১।
ঢাকা আমায় কখনোই টানতো না। ভয় ভয় করতো, মনে হত ঢাকা যেন একটা রাক্ষস, গিলে ফেলবে, আমি হারিয়ে যাবোই-যাব সেখানে গেলে ।
তাই, ঢাকায় যারা গর্ব নিয়ে বসবাস করতো সেই সময়ে সেই আশির দশকে, তাদের আমার একটুও হিংসে হত না ।
প্রথম ঢাকায় আসি বোধহয় ৮৫ এর দিকে। আব্বা হজে যাবেন, আমরা সবাই দল বেধে আগমনী এক্সপ্রেসে চড়ে ঢাকা এসেছিলাম । রাতের জার্নি ছিল সেটা। সকাল বেলা আম্মা ঘুম থেকে ডেকে তুলে দেখিয়েছিলেন “সব কটা জানালা, খুলে দাও না, আমি গাইবো, গাইবো বিজয়েরি গান ।“
স্মৃতি-সৌধ আর এই গান তখন আমাদের কাছে বাংলাদেশ টেলিভিশন এর রাত আটটার বিজ্ঞাপন ।
২।
যখন দশ বা বারো মিনিটের একটি ফোন কলে আগের কোম্পানীর সংগে যখন সবকিছু চুকে-বুকে দিলাম, তখন আমি এবং আমার বউ-বাচ্চা দুজন দুখানে থাকি ।
আমি ঢাকায়, তাঁরা চট্টগ্রামে ।
আমার হুট করে ঢাকায় চলে আসার মাঝে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাড়িয়েছিল আমার মেয়ের স্কুল । জিহানের নিজস্ব কিছু পছন্দ-অপছন্দ আছে। তাঁর স্কুলে অবশ্যই একটা বড় খেলার মাঠ থাকতে হবে, আর কিছু না থাকলেও । অতটুকু বাচ্চা কি আর বুঝবে, ঢাকায় মানুষ থাকার জায়গাই নেই, আবার খেলার মাঠ । কিন্তু তাঁর মনটাকে ভেংগে ফেলবোই বা কিভাবে, চিটাগাং এর বড় খেলার মাঠের স্কুলে সে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ৪০০ জনের মধ্যে ৮ম হয়েছে । তবেই ভর্তি হতে পেরেছে । তাও ঐ মাঠে খেলবে বলে ।
অসহায় সেই সময় আমার ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়া ছাড়া তেমন কোন উপায়ও ছিল না। লিখলাম “ঢাকার ভিসা খুঁজছি ।“ এক বন্ধু আবার জ্ঞান বিতরন করে লিখলো, “ঢাকায় তো ভিসা লাগে না ।“
সত্যি, ভালো একটা স্কুলে ভর্তি, দারুন এক যুদ্ধ । এবারো মেয়েটা টিকে গেল যুদ্ধে, ভর্তি হল নামকরা স্কুলে, যেখানে বড় একটা খেলার মাঠ আছে ।
আমিও ঢাকার ভিসাটা পেয়ে গেলাম ।
একটু বড় হয়েছি আর একটা মোটামুটি “স্টেবল-ভিসা” থাকার কারনেই কিনা জানিনা; এখনকার ঢাকায় আর “ভয় ভয়” লাগে না ।
৩।
রেসিডেন্সিয়াল স্কুলের ঠিক বিপরীতে মোহাম্মদপুরের দিকে যে রাস্তাগুলো আছে, সেখানে সকাল বেলায় ভ্র্যাম্মোমান (!) বাজার বসে । সবাই দারুন টাটকা জিনিস নিয়ে আসে বিক্রির জন্য । বিশেষ করে বড় বড় রুই, কাতলা মাছগুলো তখনো জীবিতই থাকে । স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ, আশেপাশের স্কুলের বাচ্চাকে নিয়ে আসা অভিভাবক, অফিস গামী মানুষ, সব মিলে মূহুর্তেই সেটা হাটের মত সরগরম হয়ে উঠে । প্যা, পো, হই-চই, চিৎকার, চ্যাচ্যামেচি, কি নেই ।
যেহেতু আবাসিক এলাকায় অবৈধ বাজার, সরগরম হয়ে ওঠে পুলিশও । সাইরেন দিয়ে এ গলি ও গলি তারা ঘুরে বেড়ায়, বাজার যাতে জমে না উঠতে না পারে সেই চেস্টা করে । মাঝে মাঝে মাছের ডালি উলটে ফেলে দেয় । গালাগালি করে । লাঠি নিয়ে তাড়া করে । তবে এটাও বুঝা যায়, গরিব মানুষ গুলোর প্রয়োজনটাও তারা বুঝে ভালোই । তাই তাদের অভিযানের মধ্যেও বেশ একটা “চেক এন্ড ব্যালেন্স” ফুটে উঠে । নিজেদের প্রয়োজনেই বোধহয়, ক্রেতারাও তাদের প্রতি বেশ একটু সহানুভুতিশীল । “রেকিং” এর কাজটা তারাও করে দেন স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে, প্রায়ই, কেউ না কেউ । এমনও দেখেছি, সবজি কেনার পরে ক্রেতা টাকা দিতে পারেননি, পুলিশের সাইরেনে পালিয়েছে বিক্রেতা, ক্রেতা ধৈর্য্য ধরে দাঁড়িয়ে আছেন, কখন পুলিশ চলে যাবে, বিক্রেতা আসবে, তিনি টাকা দিতে পারবেন । রাস্তায় ফেলে দেয়া মাছও কুড়িয়ে দেন কেউ কেউ, কেউ কেউ আবার দেন পাহাড়া, যাতে অন্যকেউ চুরি করে নিতে না পারে ।
বিরক্ত হন শুধু অন্যান্য পথচারীরা, যারা অফিসে যান, যারা বাচ্চাদের নিয়ে স্কুলে যান, যাদের বাজার করার দরকার নেই । জ্যাম ভর্তি এই ঢাকা শহরে, বাসা থেকে বের হয়েই এই হট্টোগোল, কার আর ভালো লাগে?
