বলের বদলে গ্রেনেড! (শেষ পর্ব)

আগের পর্বগুলোঃ ১০

২১।

নভেম্বর, ১৯৭১।

গত দুই দিন ধরে অনিক এবং ওদের দলের সবারই মন খুব প্রফুল্ল। এই মুহূর্তে ওরা গাংনির একটি স্কুল ঘরে অবস্থান নিয়েছে। ঘরটির অর্ধেকের বেশি গোলার আঘাতে বিধ্বস্ত হলেও ভেতরে কয়েকটি রুম অক্ষত আছে। আপাতত এটাই ওদের অস্থায়ী ক্যাম্প।

গত সপ্তাহে ওদের চারজন অস্ত্র ও রসদ আনার জন্য লালবাজারের পুরনো ক্যাম্পে গিয়েছিল। সেখান থেকে খবর এনেছে রতন বেঁচে আছে! সেদিন মুজিবনগর নেওয়ার পর ওখানে রতনের একটি প্রাথমিক অপারেশন করা হয়। কিছুটা স্ট্যাবল হবার পর ওকে মুজিবনগর থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারতের কৃষ্ণনগরে পাঠিয়ে দেয়। দীর্ঘ দুই সপ্তাহ ওখানকার ডাক্তারদের আন্তরিক চেষ্টার পর অবশেষে ও ধীরে ধীরে সুস্থ হতে শুরু করেছে। তবে দুঃখের বিষয়, সম্ভবত ও আর যুদ্ধে অংশ নিতে পারবে না! তবে অনিক সেটা নিয়ে চিন্তিত নয়। রতন যে বেঁচে আছে, এটাই অনেক বড় সুখবর!

এর পাশাপাশি ক্যাপ্টেন আজম স্যার ওদের দলের নাকি দারুণ প্রশংসা করেছেন। এদিকে রোজার ঈদের আর মাত্র এক সপ্তাহ বাকি আছে। শান্ত ভাই আগেই কথা দিয়েছেন ঈদের সময় ওদের কয়েকজনকে বাড়িতে যাবার সুযোগ দেবেন, এর মধ্যে অনিকও আছে। দিন যত এগিয়ে আসছে বাবা-মা, শাওনের কথা অনেক বেশি করে মনে পড়ছে। একই সাথে মনে পড়ছে খুলনার সবার কথা। কে, কোথায়, কেমন আছে- কে জানে!

এক সপ্তাহ পর বাড়ি যাবে বলে আগামী সবগুলো রোজার ইফতার তৈরি করার দায়িত্ব অনিক, আহসান, নারায়ণ এবং সাত্তারের। অবশ্য আয়োজন খুব বেশি নয়-পাশের গ্রামের কিছু মানুষ প্রচুর পরিমাণে ডাব, মুড়ি, চিড়া, খই, গুড় এবং চিনি দিয়েছেন। ওগুলো দিয়েই ইফতার করবে। আসরের নামাজের কিছুক্ষণ পর ওরা ইফতার বানানোর প্রস্তুতি শুরু করবে এমন সময়ে পাহারায় থাকা নরেনদা ঘরের ভেতরে আসলেন।
-শান্ত ভাই, একজন লোক দূরে সাদা কাপড় নেড়ে কি জানি বলতে চাইছে। কি করব?

এই কথা শুনে সবাই দ্রুত অস্ত্র নিয়ে পজিশন নিয়ে নিলো। জানালার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে সত্যিই একজন মানুষকে সামনের মাঠের ওপারে সাদা কাপড় হাতে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় দেখা গেল। শান্ত ভাই দুজনকে নির্দেশ দিলেন লোকটাকে নিয়ে আসার জন্য।

অত্যন্ত সাবধানতার সাথে দুজন গিয়ে লোকটা ক্যাম্পে নিয়ে এলো। দেখা গেল সে ওদের পূর্ব পরিচিত-কামদেবপুর গ্রামের রহমত। ওকে এবং মফিজকে সেদিন শান্ত ভাই না মেরে ছেড়ে দিয়েছিলেন।
-কি ব্যাপার রহমত? তুমি এই সময়ে এখানে? কি চাও?
-স্যার, আপনার কাছ আমি চির কৃতজ্ঞ। সেদিন আমার জীবন ভিক্ষা দিয়েছেন। এরপর আমি একদম ভাল হয়ে গেছি। আমাদের আশপাশের যত রাজাকার আর আলবদর আছে-সবাইকে বুঝিয়েছি যে ভুল পথে রয়েছে। ওরা স্যার, নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছ। সবাই মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে চায়। আপনার দলে যোগ দিতে চায়।
-কিন্তু এখন কেন? আমরা তো এখন ইফতার করতে বসব। আগামীকাল সকালে আসতে বল।
-স্যার, আজকে সবাই একসাথে ইফতার করতে চাইছে। ওরা সবাই বাসায় বানানো পেঁয়াজু, চপ, সিঙ্গারা নিয়ে এসেছে। অনেক আশা নিয়ে এসেছি স্যার, আমাদেরকে নিরাশ করবেন না…

