তুমি ভাসবে হৃদয়-মাঝে – ৫

তুমি ভাসবে হৃদয়-মাঝে – ৪
তুমি ভাসবে হৃদয়-মাঝে – ৩
তুমি ভাসবে হৃদয়-মাঝে – ২
তুমি ভাসবে হৃদয়-মাঝে – ১

ভার্সিটির সবচেয়ে কোলাহলমুখর জায়গা হল ক্যান্টিন। পুরো ক্যাম্পাসে মনে হয় তুলনা করলে সবচেয়ে বেশি হৈচৈ এখানেই হয়। এক গ্রুপ বসে চা-সিঙ্গাড়া খাচ্ছে, কেউ কেউ ক্রিকেটের গল্প করছে, কোন সংঘ হয়তো তাদের কার্যকলাপের ফিরিস্তি নিয়ে মিটিং বসিয়েছে নাস্তার টেবিলেই। জায়গায় জায়গায় আবার জোড়া শালিক-ও দেখা যাচ্ছে। এক কোনায় আবার একটা ফটোকপি মেশিনও লাগানো হয়েছে ক’দিন হল। সেখানেও ভীড়। ক্যাম্পাসে জুনিয়র ব্যাচের কিছু উদ্ভট ছেলেপেলে নতুন একটা সঙ্গীত সংঘ করেছে নাম ‘ডিস্ট ইঞ্জিন’। মনে হয় মেটাল গান-টান বাজায়। তাদেরকেও মাঝে মাঝে ঝিম মেরে এক কোনায় বসে থাকতে দেখা যায়, হাতে হয়তো টাইগারের বোতল। ভার্সিটিতে বসে তো আর ‘ওসব’ খাওয়া যায়না, তাই এনার্জি ড্রিংক দিয়েই……

আমি সাধারনত ক্যান্টিনে বসে খাওয়াদাওয়া করিনা। আমার খাওয়ার জায়গা হল বাইরের ঐ সব দোকানগুলো। কখনো কখনো দু’একটা মাউথ ফ্রেশেনার চুইংগাম কিনতে আসি ক্যান্টিনে। ব্যাপক স্মোকার তো, স্যার দের সামনে গেলে আবার যাতে বিব্রতকর পরিস্থিতি তে পড়তে না হয় তাই মাঝে মাঝে ‘সেন্টার ফ্রেশ’ অথবা ‘মেন্টোস’ এর শরণাপন্ন হওয়া। যদি কেউ দয়া করে “দোস্ত সিঙ্গাড়াটা খেতে ইচ্ছা করছে না, তুই খাবি? … নে দুই সিপ কোক খা…” বলে একটু সাধে তাহলে না করিনা।

সেদিনও এমনই বন্ধু রাজু’র এক্সট্রা সামুচা সাটাচ্ছিলাম বসে বসে। খাওয়া শেষ করে চা’র কাপে দুটো চুমুক দিয়ে হঠাৎ ঠোঁট কাপের সাথে সেটে গেল। একদম বাঁ-দিকের জানালার এক কর্ণারে সে বসে আছে, সাথে আমার জুনিয়র ব্যাচের এক পরিচিত ছোট ভাই। এতক্ষণ চোখে পড়েনি কেন? নাকি এতক্ষণে সে আসেনি? সেটাই হবে। কখন এসেছে টের পাইনি। ক্যান্টিন সারাদিন তো ছেলেমেয়ের ক্যাচকেচি তে গরম হয়ে থাকে, এখানে এসে আর মানুষকে অবসার্ভ করার zeal পাওয়া যায়না। যাই হোক, আজ একটু কথা বলার বোধহয় সুযোগ পাওয়া যাবে। আমি ওর দিকে না তাকিয়ে ওর সাথে বসা আমার পরিচিত জুনিয়রটার দিকে এগিয়ে গেলাম।

“আরে ভাইয়া কি অবস্থা?” … আমাকে দেখেই বেশ উৎফুল্ল একটা টোনে চেঁচিয়ে উঠল ইমরান। ছেলেটা গত বছর ঢুকেছে। খুব ছটফটে টাইপ, বিশেষ করে আকাম-কুকামে। ক’দিন আগেই কি যেন একটা ফালতু বিষয় নিয়ে বেশ গ্যাঞ্জাম করে ওয়ার্নিং খেয়ে বসে আছে। এসব ছেলেপেলের সাথে আমার যে গলায় গলায় দোস্তি তা নয়, কিন্তু সেই যে ‘একই গোয়ালের গরু’, যেকারণে আমি আবার সবার সাথে টার্ম রেখে চলি কি না! এখন তো আরো মনে হচ্ছে এই পোলার সাথে খাতির রেখে খুব একটা খারাপ হয়নি।
… তার প্রশ্নের উত্তরে আমি মুখে কিছু বললাম না, মাথা নাড়ালাম। একথা সেকথা’র পর হঠাৎ সে পাশের ‘সেই’জনকে উদ্দেশ্য করে বললঃ “সুমি, ভাইয়াকে চিনিস? ও তুই কেমনে চিনবি তুই তো এইবার আইসস। ইনি হইলেন গিয়া ভার্সিটির সবচেয়ে পপুলার মানুষ, বাট আমার মনে হয় উনি এটা জানেন না…” বলেই দুষ্টু হাসি। আমি ইমরানের দিকে একটু চোখ লাল করে তার পর ওর সাথে পরিচিত হলাম… শেষ-মেষ!! চান্সে ছেলেটাকে একদিন ট্রিট দিয়ে দিব। ইমরানের দিকে একটু প্রশ্নবোধক দৃষ্টি দিতেই সে বললঃ “ফ্রেন্ড ভাই জাস্ট ফ্রেন্ড, আমি আগে ভর্তি হইসি ও পরের বার দিসে। ইস্কুলের ফ্রেন্ড।”

পরিচয়পর্বের পর কিছু হালকা টাইপের কথা হল, যদিও আমি খুব একটা কথা বলতে পারছিলাম না। বুকের ভেতর কেমন একটা দুরু দুরু ভাব। মেয়েদের সাথে কথা বলতে গেলে কখনো আমার এমন হয় না কিন্তু এর সাথে স্বাভাবিক ভাবেও কথা বলতে কেমন যেন লাগছে। অন্যরকম একটা ভাললাগা, যেটাকে মনের একটা অংশ খুব পছন্দ করছে আরেকটা অংশ অস্বস্তিতে পড়ে ভাগিয়ে দিতে চাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর যখন একটু সহজ বোধ করতে লাগলাম, তখন সাহস করে বললামঃ “সুমি তোমার কি মনে আছে? এই সপ্তাহ দুয়েক আগে তোমাকে একটা ছেলে ভার্সিটির গেটের সামনে নাম জিজ্ঞেস করেছিল?”
“আপনি ছিলেন।”
“তোমার মনে আছে??”
“এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাবার মত কি ব্যাপার?”
“সরি ওভাবে ত্যাক্ত করার জন্য।”
“একটু বিরক্ত হয়েছিলাম। কিন্তু আমি ব্যাপারটা পরে আর অতটা ওভাবে মাথায় রাখিনি।”
“থ্যাঙ্কস! না… আসলে এটা স্বাভাবিক যে অপরিচিত একজন ওভাবে ডাকলে… কি করবা, যেটা করেছিলে সেটাই করা উচিত। আমিও কিছু মনে করিনি Don’t worry. ইনফ্যাক্ট তোমার এভাবে এড়িয়ে যাওয়াটা আমার ভাল লেগেছে। Good girl…and careful too.”
“তবুও আমি ক্ষমা চাচ্ছি অমন আচরণ করার জন্য। আপনি যে মন খারাপ করেছিলেন সেটা আমি বুঝেছি।”
কথাটা শুনে আমার তো মনটাই ভাল হয়ে গেল! সে কিভাবে জানল এটা? জিজ্ঞেস করলাম। সে তার শান্ত দীঘির জলের মত স্বচ্ছ চোখজোড়া দিয়ে একটা গাঢ় দৃষ্টি দিয়ে বললঃ “বোঝা যায়।” সাথে মুখে একটা অসম্ভব মিষ্টি কিন্তু রহস্যময় মুচকি হাসি। আমি আবার দ্বিধান্বিত হয়ে গেলাম, মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলাম তার চোখের দিকে। এরকম মায়াকাড়া চোখ আমি এর আগে দেখেছি কি না মনে করতে পারছি না। হয়তো এর-টাই দেখেছিলাম, কিন্তু সেদিন বোঝা যায়নি, আলো-ছায়াতে তার চোখের এই ঝকঝকে ব্যাপারটা আড়াল হয়ে গিয়েছিল। আমি তার বাদামি রঙের চোখদুটির মাঝে প্রতিফলিত আলোর বর্ণচ্ছটায় আমার অস্তিত্বের নিমজ্জন অনুভব করতে থাকি, তার মায়াবী দৃষ্টির অসীম গভীরতায় নিজেকে ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যেতে দেখি।

হঠাৎ তার ডাকে বাস্তবে ফিরে এলাম — “ভাইয়া আমার যেতে হবে। এখন ক্লাস।” আমি বললাম, “আবার দেখা হচ্ছে কবে?” “আছিই তো; একই ক্যাম্পাসে পড়ি… চেনাজানা তো হয়েই গেল; এখন দেখা হবার সাথে সাথে কথাও হবে।” খুব হাল্কা ধরনের স্বাভাবিক উচ্ছলতায় বলল, বেশ বুঝলাম আমার সেই পুরোনো ডায়লগটাকেই খানিকটা ইঙ্গিত করে, এবং তার পরই আবার সেই মিষ্টি করে হাসি। যাক বাঁচা গেল — সে বিষয়টাকে সেভাবে ধরে রাখেনি, বেশ ইতিবাচকভাবেই ঘুরিয়ে দিয়েছে পুরো ব্যাপারটা। তার আচরণগত বৈশিষ্টের এই আরো একটি দিক আমার ভাল লাগল; বরং বলা লাগে ভাললাগার পরিমান বেড়ে গেল।

বিদায় বলার ঠিক আগ মুহুর্তে আমি তাকে বললাম, “তোমার কোনো কন্ট্যাক্ট?”
আরেকবার একটি ধাক্কা সমেত তার সহাস্য উত্তরঃ “আরেকদিন?” … এবং প্রস্থান, আর আমি আরো কোনো একটি দিনের জন্য অপেক্ষামান।

to be continued…

১,৩১৮ বার দেখা হয়েছে

৯ টি মন্তব্য : “তুমি ভাসবে হৃদয়-মাঝে – ৫”

  1. মইনুল (১৯৯২-১৯৯৮)

    :clap: :clap: :clap: :clap: :clap:
    তুমি দারুন লিখছো .....................
    পরিচয়ের পার্টটা খুবই চমৎকার ......
    এখনো "ভাইয়ার" নাম জানা গেলো না, বাই এনি চান্স ভাইয়ার নাম আদনান না তো ???? 😉 😉 😉 😉 😉 😉 😉

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।