শহীদলিপির ইতিহাস-৪

শহীদলিপির ইতিহাস-১
শহীদলিপির ইতিহাস-২
শহীদলিপির ইতিহাস-৩

আমার প্রথমে ইচ্ছা ছিল যে ২১শে ফেব্রুয়ারীর আগেই শহীদলিপি চালু করবো। এমনিতে শীতের দিন। আমাদের বাংলাদেশী চামড়া তখনো অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি বিলাতের শীত সহ্য করতে। তাই বেশীর ভাগ সময় বাড়ীতে হিটিং চালিয়ে বাড়ীতেই সময় কাটাতাম আমরা। দিনে ৮-১০ ঘন্টা করে কাজ করতাম। কিছুক্ষণ পর পর সেইভ করতাম কাজটি অন্য একটি ফ্লপি ডিস্কে। এক দিন কাজ করতে করতে হঠাৎ একটি ‘এরর ম্যাসেজ’ এলো। তাড়াতাড়ি করে অন্য ফ্লপিতে সেইভ করলাম কাজটি। হয়তো একটু অন্যমনস্ক ছিলাম – ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করিনি। পরে দেখলাম কোন ফ্লপিই আর এখন কাজ করছে না। এক মাস আগের ব্যাক আপটি শুধু কাজ করল। তার মানে আমার এক মাসের কাজ নষ্ট। মাথা গরম হয়ে গেল। ওই ঠান্ডার মধ্যে শুধু একটা জামা গায়ে রাস্তায় বেড়িয়ে পরলাম। বাইরে তখন তুষারপাত হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। অল্পক্ষণে মাথা ঠান্ডা হয়ে গেল। শীতে কাঁপতে কাঁপতে ঘরে ফিরলাম।

লন্ডনের বাড়ী – শহীদলিপির জন্মস্থান

শেষ পর্যন্ত বাংলা অক্ষরের ৩টি সাইজের ফন্ট তৈরী সম্পূর্ণ হলো। এদের নাম দিলাম – যশোর, ঢাকা ও চট্টগ্রাম। এই তিন স্থানেই আমি আমার শিক্ষা জীবন অতিবাহিত করেছি। লন্ডন নামে একটি ইংরেজী ফন্টও রাখলাম যাতে প্রয়োজনে বাংলার মধ্যে ইংরেজী শব্দ লেখা যায়।

এর পর ম্যাক অপারেটিং সিসটেমের ফাইলগুলি খুঁজে খুঁজে বিভিন্ন মেনু আইটেমের ইংরেজী নামগুলি বদলিয়ে বাংলা নাম বসালাম। নিজের সীমাবদ্ধ জ্ঞানে যা বুঝলাম, সেই ভাবে ইংরেজীর বাংলা প্রতিশব্দ বানিয়ে চললাম। ফাইল, এডিট, ফাইন্ড, ফরম্যাট, ফন্ট, টাইপ -এর বদলে নথি, সম্পাদনা, অনুসন্ধান, কাঠামো, বর্ণমালা ও ধরন লিখলাম। কাট, কপি ও পেস্ট -এর স্থলে কর্তন, প্রতিলিপি ও সংযোজন লিখলাম।

নীচের তালিকায় দেখা যাবে যে এর মধ্যে কিছু মজার মজার শব্দও চলে এসেছে। ইদুর, জাঁতা, বর্তনী তাদের মধ্যে অন্যতম। হুবহু ইংরেজী শব্দ বাংলায় লেখার বদলে ভাবলাম নতুন বাংলা শব্দ ব্যবহার করলে ক্ষতি কি? মাউসের বদলে ইদুর মনে হলো ঠিকই আছে. তবে যেহেতু ‘ডিস্ক ড্রাইভ’ একটি নতুন শব্দ বাংলার জন্যে, তাই বেশ খুঁজে খুঁজে ‘জাঁতা’ শব্দটি ঠিক করলাম এর জন্যে। আমার ছোট বেলায় প্রায় ঘরে ঘরে ব্যবহার হতে দেখতাম দু’টি পাথরের চাকতীর তৈরী এই আদি বাংলার ‘গ্রাইন্ডিং’ যন্ত্রটি। এখন শহরে কদাচিৎ জাঁতা দেখা যায় এবং শব্দটি প্রায় লুপ্ত হতে চলেছে। ভাবলাম দেখি না চেষ্টা করে নতুন ভাবে বাঁচানো যায় কিনা এই শব্দটিকে। ‘ডিস্ক’-এর বদলে প্রথমে ভাবছিলাম ‘চাকতি’ ব্যবহার করবো। পরে মনে পরলো ‘বরতন’ বলে একটি গ্রামীন শব্দ শুনেছিলাম, যার মানে ছিল ‘বাসন’ বা ‘থালা’। তার থেকেই তৈরী করলাম ‘বর্তনী’।