শান্ত ভাই কিছুক্ষণ চিন্তা করে ওদেরকে আসার অনুমতি দিলেন। রহমত যেদিক দিয়ে এসেছিল, সেদিকে ফিরে গেল। সাথে দুইজন মুক্তিযোদ্ধা। ওদিকে অনিকরা ইফতার তৈরিতে ফিরে গেল। হঠাৎ বাসার পেছনে নড়াচড়া শুনে ওরা আবার সচকিত হয়ে উঠল। সাত্তার জলদি একটি এল.এম.জি বাগিয়ে পেছনে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর একজন মানুষকে সহ ফিরে এলো। খেয়াল করে দেখল ব্যাটা মফিজ। সেদিনের আরেক রাজাকার।
-কিরে তুই? কি চাস? শান্ত ভাই গর্জে উঠলেন।
-স্যার…স্যার…আপনাদের ভয়ংকর বিপদ স্যার… রহমত কি বলেছে জানি না, তবে ওরা অনেক রাজাকার মিলে আপনাদের ক্যাম্প আক্রমণ করতে এসেছে। ওদের কাছে অনেক অস্ত্র আছে, স্যার!!
-কি বলছ এসব? নিজের অজান্তেই শান্ত ভাই তুই থেকে ওকে তুমি করে বললেন!
-জ্বি, স্যার। খোদার কসম আমি সত্যি বলছি, স্যার। সেদিনের পর থেকে আমি পাকিস্তানী আর রাজাকারদের অনেক কুকর্ম দেখেছি। আমি বুঝতে পেরেছি আপনারাই সত্যের পথে আছেন। কিন্তু রহমত এখনো রাজাকার বাহিনীর হয়ে কাজ করে চলেছে।

শান্ত ভাই অনিকের দিকে তাকালেন। অনিকের মুখ রাগে, দুঃখে কালো হয়ে গিয়েছে। আজকের অ্যামবুশের জন্য মনে মনে নিজেকেই দায়ী করল। সেদিন যদি রহমতকে বাঁচাবার জন্য সুপারিশ না করত, তাহলে হয়ত আজ এই বিপদে পড়তে হত না!

এমন সময়ে বাইরে গুলির আওয়াজ শোনা গেল। শান্ত ভাই চিৎকার করে সবাইকে দ্রুত যে যা পারে নিয়ে পেছন দিয়ে সরে যেতে নির্দেশ দিলেন। ততক্ষণে সত্যি সত্যিই মতলবসহ প্রায় ৩০-৩৫ জন অস্ত্র সহ স্কুলের সীমানার মধ্যে ঢুকে পড়েছে। ওরা বুঝতে পারল মতলবের সাথে যে দুজন মুক্তিযোদ্ধা গিয়েছিল তাঁরা আর বেঁচে নেই। প্রহরায় থাকা নারায়ণ, আলমগীর, হাকিম এবং সজীব পালটা গুলি করা শুরু করল। কিন্তু এতজনের সাথে পেরে উঠল না। রাজাকারদের সম্মিলিত আক্রমণের প্রথম ধাক্কাতেই গুলি খেয়ে উলটে পড়ল। ওরা বেঁচে আছে না মারা গেছে সেটা দেখারও সুযোগ হল না। ততক্ষণে বাইরে মাগরিবের আজান শুরু হয়েছে এবং দ্রুত সন্ধ্যা হয়ে আসছে। মফিজ ওদের বলল,
-স্যার, আধা মাইল দূরে কাজলা নদীতে আমার নৌকা বাঁধা আছে, আপনারা জলদি চলুন। আমি পথ দেখাচ্ছি।

