বলের বদলে গ্রেনেড (৭ম পর্ব)

আগের পর্বগুলোঃ

১৩।

এপ্রিল, ১৯৭১

অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠনের খবর শুনে অন্যান্য স্থানের মতনই গোপালগঞ্জেও সবার মধ্যে নতুন করে উদ্দীপনা জেগে উঠল। কেননা, সরকার গঠনের মাধ্যমে চলমান স্বাধীনতা যুদ্ধ আনুষ্ঠানিক মর্যাদা পাবে। এতে করে বহির্বিশ্বেও এর গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের নির্দেশে শিলিগুড়ির অল ইন্ডিয়া রেডিওকে বদলে নাম রাখা হয়েছে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। আপাতত সেখান থেকেই প্রচারিত হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ ও অন্যান্য নানাবিধ অনুষ্ঠান।

গোপালগঞ্জ এখনো পাক হানাদার বাহিনীর থাবা থেকে মুক্ত আছে, কিন্তু কতদিন থাকবে বলা মুশকিল। ইতোমধ্যে মেজর হালিম গোপালগঞ্জে ফেরত চলে এসেছেন। অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে তিনি এবং তাঁর বাহিনী যশোর, নড়াইলে পাক বাহিনীর সাথে লড়াই করলেও শেষ পর্যন্ত পিছু হটতে বাধ্য হয়েছেন। গোপালগঞ্জে ফিরে তিনি ছাত্র, যুবক, ইপিআর ও সামরিক সদস্যদের আবারও সমবেত করা চেষ্টা করে চলেছেন। মোটামুটি দুই কোম্পানির মত সদস্য হবার পর তিনি প্রশিক্ষণ শুরু করেছেন। প্রথমে ঠিক করেছিলেন গোপালগঞ্জ সদর হবে তাঁর হেডকোয়ার্টার, পরে সেটাকে সরিয়ে নিজের গ্রামের বাড়ি মানিকহারে নিয়েছেন। সেখানকার হাই স্কুলটিই এখন হেড কোয়ার্টার।

