বলের বদলে গ্রেনেড (৪র্থ পর্ব)

১ম পর্ব
২য় পর্ব
৩য় পর্ব

৭।

আজকের সকালটা কেমন বিষণ্ণ! অনিক মনে মনে ভাবল। সকালে নাস্তা করার পর সেই কখন থেকে টেবিলে বসে পড়ার চেষ্টা করছে, কিন্তু কিছুতেই মন বসাতে পারছে না।

গতকাল গোপালগঞ্জ থেকে চিঠি এসেছে। এবার অনেকদিন পর বাবা-মা’র কাছ থেকে চিঠি এল। অবশ্য শুধু বাবার কথা বলাই ভাল, কেননা মা ওকে কখনোই লেখেন না। তাঁর নাকি চিঠি লিখতে গেলে শুধু চোখ পানিতে ভরে যায়, এজন্য কিছু লিখতে পারেন না!

মায়েরা এমন হয় কেন?

বাবা লিখেছেন বাসার সবাই ভাল আছে। ছোট ভাই শাওন প্রায়ই ওর কথা জিজ্ঞাসা করে। অনিককে অনেক মিস করে। শাওনও নাকি মেট্রিক পরীক্ষার পর খুলনা এসে থাকতে চায়, পড়াশুনা করতে চায়। যাই হোক, বাবা আরও লিখেছেন মন দিয়ে পড়াশুনা করতে। ক্রিকেট খেলা আপাতত বেশি না করতে। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ভাল করে ঢাকায় গিয়ে নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হবে…ইত্যাদি। এর সাথে বাইরে কম যাবার ব্যাপারেও নির্দেশ দিয়েছেন, দেশের এই পরিস্থিতিতে যতটা ঘরে থাকা যায় ততই মঙ্গল।

বাবার এই কথাটা অবশ্য ঠিক। গতকাল ওদের ক্লাসের ওয়াহাব এবং সগীরকে কিছু বিহারি ছেলে বেদম পিটিয়েছে। গগন বাবু রোডে অনেকে মিলে আড্ডা দিচ্ছিল, কথায় কথায় এক পর্যায়ে বাঙ্গালি-অবাঙ্গালি ইস্যুতে গ্যাঞ্জাম বেঁধে যায়। সবচেয়ে কষ্টের কথা হচ্ছে পুলিশ সেখানে উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও ওদেরকে মার খেতে হয়েছে। পুলিশ নাকি দেখেও না দেখার ভান করেছে!

এই ঘটনার পর থেকে সিটি কলেজের সবাই দারুণ ক্ষিপ্ত হয়ে আছে। যে কোন সময় দল বেঁধে অবাঙ্গালিদের উপর হামলা চালানো হতে পারে। অবশ্য ছাত্রলীগ এবং অন্যান্য রাজনৈতিক ছাত্র-নেতাদের অনুরোধে সবাই আপাতত চুপ করে আছে। তাদের মতে এমন কিছু করা যাবে না যাতে করে দেশের পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যায়।

অবশ্য পরিস্থিতি এমনিতেও তেমন একটা ভাল নেই!

১৩ ফেব্রুয়ারি সরকারী ঘোষণা এল আগামী ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন হবে। সবাই খুব খুশি এবং আশাবাদী হয়ে উঠেছিল। অবশ্য শেখ মুজিব সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন। এর ঠিক দুই দিন বঙ্গবন্ধুর কথার সত্যতা মিলল। ১৫ ফেব্রুয়ারি ভূট্টো সাফ জানিয়ে দিল আওয়ামী লীগ যদি ৬ দফা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত থেকে সরে না আসে, তাহলে তিনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগ দেবেন না। একই সাথে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অন্য কেউ যেন না আসে, তা নিশ্চিত করবেন!

এই ঘটনার পর সবার মধ্যে সন্দেহ আরও বেড়ে গেছে। কেননা, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবান করার আগে নিশ্চিতভাবেই ভূট্টোর সাথে আলোচনা করেছে। ফলে, বোঝাই যাচ্ছে পুরোটাই ইয়াহিয়া খানের লোক দেখানো এবং প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায় এড়াবার চেষ্টা মাত্র। দুজনে মিলে অযথাই কালক্ষেপণ করছে এবং গভীর কোন ষড়যন্ত্র করছে!