[এখানে একটি জিনিস বোধ হয় লক্ষণীয় – আমি ইংরেজী শব্দের বাংলা পরিভাষা সৃষ্টি না করে, বাংলা শব্দের ইংরেজী পরিভাষা যেন খুঁজে বের করেছি, এমনই একটি আভাষ দিয়েছি। তখনকার কম বয়সে বোধ হয় উগ্র বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ আমার মধ্যে একটু বেশী কাজ করছিলো …]

শেষ পর্যন্ত শহীদ দিবসের প্রায় একমাস আগেই আমার প্রথম শব্দলিপি তৈরী হয়ে গেল। ঠিক করলাম মাকে প্রথমে একটা চিঠি লিখে আমার যাত্রা শুরু করবো। দিনটি ছিল ২৫শে জানুয়ারী, ১৯৮৫ – দিনটি মনে রাখার বিশেষ কারণ হচ্ছে, কাকতালীয় ভাবে ঐ দিনটি আমার জন্মদিনও ছিল। চিঠিটা এ্যাপেলের ডট-মেট্রিক্স প্রিন্টারে প্রিন্ট করে সেদিনই ডাকে পাঠালাম মাকে।

ইন্টারনেট তখনো চালু হয়নি। তবে আমরা বিভিন্ন ইউজার গ্রুপের ‘টেকিরা’ নিজেদের মধ্যে ম্যাসেজ আদান-প্রদান ও সফট-ওয়ার ডাউনলোড আপলোড করার জন্যে ‘বুলেটিন বোর্ড’ নামে একটি জিনিস ব্যবহার করতাম। আমি তখনো আমার বাসা থেকে বুলেটিন বোর্ড ব্যবহার করতে পারতাম না, কারন আমার কোন ‘মডেম’ ছিল না। বিলাতে তখন একটা মডেমের দাম ৪০-৫০ পাউন্ডের মত। ভাবলাম দেখি কাউকে শহীদলিপির সফট-ওয়ার বিক্রি করে এই টাকাটা জোগাড় করতে পারি কিনা। লন্ডনের ড্রামন্ড ষ্ট্রিটে কিছু এশিয়ান সবজি দোকান (গ্রোসারী ষ্টোর) ছিল, যেখানে কিছু বাঙালী দোকানদার ছিল। কিন্তু সে সব দোকানে অনেকে ক্যাশ রেজিষ্টারই রাখতো না, কম্পুউটার তো দূরের কথা। তাদের কাছে তখন শহীদলিপি বিক্রির সম্ভাবনা কম।

টেলিফোন ডিরেক্টরিতে নাম্বার দেখে বিবিসি রেডিও-কে ফোন করলাম। কিছুক্ষন পরে বাংলা বিভাগের সিরাজুর রহমানকে পেলাম।

তাকে বললাম – ‘আমি একটি বাংলা ওয়ার্ড-প্রোসেসর তৈরী করেছি, এটা কি আপনাদের কোন কাজে আসতে পারে?’

প্রথমে আমার কথাটি ঠিক বুঝলেন না। বেশ কিছুক্ষণ বুঝাবার পরে তিনি প্রশ্ন করলেন :

– তার মানে আপনি বাংলা কম্পুউটার তৈরী করেছেন?
– হ্যা, তা বলতে পারেন। আমি একটি বাংলা কম্পুউটার তেরী করেছি।
– কত বড় এটি? দেখাবার জন্যে আমাদের এখানে নিয়ে আসতে পারবেন?
– ঠিক আছে, নিয়ে আসবো। – একটু চিন্তা করে উত্তর দিলাম আমি।
– কালকে সকালে নিয়ে আসেন তা’হলে – বেশ আগ্রহ দেখলাম তার কণ্ঠে।
– ঠিক আছে আগামী কাল ১০টার সময় বুশ হাউসে নিয়ে আসবো তা হলে। দয়া করে গাড়ীসহ ভেতরে ঢোকার গেইট পাসের ব্যবস্থা করে দিলে ভাল হয়।
– গেইট পাস থাকবে। চিন্তা করবেন না।

