এই লেখাটা তোর জন্যে

আমরা দু’জনে বসেছিলাম। রাত অনেক, প্রায় এগারটা বাজে। একটু দুরে স্ট্রীটল্যাম্পেরা ছাড়া আর কেউ নাই। আমরা দুজন বাস্কেটবল গ্রাউন্ডে বসেছিলাম। চারপাশে বেশ দমকা বাতাস আজকে। আমি আর তুই কংক্রিটের মাঠে পা ছড়িয়ে বসছিলাম চুপচাপ। আমাদের মাঝে খালি অনিশ্চিত নীরবতা।

তোর সাথে আমার বিরাট ঝগড়া চলতেছে। আমি অনেক নাড়া খেয়েছি ভিতরে ভিতরে। তুই আমার সাথে এরকম করতে পারলি?

ঝামেলাটা কী নিয়ে লেগেছিলো ভুলে গেছি। আমার শুধু ঐ রাতের আধঘন্টার কথা মনে আছে। তুই আমার খারাপ দিকগুলোর কথা বলতেছিলি। বলছিলি আমি একগুঁয়ে, ঘাড়ত্যাড়া, বদমেজাজি, কোন কথা বুঝার চেষ্টা করি না। খামাখা গ্যাঞ্জাম লাগাই। আমার কারণেই এই ঝামেলাটা লেগেছে। এখন তোকে দু’দিক সামাল দিতে হবে। এই উটকো কাজটা তুই আমার জন্য করবি। রাগের মাথায় তুই এরকম কতকিছু বলছিলি!!

আমি শুধু মাথা নিচু করে বসে বসে ভাবছিলাম তুই এত বাজে ব্যবহার কেন করছিস আমার সাথে? মনে হচ্ছিল তুই খুব স্বার্থপর হয়ে গেছিস, অযথা রিঅ্যাক্ট করছিস। এমন কিছু হয়নি যে তোকে সামাল দিতে হবে। হ্যাঁ ঝামেলা পাকাইছি, তো কি হইছে? আমার ঝামেলা আমি নিজেই ট্যাক্‌ল করতে পারি, তোর হেল্প কেন লাগবে? এসব টুকরা টুকরা কথা আমার মাথায় পাক খাচ্ছিল।

তোর মনে পড়ে দোস্ত? আমরা কী দুর্দান্ত ছিলাম! কী ডায়নামিক ছিলাম। পুরা ক্লাসে এরকম আর কয়টা দোস্তি ছিল? একটাও কি ছিল? সেই ক্লাস এইটে একবার সিটপ্ল্যানে স্যার তোকে আর আমাকে পাশাপাশি বসিয়ে দিল। তার আগে তেমন কোন খাতিরও ছিল না। আর তারপর থেকে কীভাবে কীভাবে জানি তোর সাথে দারুন একটা বন্ধুত্ব তৈরি হয়ে গেল! একসাথে পড়তাম আমরা মনে আছে। আমি তোরে ঠেলতাম, “ঐ বলদ! এইডা পড়, ফোর্টনাইটে আসবে। আজাইরা টাইম লস করিসনা!”

তুই কম পড়াশোনা করতি। কী কী নিয়ে ভাবতি। হাউসের নানা ফালতু ঝামেলায় জড়াইতি। কে কাকে কি বলছে, কেন বলছে এগুলা নিয়ে গুড ফর নাথিং পোলাগুলার সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা ঘোঁট পাকাইতি। একটা সময়ে আবার আমার ঝাড়িতে কাজ হত, ওসব বাদ দিয়ে পড়তে বসতি। এভাবে ক্লাস নাইন, টেন, এসএসসি!

মনে আছে তোর, একবার স্যার সিটপ্ল্যানে আমাদের পাশাপাশি সীট না দিয়ে সামনা-সামনি দিয়েছিল। আমরা দুইজন গিয়ে স্যারকে ধরেছিলাম ঠিক করে দেয়ার জন্য! স্যার একটা দাবড়ানি দিয়ে বললেন, “সারাদিন দেখি দুইটা বকর বকর করতেছিস! সামনা-সামনি বস্‌, তাইলে বদমায়েশি একটু কমবে তোদের! হা হা!” …কমেছিল কি দোস্ত?

