দর্শক প্রতিক্রিয়াঃ হোর’স গ্লোরী (২০১১)

মেলা দিন হলো, সিসিবিতে এসে কেবল পড়ি, ঘুরি, চলে যাই। লেখালেখির আপ্রাণ চেষ্টাতেও দু’লাইন বের হয়নি। বিশেষত, খুব কাছের মানুষের অনুরোধেও প্রায় পুরো দিন বসে থেকে ৪-৫ লাইন লিখে মুছে দিয়েছি। সেই প্রিয় মানুষটার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে আজকের লেখাটা ঝেড়ে দিচ্ছি। ঘটনা হলো, এটাও কিঞ্চিৎ পুরনো লেখা, তবে ফেসবুকে একটা সিনেমা নিয়ে গ্রুপে হালকা দর্শক প্রতিক্রিয়া হিসেবে দিয়েছিলাম; চলচ্চিত্র-সমালোচনা হিসেবে ভাবলে ভুল করবেন।

________________________________________________________________________

আগার তাহার বিভীষিকাভরা, জীবন মরণময়!
সমাজের বুকে অভিশাপ সে যে – সে যে ব্যাধি, সে যে ক্ষয়;
প্রেমের পসরা ভেঙে ফেলে দিয়ে ছলনার কারাগারে
রচিয়াছে সে যে, দিনের আলোয় রুদ্ধ ক’রেছে দ্বার!
সূর্যকিরণ চকিতে নিভায়ে সাজিয়াছে নিশাচর,
কালনাগিনীর ফণার মতন নাচে সে বুকের পর!
চক্ষে তাহার কালকূট ঝরে, বিষপঙ্কিল শ্বাস,
সারাটি জীবন মরীচিকা তার প্রহসন-পরিহাস!
ছোঁয়াচে তাহার ম্লান হয়ে যায় শশীতারকার শিখা,
আলোকের পারে নেমে আসে তার আঁধারের যবনিকা!
সে যে মন্বন্তর, মৃত্যুর দূত, অপঘাত, মহামারী-
মানুষ তবু সে, তার চেয়ে বড় – সে যে নারী, সে যে নারী!

(পতিতা- জীবনানন্দ দাশ)

সিনেমা নিয়ে আলোচনা করতে এসে কবিতা কিঞ্চিৎ বেমানান; সেজন্য প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। তবে সত্যি বলতে, সম্প্রতি দেখা একখানা ডকুমেন্টরীর পুরোটাই দর্শক প্রতিক্রিয়া হিসেবে কবিতাটাতে জানান দেয়া হয়েছে; সে দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বোধহয় খুব একটা অসংলগ্ন নয়।

হালকা কিছু তথ্য দিয়ে নেই শুরুতেইঃ

Movie: Whore’s Glory (Chwala dziwkom) (2011)
Genre: Documentary
Director: Michael Glawogger
Writer: Michael Glawogger
Location: Thailand, Bangladesh, Mexico
Trailer: ক্লিক করুন

অস্ট্রিয়ান পরিচালক মিশেল গ্ল্যাওয়েগগের-এর ‘গ্লোবালাইজেশন’ ট্রিলজির সর্বশেষ সংযোজনা এই ডকুমেন্টরী সিনেমাটি (হোর’স গ্লোরী)| মূলতঃ তিনটি দেশের নির্দিষ্ট একটি পতিতাপল্লীকে কেন্দ্র করেই পুরোটা সময় ক্যামেরা ঘুরে ফিরে বেড়িয়েছে। থাইল্যান্ডের ‘দ্যা ফিশ ট্যাঙ্ক’, বাংলাদেশের ফরিদপুর অঞ্চলের ‘আনন্দনগর’ এবং সবশেষে মেক্সিকোর ‘রেইনোসা’ – এই তিন ভিন্ন ভৌগলিক অঞ্চলের তিন ভিন্ন পল্লীর নারীদের জীবন যাত্রা নিয়েই পুরো সিনেমা। কোন ডাটা, গ্রাফ, থিওরি কিংবা অন্য কোন আনুষঙ্গিক পরিপূরকের আশ্রয় না নিয়েই কেবল ক্যামেরা ঘুরে বেড়াচ্ছিল দৈনন্দিন জীবনাচরণ, ক্লায়েন্টদের সাথে দর কষাকষি, পতিতাপল্লীর নেত্রীর কার্যকলাপ – এধরণের সরাসরি চিত্ররূপের উপরে।

***যারা দেখবেন তাদেরকে আগাম একটুখানি সতর্ক সংকেত দিয়ে রাখি। শেষাংশে গিয়ে যখন মেক্সিকোর আলাপন শুরু হবে; সেখানে যথেষ্টই নগ্নতা এবং সরাসরি সঙ্গম-দৃশ্যের উপস্থিতি রয়েছে। চাইলে এড়িয়ে যেতে পারেন। তবে তারপরও বলবো- সিনেমাটা দেখা উচিৎ। অন্তত ৩৩ মিনিট থেকে ১ ঘন্টা ১২ মিনিট পর্যন্ত বাংলাদেশের অংশটুকুর জন্য দেখুন।