নাহ কিছুই ভাল লাগছে না! আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবল ও।

এদিকে ক্রিকেট প্র্যাকটিসও বেশ কিছুদিন ধরে বন্ধ আছে। সুনীলদা খুলনার ডিসি নুরুল ইসলামের সাথে কথা বলেছেন। কোন লাভ হয় নি। আপাতত সার্কিট হাউজের মাঠে না খেলার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। আসলে মাসখানেক প্র্যাকটিস না করার জন্যই বলে দিয়েছেন। কেননা খুলনার নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজন চাইছে না একখানে একাধিক লোক একত্রিত হোক, তা সে যে কারণেই হোক না কেন।

কিছুক্ষণ হাতের মধ্যে ডিউস বলটা লোফালুফি করল। সুনীলদা বলেছেন সবসময় বল সাথে রাখতে এবং সময় পেলেই হাতের মধ্যে বলটা ঘুরাতে। স্পিনারদের জন্য এটা নাকি খুব ভাল ব্যায়াম। বিশেষ করে যারা রিস্ট স্পিনার অর্থাৎ ওর মত লেগ স্পিন করে। এই সপ্তাহ থেকে ওর ফ্লিপার নিয়ে কাজ শুরু করার কথা ছিল। গতদিনের ম্যাচের পর দুই আম্পায়ার নাকি সুনীলদার কাছে ওর ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছিল। ওরা বলেছেন ইন্টারের পর অনিক যেন ঢাকায় গিয়ে ওদের সাথে যোগাযোগ করে। নামকরা যে কোন একটি ক্লাবে ওকে ঢুকিয়ে দেবার ব্যবস্থা করবেন। সে কারণে সুনীলদা চাচ্ছিলেন আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই অনিক যেন ফ্লিপার এবং টপ স্পিন রপ্ত করে নেয়। কিন্তু, এখন তো আপাতত খেলাই হবে না মনে হচ্ছে!!

দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হতেই ওর চিন্তায় বাঁধা পড়ল। পড়ার টেবিল থেকে উঠে গিয়ে নিজেই দরজা খুলল। দেখল কাইয়ুম, এরশাদ সহ ওদের ক্লাসের সাত-আটজন দাঁড়িয়ে আছে। সবাই সিটি কলেজে পড়ে।
-কিরে? তোরা এই সময়ে?
-তোর সময় হবে? কাইয়ুম জিজ্ঞাসা করল।
-কেন? কি দরকার?
-তেমন কিছু না… চল, হাঁটতে যাই।
-কোথায়? অনিক কিছুটা অবাক হয়ে গেল!
-এই তো সামনেই…

কিছুক্ষণ চিন্তা করে অবশেষে রাজি হল অনিক।
-তোরা রাস্তার সামনের দোকানের কাছে গিয়ে দাঁড়া, আমি চাচীকে বলে আসছি…

চাচী কোন সমস্যা করলেন না, শুধু জানতে চাইলেন কাদের সাথে বের হচ্ছে। কাইয়ুমের কথা বলতেই রাজি হয়ে গেলেন। অবশ্য সাবধানে থাকতে বলার কথা বলতে ভুললেন না! একই সাথে চাচা দুপুরে ভাত খেতে আসার আগেই ফেরার কথা মনে করিয়ে দিলেন।

সব মিলিয়ে প্রায় দশ মিনিটের মাথায় অনিক বন্ধুদের সাথে মিলিত হল। এরপর ওরা একসাথে মেইন রোড ধরে হাঁটতে থাকল। ইতোমধ্যে অনিক জানতে পেরেছে ওরা সবাই মিলে ইসলামাবাদ কমিউনিটি সেন্টারে যাচ্ছে। কেন যাচ্ছে তা অবশ্য খোলাসা করে বলে নি। এদিকে এতজনকে একসাথে দেখে অনেকেই ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে কাইয়ুম বলল,
-আমাদের একসাথে যাওয়া ঠিক হচ্ছে না-চল, আমরা কয়েক ভাগে ভাগ হয়ে যাই।

এরশাদও ওর কথায় সায় দিল,
-ঠিকই বলেছিস। সবাই কেমন তাকিয়ে আছে! তারমানে পুলিশ কিংবা আর্মি দেখলে ঝামেলা করবে। এতজন একসাথে কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি ইত্যাদি প্রশ্ন শুরু করবে।