এসএসসির পুরা তিনমাস ছুটি আমার কী যে বাজে কাটল! এলাকায় একটা ফ্রেন্ড নাই। গল্পের বই শেষ, টিভি দেখতে দেখতে মুখস্ত হলো “কহো না প্যায়ার হ্যায়”-এর গান! তোর সাথে কথা বলবো তার একটা মাধ্যম নাই। কলেজে ফিরলাম ২২শে জুন, মনে আছে? রেজাল্ট নিয়ে কী আনন্দ! আর তার চেয়ে বড় আনন্দ তোর সাথে এতদিন পরে দেখা, কত গল্প! ছুটির মধ্যে ঈদে তোর সেই ফোনালাপী মেয়েটা, সেই ঈদের শুভেচ্ছা দেয়া। কলেজে এসে সেই মেয়েটাকে কী লেখা যায় তাই নিয়ে আমার সাথে তোর কত পরামর্শ!!!

কী সব দিন গেছে! আর সেই তুই আমার সাথে এরকম করলি? আমার না হয় মাথা গরম, পাগলা থাকি। তুই তো শান্ত-শিষ্ট, মাথা ঠাণ্ডা, আমারে বুঝাইলেও পারতি। রাগের চে’ বেশি জন্মাইছিলো অভিমান। তুই আমারে ক্যামনে ভুল বুঝলি? আজকে আমারে ভূতে পাইল যে আমি এইসব ভাবতেছি। কত বছর আগের কথা সেই বাস্কেটের গ্রাউন্ড? মনে হয় আগের জন্মের স্মৃতি বিধাতা কৌতুক করে ভইরা দিছে মাথায়। সেগুলো আজকে বড় কাঁদায়!

কলেজ ছেড়ে আসার আগে দিয়ে তোর উপর দিয়ে ঝড় যাচ্ছিল। প্রিন্সিপ্যাল, অ্যাডজু’ সবাই তোরে বাঁশ দিতেছিল। পড়তে পারতি না, টাইম পাইতি না। সেই তুই মাঝেমাঝে আমাকে এসে বলতি, “একটু পড়ায়ে দে দোস্ত, এইটা বুঝতেসি না”। আজকে মনে হয়, “আর তো কেউ কোনদিন এভাবে বললো না!” কলেজ ছেড়ে বের হয়ে তুই গেলি আর্মিতে, আর আমি গেলাম বুয়েটে। তাও ভর্তির আগে তবু ঢাকায় ছিলি, ডিসেম্বরে চলে গেলি চিটাগাং। কত দুরে! তোর সাথে দেখা হইতো না, কথা হইতো না, কিন্তু তুই ছিলি। এমন কতদিন গেছে তোর কথা মনেও পড়ে নাই! কিন্তু আড্ডার মধ্যে কেউ বেস্ট ফ্রেন্ড নিয়ে কথা তুললে আমার ঝাঁ করে তোকে মনে পড়ত। তারপর আর কিছুই ভাল লাগত না, ঐ আড্ডা, ঐ হৈচৈ। আমি তখন সেখানে অপাংক্তেয়!

তোর পোস্টিং হলো বগুড়ায়। মাঝে মাঝে ঢাকায় আসতি। দুই একদিনের জন্য। আমি কাজ ফেলে যাইতাম বিকালে বা সন্ধ্যায়, তোর সাথে রাস্তায় রাস্তায় হাঁটতাম! কী অদ্ভুত লাগত তখন বাস্তবতা! আমার মাঝে মাঝে মনে হত এ কেমন জীবনে ফেঁসে গেছি তুই আর আমি! একটা দিন দেখা হলেই মনে হত অনেক পেলাম!!

এখন তুই তো আরো দুরে। কোন সুদুরে আইভরি কোস্টে। কবে ফিরবি রে? তোরে দেখিনা বহুদিন, বহুদিন!!

একটা জীবনে মানুষ কয়টা বন্ধু পায়? কয়জন তাকে পুরোপুরি বুঝে? রেগে গেলে শান্ত করে, ক্ষমা চাওয়ার আগেই ক্ষমা করে দেয়? তোকে একদিন বলেছিলাম, (কবে মনে নাই) “আমি তোর উপরে আর কোনদিন রাগ করবো না। চ্যাত দেখাবো না।” তুই বলেছিলি, “ক্যান?” আমি মুখে বলেছিলাম, “কারণ লাভ নাই, তুই একটা টিউবলাইট। বুঝবিও না যে আমি চ্যাতছি। হুদাহুদি আমার রাগ নষ্ট করমু ক্যান। তুই হালায় একটা ফাউল!”

আসল কারণটা হইল আমি তোর উপ্রে ক্যামনে রাগ দ্যাখাই? তুই যে আমার না জন্মানো ভাই! ভাল থাকিস। আমার এলোমেলো জীবনের সবটুকু ভাল জিনিশ দিয়ে তোর জন্য দোয়া করি, তুই ভাল থাকিস, বন্ধু!

—-

[লেখাটার জন্ম ৩রা আগস্ট, ২০০৮। এ বছর বন্ধু দিবসে। আমার প্রিয় বন্ধুটির জন্মদিন ছিলো তার তিনদিন পরেই। তাকে লেখাটা পড়তে দেয়ার পরে সে কী অনুভব করেছিলো দেখতে পারি নাই। ম্যাসেঞ্জারের মধ্যে দিয়ে আর কতটুকুই বা আবেগ আসে?…]

৯,০৪০ বার দেখা হয়েছে

৮৪ টি মন্তব্য : “এই লেখাটা তোর জন্যে”

  1. সায়েদ (১৯৯২-১৯৯৮)

    এই অসীম সৌভাগ্যবানটা কে?
    প্রথম সুযোগেই দেখা করতে চাই।
    ডিসেম্বরে আইভোরি কোস্ট যাব ইনশাআল্লাহ।
    হিংসা হচ্ছে তার জন্য।
    হিংসা হচ্ছে লেখককে - এই জন্য যে বন্ধুকে নিয়ে এমন করে প্রকাশ করতে পারি না।
    জয়তু.... :salute:


    Life is Mad.

    জবাব দিন
  2. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    আন্দালিব ভাই,আপনার প্রিয় বন্ধু আমারো খুব,খুব প্রিয় একজন সিনিয়র।সহজ সরল আর বিশাল হৃদয়ের এই মানুষটার সাথে অনেক শঠতা করা হলেও বিধাতাপুরুষ আপনার মত একজন বন্ধু দিয়ে তার সবটাই যেন পূরণ করে দিয়েছেন!

    জবাব দিন
  3. ফয়েজ (৮৭-৯৩)

    বাহ, চমৎকার প্রকাশ করেছ তো, কোন লজ্জা পাও নি। আমরা তো এইগুলা বলতে লজ্জাই মরে যাই।

    তোমাকে, তোমার বন্ধুকে এবং তোমার লেখনিকে :salute:


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন
    • আন্দালিব (৯৬-০২)

      কী ভূতে পাইছিলো, কে জানে, ফয়েজ ভাই! আমি লেখার সময়ে এতো কিছু ভাবি নাই। এই অনুভূতিগুলো সামনা সামনি কাউকে বলা সম্ভব না। ইন্টারনেট ভালো জিনিস, এখন সেই সুযোগ করে দিয়েছে। 😀

      এক বছর দেরি হলো, তবু আপনাকে ধন্যবাদ ভাই।

      জবাব দিন
  4. রবিন (৯৪-০০/ককক)

    অসাধারন লেখা। মনে হয় না আমাদের এরকম অনূভুতিগুলো এভাবে প্রকাশ করতে পারতাম।আমারো সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু নিয়ে অনূভুতি গুলো একি রকম। লেখার প্রেরনা পেলাম

    জবাব দিন
  5. তাইফুর (৯২-৯৮)

    'ইশ', আমারে নিয়া কেউ যদি লিখত এমন কইরা ... :dreamy:
    আন্দালিব, আমার মনের এই 'ইশ'টাই লেখকের প্রাপ্তি।


    পথ ভাবে 'আমি দেব', রথ ভাবে 'আমি',
    মূর্তি ভাবে 'আমি দেব', হাসে অন্তর্যামী॥

    জবাব দিন
  6. তাইফুর ভাই, টিটো , আন্দালিব

    আপনারা তো মিয়া মানুষ খারাপ। :grr: :grr: এতোদিন সিসিবিতে ধুনফুন লেইখা পাবলিকরে বহুত ঘোল খাওয়াইছি। কিন্তু আপনারা দিলেন তো আমার জারিজুরি সব ফাঁস কইরা।
    এতো ভালো না লিখলে কি এমন ক্ষতি হয়। :grr: :grr:

    ধুর , ক্যাম্নে কী। এইরম করলে খেলুম না কইলাম। 🙁

    জবাব দিন
  7. তৌফিক (৯৬-০২)

    আমরা কলেজে এই রকম বেস্ট ফ্রেন্ডগুলারে বাটারবন বইলা ডাকতাম। কারণ বাটার আর বনের মতোই এরা একজন আরেকজনের সাথে লাইগা থাকত। :grr:

    লেখা ভালো হইছে আন্দালিব। 🙂

    জবাব দিন
  8. দিহান আহসান

    তোমার এই লেখাটা কিভাবে চোখ এড়িয়ে গেলো, তাও বন্ধু নিয়ে লেখা,
    আসোলেইতো এক বছর পর প্রায়।
    অসম্ভব সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছো তোমাদের বন্ধুত্ব, এমন বন্ধু পাওয়া খুব ভাগ্যের ব্যাপার।
    যদিও সিটপ্ল্যানে না বসালে, হয়ত তুমি তাকে বুঝতেও না এমন করে 🙂

    অবশ্য আমিও অনেক ভাগ্যবতী কারন আমি এমন একজন বন্ধু পেয়েছি যাকে খুব কাছের বন্ধু করতে আমার সিটপ্ল্যান বা ৬ বছর একসাথে সুখ দুঃখে থাকতে হয়নি। 😀

    দেরীতে হলেও তোমার আর তোমার বন্ধুর জন্য অনেক অনেক শুভকামনা রইলো।

    জবাব দিন
  9. জুলহাস (৮৮-৯৪)

    আন্দালিব,
    চ্যালেঞ্জ রইলো...(ইমো নাই ক্যান??) :dreamy: :dreamy:
    পারলে এই রকম আরেকটা ভালো লেখা লিখে দেখা তো!!! (অবশ্যই আমারে নিয়া!!!)
    সম্ভব নয়... :no: :no: :no:
    :hatsoff: :hatsoff: :hatsoff: :hatsoff: :salute: :salute: :salute:


    Proud to be an ex-cadet..... once a cadet, always a cadet

    জবাব দিন
  10. আন্দা,লেখা টা অসাধারন হইসে.পড়েই বুঝেসি সে কে ..তবে তোমার সেই প্রিয় বন্ধু খুবই ভাগ্যবান তোমার মত এমন বন্ধুর জন্য,যে এত সুন্দর করে মনের কথা প্রকাশ করতে পারে.. :hatsoff: .

    জবাব দিন
  11. আন্দা ভাই,সিপি ভাইয়ের প্রোফাইল ঘুইরা আইসাই কেম্নে কেম্নে এই লেখা চোখে পড়ল 🙂 আবারো বলি- অ-সা-ধা-র-ণ লেখা। আর আপনার বন্ধুটাও অসাধারণ,আমার দেখা সেরা অলরাউন্ডারদের একজন।আপনাদের বন্ধুত্বকে আবারো সেলাম।

    জবাব দিন
  12. মামুন (০০-০৬)

    খুব সুন্দর হইছে ভাইজান।নস্টালজিক হয়ে গেলাম.......
    সবাই সব কইয়া ফালাইসে তাই সবচেয়ে ভালো লাগায় আরেকজনের comment টাই copy-paste মাইরা দিলাম........(sorry, FARHANA আপু) 🙂 🙂
    :boss: :boss: :boss: :boss:

    জবাব দিন
  13. তানভীর (98-04)

    একটা ইংলিশ গান শুনেছিলাম-
    'Lean on me, when you're not strong, and I'll be your friend, I'll help you carry on, for it won't be long, 'til I'm going to need somebody to lean on'
    কলেজের বন্ধুরা সব এমনই...একে অন্যের কাধে ভর করে চলতে হয়
    বন্ধুদের অনেক মিস করি ......ভাই আমি আপনার প্রিয় বন্ধুর হাউসেরই ১জন...
    আপনার লেখা পরে মন খারাপ হয়ে গেল...

    জবাব দিন
  14. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    এই লেখাটায় আমার কমেন্ট নাই দেহে অবাক হলাম, অনেক আগেই পড়েছিলাম, দারুন একজন মানুষ্কে নিয়ে দারুন একটা লেখা। ওর উপরে ভর করেই বলা যায় গত বছর পাঁচ মাসের একটা কোর্স পার করে এসেছি 😛


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।