অনিক সেখানে প্রশিক্ষণের জন্য যেতে চাইলেও রতনের বাঁধায় যাওয়া হল না। রতনের মতে এই প্রশিক্ষণ ওদের জন্য ফলপ্রসূ হবে না। ওদের দরকার আরও সুশৃঙ্খল, দীর্ঘমেয়াদী এবং পরিকল্পিত প্রশিক্ষণ। কিভাবে তা সম্ভব হবে- অনিকের এই প্রশ্নের জবাবে রতন বলল,
-আমাদের মতন বেসামরিক লোকদের জন্য ঐ প্রশিক্ষণ করে লাভ হবে না। আমাদেরকে ভারতে যেতে হবে। খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি ভারত সরকার আমাদের ট্রেনিং এবং অস্ত্রের ব্যাপারে সাহায্য করছে। সরকার গঠন হবার ব্যাপারটি দারুণ একটি কাজের কাজ হয়েছে!
-কিন্তু আমরা পাকবাহিনীর নজর এড়িয়ে যাব কিভাবে? তাছাড়া মুসলিম লীগ এবং জামায়াতের অনেক সমর্থকও নাকি পাকিদের হয়ে কাজ করছে!
-এজন্য আমাদের ঘুর পথে ভারতে যেত হবে। সবাই বলছে আপাতত বেনাপোল হয়ে ভারতের দিকে যাওয়া খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হবে, ফলে আমাদেরকে ঝিনেদা হয়ে যেতে হবে।
-ঝিনেদা হয়ে?
-হ্যাঁ, ঝিনেদার মহেশপুর দিয়ে আমরা বর্ডার পার হব। প্রথমে এখান থেকে নদী পথে আমরা মাগুরা মহকুমার মোহাম্মদপুর পৌঁছব। এরপর মাগুরা শহর, ঝিনেদা, কোটচাঁদপুর হয়ে মহেশপুর। ওখান থেকে কোন এক সুযোগ বুঝে আমরা ভারত চলে যাব।
-মহেশপুর আমার এক মামার বাসা আছে, ওখানে মনে হয় থাকা যাবে!
-তাহলে তো আরও ভাল! রতন খুশি হয়ে গেল!
-কিন্তু এরপর ভারতের কোথায় যাব?
-ভারতে বেশ কয়েকটা ইয়থ ক্যাম্প চালু হয়েছে শুনেছিস তো? আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ এবং বাঙালি সেনা সদস্যদের পরিচালনায় এই ইয়থ ক্যাম্পগুলো হচ্ছে অনেকটা রিপোর্টিং সেন্টারের মতন। প্রথমে আমরা সেরকম একটি ক্যাম্পে যাব, সেখান থেকে আমাদের যেখানে পাঠায় সেখানে যাব।
-আমরা কোন ইয়থ ক্যাম্পে যাব?
-মসলন্দপুরের কাছে ঘোষপুর নামের একটি জায়গা আছে। ওখানে যাব। আমি আগে একবার ঘোষপুর গিয়েছি, আমার এক পিসির বাসা আছে। কোন সমস্যা হবে না।
-কবে যাবি?
-যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। পাকিরা এখানে চলে আসলে কি হবে বলা মুশকিল। এর আগেই চলে যেতে হবে।
-আর কে কে যাবে আমাদের সাথে?
-রশিদ, পান্না, সোলায়মান, শহীদ, চিত্ত, সুব্রত, সাব্বির…অনেকেই বলেছে! তবে, শেষ পর্যন্ত কে কে যাবে বা যেতে পারবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। ভাল কথা, আমি কিন্তু বাসায় কিছু জানাচ্ছি না। খুড়ো শুনলে ঝামেলা করবে! তুই কি করবি?
-আমি জানিয়েই যাব। মা হয়ত একটু কান্নাকাটি করবে, তবে বাবা রাজি হয়ে যাবেন। সবচেয়ে সমস্যা হবে শাওনকে বোঝাতে-ওকে মনে হয় না বলাই ঠিক হবে।
-ঠিক আছে তুই বাসায় কথা বল। বেশি কাপড়-চোপড় নেয়ার দরকার নেই। আর টাকা-পয়সা কিছু নিস। পথে টাকা পয়সা লাগতে পারে। আর লুঙ্গি নিতে ভুলিস না, কাজে আসবে। সব জায়গায় প্যান্ট শার্ট পড়ে পথ চলা, যাবে না। ঝামেলা হতে পারে।
-ভাল কথা বলেছিস। আমি আজকেই বাসায় জানিয়ে দেব।

——-

সন্ধ্যার দিকে মাকে ভারতে যাবার কথা কয়েকবার বলতে গিয়েও পারল না অনিক। কেন জানি সংকোচ হতে লাগল। এমনিতেই রাশেদ চাচা বা চাচী কেমন আছে সে খবর ওরা এখনো জানতে পারেনি, মা এটা নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা করেছেন। ওর ভারতে যাওয়ার কথা শুনে মা আরও ভেঙে পড়েন কি না…

ঠিক করলো আগে বাবার সাথে কথা বলবে।

শাওন ওর রুমে এবং মা রান্নাঘরে ব্যস্ত আছে দেখে আস্তে করে ড্রয়িং রুমে বাবার পাশে গিয়ে বসল অনিক। বাবা কিছু কাগজপত্র দেখছিলেন। ওর দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে কি বুঝলেন কে জানে, তবে কাগজ সামনের টেবিলে নামিয়ে রেখে জিজ্ঞাসা করলেন,
-কিরে বাবা, কিছু বলবি?
-বাবা, আমি ভারতে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ট্রেনিং এর জন্য!