শান্ত, অনিক, সাত্তার সহ ৮ জন নিজের অস্ত্র এবং হাতের সামনে যা পেল তা নিয়ে স্কুলের পেছন দিয়ে ছুটতে শুরু করল। সবার সামনে মফিজ ছুটছে, ওরা তাকে অনুসরণ করছে। ওদের দলের বাকি সদস্যরা পাশের কুয়োর পানিতে ওজু করছিল। ওরা অস্ত্র হাতে প্রতিরোধ করা শুরু করল। অনিকরা ছুটন্ত অবস্থাতেই শুনতে পেল ওদের পেছনে ভীষণ গোলাগুলি চলছে। এই সুযোগে ওরা আরও জোরে ছুটে দূরত্ব কিছুটা বাড়িয়ে নিলো। ওরা যখন নদীর প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গেছে তখন পেছনে হৈ হুল্লোড় শুনতে পেল। সম্ভবত ওদের দলের বাকি সবাই খতম হয়ে গেছে। রাজাকারগুলো এগিয়ে আসছে সাক্ষাত যমের মতন।

নদী বরাবর দৌড়চ্ছে ওরা। সবার প্রথমে মফিজ, তার পেছনে বাকি সবাই এবং সবার পেছনে শান্ত ভাই। কিছুটা মোটাসোটা হবার কারণে তিনি পিছিয়ে পড়েছেন। হঠাৎ করে শান্ত ভাই কাদায় পা পিছলে পড়ে গেলেন। বাকি সবাই বেশ খানিকটা সামনে চলে গেল। দড়াম করে পতনের শব্দে অনিক পেছনে ফিরে সন্ধ্যার ঝাপসা আলোয় দেখল শান্ত ভাই মেঠো পথে পড়ে আছেন। হাতের অস্ত্র ফেলে দিয়ে ও শান্ত’র কাছে ছুটে গেল। শান্ত ভাইকে টান মেরে দাঁড় করিয়ে দুজনে আবার ছুটতে শুরু করল। এদিকে রাজাকারদের সাথে ওদের দূরত্ব অনেক কমে গেছে। দৌড়াতে দৌড়াতেই শয়তানগুলো গুলি শুরু করল।

অনিক টের পেল গুলি থেকে বাঁচার কোন উপায় নেই, চট করে নিজের চলার গতি কমিয়ে দিল। কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে শান্ত ভাইকে আড়াল করে দৌড়াতে লাগল। এবার একেবারে কাছ থেকে গুলির শব্দ ভেসে এলো। ‘হুপ’ শব্দ করে অনিক সামনের দিকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল, শান্ত ভাই ওকে কোনমতে ধরে ফেললেন। ঠিক তখনই ওদের সামনে থেকে গুলি শুরু হল। অর্থাৎ এগিয়ে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা উলটো ঘুরে পালটা গুলি শুরু করেছে!

রাজাকারগুলো একেক জন একেক দিকে লাফিয়ে পড়ল। একজন তো ঝোপ-ঝাড় ভেঙে নদীতেই পড়ে গেল। এই সুযোগে শান্ত ভাই অনিককে ধরে নিয়ে নৌকায় উঠলেন। বাকিরাও ততক্ষণে কাভার ফায়ার করতে করতে নৌকায় উঠে পড়েছে। ওঠার আগে কয়েকজন মিলে ধাক্কা দিয়ে নৌকাটিকে কূল থেকে সরিয়ে কিছুটা গভীর পানির ভেতরে ঠেলে দিল। মফিজ প্রাণপণে বৈঠা চালানো শুরু করল। স্রোত এবং দ্রুত গতির বৈঠা চালানোর ফলে নৌকাটি দ্রুত রাজাকারদের গুলির রেঞ্জের বাইরে চলে এলো। বিপদ কেটে গেছে বুঝতে পেরে শান্ত ভাই হারিকেন নিয়ে অনিকের আঘাত পরীক্ষা করলেন। রক্তে জামা ভেসে যাচ্ছে। দ্রুত ওর পরনের শার্টটি ছিঁড়ে ফেললেন। দেখা গেল অনিকের পিঠে দুটো গুলি লেগেছে, দু’টোই ভেতরে রয়ে গেছে। সম্ভবত ওর ফুসফুসে লেগেছে। কেননা, অনিক কাশতে শুরু করল এবং কাশির সাথে চাপ চাপ রক্ত পড়তে লাগল। শান্ত ভাই যা বোঝার বুঝে গেলেন। ওদের আর কিছুই করার নেই। ইতোমধ্যেই অনিকের চোখ ঘষা কাচের মত ঘোলাটে হয়ে গেছে।

-অনিক, তুই এ কি করলি ভাই? আমাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজে গুলি খেলি? অনিক, চোখ খোল। প্লিজ, ভাই আমার, একবারের জন্য হলেও চোখ খোল…

শান্ত ভাই হাউমাউ করে কান্না শুরু করলেন। হঠাৎ অনিক চোখ বন্ধ থাকা অবস্থাতেই বলে উঠল,
-শাহিন ভাই, আমি রান আউট হয়ে গেলাম। আপনাকে উইকেটে থাকতে হবে। ম্যাচ বের করে আনবেন কিন্তু!!