পুরো ঢাকাতেই এই তো চলছে, কেউ বেচে থাকার জন্য লড়ছে, কেউ লড়ছে চাকুরী বাচানোর জন্য, কেউবা লড়ছে আরও একটু ভালো থাকার জন্য ।
৪।
বাংলামোটর থেকে মোহাম্মদপুর, সুনিদির্ষ্ট করে বললে মোহাম্মদী হাউজিং লিমিটেড ৬ নম্বর রোড কতক্ষনের রাস্তা ?
বলতে পারবেন কেউ সঠিক করে ?
বাংলামোটর থেকে অনেকভাবে যাওয়া যায় আমার বাসায় । নিজস্ব বাহন বিহীন এই শহরে প্রথম যে অপশন তা হল ৩৬/বি বাস । বিরাট বদখত চেহারার মিনিবাস, ভিতরে বোটকা একটা গন্ধ ঘাপটি মেরে থাকে সবসময়, ঠিক থামবে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে । রাস্তা ফাকা থাকলে বিশ মিনিটের বেশী লাগার কথা না । শর্ত হচ্ছে আপনি অফিস থেকে নেমেই বাস পাবেন, এবং সে আপনার মর্জিমত চলবে, ফার্মগেটে মোটেই দাঁড়াবে না, এবং রাস্তায় জ্যাম থাকবে না । এছাড়া অফিস থেকে নেমে রিকসা নিতে পারি, নিয়ে যেতে পারবে সংসদের সামনে দিয়ে আড়ং পর্যন্ত, এর পরে রাস্তা পার হয়ে আরেক রিক্সা নিয়ে বাসায় । বা উল্টো পথে কাটাবনে, সেখান থেকে বাসে । সাইন্স ল্যাব পার হয়ে ধানমন্ডি দুই নম্বর থেকে রিকসা বা বাসে করেও গিয়েছি কয়েকবার ।
কিন্তু সময়! যেভাবেই যান, কত সময় লাগতে পারে ? গ্যার্যান্টি আছে কোন ? দেয়া কি সম্ভব ?
আমি এখন তাই হাঁটি । সার্ক ফোয়ারা পেরিয়ে, সানাউল্লাহ ভাইয়ের অফিস কে ডানে রেখে হাটি । ফার্মগেটের পার্কটায় ছেলেরা টি-টোয়েন্টির মত করে খেলে, ফুটপাতে কত কিছু বিক্রি হয়, সেগুলো দেখি আর হাটি । সংসদ পার হই, কত কত লোক বেড়াতে আসে, নানান বয়সের, নানান রঙের মানুষ, ফুচকা খায়, বকুল ফুল কুড়ায়, আনারস খায় । হাত দেখার লোক, পিঠার ফ্রেম বিক্রী করা লোক, নাম লেখানো চাবির রিং, ওজন মাপার মেশিন, প্ল্যাস্টিকের খেলনা আরও কত কি দেখি । প্রতিটি মানুষ যেন একেকটা গল্প নিয়ে চলে নিজের সাথে । এসব দেখি আর হাটি ।
এসব কিছু দেখে দেখে অফিস থেকে বাসায় পৌছতে আমার লাগে ঠিক ৫০ থেকে ৫৫ মিনিট ।
আমার অনেকটা সময় বেচে যায় প্রতিদিন ।
:clap:
লেখা ভাল হইছে ... মানে ভাল লাগছে 🙂
ধন্যবাদ হাসান। 🙂
পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না
চল চল চল
ফয়েজ ভাই বস :salute:
ভাই সিরাম হইছে :thumbup: যাষ্ট অসাধারন :boss: :boss: :boss:
"আমি খুব ভাল করে জানি, ব্যক্তিগত জীবনে আমার অহংকার করার মত কিছু নেই। কিন্তু আমার ভাষাটা নিয়ে তো আমি অহংকার করতেই পারি।"
ধন্যবাদ ক্যাস্পার । 😀
পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না
ফয়েজ ভাই দীর্ঘদিন পর আড়মোড়া ভাঙলেন। বুঝলাম আপনার লেখার সমস্ত প্রেরণা মনে হয় জিহান। ও কাছে ছিল না আপনিও চুপচাপ এখন আবার পিচ্চিটা চলে আসছে আপনিও ফর্মে।
আমার অফিসের খুব কাছেই ভাইয়া আপনার বাসা। এই উইকএন্ডে কোথাও বেড়াতে যাবার যায়গা খুজছি। চলে আসব নাকি?
