সুঁই

“ক্যাডেট সব পারে” পর্বে আমাদের বন্ধু X কে নিয়ে লিখেছিলাম। আর এবার লিখছি ওর রুমমেটকে নিয়ে। ওর রুমমেট ছিল সাদাত আর রাশেদ। এবারের ঘটনাটা রাশেদকে নিয়ে লিখা। সময়টা মাধ্যমিক পরীক্ষার আগেই। পরীক্ষা তখন দরজায় কড়া নাড়ছে। সবার দৃষ্টি তখন টেষ্ট পেপারের পাতলা নিউজপ্রিন্ট কাগজেই বেশিরভাগ সময় আবদ্ধ থাকে। আমরা তখন সাদা পোষাক পরিহিত দল। যা হোক, যতদূর মনে পড়ে তখন আমরা সন্ধ্যার পর হাউসে পড়াশুনা করতাম। এমনই একদিন আনুমানিক রাত ৮ টার দিকে হঠাত আবার জাহাঙ্গীর হাউসের সেই একই রুম থেকে হুলুস্থুল শুনতে পেলাম। আমরা তখন কয়েকজন ২ তলার তিতুমীর হাউসের বারান্দায় বেরিয়ে আসলাম। সবারই কৌতুহলী দৃষ্টি তখন আবার এই রুমে কি হলো? আমার যতদূর মনে পড়ে আমি দেখলাম রাশেদ দ্রুত গতিতে দৌড়াচ্ছে। পিছন থেকে সাদাত রাশেদকে ডাকছিল। মুহুর্তের মধ্যে রাশেদ দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে গেল হাসপাতালের দিকে। সবাই তখন সাদাতকে জিজ্ঞাসা করছে কি হয়েছে? সাদাত তখন আমাদেরকে অবাক করে দিয়ে বলল রাশেদ সুপার গ্লু এর সুঁই খেয়ে ফেলেছে। সবাই তখন অবাক। আমরা বিশ্বাস করলাম না। আমরা ভাবলাম ও মনে হয় আমাদের সাথে রসিকতা করছে। কারণ ওর চোখে মুখেও ছিল এক আতঙ্কিত বিস্ময়ের ছাপ। আমরা তখন অনেকেই প্রশ্ন করলাম সুঁই যদি খেয়েই ফেলে তাহলে তো গলাতে আটকানোর কথা। এত বড় একটা সুঁই গলার ভিতর দিয়ে ঢুকলো কি ভাবে? সাদাতও তখন আমাদেরকে জিজ্ঞাসা করল তাই তো দোস্ত ঢুকল কিভাবে? তারপর আমরা ডিনারে যাওয়ার আগেই পুরো কলেজে এক বিশাল আলোড়ন সৃষ্টি হয়ে গেলো। এ্যাডজুটেন্ট, মেডিক্যাল অফিসার, ভি পি, প্রিন্সিপাল সকলেরই হাসপাতালে আগমন ঘটল এবং যথারীতি সাদাতের জবানবন্দি গ্রহন। আমরা সাদাতকে জিজ্ঞাসা করলাম ও কি খেতে দেখেছে কি না? ও আমাদেরকে বলল রাশেদ বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে ছিল। সুপার গ্লুর সুঁই ছিল ওর হাতে। এর মধ্যে কি যেন একটা হাসির ব্যাপার ঘটেছে, আর রাশেদ তখন হো হো করে হেসে উঠেছে। এখানে বলে রাখি রাশেদের হাসি আবার ছিল সেই রকম। শুরু হলে শেষ হয় না টাইপের এবং অত্যন্ত প্রাণখোলা হাসি। তো সে যখন হাসছিল তখন শরীরের দুলুনিতে হাত থেকে সুঁইটা পড়ে যায়। রাশেদ প্রথমে নিজেও বুঝতে পারে নি। ও ভেবেছে সুঁইটা মনে হয় বিছানায় পড়েছে। একটু পর সে গলায় খাকাড়ি দিয়ে বলল সাদাত দোস্ত সুঁই খেয়ে ফেলেছি। সাদাত তখন হেসেই উড়িয়ে দিল। ও হয়ত ভেবেছে এ কি করে সম্ভব? ও তখন বিছানা, মেঝেতে খুঁজতে শুরু করে দিল। যখন পেল না তখন রাশেদ এক দৌড়ে হাসপাতালে। রাতেই ওকে নিয়ে যাওয়া হলো রংপুর সি এম এইচ এ। আমরা তখনও ভাবছি হয়ত রুমেই কোথাও পড়েছে। কিন্তু পরের দিন সকাল বেলা আমাদের মিজান স্যার এসে বললেন আল্ট্রাসনোগ্রাম করে ধরা পড়েছে যে সে সত্যিই সুই গিলেছে এবং তা অক্ষত অবস্থায় পেটের ভিতরে রয়ে গেছে। আমরা তো অবাক। কিন্তু তার চাইতেও অবাক করা বিষয় হচ্ছে যে কলেজ প্রশাসনের বোদ্ধা ফেলুদা বাহিনী সাদাতকে ঘটনার মূল উদঘাটন করতে গিয়ে বলল-