কথাগুলো শুনে শান্ত ভাই অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলেন।
-অনিক, তুই আমাকে শাহিন ভাই বলে ডাকছিস কেন? আমি তোর শান্ত ভাই। প্লিজ, চোখ খোল!

অনিক আবার ভীষণভাবে কাশি দেয়া শুরু করল। এবার একজন ওকে পানি খাওয়ানোর চেষ্টা করল, কিন্তু পানি ওর ঠোঁটের কোণ দিয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল। কিছুক্ষণ পর অনিকের চোখে খুলে গেল। শান্ত ভাই এর দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকল। ঝাপসা আলোর কারণে শতভাগ নিশ্চিত হতে পারল না, তবে শান্ত’র মনে হল ও যেন অনিকের মুখে হাসির সূক্ষ্ম রেখা দেখতে পেল। এরপর ধীরে ধীরে অনিকের চোখের পাতা বন্ধ হয়ে গেল।

নৌকার মধ্যে সবাই ওকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রইল। হারিকেনের মৃদু আলোয় কারো চেহারা ঠিক মত বোঝা না গেলেও সবার পাথরের মতন নির্বাক মূর্তিই বলে দিল প্রিয় একজন সহযোদ্ধাকে হারিয়ে ওরা কতটা কাতর হয়ে পড়েছে। শুধু শান্ত সযত্নে অনিকের মাথাটা কোলের উপর নিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। একই সাথে বাইরে থেকে মফিজের বৈঠা চালাবার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ ভেসে আসতে লাগল…

২২।

২২ এপ্রিল, ২০১৫।

লোকজনের প্রচণ্ড চিৎকারে কান পাতা দায়। তামিম-সৌম্য জুটি একেকটি চার-ছয় মারছে, সাথে সাথে স্টেডিয়ামে উপস্থিত হাজার হাজার দর্শক যেন খুশিতে পাগল হয়ে পড়ছে। বাংলাদেশে বনাম পাকিস্তানের একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সিরিজের শেষ ম্যাচ চলছে। বাংলাদেশ সিরিজে ২-০ ব্যবধানে এগিয়ে আছে। আজকের ম্যাচটি জিতলেই হোয়াইট ওয়াশ! কিংবা সাম্প্রতিককালে জনপ্রিয় হয়ে যাওয়া টার্ম-বাংলা ওয়াশ!

আজকের ম্যাচে প্রথমে ব্যাট করে পাকিস্তানীরা কাঁটায় কাঁটায় ২৫০ করেছে। এখন বাংলাদেশ ব্যাট করছে। দেখতে দেখতে উদ্বোধনী জুটিতে শত রান হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত তামিম ব্যক্তিগত ৬৪ রানে আউট হল, দলের সংগ্রহ ১৪৫। পরের ব্যাটসম্যান রিয়াদ দ্রুত আউট হলেও সৌম্য অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলল। ওর হাতে বেদম মার খেয়ে পাকিস্তানী বোলারদের হল একেবারে ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা! মাত্র ৯৪ বলে ছেলেটা ওর শতক পুরো করে ফেলল। অন্যপ্রান্তে মুশফিকও দারুণ আস্থার সাথে খেলতে লাগল।

১০ ওভার ৩ বল বাকি থাকতেই ৩য় উইকেট জুটি যখন জয়সূচক রানটি তুলে ফেলল স্টেডিয়াম যেন আনন্দে ফেটে পড়ল। শেষ পর্যন্ত সৌম্য সরকার ১২৭ এবং মুশফিকুর রহিম ৪৯ রানে অপরাজিত রয়ে গেল। বাংলাদেশ জিতল ৮ উইকেটের বড় ব্যবধানে। একই সাথে বাংলা ওয়াশও নিশ্চিত করল!

গ্যালারিতে থাকা শত শত দর্শকের সাথে সোহরাব হোসেনও লাফিয়ে লাফিয়ে আনন্দ প্রকাশ করতে থাকলেন। ৬৫ বছর বয়সী একজন প্রবীণ মানুষকে এভাবে লাফাতে দেখেও কেউ কিছু মনে করল না বরং আশপাশের সবাই এমন ভাব করল যেন এরকম দিনে এটাই স্বাভাবিক। অবশ্য পিচ্চি অনিক এবং সিফাত কিছুটা অবাক হয়ে দাদুর দিকে তাকিয়ে রইল। ওদের বয়স যথাক্রমে ১০ বছর এবং ৭ বছর। দাদুর সাথে ওরা প্রায়ই স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে আসে, কিন্তু এর আগে কোনদিন দাদুকে এতটা খুশি হতে দেখে নি।

বাবার কাছে শুনেছে দাদু কখনোই ঢাকায় হওয়া বাংলাদেশের কোন আন্তর্জাতিক ম্যাচ মিস করেন না। যত ব্যস্ততাই থাকুক না কেন, মাঠে হাজির হবেন-ই। কিছুক্ষণ পর ক্লান্ত হয়ে চেয়ারে বসার পর ওরা দেখতে পেল দাদুর চোখে পানি। অনিক জিজ্ঞাসা করল,
-দাদু, তুমি কাঁদছ কেন?
-খুশিতে কাঁদছি দাদু। আজ আমি অনেক খুশি রে…
-আমরাও অনেক খুশি, দাদু!
-খুব ভাল, অনিক বাবা। আজকে আমার আরও একজন অনিকের কথা মনে পড়ছে, ও এখানে থাকলে তোদের মতনই খুশি হত।
-কোন অনিকের কথা বলছ দাদু?
-আজ থেকে ৪৪ বছর আগে যে অনিক তোদের দাদুকে বাঁচাবার জন্য নিজে গুলি খেয়ে জীবন দিয়েছে! যার নামের সাথে মিল রেখে তোর নাম রেখেছিলাম…

অনিক জানে দাদু এক সময় খুব নামকরা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তিনি ছিলেন শান্ত বাহিনী নামের একটি দুঃসাহসিক দলের নেতা। তাঁর ডাক নামানুসারে দলের নামকরণ হয়েছিল। কিন্তু এর বেশি কখনো কিছু জানা হয় নি।
-বল কি দাদু??!! এই গল্প আমাদের কখন বলবে?
-বাসায় চল, আজকে রাতেই বলব।

চোখে মুছে সোহরাব সাহেব মাঠের দিকে তাকিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের আনন্দ উৎযাপন দেখতে লাগলেন। বাংলাদেশের পতাকা হাতে ওদেরকে দেখে তাঁর চোখ আবার ঝাপসা হয়ে গেল। তামিম, সাকিব, মুশফিক, মাশরাফি, নাসির, সৌম্য, সাব্বিরের বদলে তিনি যেন একেকটি অনিক দেখতে পেলেন, ৪৪ বছর আগের সেই দুরন্ত এবং অসম সাহসী অনিক!!

*********************** সমাপ্ত *************************

২ টি মন্তব্য : “বলের বদলে গ্রেনেড! (শেষ পর্ব)”

  1. সাজেদ (২০০৪-২০১০)

    ভাই, এক নাগাড়ে, প্রায় এক নি:শ্বাসেই পুরো ১১ টা পর্ব শেষ করলাম। সেই ভোর ৪:০০ টায় শুরু করে ৫:৪৫ এ শেষ হল। চোখের কোণ আর্দ্র হয়ে গেছে আগেই। শেষটুকু পড়ে চোখে ঝাপসা দেখতেছি।
    মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমার নিজের অনেক আগ্রহ। সে সময়ের কাউকে পেলে আমি ঘন্টার পর ঘন্টা তার গল্প শুনি, আর শরীরে কাঁটা দিতে থাকে পুরো টা সময়। ধন্যবাদ ভাই, অসাধারণ একটা লেখা পড়ার সুযোগ দেয়ার জন্য। যদিও অনেক দেরী হয়ে গেছে পড়তে, তবু, "Better late than never".
    শুরু থেকে মাঠের বাইরে বসে অনিকের খেলা দেখেছি, গোপালগঞ্জ থেকে ভারত পর্যন্ত পাড়ি দিয়েছি, গেরিলা যুদ্ধ করেছি, শেষে শাহিন ভাই কে উইকেট ধরে রাখতে বলেছি। দর্শক থেকে নিজেই যেন প্রধান চরিত্র হয়ে গেছিলাম পড়তে পড়তে।
    আজ আর ঘুমাবো না!


    "মরনের বীথিকায় জীবনের উচ্ছ্বাস,

    জীবনের যাতনায় মৃত্যুর মাধুরী"

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।