আমাদের তথাকথিত ভদ্রসমাজেরই সৃষ্টি দেহপসারিণী এই নারীরা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার ভোগাচ্ছন্নতার ফলশ্রুতিতেই পৃথিবীর এই প্রাচীন পেশাটির জন্ম হয়েছিল। আঁধারের মগ্নতাতে যারা ভোগ্য, অতি-কামনার দেবী হয়ে ওঠে; দিনের আলোতে সভ্য সমাজপতিরাই এদের দেখে কপাল কুঁচকে নাক সিটকে ফেলে। এটা অবশ্য কেবল আমাদের তৃতীয় বিশ্বের গল্প নয়; পুরো পৃথিবীর রূপরেখাই এটা। পার্ট টাইম কাজ করি একটা কফি শপে, এদের ব্যবসা কিছুটা পড়তি। ছুটির দিনে আমার শিফটে তাই লোকজনের পরিমাণ এমনিতেই কম থাকে। এখানেই মুখ চেনা দু তিন জন কাস্টোমার আছেন; যারা সাধারণত আসেন সন্ধ্যার পর। দেড় টাকা দিয়ে কফি কিংবা সফট ড্রিঙ্ক কিনে কফি শপের বাথরুম ব্যবহারের সুযোগ করে নেয়াটাই যদিও এদের মূল উদ্দেশ্য থাকে। এরা ভাসমান দেহজীবি নারী; নির্দিষ্ট কোন ঠিকানা নেই; হাতের কাছেই দুটো বেশ বড়সড় বার থাকায় কফি শপের উলটো পাশের রাস্তায় তারা খদ্দেরের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকেন। অস্বীকার করবো না; প্রথম প্রথম আমারও কিছুটা শুচিবায়ু ছিল তাদের নিয়ে। কফির নিয়মিত ক্রেতা এক কেতাদুরস্ত ভদ্রলোককে (যিনি বিবাহিত এবং অন্তত দুজন সন্তানের পিতা; সাথে আসেন মাঝে মধ্যে তারা, এ সূত্রেই নিশ্চিত হয়েছি) এক রাতে দেখলাম তাদেরই একজনকে গাড়িতে করে তুলে নিয়ে যেতে; অবশ্যই হাসি ঠাট্টা করতে করতেই দুজনকে গাড়িতে উঠতে দেখেছি দূর থেকে। অদ্ভুত হলেও সত্য যে সপ্তাহ খানেকের ব্যবধানে একই নারীর সাথে তার সম্পূর্ণ বিপরীত আচরণ দেখে খানিকটা বীতশ্রদ্ধ হয়েছি- ভদ্রলোক আমাকে কথাচ্ছলে বলছিলেন- তোমরা এদের স্টোরে অ্যালাউ করো কেন? They are disgrace for this locality. জবাবে কিছু বলা হয়নি।

বাকী দুটো অঞ্চল বাদ দিয়ে কেবল বাংলাদেশের অংশটুকু নিয়েই দুটো কথা বলি। ডকু দেখতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম, অধিকাংশ মেয়েগুলোর বয়সই বেশ কম- কিশোরী কিংবা ১৮ এর নিচেও হবে এমনও আছে। নিয়তিকে তারা মেনে নিয়েছে; এ চক্রের মাঝ থেকে বের হবার সাহস যেমন তাদের নেই; তেমনি নেই সমাজের কাছ থেকে প্রশয়ও। একটা অংশে এক কিশোরী মেয়ের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়, ছোট অংশটুকু এখানে দেখতে পারেন।

মেয়েটার প্রশ্নটা বড্ড নির্মম; জবাব জানা নেই; কিংবা জানা থাকলেও জবার দেবার মতো সাহসটুকু হয়তো এখনো তৈরি হয়নি। আদৌ হবে কী কখনো?

এক পর্যায়ে ব্যাকগ্রাউন্ড সংগীত হিসেবে সামিনা চৌধুরীর একটা গান বাজতে থাকে- ‘ কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে’; অচেনা লাগতে শুরু করেছিল গানটা।

তথ্যচিত্রটি দেখবার পর নতুন কোন উপলব্ধি তৈরি হলো কী না বলতে পারছি না; তবে অসহায় ভাবে কালচক্রে আটকে পড়া মানুষগুলোর জন্য হাহাকার যে জাগেনি- সেটা বললে মিথ্যে বলা হবে।

Sight & Sound ম্যাগাজিনের কিরণ করলেসের কথাগুলো অসাধারণ লেগেছে- “It’s a complex, multifaceted, non-judgmental study of working conditions and what it takes to survive in these environments. There are horrors, for sure, but also pleasures, and a great deal of exuberance and togetherness.

শেষটায় তাই ঘুরেফিরে কানে বাজতে থাকে সিনেমায় ধীর লয়ে বাজতে থাকা গানটার লাইনগুলো —

Where We Meet

where lies are true
and hunger is forgotten
and darkness makes us free
and night and day they cannot be

……………….
……………….

where doors are always locked
and longing makes you lonely
and waiting is your daily grind
and love is lost long time ago

is where i want you to look at me
and everywhere else we will not meet…

256451_10150895083626302_1271274052_o

৭ টি মন্তব্য : “দর্শক প্রতিক্রিয়াঃ হোর’স গ্লোরী (২০১১)”

  1. সাকেব (মকক) (৯৩-৯৯)

    একই রকম সাবজেক্ট এর উপরে বিভিন্ন দেশের সেটিংস এ একটা অসাধারণ ডকুমেন্টারী দেখসিলাম। লিঙ্ক পাইলে শেয়ার করবো নে।


    "আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
    আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস"

    জবাব দিন
  2. রাব্বী (৯২-৯৮)

    ডকুমেন্টারিটা দেখেছিলাম। তখন কেন যেন খুব 'ডিস্টার্বিং' মনে হচ্ছিল। পরে মনে হলো এটাই হয়তো ডিরেক্টরের উদ্দেশ্য। যে বিষয়গুলি যেমন স্বাভাবিক সেভাবেই দেখানো। ভাল ডকুমেন্টারি।


    আমার বন্ধুয়া বিহনে

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।