“ সাদাত বলতো ঘটনাটা কি? সাদাত সবিনয়ে সমস্ত ঘটনাটা বর্নণা করল। কিন্তু ফেলুদারা(স্যাররা) বিশ্বাস করে না। তারা ঘটনার ব্যাখ্যা করল এভাবে যে তোমরা নিশ্চয়ই কোন বাজি ধরেছিলে। নয়ত এরকম করার কথা না……………… এ রকম আরও অনেক কিছু। ”

কিন্তু ফেলুদাদের (স্যার) এই মতবাদ শেষ পর্যন্ত দাড়াতে পারে নি। পরের দিন আমাদের গণিতের দেলোয়ার স্যার আমাদেরকে বললেন তোমরা ওর জন্য দোয়া কর। ও ভালোও হয়ে যেতে পারে। আমরা ততক্ষণে শুনেছি যে রাশেদের অপারেশন করা হবে। আমরা শুধু তখন অপেক্ষার প্রহর গুণছি। আর মাধ্যমিক পরীক্ষার তখন মাত্র ২৭ দিন বাকী। আমরা মনে করছি আমাদের পরীক্ষা মনে হয় ভালো হবে না। শুধু চারিদিকে অঘটন আর অঘটন। ২ দিন পর আমরা জানতে পারলাম কোনধরণের অপারেশন ছাড়াই রাশেদের পেট থেকে সুঁই অক্ষত অবস্থায় (পায়ু পথে) বের হয়ে গেছে। এবার আময়াদের ২য় বার অবাক হবার পালা। এটা কি করে হলো? তো আমরা দেলোয়ার স্যারের গণিত ক্লাসে সবাই সযারকে কৌতুহল বশত জিজ্ঞাসা করলাম স্যার আপনি কি কিছু জানেন? স্যার দেখি মিটিমিটি হাসে। তখন আমরা বুঝলাম স্যার মনে হয় কিছু জানে। সযারকে সবাই মিলে ধরলাম বলার জন্য। স্যার তখন বললেন যে তিনি রাশেদকে দেখতে গিয়ে একটা হোমিওপ্যাথিক ঔষধ দিয়ে এসেছিলেন। আর বলে এসেছিলেন, তুমি এটা খাবে কিন্তু কাউকে বলতে পারবে না। কাজে দিতে পারে। আর যদি কাজে না দেয় তাহলে কোন ক্ষতি করবে না। আর কাজ করলে বা না করলেও কাউকে বলতে পারবে না এই ঔষধের কথা। রাশেদ রাজি হয়েছিল। ঔষধটা ছিল “ সাইলেশিয়া”। স্যার আবার আমাদের তখন বলল সাইলেশিয়া মানে হল বালি। আমরা তখন বললাম তার মানে কি সযার আপনি ওকে বালি খাওয়াইছেন? স্যার তখন বলে না রে বেটা তোমরা বুঝবা না। সেই জিনিস আজও বুঝিনি। সেই মহৌষধ কি বা কি রকম এর কার্যক্রম???? স্যার এও বললেন আমি হোমিওপ্যাথির একটা ২৮০০ মার্ক এর কোর্স করেছিলাম এফ সি সি তে থাকতে। সেই সুবাদে কিছু একতা করতে চাইলাম ছেলেটার জন্য। সযার সেদিন বলেছিলেন তমরা আমার ছেলের মত। আমি ওকে ঔষধটা দিয়ে সেদিন সারা রাত ঘুমাতে পারিনি। শুধু চিন্তা করছিলাম কি হয় না হয়? বারবার শুধু আল্লাহ কে স্মরণ করছিলাম। অবশ্য তখন ফেলুদা রা রহস্য উদ্ঘাটন করতেই ব্যাস্ত ছিলেন। অতঃপর রাশেদ কলেজে ফিরে এল এবং মাধ্যমিক পরীক্ষা দিল। কিন্তু কেন জানি না দেলোয়ার স্যারের এই অসামান্য অবদানকে কলেজ থেকে কোন স্বিকৃতি দেয়া হলো না। দেয়া হয়েছিল কি না তা ও জানি না। তবে আমরা সারাজীবন স্যারকে মনে রাখব। আল্লাহ স্যারকে দীর্ঘজীবি করুন। আর সবার জন্য বলছি সুঁই থেকে সাবধান থাকার জন্য।