বাবা কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। হতচকিত ভাব কাটিয়ে স্বাভাবিক হতে কিছুটা সময় লাগল। এরপরও চোখের চশমা খুলে টেবিলের উপর রেখে যখন কথা বললেন গলাটা কিছুটা হলেও কেঁপে উঠল,
-মনে মনে আমি এই কথোপকথনের জন্য প্রস্তুত হয়ে ছিলাম। কিন্তু দেখা যাচ্ছে প্রস্তুতি নিয়ে কোন লাভ হয় নি। তোর কথায় আমার ভেতরটা যেন কেঁপে উঠল।
-এ ব্যাপারে তোমার কি মত?
-একজন বাঙালি হিসেবে আমি অবশ্যই তোকে সমর্থন করছি। বিশেষ করে শেখ সাহেবের এলাকার লোক হয়ে যুদ্ধে যাবার ব্যাপারে তোকে বাঁধা দেবার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু একজন বাবা হিসেবে আমার বুকটা ভেঙে যাচ্ছে…তবে হ্যাঁ, অনেক গর্বও হচ্ছে- তোর মত ছেলের বাবা হতে পেরেছি বলে! সারাজীবন তুই সবসময়ই সঠিক কাজটিই করে এসেছিস। তোর মত ছেলে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার…
-কি বলছ বাবা এসব? এখন পর্যন্ত যা অর্জন করেছি-তা তো তোমার জন্যই…
-তোর মাকে জানিয়েছিস?
-এখনো বলার সাহস করে উঠতে পারি নি…আমি বলব, নাকি তুমি জানাবে?
-আচ্ছা আপাতত কিছু বলার দরকার নেই। আমি আজকে রাতে খাওয়ার পর তোর মার সাথে কথা বলব। কবে রওনা দিচ্ছিস ঠিক করেছিস?
-২৮ তারিখ ভোরে। রতনের পরিচিত এক মানুষের একটি ইঞ্জিন চালিত নৌকা পাওয়া গেছে। সেটা আমাদের এখান থেকে মাগুরার মোহাম্মদপুর নামিয়ে দেবে। ওখান থেকে ঝিনেদা, কালীগঞ্জ হয়ে আমরা মহেশপুর যাব। এরপর বর্ডার পেরিয়ে ভারত।
-ওহ! তাহলে আর তো মাত্র দুইদিন বাকি…
-হ্যাঁ, বাবা! যত দ্রুত যাওয়া যায় ততই মঙ্গল, পরে পাকবাহিনী এই এলাকায় চলে আসলে ঝামেলা হয়ে যাবে!
-সেটা ঠিক। আচ্ছা, তোদের পুরো প্ল্যানটা আমাকে বল।

অনিক এবার রতনের বলা কথাগুলো একেবারে শুরু থেকে বাবাকে বলতে লাগল।

——-

২৮ এপ্রিল ফজরের আযান দেবার আগেই অনিক ব্যাগ গুছিয়ে প্রস্তুত হয়ে গেল। অবশ্য, ব্যাগ না বলে ছোট পোটলা বলাই ভাল। অল্প কিছু কাপড়, দু’টো ক্রিকেট ম্যাগাজিন এবং বলটি নিলো। সুনীলদার কথা মত সবসময় হাতের কাছে বল রাখাটা এখন অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিছুক্ষণ হাতে বল না ঘুরালে এখন ঘুমাতেও সমস্যা হয়।

শাওন এখনো ঘুমিয়ে আছে দেখে মনে মনে স্বস্তি বোধ করল। শাওন বোধহয় ভেবেছিল এবার অনেকদিন একসাথে থাকা হবে। বেচারা! ওর সাথে বেশি সময় থাকাই হল না! ‘কি আর করা’ ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওর কপালে সাবধানে চুমু দিয়ে এবং ঝাঁকড়া চুলগুলো আলতো করে এলোমেলো করে দিয়ে ওদের ঘর থেকে বের হয়ে পড়ল অনিক।