দ্রুত আলাদা হয়ে ওরা ভিন্ন ভিন্ন পথে ইসলামাবাদ কমিউনিটি সেন্টারের দিকে যাত্রা শুরু করল। যাবার পথে কয়েকবার প্রশ্ন করেও অনিক কোন জবাব পেল না। অগত্যা কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ হাঁটার সিদ্ধান্ত নিলো ও।

কমিউনিটি সেন্টারের ভেতরে ঢুকে অনিক অবাক হয়ে গেল। ভেতরের ফাঁকা জায়গাটাতে ওদের কলেজের প্রায় ৩০-৩৫ জনকে দেখতে পেল। সবাই সিটি কলেজের স্কাউটের সদস্য। এই মুহূর্তে মিলিটারি কায়দায় তিন সারিতে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের উলটো পাশে আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকে দেখতে পেল।

ওদেরকে দেখে শেখ আব্দুল কাইয়ুম ভাই এগিয়ে আসলেন। তিনি খুলনা ছাত্রলীগের একজন বড় নেতা।
-আরে ছোট কাইয়ুম যে! তোদের আরও পোলাপান যোগাড় করতে পেরেছিস?
-জ্বি ভাই, প্রায় ১০-১২ জনকে ম্যানেজ করেছি, সবাই ভেঙ্গে ভেঙ্গে আসছে। এক সাথে আসলে লোকে সন্দেহ করত বলে আমরা আলাদা আলাদা আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ‘ছোট’ কাইয়ুম জবাব দিল।
-দারুণ! এ কি তোদের সেই গ্রেট অলরাউন্ডার অনিক? অনিকের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।
-জ্বি ভাই।

-স্লামালিকুম। অনিক সালাম দিল।
-ওয়ালাইকুম সালাম। শুধু ক্রিকেট খেললে চলবে? দেশকে স্বাধীন করতে হবে না? এখন ক্রিকেট ব্যাট-বলের বদলে হাতে রাইফেল তুলে নিতে হবে। পারবি না?
-জ্বি ভাই, শিখিয়ে দিলে অবশ্যই পারব।
-শাব্বাস! এই তো বাঘের বাচ্চার মতন কথা। দেশ স্বাধীন করা ছাড়া আমাদের কোন মুক্তি নেই, বুঝলি? তুই যে ক্রিকেট খেলতে চাইছিস, ওরা কি জাতীয় দলে খেলতে দেবে? দেবে না। রকিবুলের মতন তোকেও ঝুলিয়ে রাখবে। ব্যবসা-বানিজ্য, স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, সরকারী-বেসরকারী চাকুরী… সবখানে ওরা আমাদের এভাবেই বঞ্চিত করে রাখবে। সময় হয়েছে নিজেদের অধিকার বুঝে নেওয়ার! কি, ঠিক না?
-জ্বী ভাই!
-যা, এবার সবাই ঐ স্কোয়াডে দাঁড়িয়ে যা। আফজাল ভাই তোদের ট্রেনিং এর কাজ শুরু করবেন।

ওরা সবাই দ্রুত লাইনে দাঁড়িয়ে গেল। ততক্ষণে বাকিরাও চলে এসেছে।

শেখ আফজাল সবার দিকে কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে রইলেন। সম্ভবত কি বলবেন তা গুছিয়ে নিচ্ছেন।
-তোমরা সবাই তো স্কাউটের সদস্য, তাই না?
-জ্বি ভাই। সবাই সমবেত কণ্ঠে জবাব দিল।
-যারা এখনো জান না, তাদের জন্য বলছি-এখন থেকে এই কমিউনিটি সেন্টারে তোমাদের সামরিক ট্রেনিং চলবে। তোমাদের কিছুটা হলেও ব্যাসিক জ্ঞান আছে বলে সরাসরি আমরা অস্ত্র চালনা শিক্ষায় চলে যাব। আমাদের এখানে অনেকগুলো ডামি রাইফেল আছে। এগুলো দিয়ে তোমরা শিখবে কিভাবে রাইফেল ধরতে হয়, সেফটি অন/অফ করতে হয়, গুলি ভরতে হয়, গুলি করতে হয়, রাইফেল পরিষ্কার করতে হয় ইত্যাদি। এছাড়া যুদ্ধের কিছু ব্যাসিক স্ট্র্যাটেজি নিয়েও আমরা আলোচনা করব। ঠিক আছে?
-জ্বি, ঠিক আছে। সম্মিলিতভাবে ওরা জবাব দিল।
-পশ্চিম পাকিস্তান কখনোই আমাদেরকে ন্যায্য হিস্যা দেবে না। সব দিক থেকে ওরা আমাদের বঞ্চিত করেই যাবে। ওরা আমাদের রক্ত জোঁকের মতন শুষে খাবে আর আমরা তা মেনে নেব-এটা হতে পারে না। আমরা এখন আর স্বায়ত্তশাসন চাই না, আমরা চাই স্বাধীনতা। জয় বাংলা!
-জয় বাংলা! সবাই একইভাবে দৃপ্ত উচ্চারণ করল।
-সসসস…একটু আস্তে…!! তিনি ওদেরকে থামিয়ে দিলেন। কোনমতেই কেউ যেন জানতে না পারে এখানে কিসের ট্রেনিং হচ্ছে। কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলবে সামনের পাকিস্তান দিবসে সিটি কলেজের স্কাউটদের প্রোগ্রাম আছে, সেটার রিহার্সাল চলছে। সবার জন্য শুভ কামনা রইল।

কথা শেষ করে তিনি পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজনের দিকে ইশারা করলেন। তারা সবাই ডামি রাইফেল হাতে নিয়ে ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে ওদেরকে হাতে কলমে শিক্ষা দেয়া শুরু করল।

৮।

-অনিক! এই অনিক…
অনিক নিজের রুমে এক মনে পড়াশুনা করছিল। চাচার জোরালো ডাক শুনে এক দৌড়ে ড্রয়িং রুমে ছুটে গেল। আজকে শনিবার বলে চাচা বাসাতেই আছেন। সকালের নাস্তা করে পেপার পড়ছিলেন।
-কি হয়েছে, চাচা?
-গতকাল থেকে পাকিস্তান বনাম কমনওয়েলথ একাদশের টেস্ট শুরু হয়েছে, জানিস তো?
-জ্বি, জানি। কিন্তু খেলার কি অবস্থা তা জানি না…
-রকিবুলকে ওরা শেষ পর্যন্ত মূল একাদশে নিয়েছে। বাঘের বাচ্চাটা কি করেছে দেখ…
-সেঞ্চুরি করেছে?
-তারচেয়েও বেশি…
-মানে?
-পাকিস্তান প্রথমে ব্যাট করতে নেমেছিল, রকিবুল তো ওপেনিং ব্যাটসম্যান। ও যখন ব্যাট করতে নামে ব্যাটের উপরে বাংলাদেশের পতাকা এবং ‘জয় বাংলা’ লেখা একটি স্টিকার ছিল। ঢাকার দর্শক দারুণ খুশি হয়েছে…
-বল কি? এ তো বিশাল ব্যাপার!! পাকিরা কিছু বলে নি…
-আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো কিছু বলে নি, তবে এটা নিয়ে পরে নিশ্চয়ই কোন ঝামেলা করবে!
-কত রান করেছিল ও?
-রান করেছে মাত্র ১, হক (Hawke) নামের এক বোলারের বলে এল.বি.ডব্লিউ আউট হয়েছে। তবে যে কাজটি করল তা আমাদের দেশের ইতিহাসে দারুণ একটি মাইলফলক হিসেবে রয়ে যাবে!
-চাচা তোমার পেপার পড়া হয়েছে? আমি ওটা ক্লাবে নিয়ে যেতে পারি?
-ক্লাবে যাবি নাকি ইসলামাবাদ কমিউনিটি সেন্টারে?

অনিক ভেতরে ভেতরে চমকে গেলেও মুখে তা প্রকাশ করতে দিল না। ভাবছে, চাচা জানল কি করে??
-কমিউনিটি সেন্টারে কেন যাবো? নিরীহ ভঙ্গিতে জিজ্ঞাসা করল ও।
-তা তুই জানিস আর তোর কাইয়ুম ভাই জানে। ভাবলেশহীন ভাবে বললেন তিনি।