১,০৫৪ বার দেখা হয়েছে

১৮ টি মন্তব্য : “সুঁই”

  1. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    ক্যাডেটের উপকার করা স্যারদেরকে পুরষ্কৃত করলে তো আর ক্যাডেট কলেজ সিস্টেম বিশু টাইপ লোকদের প্রিন্সিপাল বানাতোনা।
    বিচিত্র এ ঘটনার সরস বিবরণ পড়ে খুবই মজা পেলাম ভাইয়া।আসলেই,ক্যাডেটদের কাহিনীর কোন শেষ নেই!

    জবাব দিন
  2. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

    আয় হায়! কলেজ ছেড়ে আসার সময় যে পিচ্চিগুলারে রাইখা আসছিলাম তারা যে এমন বিচ্ছু হবে তা' একেবারেই বোঝা যায়নি।


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন
  3. রাব্বি (১৯৯৮-২০০৪)

    কলেজের সত্তিকারের স্যারদের যারা ১২/১৩ বছ্রের ছেলেদের মানসিকতা বুঝে তাদের পক্কে কথা বলত তাদের মূল্যায়ন কি কোনো দিন হইসে ??
    হইসে MR. BISU r মূল্যায়ন

    জবাব দিন
  4. আছিব (২০০০-২০০৬)

    :boss: স্যার ,বস :salute:
    x-( বিশু যদি জানত দেলোয়ার স্যার ক্যাডেটদের উপকার করছে,তাইলে ওই টার্মেই স্যারের বদলির ব্যবস্থা করত। ~x( আমাদের লীডিং এর সময় বেশ কজন টিচারকে বদলি করা হইছে, 😡 এমনকি এক সাথে ৭ জন বদলি হইছিল। :chup:

    জবাব দিন
  5. রহমান (৯২-৯৮)

    ঘটনাটা পড়ে একই সাথে মজা পেলাম ও অবাক হলাম। 🙂 😀 :)) :)) =)) :khekz: :goragori: :grr: :pira: : এই ইমোগুলার মইধ্যে কোন ষ্টাইলে হাইসা তোমার বন্ধুর মুখের মধ্যে সুই লাফ দিয়ে ঢুকল সেইটা চিন্তা কইরতেছি :dreamy: । তোমার বন্ধুর হাসি রকস্‌ :thumbup:

    জবাব দিন
  6. রাশেদ কিন্তু বদলায় নি, এখনো ওইরকম করেই হাসে। =))
    মুহিব্বুল কি খবর তোর ...
    শাজাহান মিয়ারে নিয়া সাধারণ জ্ঞানের উত্তর নিয়া একটা লিখা ফেল।

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।