তুমি ঢাকায় চাক্রি শুরু করছো নাকি? জাপান থেকে কবে আসছো? তোমার ব্যাথা পুরা ভালো হয়ে গিয়েছে? অফিস কই তোমার?
লেখার জন্য জিহান প্রেরনা নয়, আসলে লিখতে গেলে প্রচুর পড়তে হয়, চোখ-নাক-কান খুলে রাখতে হয়। এর কোনটাই হচ্ছে না, তাই লিখতে পারছিনা ।
শুক্র-শনিবার সাধারনত বাসায় থাকি না, ট্রেনিং নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। তবে সময় করে সবাই মিলে কোথায় থেকে ঘুরে আসাই যায়।
পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না
আমি ভাইয়া ঢাকায় আসছি ৬ মাস হয়ে গেছে। একটা প্রাইভেট ইউনিতে গলাবাজি করি। ধানমন্ডির এই লাইনে প্রচুর প্রাইভেট ইউনি আছে। আল্লাহর রহমতে এখন ভাইয়া ভাল আছি।
চোখ কান খুলে রাখেন ভাইয়া আপনার লেখা অনেক মিস করি।
তুমি কোন উইনিতে, UIU?
পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না
ফয়েজ ভাই। অনেক দিন পর। খুব ভাল লাগল।
আমি ভাই থাকি তাজমহল রোডে। আশাকরি দেখা হবে।
চ্যারিটি বিগিনস এট হোম
দেখা হবে, আশা করি 😀
পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না
ফয়েজ ভ্রাতা, লেখা চমৎকার হইছে। অনেকদিন পর লেখা দেখলাম আপনার।
মোহাম্মদপুরে দেখি সব পরিচিত লোকজনে'রা থাকে। আমিও প্রায় দুই বছর তাজমহল রোডে ছিলাম। ভার্সিটির 'তরঙ্গ' বাসে যাতায়াত করতাম। চমৎকার সেই সব দিন...আহা রে।
তরঙ্গ তো দেখি মেল্লা সকালে যায়, ঘুম ভাংতো ডেইলি 🙂
পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না
ফয়েজ ভাই, এইবার ঢাকায় যেয়ে আপনার সাথে দেখা করতে চাইছিলাম, কিন্তু চার বছর পর মাত্র আড়াই সপ্তাহের জন্য ঢাকায় যেয়ে আর বাসা থেকে বের হতে ইচ্ছা করত না।
আমি ঢাকা যাবার আগে সবার কাছে ঢাকার জ্যামের কথা শুনে হেটে হেটে সব জায়গায় যাবার কথা ভাবসিলাম, এর পরে ঢাকাইয় আসলে হেটেই আপনার বাসায় চলে আসব। আমার বাসা থেকে আপনার বাসা ও ৫০-৫৫ মিনিট মনে হয় লাগার কথা 😀
আপনার লেখে বরাবরের মতোই অসাধারণ হয়েছে...
ঐ বান্ধা গরু, আছো-টাছো কেমন?
হুম, বুঝতে পারছি ব্যাপারটা, সমস্যা নাই, দেখা হবে নিশ্চয়, কোন না কোন একদিন, বাংলার কোন এক প্রান্তে। 🙂
ভালো থাইকো।
পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না
২য় পর্ব দাও তাড়াতাড়ি।
চিটাগাং নিয়েও কিছু লেখো হে।
ঢাকা নিয়ে লেখা দেখলেই কেমন আপন আপন লাগে.. নূপুরদা'র যেমন চিটাগাং 🙂
সুখপাঠ্য লেখার পরের পর্বের অপেক্ষায় মনজুর :dreamy: