জবাই

শান দেয়া ছুরিটা দুই হাতে শক্ত করে ধরতেই সুলতান মিয়ার শরীর একটু কেঁপে ওঠে। হালকা কাঁপুনি, দুই সেকেন্ডেই হারিয়ে যায়। আঙুলগুলো নাড়াচাড়া করে সুলতান আরো শক্ত করে ধরে লম্বা বাঁকানো ছুরিটার বাট। বেলা প্রায় দ্বিপ্রহর। নামাজের ওয়াক্ত চলে গেছে। আজকে সারাদিন আকাশ মেঘলা বলে সূর্যের তেজ বুঝতে পারছে না সুলতান। ঘোলা ঘোলা মেঘের সাথে আজকে বেশ বাতাস ছুটেছে। গ্রামের মাঠে বাতাসের তোড়ে লুঙ্গি সামলানো কঠিন। সকালে দশটার দিকে মাঠে গিয়ে লুঙ্গি উড়ে যাচ্ছিলো তার। হঠাৎ দমকা বাতাসে পাছার কাপড় সরে গেলে এক পিচ্চি ফ্যাক করে হেসে দিছিলো। হাসি শুনে কটমট করে তার দিকে তাকায়ে সুলতান একটা চাপা হুঙ্কার ছাড়ে। হুঙ্কারে কাজ হয়, পিচ্চি ভয়ে উল্টা দিকে দৌড় দেয়। সিকনি-পড়া নাক টেনে দৌড়ানোর সময় সুলতান দেখে, পিচ্চিটারও উদোম পাছা।

‘যাকগে, গেছে গেছে, আর কেউ খেয়াল করে নাই, মানীর মান আল্লায় রাখে’, ভেবে নজর ফেরায় মাঠের এক পাশে গাছগুলোর গোড়ায়। এখানে দুইটা শয়তানের পুত বেজন্মাকে গাছের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। চোখ বাঁধা আছে বেজন্মাগুলার, দুইটার মুখে রাইফেলের বাট দিয়ে শক্ত বাড়ি দেয়াতে দাত ভেঙে গেছে, ঠোঁট কেটে গেছে। রক্ত জমে কালসিটে পড়ে ফুলে আছে চেহারা, বোঝার উপায় নাই বেজন্মাগুলা আসলে দেখতে কেমন ছিলো। সুলতান দাঁতে দাঁত ঘষে। নালায়েকের দল। হিন্দু মালাউনদের সাথে হাত মিলানো কুত্তা এইগুলা। আজকে এইগুলারে উচিত শিক্ষা দেয়া হবে। কুরবানি দেয়া হবে সবার সামনে।

বাসায় ফিরে লুঙ্গি বদলে পায়জামা পাঞ্জাবি পড়ে নেয় সুলতান মিয়া। বাতাসের বেগ বিকালে আরো বাড়বে, রিস্ক নেয়া ঠিক না। উঠানে বসে ছুরিতে শান দিচ্ছিলো এক খাদেম। তাকে ডেকে এনে ছুরির শান পরীক্ষা করে সুলতান। বুড়া আঙুল ছোঁয়াতেই বুঝতে পারে, ধার মাশাল্লাহ দারুণ হয়েছে। এইসব কাজে ছুরি ভোঁতা হইলে খুব অসুবিধা। মনে মনে সন্তুষ্ট হলেও সেটা মুখে প্রকাশ করে না সে। খাদেমকে গম্ভীর গলায় আরো ধার দিতে বলে। ‘বালু মিশায় নে, ধার তাড়াতাড়ি হইবো’।

শান্তি কমিটির অফিস থেকে বাকিদের নিয়ে দুপুরের পরে মাঠে গিয়ে হাজির হয় সুলতান মিয়া। এতোক্ষণে অনেক মানুষ জমায়েত হয়ে গেছে। এদের সবার উদ্দেশ্য একটাই, সুলতান মিয়াকে দেখা। ‘ভেড়ার দলের জন্যে ভালো লিডার লাগে, ভেড়ার দল হাতের মুঠির মধ্যে রাখতে হবে’, ভাবে সে। গাছগুলোর সামনে দুইটা ছোট ছোট গর্ত খোঁড়া হয়েছে। এক হাত গভীর এবং এক বর্গহাত আকারের। এই বিষয়ে স্পষ্ট মাপ থাকা জরুরি। রক্ত যেন গড়ায় না পড়ে, রক্ত গড়ানো ভালো লক্ষণ না। খাদেমদের চোখের ইশারা করে সুলতান। প্রথম বেজন্মাটাকে ধরে আনতে বলে সে। পা ছেঁচড়ে নিয়ে আসে চারজন খাদেম। হাত পিছনে মুঠ করে বাঁধা, চোখ বাঁধা, গলা দিয়ে গ্যাঁগ্যাঁ শব্দ করছে শুয়োরের বাচ্চাটা। সুলতান একদলা থুতু ফেলে ওইটার মুখের ওপর। জমায়েতের মধ্যে চাঞ্চল্য দেখা দেয়। সুলতান জানে এখন এদেরকে ভয় দেখাতে হবে। কুরবানি কোন মশকরা না। এই বেজন্মাগুলার মতো আর কোন বেজন্মা যেন মাথা তুলতে না পারে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। গলা উচু করে জমায়েতের দিকে স্থির চোখে তাকায় সে; বলে ওঠে, ‘ইসলামের শত্রু, পাকিস্তানের শত্রু এই দালালরা। ইন্ডিয়ার ট্যাকা খায়া এখানে ব্রিজে বোমা ফেলছে এরা। পাকিস্তান ভাইঙ্গা দিতে চায় এরা। এগোরে কুরবানি দেয়া হবে এখন। সবাই হুঁশিয়ার!’ চার জন খাদেম শক্ত করে চেপে ধরে শুয়োরটাকে। পায়জামাটা টেনে কাছে ঝুঁকে আসে সুলতান, ওইটার গলার চামড়াটা ফর্শা লাগছে। ছুরি শক্ত করে ধরে গলার চামড়ায় ছোঁয়ায়। ‘ছুরির গোড়া থেকে আগার দিকে যাইতে হবে’, ‘এক টানে কাইটা ফেলতে হবে’। “আল্লাহু আকবর” বলে জোরে পোচ বসায় সুলতান মিয়া। গলার চামড়া ফ্যাট করে কেটে ছুরিটা ভিতরে ঢুকে যায়। মুহূর্তেই গরম রক্ত ফিনকি দিয়ে বের হয়ে আসে। সুলতান দুই হাতে উষ্ণবোধ করে, স্বয়ংক্রিয়ভাবে ছুরিটা গেঁথে দিতে থাকে গলার ভিতরে। ঘড়ঘড়ঘড়ঘড়…

চার জনে চার হাত-পা ধরে রাখায় ছুটাতে পারে না বেজন্মাটা। একটু দাপাদাপি করে। শান্ত হয়ে গেলে সুলতান খাদেমদের বলে ‘শরীর উল্টায় দে। রক্ত ছিটা না পড়ে।’

‘পরেরটারে ধইরা আন’, হুকুম তামিল হতে সময় লাগে না। এটার স্বাস্থ্য একটু ভালো। পা ছুঁড়ে ছিটকে ফেলার চেষ্টা করে এইটা। সুলতান ধমক মারে, ‘শক্ত কইরা ধর, ভাত খাস নাই নালায়েক!’ গালিতে কাজ হয়, পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আরেক উৎসাহী খাদেমও এসে হাত লাগায়। পাঁচজনে মিলে ধরে বসে মোটা বেজন্মাটাকে। সুলতান ছুরিটা সরিয়ে বড়ো দা’টা হাতে নেয়। ‘এইটারে দাও দিয়া কোরবানি দিতে হইবো’, ভেবে একই নিয়মে বলে ওঠে, “আল্লাহু আকবর”। ঘড়ঘড়ঘড়ঘড়ঘড়…

দাপাদাপির চোটে একটা পা ছুটে যায়। শুকনো মাটিতে ক্রমাগত বাড়ি দিতে থাকে গোড়ালি দিয়ে। গর্তের চারপাশের ঘাসগুলো দ্রুত কালচে হয়ে ভিজে যেতে থাকে রক্তে। গরম উচ্ছ্বল রক্তে ভেসে যায় সুলতান মিয়া। চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে দোয়া আওড়াতে থাকে সে। মিষ্টি বাতাস তার গায়ে প্রশান্তির আবেশ বইয়ে দেয়। কুরবানি সম্পন্ন। পেয়ারা পাকিস্তান জিন্দাবাদ!

*****
– অনীক আন্দালিব
২৬/৪/১১

(দ্রঃ আজ ২৬ এপ্রিল, বাংলাদেশের স্বাধীনতার চল্লিশ বছর এক মাস। এখনও মনে পুষে রাখি। এখনও মনে রাখি। কারও বিচার হয় নি। এক জনেরও না! লেখাটির পিছনে সম্পূর্ণ কৃতজ্ঞতা নাসির উদ্দিন ইউসুফ, সৈয়দ শামসুল হক ও ‘গেরিলা’ ছবির সাথে জড়িত সকল মানুষের।)

২,৫৪৮ বার দেখা হয়েছে

২৫ টি মন্তব্য : “জবাই”

  1. রকিব (০১-০৭)

    তীব্র! সুতীব্র লেখনী। আমাদের সবার মুক্তিযুদ্ধ এবং দেশাত্মবোধক চেতনা যদি এতটা তীব্র হতো; তাহলে হয়তো এই পশুগুলোর শাস্তি এতদিনে কেবল একটা দাবী কিংবা বিচারাধীন না থেকে সম্পন্ন হয়ে যেত।
    সাধুবাদ জানিয়ে গেলাম গল্পের জন্য আন্দাদা। :clap:


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন
  2. রাব্বী (৯২-৯৮)

    তীক্ষ্ম, ধারালো এবং শক্তিশালী একটি গল্প। নিখুঁত বর্ননায় এক কথায় দুর্দন্ত চিন্তাশক্তির প্রতিফলন। শাসকের প্রতি -

    এখনও মনে রাখি। কারও বিচার হয় নি। এক জনেরও না!

    :thumbup:


    আমার বন্ধুয়া বিহনে

    জবাব দিন
    • ঘৃণাটুকুই এখন ভরসা। আর বেশি কিছু কারো কাছে আশা করি না। না সরকার, না রাষ্ট্র।

      এই কারনে এর বেসি কিছু আমরা পাইওনা... যখন সবাই মিলে আর বড়ো আসা করব, যখন "পুতুল/দালাল" রাষ্ট্রের আসাই বসে না থেকে নিজেদের "ন্যায্য" দাবি নিজেরাই আদায় করে নিতে সচেষ্ট হবো, তখন বিচারও সুড়সুড় করে হএয়ে যাবে... আমি বলতেসিনা এখানের যারা পাঠক এবং লেখক তাদের সেই সদিচ্ছা নেই, কিন্তু সুধু ইছছা থাকলেই হইনা, তার জন্য সেই পরিমান খাত্নিও দিতে হই। যেদিন আমরা নিজের প্রয়জনের উপরে উঠে চাইবো সেদিনই সব হবে, তার আগে না...আর আমরা আর বেশি বুঝি বলে আমাদের দায়িত্বটাও অনেক বেশী...

      জবাব দিন
  3. ইফতেখার (৯৫-০১)

    এখনও মনে পুষে রাখি। এখনও মনে রাখি। কারও বিচার হয় নি। এক জনেরও না!

    তুলনাটা ঠিক হচ্ছে না, তাও দেই ... এই অংশটা পড়লে মনে পড়ে দ্যা ইনসাইড জবের ডিরেক্টর চার্লস ফার্গুসনের এ্যক্সেপটেন্স স্পীচের কথা, যেখানে সবাই একে ওকে ধন্যবাদ দেয় ... সে বলেছিলো যে "নোবোডি ওয়েন্ট টু জেইল, দিস ইস রং"।

    আমরা সবাই ই মনে হয় আশা পুষে রাখি হয়ত আমরাই দেখে যেতে পারবো, ঐ 'হয়তো' শব্দটার জন্যই কষ্ট। বর্তমান লীডারদের এইটুকু বলস গজানোর আশা করা বৃথা মনে হয়।

    যাই হোক, লেখা হার্ডকোর হৈসে।

    জবাব দিন
  4. আদনান (১৯৯৪-২০০০)

    বাস্তবতাকে হয়তো কিছুটা ছুঁয়ে গেলি । আসল অভিজ্ঞতা নিজে দেখলেই হয়তো সে সময়ের আতংক আর নারকীয়তা বোঝা সম্ভব হতো । তবে গেরিলা মুভি দেখে, তুই এ'ধরনের একটা লেখা লিখতে পারছিস এজন্য অভিনন্দন । অফটপিক তোর গদ্যের এই ফর্মটা খুবই পছন্দ হইছে । এরকম নাড়া দেয়া লেখা আরো লিখে যা । মনটা ঘৃণায় ভরে উঠলো ।

    জবাব দিন
  5. রায়হান (১৯৯৮-২০০৪)

    ভাই প্রথমেই :boss: ..............অসাধারন একটা লেখা উপহার দেয়ার জন্য...............

    আসলে আমরা নিজের চোখে দেখিনি.........কিন্তু রাজাকার রা যে নৃশংসতা করেছে তা কোন বাঙালি ই কোন দিন ভুলতে পারবে না............এটা যেমন সত্যি ঠিক একই রকম সত্যি যে এই রাজাকার দের এখনও বিচার করতে না পারার লজ্জা আমাদের সবার পাওয়া উচিত।আজ ও দেশে অনেক রাজাকার রা বহাল দবিয়তে বেচে আছে আর অনেক মুক্তিযোদ্ধা ঠিক মত দু বেলা খেতে পারছে না।
    এই লজ্জা আমরা কোথায় রাখবো?????????????

    ভাই আমাদের বিবেক কে আরও এক বার নাড়া দেয়ার জন্য ::salute::


    একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার,সারা বিশ্বের বিস্ময় তুমি আমার অহংকার

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।