রেজাউর রহমান ও তার সহকর্মী শ্যামল লোদ আমাকে অভ্যর্থনা করলেন বুশ হাউসে (লন্ডনে বিবিসি ওয়ার্ল্ড রেডিও-র হেড অফিস)। কম্পুউটার অন করার পর যখন প্রথমেই শহীদ মিনারের ছবি এবং বাংলায় লেখা শহীদলিপিতে স্বাগতম দেখলেন – দু’জনেই খুব উৎসাহিত হয়ে উঠলেন। তার পর যখন দেখলেন যে কম্পুউটারের সমস্ত কিছু বাংলায়, তখন তারা দু’জনেই আনন্দ যেন আর ধরে রাখতে পারছেন না এবং আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরলেন। শ্যামল লোদকে দিয়ে তখনি আমাকে ষ্টুডিওর ভেতরে নিয়ে যেয়ে একটি ইন্টারভিউ রেকর্ড করালেন। তাদের এই উৎসাহ দেখে আমি আর চক্ষুলজ্জায় বিক্রির কথা উঠাতে পারলাম না। তবে ভালই লাগলো তাদের এই স্বতঃস্ফুর্ত উৎসাহ দেখে।

বাংলাদেশ ও ভারতের উদ্দেশ্যে প্রচারিত বিবিসি-র বাংলা এক্সটারনাল সার্ভিস লন্ডনে বসে শোনা যেত না। ঢাকাতে আমার এক বোন রেডিওতে এটা শুনে তাৎক্ষনিক ভাবে তার ক্যাসেট রেকর্ডারে রেকর্ড করে আমাকে তার একটি কপি পাঠিয়ে দিলেন। দেখলাম প্রচারের সময় সাক্ষাৎকারের সূচনাতে আরও কিছু অতিরিক্ত প্রশংসা জুড়ে দিয়েছেন পরিচালক।

এর কয়েকদিন পর বিবিসি টিভি থেকে ফোন পেলাম। তারা আমার সাথে দেখা করতে চান। সম্মতি দিলাম। বিবিসি টিভি বার্মিংহামে অবস্থিত। প্রতি রবিবার ‘এশিয়ান ম্যাগাজিন’ নামে এক ঘন্টার একটি অনুষ্ঠান প্রচারিত হতো বিবিসি-১ চ্যানেলে। এটি মূলত ভারতীয় এবং পাকিস্তানীদের দখলে ছিল এবং কদাচিৎ কোন বাংলাদেশীকে দেখা যেত। ইউসুফ আজিজ নামে বিবিসিতে কর্মরত এক পাকিস্তানী ভদ্রলোক বার্মিংহাম থেকে লন্ডনে এলেন শুধু আমার সাথে দেখা করার জন্যে। শহীদলিপির সামান্য একটু ডেমো দেখেই বললেন যে বিবিসি টিভিতে আমার একটি টিভি ইন্টারভিউ প্রচার করতে চান। তাদের নির্দিষ্ট সম্মানী ছাড়াও আমার বার্মিংহাম যাওয়া আসার খরচ দেওয়া হবে। আমি রাজী আছি কিনা? সম্মতি জানালাম। তবে জানালাম আমি সাথে করে ম্যাকিন্টশ কম্পুউটার নিয়ে যেতে চাই না। তারা যেন একটা নতুন ম্যাক জোগাড় করে রাখে। বিবিসি থেকে টেলিফোন পেয়ে স্থানীয় এ্যাপেল ডিলার নতুন একটি ম্যাক নির্দিষ্ট দিনে ষ্টুডিওতে পৌছে দিল।

লন্ডনে আমাদের বাড়ী থেকে বার্মিংহামের দূরত্ব ১০০ মাইলের কিছু বেশী। ভাবলাম দুই ঘন্টার বেশী লাগবে না গাড়ীতে, যদি আমি ড্রাইভ করি। এম-১ হচ্ছে ইংলান্ডের মটরওয়ে (আমেরিকার ফ্রী-ওয়ের অনুরূপ)। রাস্তায় নেমে বুঝলাম দেরী হয়ে যাবে। ফলে মটরওয়েতে উঠে গাড়ীর গতি ৯০ মাইলে উঠালাম। অন্য সব গাড়ীকে ওভারটেক করে ভালই যাচ্ছিলাম, কিন্তু না দেখে এক পুলিসের গাড়ী ওভারটেক করার পরে পুলিসের কাছ থেকে টিকিট পাবার ভয়ে গাড়ীর গতি কমিয়ে দিলাম। দেখলাম পুলিস অফিসার আমার দিকে তাকিয়ে দেখলো, কিন্তু আমার পিছু ধাওয়া করলো না। তবু সতর্ক হয়ে চালালাম বাকী পথটা। ১৫ মিনিট দেরীতে পৌঁছিয়ে দেখলাম আমার জন্যে সবাই অপেক্ষা করছে।

এক তরুনী ভারতীয় মহিলা ইন্টারভিউ নিলেন। আগের থেকে প্রস্তুত প্রশ্ন একে একে করে গেলেন। আমি তেমন কিছু চিন্তা না করে যখন যেমন মনে এলো উত্তর দিয়ে গেলাম। প্রশ্নকর্ত্রী জানতে চাইলেন বিলাতের ‘মাল্টিকালচারাল এডুকেশনের’ বাপারে আমার এই আবিস্কার কিভাবে কাজে আসতে পারে? বললাম – আমি যেমন বাংলা ভাষাতে কম্পুউটার ব্যাবহার করছি, তেমনি অন্যান্য ভারতীয় ভাষায় কম্পুউটার ব্যবহার করতে পারলে এখানকার শিশুরা সেই সব ভাষা সহজে শিখতে পারবে। প্রায় এক ঘন্টা রেকর্ডিংয়ের পর বিবিসির দেওয়া টাকার চেক পকেটাস্থ করে বাড়ীর পথে রওয়ানা দিলাম। এই টাকায় আমার মডেম কেনার সমস্যার সমাধান হয়ে গেলো।

পরের রবিবারে পরিবারের সবাই এক সাথে বসে টিভিতে আমার ইন্টারভিউ দেখলাম। আমি জানতাম না যে এই অনুষ্ঠানটি বিলাতের ‘দেশী’ গোষ্ঠির এতটা প্রিয়। স্ট্যাফোর্ড থেকে আমার মামাত বোন ফোন করে শুভেচ্ছা জানালেন। অনুযোগ করলেন কেন আমি বার্মিংহাম থেকে সামান্য দূরে তাদের বাড়ীতে গেলাম না। কথা দিলাম শিগ্রি একদিন যাবো তাদের ওখানে। আমাদের লন্ডন অফিসের ইন-চার্জ ফোন করে বললেন খুব ভাল প্রোগ্রাম হয়েছে। আমিও তাকে ধন্যবাদ দিলাম তার ম্যাক ব্যবহার করে এই সুযোগ করে দেবার জন্যে। আরও কিছু স্থানীয় বন্ধুদের কাছ থেকে শুভেচ্ছা পেলাম।

প্রোগ্রামটি প্রচারিত হবার সময় আমরা আমাদের ভি সি আর-এ রেকর্ড করে নিয়েছিলাম। ক্যাসেটটি হাতে করে বাড়ীর কাছের এক ভিডিও দোকানে নিয়ে গেলাম। বললাম – বাংলাদেশী স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী প্যাল-বি উপযোগী করে দু’টি কপি করে দিতে। পরের দিন যখন ক্যাসেট নিতে গেলাম, ভারতীয় দোকান মালিক আমাকে চিনলো এবং বলল – ‘দেখো, এটা ইংল্যান্ড বলে আজ তুমি কত সম্মান পেলে, এটা কি দেশে থাকলে পেতে?’ তার কথা তখন ঠিক বুঝতে পারিনি, তবে অনেক বছর পরে কথাটার মানে অনুধাবন করতে পেরেছি।

টিভির এই প্রোগ্রাম দেখে লন্ডনের এক নাম করা গুজরাটি ব্যবসায়ী আমার সাথে দেখা করে অনুরোধ করলেন গুজরাটি ভাষায় কম্পুউটার বানাতে। ৫,০০০ থেকে ১০,০০০ পাউন্ড দিতে চাইলেন তার বিনিময়ে। যেহেতু আমি হিন্দী দেব-নাগরী অক্ষর কিছু কিছু পড়তে পারতাম এবং হিন্দীর সাথে গুজরাটির মিল আছে (অক্ষরের চেহারা অবশ্য আলাদা) – চেষ্টা করলে হয়তো শহিদলিপির মতো গুজরাটি ভাষায় কম্পুউটার ব্যবহারের ব্যবস্থা করতে পারতাম। কিন্তু তখন আমি লেজার প্রিন্টারের উপযোগী করে বাংলা ফন্ট বানাবার কাজে ব্যস্ত। তাই আর্থিক প্রলোভন আমাকে অন্য কাজে তেমন আকৃষ্ট করতে পারলো না।

আর একটা স্মরণীয় টেলিফোন পেলাম সংগীত শিল্পী নাহিদ নিয়াজীর কাছ থেকে। বিবিসি থেকে আমার টেলিফোন নাম্বার জোগাড় করেছেন তিনি। পাকিস্তানী আমলে নাহিদ নিয়াজী ও মুসলেউদ্দিন সংগীত জগতের এক নাম করা জুটি। বাংগালী মুসলেউদ্দিন ছিলেন রেডিওতে সংগীত পরিচালক এবং পশ্চিম পাকিস্তানী সুন্দরী গায়িকা নাহিদ নিয়াজীকে প্রেম করে বিয়ে করেন। আমাদের বয়সের অনেকে এখনো নাহিদের গাওয়া বাংলা গান – “আকাশের ওই মিটি মিটি তারার সাথে কইবো কথা, নাই বা তুমি এলে” – মনে রেখেছেন। আমার প্রিয় গায়িকার এক জন তিনি। কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি তার কাছ থেকে ফোন পাবো। তারা তখন স্থায়ী ভাবে বিলাতে থাকেন। তার সন্তানকে বাংলা শেখাবার জন্যে শহীদলিপিতে আগ্রহী তিনি। শুনে ভালো লাগলো।

লন্ডনে সাপ্তাহিক জনমত বলে একটি বাংলা পত্রিকা প্রকাশিত হতো। আমার স্ত্রী মমতাজ শহীদের লেখা মাঝে মাঝে সেখানে প্রকাশিত হতো। সেই সূত্রে সামাদুল হক নামে জনমতের এক সাংবাদিকের সাথে পরিচয় ছিল তার। শহীদলিপির কথা জেনে আমার সাথে দেখা করতে এলেন তিনি। তারপর সাপ্তাহিক জনমতে শহীদলিপির উপরে আমার একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করলেন।

ব্রিগেডিয়ার আমসা (এ এম এস এ) আমিন, আমাদের সিনিয়ার ফৌজিয়ান, তখন লন্ডনের বাংলাদেশ দূতাবাসে ডিফেন্স এডভাইজার। সস্ত্রীক দেখা করতে এলেন আমাদের বাড়ীতে।

[উপরের ছবিতে বা-দিকে আমিন ভাই মেয়েকে কোলে নিয়ে ও ডান-দিকে আমি, ভাবীর কোলে আমার মেয়ে মারিয়া ও আমার পাশে ছেলে সাঈদ]

আমার অন্য বন্ধুদের মধ্যে যারা এসে ঐ সময় আমাকে আমার কাজে উৎসাহ দিয়েছে তাদের মধ্যে ছিলো ব্যারিষ্স্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ (পরে পররাষ্ট্র মন্ত্রী), প্রফেসর স্বপন আদনান (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), ডাঃ মোয়াভিনুল ইসলাম (কুয়েত), ডাঃ মুশফিকুর রহমান (দাহরান বিশ্ববিদ্যালয়), মেজবাহ উল ইসলাম (বিসিসি ব্যাঙ্ক), মঞ্জুর মান্নান (বর্তমান কমিশনার, দূনীতি দমন কমিশন), ব্রিগেডিয়ার ইমতিয়াজ চৌধুরী, ব্রিগেডিয়ার সাহিদ সেলিম, ইত্যাদি।

বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে একটা জাতীয় অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করার ডাক এলো আমাদের স্বামী-স্ত্রী দু’জনের। প্রথম দিনের অনুষ্ঠানে মমতাজ তার লেখা কবিতা পাঠ করলো আর আমি বাড়ীতে থেকে বাচ্চাদের দেখা-শোনা করলাম। পরের দিনের আলোচনা অনুষ্ঠানে আমি অংশ নিলাম। সংগীত শিল্পী শাহীন সামাদ নিজে থেকে এগিয়ে এসে আমার সাথে পরিচিত হয়ে আমাকে শুভেচ্ছা জানালেন। মনে পড়লো, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় নব-বর্ষের প্রথম দিনে রমনার বটমূলে ছায়ানটের অনুষ্ঠানে শাহীনের গান আমরা আগ্রহ ভরে শুনতাম। এমন এক জন শিল্পীর কাছ থেকে শুভেচ্ছা পেয়ে ভাল লাগলো।

[ চলবে … ]

শহীদলিপির ইতিহাস-৫

৫,৩৮২ বার দেখা হয়েছে

৩৩ টি মন্তব্য : “শহীদলিপির ইতিহাস-৪”

  1. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    ব্রিগেডিয়ার আমসা আমীন সম্ভবত পরবর্তীতে এ্যাডজুটেন্ট জেনারেল হয়েছিলেন এবং আমি খুব ভুল না করে থাকলে ১৯৯৯ সালের দিকে জেসিসিতে পরিদর্শনে এসেছিলেন।

    সাইফ ভাই, বরাবরের মতই অনবদ্য লেখা।একটানে পড়ে শেষ করলাম।ইশ,গুজরাটি ব্যবসায়ীর কথা শুনলে হয়তো ভারতীয় বন্ধুদের কাছে আমি পার্ট নিয়ে বলতে পারতাম-তোদের গুজরাটের প্রথম কম্পিউটারে লেখা আমাদের দেশের একজনের করা,বুঝলি?? ওই ব্যবসায়ী ভদ্রলোকের প্রতি শ্রদ্ধাও হচ্ছে-নিজের ভাষার প্রতি কত সচতন তিনি!

    আপনার প্রতি আবারো হ্যাটস অফ!! :boss:

    জবাব দিন
    • সাইফ শহীদ (১৯৬১-১৯৬৫)

      মাসরুফ,
      অনেক ধন্যবাদ তোমার মন্তবের জন্যে। আমিন ভাইয়ের চীপ হবার সম্ভাবনা ছিলো বলে শুনেছিলাম। পরে তাকে বিদেশে রাষ্ট্রদূত করা হয়েছিলো।

      গুজরাটি ব্যবসায়ীর নাম ছিলো, যত দূর মনে পরে, রতিলাল আগারওয়াল। তিনি প্রথমে আমাকে ফোন করে তার অফিসে কম্পুউটার নিয়ে যেয়ে ডেমো দেখাতে বলেছিলেন। ওই বয়সে আমি বেশ 'এগ্রেসিভ' ছিলাম। আমি তাকে বলেছিলাম, দেখতে হলে তুমি আমার বাড়ীতে এসে দেখে যাও। আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব না। পরে সে যখন আমার বাড়ীতে এক বিরাট গাড়ীতে করে এলো এবং সুন্দর ভাবে কথা বললো তখন নিজেকেই ছোট লাগলো।
      "ওই ব্যবসায়ী ভদ্রলোকের প্রতি শ্রদ্ধাও হচ্ছে-নিজের ভাষার প্রতি কত সচতন তিনি!" - আসলে বড় ব্যবসায়ী হিসাবে তার দূরদৃষ্টি ছিলো এটার সম্ভাবনার নিয়ে, যেটা আমার ছিলো না।

      জবাব দিন
  2. মইনুল (১৯৯২-১৯৯৮)
    পরের দিন যখন ক্যাসেট নিতে গেলাম, ভারতীয় দোকান মালিক আমাকে চিনলো এবং বলল – ‘দেখো, এটা ইংল্যান্ড বলে আজ তুমি কত সম্মান পেলে, এটা কি দেশে থাকলে পেতে?’ তার কথা তখন ঠিক বুঝতে পারিনি, তবে অনেক বছর পরে কথাটার মানে অনুধাবন করতে পেরেছি।

    খুবই দুঃখজনক কিন্তু সত্য কথা।
    বরাবরের মতই অনেক ভালো লাগলো সাইফুদ্দাহার ভাই।

    জবাব দিন
  3. রকিব (০১-০৭)

    এইই সিরিজটা এমন যে কেবল নিজে পড়ে শান্তি পাচ্ছি না; অন্যদের পড়িয়ে ছাড়ছি। সাইফ ভাই আপনি অনবদ্য। :salute:


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন
    • সাইফ শহীদ (১৯৬১-১৯৬৫)

      তানভীর,
      তোমাদের সামনে অনেক বড় জীবন পরে আছে। কত কিছু নতুন নতুন হচ্ছে এবং হবে। পৃথিবীর ইতিহাসের সব চাইতে ঘটনা বহুল সময়ে বাস করছো তোমরা। অনেক কিছু দেখার ও করার সুযোগ পাবে ভবিষ্যতে।

      সব সময় নিজের যেটা ভালো লাগে সেটা করার চেষ্টা কোরো। জীবনটা যে একান্তই তোমার।

      জবাব দিন
  4. রাব্বী (৯২-৯৮)

    আপনার বন্ধদের একজনকে চিনি। প্রফেসর স্বপন আদনানের সাথে একবার দেখা করতে গিয়েছিলাম ২০০৪-এ। খুব মনযোগ দিয়ে কথা শোনেন। আমাকে ওনার একটা বই দিয়েছিলেন সেটা মার্কেটে আসার আগেই। উনি তো এখন এনইউএস-এর প্রফেসর।

    লেখা অনবদ্য।


    আমার বন্ধুয়া বিহনে

    জবাব দিন
    • সাইফ শহীদ (১৯৬১-১৯৬৫)

      আমাদের ক্লাশে সব সময় পরীক্ষাতে প্রথম হতো আদনান। বোর্ডের পরীক্ষাতে অংকে ১০০-তে ১০০ পেয়েছিল সে।

      বর্তমানে কোন এক প্রজেক্টের কাজে ইংলান্ডে আবস্থান করছে। টেলিফনে এবং ই-মেলে যোগাযোগ আছে তার সাথে। চট্টগ্রাম হিল ট্রার্সের উপর তার লেখা একটি অনবদ্য বই আছে।

      ধন্যবাদ তোমাকে।

      জবাব দিন
  5. সাইফ শহীদ (১৯৬১-১৯৬৫)

    মাঈনুল, রবিন, ফয়েজ, মামুন,
    তোমাদের মন্তব্য পড়ে সেই নদীর মাঝির 'জীবন ১৬ আনাই মিথ্যা'-র গল্প মনে পড়লো। আসলে এটি খুব কঠিন প্রশ্ন - কোন কাজটি করা জীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিত।

    সুযোগ পেলে ভবিষ্যতে 'আমার হিরোর' গল্প লিখবো। হয়তো বুঝবে আমি কি বলতে চাইছি।

    একদিকে দেখতে গেলে জীবনের কোন অর্জনই সামান্য নয়, আবার অন্য ভাবে দেখলে সবই শূন্য।

    জবাব দিন
  6. সাইফ শহীদ (১৯৬১-১৯৬৫)

    নাহিদ নিয়াজীর গানটা ইউ-টিউবে খুঁজে পেলাম তাই এখানে উঠিয়ে দিলাম। রেকর্ডিংটা অতটা ভাল হয়নি, তবুও বহু দিন পরে গানটি শুনে ভাল লাগলো। শুনে খারাপ লাগলো এই শিল্পী এখন মৃত।

    জবাব দিন
  7. তানভীর (০২-০৮)

    " আমি লোকজনকে বলি যে, আমি জীবনে কোন পরীক্ষাতে দ্বিতীয় হইনি। যেটা বলিনা সেটা হচ্ছে – আমি জীবনে কোন পরীক্ষাতে প্রথম হইনি "
    আপনি এখন ও ইউং । ধন্যবাদ বরাবরের মত সহজ সাবলীল লেখার জন্য । “আকাশের ওই মিটি মিটি তারার সাথে কইবো কথা, নাই বা তুমি এলে” গানটা অনেক দিন পরে শুনলাম । ধন্যবাদ
    Old is always gold!

    জবাব দিন
  8. জিহাদ (৯৯-০৫)

    সবগুলো লেখাই পড়েছি ভাইয়া। মোবাইল থেকে পড়তাম বলে মন্তব্য করা হয়নি। চলতে থাকুক ইতিহাসের কাব্য। বিমুগ্ধ শ্রোতা হিসেবে সাথে আছি


    সাতেও নাই, পাঁচেও নাই

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।