খাইছে! চাচা তো মনে হয় সব জানেন! ভয়ে ঘেমে উঠল ও।
-না মানে…আমি তো…
-থাক। তোকে কোন ব্যাখ্যা করতে হবে না। আমি যা জানি তা আমার মধ্যে থাক, আর তোর ব্যাখ্যা তোর কাছে থাক। শুধু এটুকুই বলব, চোখ-কান খোলা রাখবি এবং খুব সাবধানে থাকবি। অপরিচিত কারও সাথে কোন প্রকার কথা বলতে যাবি না। ঠিক আছে?
-ঠিক আছে। চাচার প্রতি মনে মনে কৃতজ্ঞ বোধ করল অনিক। যাক, কোন মিথ্যা অজুহাত দিতে হল না।
-আমার পড়া হয়ে গেছে, চাইলে পেপার নিয়ে যেতে পারিস।
-চাচা, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।

রাশেদ চাচা কিছু না বলে স্মিত হাসি দিলেন।

ঘর থেকে বের হয়ে সোজা ক্লাব ঘরের দিকে হাঁটা দিল অনিক। শনিবার বলে রাস্তায় বেশি মানুষ নেই, অবশ্য বেশ কিছুদিন হল রাস্তায় এমনিতেও মানুষ কম চলাচল করছে। পথে-ঘাটে পুলিশ, আর্মি হঠাৎ হঠাৎ লোকজনকে থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে, তল্লাশি করে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত বেশিরভাগ মানুষই যতটা সম্ভব ঘরেই থাকছে।

সুনীলদা ক্লাবেই আছেন। তিনি একা নন। শারেক, সুমন, হাসান এবং শোভনকেও দেখা গেল।
-সুনীলদা আজকের পেপার দেখেছেন? রকিবুলকে নিয়ে খবর ছাপা হয়েছে। কথাটা বলতে গিয়ে অনিকের চোখ চকচক করে উঠল।
-দেখেছি। উল্লসিত কণ্ঠে বললেন সুনীলদা। এদেরকে সে কথাই বলছিলাম। ক্রিকেটার হলে এরকমই হওয়া উচিত, হার্ট হতে হবে বাঘের মতন! ক্রিকেট শুধু শক্তি বা ব্যাটিং-বোলিং এর খেলা নয়, লড়াই করার মতন কলিজাও থাকতে হবে। রকিবুলের এই ছোট্ট ঘটনা বাংলার হাজার হাজার যুবক-তরুণের জন্য দারুণ শিক্ষণীয় হয়ে থাকবে।
-অবশ্য, ব্যাটিং এ তেমন কিছু করতে পারে নি, মাত্র এক রান করেছে…
-পুরো দলই তো খারাপ করেছে। মামুলি ২০০ রানে অল আউট! জহির আব্বাস এবং মুশতাক মোহাম্মদও ভাল করতে পারে নি। শুধু আজমত রানা ৫৬ করেছে আর শেষের দিকে ইন্তিখাব আলমের ৪৬। অবশ্য কমনওয়েলথ দল বেশ শক্তিশালী! ওদের হক, কোটাম, গিফোর্ড, হবস…এরা বেশ ভাল বোলার। ওদের দলে কয়েকজন খুব ভাল ব্যাটসম্যানও আছে। প্রথম ইনিংসে বড় লিড নিতে পারলে আমাদের এই ম্যাচে ফেরা তেমন আশা নেই।
-সুনীলদা আমাদের প্র্যাকটিসের কোন ব্যবস্থা হল? আর কতদিন ক্রিকেট ছাড়া থাকব?
-নারে। এখনো কিছুই করতে পারি নি। সবাই বলছে মার্চ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে। এরপর বোঝা যাবে দেশের পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে…
-আমি কাল বাগেরহাট চলে যাচ্ছি, শারেক জানালো। বাবা বলেছে বই-খাতা নিয়ে নিয়ে আপাতত বাসায় থেকেই পড়াশুনা করতে। বাবা-মা আমাকে আপাতত দূরে রাখতে চাইছেন না।
-হুম। এটাই মনে হয় ভাল হবে। সুনীলদা জানালেন।
-অনিক তুই কি করবি? গোপালগঞ্জ চলে যাবি নাকি? সুমন জানতে চাইল।
-বাবা-মা এখনো সেরকম কিছু বলেন নি, অবশ্য এ ব্যাপারে চাচাই সিদ্ধান্ত নেবেন। তিনি বললে আমি বাড়ি চলে যাব। আপাতত তো ক্লাস কিংবা প্র্যাকটিস কোনটাই হচ্ছে না, ফলে বাড়ি যেতে সমস্যা নেই। অবশ্য গোপালগঞ্জে আমার তেমন ভাল লাগে না। বন্ধু-বান্ধব এখন তো প্রায় সবাই ই এখানে।
-যে যেখানেই যাবি আমাকে জানিয়ে যাস, তা না হলে অযথাই দুশ্চিন্তায় পড়ে যাব।
-অবশ্যই, সুনীলদা।

