করল। ভাগ্যকে কি বলে ধন্যবাদ দিব ভেবে পাচ্ছিনা – আমার বাসার কয়েক ব্লক পরেই থাকে! WoW!! ওকে কথাটা বলাতে সে-ও দেখি বেশ উৎফুল্ল একটা ভাব দেখালো; রসিকতা করে বললঃ “ভালই তো হল। আপনি আমার প্রতিবেশি। বিভিন্ন ফেস্টিভে তাহলে ফিস্ট পেতে অসুবিধা হবেনা।”

তার আবার চলে যাবার কথা শুনে মনটা ভার হয়ে আসল। এত অল্প সময় দেখা হলে তো মনের কথা বলার সময়ই করতে পারব না। তবে আমি ভাবছি ওকে এখন অফারটা দেওয়া যায় কি না। একটু উশখুশ করে পরে বলেই ফেললামঃ “উমম…যদি কিছু মনে না কর, May I have the pleasure to offer you a ride?” সে একটু দ্বিধায় পড়ে গেল; আমি তার অস্বস্তি কাটানোর জন্য বললামঃ “তোমার যদি সমস্যা থাকে তাহলে আমার কিছু বলার নেই, তবে যদি একসাথে যেতে পারতাম তাহলে… সত্যি কথা বলছি, অনেক ভাল লাগত।” তার চিন্তিত চোখজোড়া শুন্য দৃষ্টিতে কি যেন ভাবল, তার পর রাজি হয়ে গেল। আমার মনে যে আনন্দের জোয়ার বইছে সেটা কি সে ধরতে পারছে? তার ঠোঁটে আবার সেই রহস্যময় হাসিটা দেখা যাচ্ছে কেন?

ঘন্টাখানেক ড্রাইভারকে অপেক্ষা করিয়ে (যেটা ধারনা করছি আর কি) তারপর গাড়িতে উঠার পর মনে মনে নিজেকে গালি দিতে লাগলাম। কেন যে আজ ঐ ড্রাইভারটা এসেছে!! শালার কাবাব-মে-হাড্ডি!!! ঐ ব্যাটা না থাকলে তো পাশে বসিয়ে নিজেই ড্রাইভ করে তাকে একটা ড্রপ দিতে পারতাম। এখনো যদিও আমরা পেছনের সিটে পাশাপাশি-ই বসেছি, তবে ঐ ব্যাপারটার একটা আলাদা ভাব আছে না?? আর হয়তো তখন সুযোগ-ও আসত অনেক কিছু বলার। … কি আর করা?! পুরো রাস্তা চিমসানো কথাবার্তা দিয়েই সারা লাগলো।

কৃতজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশের তোড় আপাততঃ সামলে তাকে নামিয়ে দেবার পর বাসার মেইন গেইট দিয়ে ঢোকার সময় হঠাৎ উল্টা ঘুরে আমার দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে বিদায় জানালো। বিকেল বেলার আলোতে তার উজ্জ্বল চেহারায় ছড়িয়ে থাকা স্নিগ্ধতা-মাখা মোহনীয় হাসিতে আমি আবারও ধাক্কা খেলাম, ঠিক এই বুকের মাঝে কোথাও, যেই জায়গাটা ডাক্তাররাও কোনোদিন খুঁজে বের করতে পারবেন না।

to be continued…

১,৭৬৩ বার দেখা হয়েছে

১৪ টি মন্তব্য : “তুমি ভাসবে হৃদয় মাঝে – ৬”

  1. মেহেদী হাসান (১৯৯৬-২০০২)

    আদনান, লেখাটা এত ভাল হয়েছে যে পড়তে পড়তে কখন শেষ হয়ে গেছে বুঝতে পারিনি। to be continued… লেখাটা দেখে একটা ধাক্কা খেলাম। :just: আসাধারণ......।।

    পরেরটা তাড়াতাড়ি দাও............ :thumbup: :thumbup:

    জবাব দিন
  2. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    সে আমার মত এই অধমের গলা দিয়ে বেরুনো নিরেট চিৎকারস্বরুপ গানকে যে এভাবে মূল্যায়ন করবে আমি কখনও ভাবতেই পারিনি

    যারা জানেন না তাঁদের উদ্দেশ্যে বলছি-আমাদের আদু কিন্তু আইসিসিএলএমএম ২০০২ এ ব্যান্ড সংগীতে রৌপ্যপদক পাওয়া পাবলিক।ওর এই অযাচিত বিনয়ের কারণে ওকে সিসিবিতে এই সপ্তাহের অমায়িক োদা উপাধি দেওয়ার তীব্র দাবী জানাই x-(

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।