বাবা এগিয়ে এসে ওর কাছে একটি খাম দিলেন। বললেন,
-এখানে এক হাজার টাকা আছে। আর তোর খালিশপুরের দিলু মামার ঠিকানাও এখানে লিখে দিয়েছি। ভারত থেকে যে কোন খবর পাঠাতে চাইলে ওর বাসা পর্যন্ত জানিয়ে দিস। দিলু খুব প্রভাবশালী ছেলে, ঠিকই সেটা আমার পর্যন্ত পৌঁছানোর ব্যবস্থা করে ফেলবে।
-এত টাকা দিচ্ছ!!
-পথ ঘাটের কথা তো কিছু বলা যায় না…তাছাড়া, আবার কবে বাড়ি আসতে পারবি তার কোন ঠিক নেই…
-ঠিক আছে, বাবা। বলে অনিক বাবাকে জড়িয়ে ধরল।

এদিকে পেছনে মা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন! চোখে দেখেই বোঝা গেল সারারাত ঘুমান নি এবং একনাগাড়ে কান্নাকাটি করেছেন। বাবাকে ছেড়ে এবার মাকে জড়িয়ে ধরল ও। বাবা সামনে এগিয়ে গিয়ে দরজার খুলে বাইরে গিয়ে দাঁড়ালেন। এই সুযোগে মা আঁচল থেকে একশ’ টাকার দু’টি ভাঁজ করা নোট ওর হাতে দিয়ে বললেন,
-বাবা, এটা তোর কাছে রাখ। আলাদা করে রাখিস। বিপদে আপদে কাজে লাগবে!
-মা, তুমি কিচ্ছু ভেবো না। আমার কিছু হবে না…তোমার দোয়া তো আমার সাথেই থাকছে…

সান্ত্বনায় কোন কাজ হল না। মা কেঁদেই চললেন। কয়েক মুহূর্ত পর কিছুটা সামলে নিয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া-দরুদ পরে ফুঁ দিলেন। এরপর দু’হাতে ওর মুখ জড়িয়ে ধরে কপালে একটি সস্নেহের চুমো দিলেন। মা এর পা ছুঁয়ে সালাম করে ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বাসা থেকে বের হল অনিক। এবার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা বাবাকেও সালাম করে রাস্তায় নেমে পড়ল ও। ওকে দেখে অন্ধকারের মধ্য থেকে রতন এগিয়ে আসল। বাবা রতনকে দেখে শুষ্ক একটি হাসি দিলেন। জবাবে রতনও ছোট্ট করে হাসি দিল। অনিক পেছন ফিরে তাকিয়ে আরেকবার বাবা-মাকে দেখে নিলো। এরপর দুজনে মিলে দ্রুত শেষ রাতের অন্ধকারে মিশে গেল…

এই মুহূর্তে ওরা দুজনই শার্ট-প্যান্ট পড়ে আছে। ওদের ধারণা অনুযায়ী মোহাম্মদপুর পর্যন্ত আপাতত নির্ভয়েই পথ চলা যাবে, বিপদের কোন আশংকা নেই। কিন্তু ঝিনেদা থেকে সমস্যা হতে পারে। রতনের কাছ থেকে জানতে পারল পান্না এবং সোলায়মান ছাড়া বাকি সবাই যাবার ব্যাপারে চূড়ান্ত কথা দিয়েছে। আগে থেকেই ঠিক করা আছে ভোরের আগেই সবাই হরিদাসপুরের কাছে মধুমতি নদীর কালীঘাটে একত্রিত হবে। ওখান থেকে ঠিক ৬ টা বা খুব বেশি হলে সাড়ে ৬ টার সময়ে নৌকা যাত্রা শুরু করবে। এর মধ্যে যারা আসতে পারবে না, তাদের জন্য আর কোনমতেই অপেক্ষা করা হবে না।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আশপাশের মসজিদগুলো থেকে ফজরের আজান দেয়া শুরু হল। একটু পর পূবের আকাশও আলোকিত হওয়া শুরু করল। ভোরের আলোর ক্রমবর্ধমান চাপে অন্ধকার ধীরে ধীরে সরে গিয়ে চারিদিকে উজ্জ্বল হতে থাকল। অনিক এবং রতন ওদের হাঁটার গতি আরও বাড়িয়ে দিল।

১৪।

মে, ১৯৭১

ওদের অনুমান নির্ভুল ছিল। ঝিনেদা পর্যন্ত পথে তেমন কোন সমস্যা হল না। বিশেষ করে মোহাম্মদপুর পর্যন্ত নৌকা যাত্রাটি তো উলটো বেশ আরামদায়কই ছিল। নৌকার মাঝি সুকুমার অনেক করিৎকর্মা মানুষ। দক্ষতার সাথে এবং খুব সাবধানে ওদেরকে মোহাম্মদপুর নামিয়ে দিয়েছিল। এমনকি ওদেরকে রান্না করেও খাইয়েছে। দেশের পরিস্থিতি খারাপ না হলে যাত্রাটিকে পিকনিক বলে চালানো যেত।

অনিক, রতন ছাড়া শেষ পর্যন্ত ওদের সাথে আরও তিনজন যোগ দিতে পেরেছে- চিত্ত, সুব্রত এবং সাব্বির। রশিদের আসার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে ওর বাবা টের পেয়ে ওকে বাসায় আটকে রেখেছিল। অথচ ভারতে যাবার ব্যাপারে ওর আগ্রহই ছিল সবচেয়ে বেশি। এছাড়া সাব্বিরও আসতে পারেনি। ওর শরীর খারাপ করেছে, প্রচণ্ড জ্বর আর মাথা ব্যথা। অবশ্য ঐ অবস্থায় ও না আসাই ভাল হয়েছে। শুধু শুধু ঝামেলা বাড়ত।

কালীগঞ্জ বাজার পৌঁছানোর পর ওরা খারাপ খবর পেল। ক’দিন আগেই নাকি যশোর থেকে বিপুল পরিমাণ পাক সৈন্য এদিক দিয়ে মহেশপুর পর্যন্ত হামলা চালিয়েছে। স্থানীয় কিছু সাহসী মানুষ প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু বেশিক্ষণ তা ধরে রাখতে পারেন নি। তবে, বাংলাদেশ সরকার গঠিত হবার পর সবাই আবার নতুন করে সংগঠিত হচ্ছে। এই মুহূর্তে পরিস্থিতি মোটামুটি স্বাভাবিক। কিন্তু, ওদিকে যাবার ব্যাপারে বাজারের সবাই ওদেরকে সতর্ক করে দিল।

ওরা দ্রুত করণীয় ঠিক করে ফেলল। সবার মত হচ্ছে এতদূর যখন চলে এসেছে আর পিছপা হওয়া যাবে না। সিদ্ধান্ত নিলো ওরা সামনেই এগুবে এবং আগের চেয়ে আরও বেশি সতর্ক হয়ে পথ চলতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা বাঙ্গালি হলেও কোন অপরিচিত মানুষের কাছে ওদের গন্তব্য এবং লক্ষ্য প্রকাশ করা যাবে না। পুরো এলাকা জুড়ে নাকি পাকিদের চর ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রতিদিন যে শত শত মানুষ মহেশপুর দিয়ে সীমান্ত পার হবার চেষ্টা করছে, তাদের মধ্যে খুঁজে খুঁজে তরুণ ও যুবকদের ধরে জিজ্ঞাসাবাদ এবং তল্লাশি করছে। অনেককেই নাকি সামনে এগোতে না দিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছে।

যাই হোক, উপরওয়ালার নাম নিয়ে সবাই সামনে এগোনো শুরু করল। বাসা থেকে বের হবার নবম দিনে ওরা ঝিনেদা মহকুমার কোটচাঁদপুর পৌঁছল। মাঝে অনেক বৃষ্টি হওয়ায় পুরো একদিন ওরা একেবারেই পথ চলতে পারেনি, মাগুরার এক পরিত্যক্ত বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল। গত কয়েকদিনে ওরা বিভিন্নভাবে পথ চলেছে-নৌকা, ভ্যান, বাস, গরুর গাড়ি, হেঁটে, হামাগুড়ি দিয়ে… অর্থাৎ যখন যেভাবে পেরেছে! এর মধ্যে কালীগঞ্জের মাইলখানেক আগে আর একটু হলেই তো পাক বাহিনীর সামনেই পড়ে যাচ্ছিল! দূর থেকে গাড়ির শব্দ শুনে ওরা রাস্তা থেকে নেমে পাশের পাট ক্ষেতে গিয়ে লুকিয়ে ছিল। কিছুক্ষণ পরে ওদের সামনে দিয়ে দু’টো ট্রাক এবং একটি জিপ সাঁ করে ছুটে গেল। রাস্তার উপর থাকলে কি হত তা সহজেই অনুমেয়!

এ ক’দিনে পথ চলার সময়ে ওরা পাক হানাদার বাহিনীর চরম নৃশংসতার অজস্র নমুনা দেখতে পেয়েছে। যেসব জায়গায় লোকবসতি ছিল তার অনেকগুলোতেই প্রচুর পুড়ে যাওয়া বাড়িঘর ছিল। অনেক খানে গলিত-অর্ধগলিত মৃতদেহও চোখে পড়েছে। স্থানে স্থানে পড়ে রয়েছে শুকিয়ে যাওয়া চাপ চাপ রক্ত! এত কিছু সত্ত্বেও ওরা এগিয়ে চলতে থাকল।

সন্ধ্যার অল্প কিছুক্ষণ আগে ওরা কোটচাঁদপুরে পৌঁছল। সারাদিনে শুধু একবার কলা, পাউরুটি খেয়েছে। ফলে, সবাই ভীষণ ক্লান্ত এবং ক্ষুধার্ত। বাস স্ট্যান্ডের পাশের বাজারে কয়েকটি হোটেল দেখে সেখানে কিছু খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো ওরা। তবে সবাই একসাথে বসা ঠিক হবে না চিন্তা করে দুই হোটেলে আলাদা করে বসল। চিত্ত, সুব্রত এবং অনিক গেল একটাতে, অন্যটায় বসল সাব্বির এবং রতন।

হোটেলের লোককে ডেকে অনিক পুরি-সিঙ্গারা দিতে বলল। ওরা যখন অপেক্ষা করছে ঠিক তখন হঠাৎ করে চার-পাঁচ জন লোক এসে ওদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করল। তোমরা কারা? কোথা থেকে এসেছ? কোথায় যাচ্ছ? এইসব প্রশ্ন করল। অনিক অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় জানালো ওরা তিনজন বন্ধু মিলে মহেশপুর যাচ্ছে। মহেশপুরের দিলু খান ওর মামা হন, মামার বাড়িতে বেড়াতে যাচ্ছে। বাবা আগেই বলে দিয়েছিলেন কালীগঞ্জ পার হবার পর যেখানেই কেউ জিজ্ঞাসা করুক না কেন, দিলু মামার কথা বলতে। মামাকে নাকি এই এলাকায় এক নামে চেনে!

লোকগুলোর চেহারা দেখে বুঝল বাবার কথা সঠিক, দিলু মামাকে এরা সবাই চিনেছে। সম্ভবত ভয়ও করে। ওদেরকে বসতে বলে লোকগুলো সামনে এগিয়ে গেল। অনিক হোটেলের বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখতে পেল দূরে আরও কয়েকজনের সাথে ঐ লোকগুলো কথা বলছে। হঠাৎ করে ওদের দিকে হাত দেখিয়ে কি জানি বলল। এটা খেয়াল করে অনিক দ্রুত বলে উঠল,
-দোস্তরা, তাড়াতাড়ি ওঠ। লোকগুলোর মতিগতি ভাল লাগছে না!

হোটেলের পিচ্চি ছেলেটা ওদেরকে ইশারা করে পেছনের একটি চোরা পথ দেখিয়ে দিল। অনিক দ্রুত পাশের হোটেলে গিয়ে সাব্বির এবং রতনকে ডেকে নিয়ে সবাই মিলে পেছন পথ দিয়ে বের হয়ে পড়ল। হোটেলের পেছনেই একটি পাট ক্ষেত ছিল। ক্ষেতের মধ্যে ঢুকে আন্দাজে সামনে পথ চলতে লাগল। প্যাচপ্যাচে কাদার মধ্য দিয়ে পথ চলতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। পেছনে মানুষের হৈ চৈ শুনে ওরা চলার গতি আরও বাড়িয়ে দিল। দুটো ব্যাপারে ওদের পক্ষে গেল- সন্ধ্যে হয়ে গেছে বলে বেশি দূরের জিনিস কম চোখে পড়ছে এবং বাজারে অনেক লোকের সমাগম ছিল, ফলে ওরা কোন পথে এগিয়েছে তা ধরতে সময় লাগার কথা।

বেশ কিছুক্ষণ চলার পর ওরা ক্ষেত পেরিয়ে শুকনো রাস্তায় উঠে পড়ল। রাস্তা দিয়ে দশ-পনের মিনিট চলার পর সামনে পশু হাসপাতালের সীমানা দেখতে পেল। হাসপাতালের পেছনের রাস্তা দিয়ে আরও বেশ কিছু দূর যাওয়ার পর পর পর কয়েকটি একতলা ইটের বাড়ি দেখা গেল। ততক্ষণে চারিদিকে রাতের অন্ধকার নেমে এসেছে। দোয়া পড়ে অনিক প্রথম বাড়ির দরজায় টোকা দিল!
-কে? কিছুক্ষণ পর ভেতর থেকে ভয়ার্ত জবাব আসল।
-আমরা কয়েকজন মহেশপুর যাব। রাত হয়ে গেছে বলে আটকা পড়েছি। দয়া করে আমাদের আজকের রাত কাটাবার জন্য একটু আশ্রয় দেবেন?

এরপর আর কোন কথা শোনা গেল না। আরও কয়েকবার ধাক্কা দিয়েও কোন জবাব না পেয়ে ওরা হাল ছেড়ে দিল। পরপর আরও দুটি বাড়িতেও ওদের ভাগ্য সহায় হল না। চতুর্থ বাড়িতে একই রকম কথোপকথনের পর ওরা যখন হাল ছেড়ে সামনে এগোতে ধরল, তখন দরজাটা একটু ফাঁক হয়ে গেল। হারিকেন হাতে একজন মধ্য বয়সী মহিলা বের হয়ে আসলেন। প্রথমেই কিছুক্ষণ তিনি ওদের দিকে তাকিয়ে দেখলেন। এরপর উঁকি মেরে রাস্তার দুই দিকে তাকিয়ে ওদেরকে নিঃশব্দে ভেতরে ঢোকার নির্দেশ দিলেন। দ্রুত জুতো-স্যান্ডেল খুলে হাতে নিয়ে ওরা ভেতরে ঢুকে পড়ল।

-তোমরা কি মুক্তি? তিনি ফিসফিস জিজ্ঞাসা করলেন।
-না চাচী, তবে আমরা ভারত যাচ্ছি…ট্রেনিং এর জন্য। অনিক সত্য কথাটাই জানালো। কেন জানি মনে হলে ভদ্রমহিলাকে সত্য কথাটা বলতে কোন সমস্যা নেই।
-তা আমি দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম। হারিকেনের আলোতে মহিলার চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আমার ছেলেও দুই সপ্তাহ আগে চলে গেছে!
-চাচী, বাসায় আর কেউ নেই?
-না, বাবা। ছেলে ভারতে যাবার পর আমি এখন একাই আছি। তোমরা কি ভাত খাবে? দেখে মনে হচ্ছে অনেকক্ষণ কিছু খাও নি…
-তাহলে তো খুবই ভাল হয়।
-ঠিক আছে, তোমরা হাতমুখ ধুয়ে নাও। আমি জলদি রান্না করে ফেলি…

চল্লিশ মিনিটের মধ্যে গরম ভাত, ডিম ভাজি এবং ডাল দিয়ে ওরা পেট পুরে খেয়ে নিলো। প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত ছিল বলে ওদের কাছে মনে হল যেন অমৃত খেল! কিছুক্ষণ পর মেঝেতে কাপড় বিছিয়ে ওরা শুয়ে পড়ল এবং খুব দ্রুতই ঘুমিয়ে পড়ল।

——–

ভোর চারটের দিকে মহিলা ওদেরকে ডেকে দিলেন। ওদেরকে একটি রাস্তা দেখিয়ে বললেন এদিক দিয়ে সোজা এগিয়ে যেতে। তাহলে ওরা কোটচাঁদপুর শহর ছাড়িয়ে বলুহর নামক এক জায়গায় বিশাল বাঁওড় আছে, সেখানে পৌঁছতে পারবে। সকাল হওয়া পর্যন্ত রাস্তার পাশে কোথাও লুকিয়ে থেকে এদিক থেকে যাওয়া যে কোন বাসে উঠলেই সোজা মহেশপুর নিয়ে যাবে। ওদেরকে বিদায় জানাতে গিয়ে অচেনা, অজানা মহিলার চোখে পানি চলে এলো। সম্ভবত ওদের দেখে নিজের ছেলের কথা মনে পড়েছে।

কিছু মানুষ কত সহজেই অন্যকে আপন করে নেয়!

ভোরের আলো ফোঁটার আগেই ওরা পথ চলা শুরু করল। বলুহর বাঁওড়ের কাছাকাছি যখন পৌঁছল তখন চারিদিকে প্রায় আলোকিত হয়ে এসেছে। এরই মধ্যে চিত্ত খাবারের জন্য ঘ্যানঘ্যান শুরু করল। ওর স্বাস্থ্য অন্যদের তুলনায় একটু বেশি ভাল, খাওয়া-দাওয়াও একটু বেশি করে। কিছুক্ষণ খোঁজা-খুঁজির পর গ্রামের ভেতরের এক ছোট্ট দোকানে কলা-বিস্কুট পাওয়া গেল। সেগুলো খেয়ে ওরা দূরে রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইল। দোকানদার বলেছে বাস বা অন্য কিছু গেলে এখান থেকেই দেখা যাবে। এখন আপাতত বাসের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া ওদের কিছু করার নেই!

ঠিক দুপুর ১২ টার দিকে একটি ভাঙাচোরা বাস দেখা গেল। দৌড়ে সবাই বাসের দিকে ছুটে গেল। একসাথে কয়েকজনকে ছুটতে দেখে বাসের চালক প্রথমে ভড়কে গতি বাড়িয়ে দিতে চেয়েছিল। কাছাকাছি আসার পর ভাল করে দেখে গতি কমাল। বাসের কন্ডাকটর ওদের জলদি উঠতে বলল। একে একে সবাই ওঠার পর বাস ছেড়ে দিল। ওরা সবাই এক সাথে বাসের পেছনের সিটে গিয়ে বসল।

এরই মধ্যে যাত্রীদের কাছ থেকে জানতে পারল চলার পথে বাসকে একাধিকবার থামতে হয়েছে। ওদের মতন কমবয়সী ছেলে দেখলেই কয়েক জায়গায় তাদেরকে বাস থেকে নামিয়ে ফিরতি পথে পাঠিয়ে দিয়েছে। ওরা শহরের বাইরে থেকে উঠে খুব ভাল কাজ করেছে। তা না হলে আর মহেশপুর যাওয়া হত না!

উপরওয়ালাকে মনে মনে ধন্যবাদ দিয়ে ওরা আরাম করে বসার চেষ্টা করল। বাসের সিটের অবস্থা বেশ খারাপ হবার কারণে যদিও সেটা সম্ভব হল না, তবুও কিছুক্ষণের মধ্যে সবাই ঘুমিয়ে পড়ল। লক্কড়-ঝক্কড় বাসটি হেলে দুলে চলতে লাগল মহেশপুরের দিকে।

৪ টি মন্তব্য : “বলের বদলে গ্রেনেড (৭ম পর্ব)”

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।