———————–

উত্তাল মার্চ, ১৯৭১।

ম্যাচের প্রথম ইনিংসে কমনওয়েলথ একাদশ শেষ পর্যন্ত সব উইকেট হারিয়ে ৩৭৮ রান সংগ্রহ করল। ওদের ভার্জিন নামের একজন ওপেনার ১৫২ রানের দুর্দান্ত একটি ইনিংস খেলল। অন ডাউনে খেলা পাইলিং এর ৭১ রান এবং অন্যান্যদের ছোট খাট ইনিংসে ভর করে শেষ পর্যন্ত ওরা বেশ ভাল লিড নিয়ে নিলো। পাকিস্তানের পক্ষে সবচেয়ে ভাল বল করল ইন্তিখাব আলম, ১০৪ রানের বিনিময়ে ৬ উইকেট নিয়েছে। এছাড়া সরফরাজ নেওয়াজ এবং আসিফ মাসুদ ২ টি করে উইকেট দখল করতে সক্ষম হল।

১৭৮ রানে পিছিয়ে থেকে পাকিস্তানের শুরুটা আবারও খারাপ হল। রকিবুল আবার ১ রান করে আউট হল। এবার কোটামের বলে মারে নামক এক ফিল্ডারের হাতে ক্যাচ দিয়ে। আজমত রানা দ্বিতীয় ইনিংসেও ভাল ব্যাট করে দারুণ সেঞ্চুরি করল। ১১৮ রানের একটি চমৎকার ইনিংস উপহার দিল সে। মুশতাক মোহাম্মদ ৫৮ এবং জহির আব্বাস ৪০ রানে আউট হয়ে গেল।

ম্যাচের ৪র্থ দিন অর্থাৎ ১ মার্চ বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত ইয়াহিয়া খানের একটি সরকারী আদেশ জারি হল। ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনিবার্য কারণ দেখিয়ে স্থগিত ঘোষণা করলেন! একই সাথে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ভাইস এডমিরাল এস.এম আহসানকে বরখাস্ত করে লেঃ জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খানের উপর দায়িত্ব দিলেন। অবশ্য তিনি মাত্র দুই দিনই দায়িত্বে ছিলেন, কেননা ৩ মার্চ রাতে তাকে সরিয়ে ‘যুদ্ধবাজ জেনারেল’ নামে খ্যাত টিক্কা খানকে দায়িত্ব দেয়া হয়!

যাই হোক, ১ মার্চের ঘোষণার সাথে সাথে ঢাকার মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ল এবং রাস্তায় নেমে এল। ঢাকার রাস্তাঘাট, অফিস-আদালত সবকিছু বন্ধ হয়ে গেল। ঐ সময়ে পাকিস্তানের স্কোর ছিল ৮ উইকেটের বিনিময়ে ৩০৬। পরিস্থিতি বিবেচনা করে আম্পায়ারগণ খেলা বাতিল করে দিলেন।

ঐ দিন বিকাল বেলা ঢাকার হোটেল পূর্বাণীর সামনে বিশাল এক সাংবাদিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু ঘটনার প্রতিবাদে কঠোর ভাষায় সরকারের সমালোচনা এবং তীব্র নিন্দা জানালেন। একই সাথে ঘোষণা দিলেন আগামী ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ সারাদেশে হরতাল পালন করা হবে।

ঢাকার খবর জানার পর খুলনাতেও ব্যাপক বিক্ষোভ সমাবেশ শুরু হল। খুলনা আওয়ামী লীগ, ছাত্র লীগ এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সর্বাত্মক আন্দোলনে খুলনা শহর অচল হয়ে গেল। প্রতিটি রাস্তায় দেখা গেল একের পর এক মিছিল। কোন কোন মিছিলে অনেককে লাঠি-সোটা, বর্শা নিয়েও শহর প্রদক্ষিণ করতে দেখা গেল। এরই মাঝে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইন-শৃঙ্ক্ষলা বাহিনীর পাশাপাশি রাস্তায় সেনাবাহিনীও মোতায়েন করা হয়।

পরেরদিন অর্থাৎ ২ মার্চ ঢাকার মত খুলনা জেলাতেও সর্বাত্মক হরতাল পালিত হল। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য! রাস্তায় কোন গাড়ি-ঘোড়া নেই, আছে শুধু মানুষ আর মানুষ। স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীগণ ছাড়াও আপামর জনসাধারণের সমন্বয়ে গঠিত সেই মিছিলে খুলনা নগরী প্রকম্পিত হতে থাকল।

এরমধ্যে খবর আসল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ক্যাম্পাসে মানচিত্র খচিত লাল-সবুজের পতাকা উত্তোলন করেছে। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা! আরও জানা গেল পুলিশ ঢাকার এক মিছিল লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে ৮-৯ জনকে মেরে ফেলেছে। এতে করে খুলনার আন্দোলনও তীব্রতর হয়ে উঠল। প্রতিটি এলাকায় দেয়ালে লেখা-লিখি শুরু হল। খুলনার সবচেয়ে নামকরা বর্ণালী প্রেস থেকে ছাপা হতে থাকল শত শত পোস্টার। সবখানে ঘুরে ফিরে একই কথা-‘বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, কিংবা ‘আর নয় অধীনতা, এবার চাই স্বাধীনতা’, ‘লড়াই লড়াই লড়াই চাই, লড়াই করে বাঁচতে চাই’ ইত্যাদি শ্লোগান। বর্ণালী প্রেসের পাশাপাশি শাহীন হোটেলও হয়ে উঠল আন্দোলনের অপারেশন সেন্টার। মূলত এ দুই জায়গা থেকেই সব ধরনের কর্মসূচী পরিচালনা করা শুরু হল।

৩ মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আহবানে সাড়া দিয়ে খুলনাতেও অসহযোগ আন্দোলন শুরু হল। ঐ দিন বিকেলে হাদিস পার্কে বিশাল এক জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হল। লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল পুরো এলাকা। জনসভায় সবারই এক কথা-আমরা আর কোন অন্যায়-অবিচার মেনে নেব না। আমাদের ন্যায্য অধিকার দিতে হবে।

জ্বর থাকার কারণে অনিক হাদীস পার্কের জনসভায় যেতে পারল না। তবে, সম্ভবত এ কারণে ও প্রাণে বেঁচে গেল। কেননা, জনসমাবেশ শেষে একটি বিশাল মিছিল লোয়ার যশোর রোড হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশ দিয়ে শহরে প্রদক্ষিণ করার সময়ে যখন সার্কিট হাউজের সামনে পৌঁছল, তখন কোন প্রকার উস্কানি ছাড়াই কিছু পাকি সৈন্য সেই মিছিলে গুলি চালাল! বাসায় থাকা অবস্থায় অনিক গুলির শব্দ শুনতে পেল। অজানা আশংকায় ওর মন কেঁপে উঠল। অবশ্য, চাচা আসার আগ পর্যন্ত কিছুই জানতে পারল না। পরে চাচার কাছ থেকে শুনল ঘটনাস্থলেই ৭ জন মারা গেছে। এদের মধ্যে মুজিবর নামের এক কিশোর ছেলে ছিল, অনিকের সাথেই পড়ত!

অনিক যদি সুস্থ থাকত তাহলে মুজিবরের মত গুলিতে একই সাথে মারা যেতে পারত!

ঐ দিন রাতে খুলনার পরিস্থিতি আরও উত্তাল হয়ে উঠল। সাউথ সেন্ট্রাল রোড, গল্লামারী, শিববাড়ির মোড়, দৌলতপুর সহ বেশ কিছু জায়গায় বাঙালি এবং অবাঙালিদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শুরু হয়। ৩ ও ৪ মার্চ ধরে চলা এই সংঘর্ষে পুলিশ সবখানে অবাঙালিদের পক্ষ নিয়ে লড়াই করেছে। এ দুইদিনে মারা গেছে চল্লিশ জনেরও বেশি মানুষ, এদের মধ্যে বেশিরভাগই বাঙালি!

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।