বলের বদলে গ্রেনেড (৩য় পর্ব)

১ম পর্ব
২য় পর্ব

৪।

পরদিন সকাল বেলা।
ওয়ার্ম আপ শেষে সবাই মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। সুনীলদা অনিককে ডেকে বললেন,
-এখন থেকে তুই পয়েন্টে ফিল্ডিং করবি। শুধু প্র্যাকটিসের সময় নয়, ম্যাচের সময়েও।
-কেন, সুনীলদা?
-পয়েন্ট এবং গালি’তে দলের সবচেয়ে ভাল ফিল্ডারকে থাককে হয়। শার্প ক্যাচের ব্যাপারটি তো আছেই, বিপক্ষ দলের ব্যাটসম্যান রান চুরি করতে চাইলে রান আউটের সুযোগ পাওয়া যায়। তোর থ্রোয়িং সবচেয়ে ভাল, এজন্য এখন থেকে তুই-ই পয়েন্টে ফিল্ডিং করবি।
-আচ্ছা, ঠিক আছে। বলে অনিক পয়েন্টের দিকে এগিয়ে গেল।

আজকে সকালে টুটুল ভাই, দীপ্তদা সহ ৬ জন ব্যাট করবে। শনি এবং রোববার সকাল-বিকাল প্র্যাকটিস করার সুযোগ পাওয়া যায় বলে প্রতিদিন সকালে ৬ জন এবং বিকেলে ৬ জন, অর্থাৎ ১২ জন ব্যাট করে। আগামী রোববারের আগ পর্যন্ত দুইজন ব্যাটসম্যান একসাথে ব্যাট করতে নামবে। একই সাথে রান নেওয়ার প্র্যাকটিসও হয়ে যাবে। সুনীলদা রান নেবার ব্যাপারে বেশি জোর দিচ্ছেন, কেননা ওদের অনেকেরই রান কলের ব্যাপারে সমস্যা হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, প্রায়ই একে অন্যের সাথে ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে। সুনীলদা’র মতে এটা থেকে পরিত্রাণ পেতে প্রচুর প্র্যাকটিস করতে হবে।

প্রথমেই নামলেন টুটুল ভাই এবং নয়ন। টুটুল ভাই মারকুটে ব্যাটসম্যান, তুলে মারতে পছন্দ করেন। তবে, সুনীলদা’র কঠোর নির্দেশ তিনি অনুমতি না দেয়া পর্যন্ত মারা যাবে না। সব শট গ্রাউন্ডে খেলতে হবে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে সাবধানে খেলার পর টুটুল ভাই উশখুশ করতে লাগলেন। ওর কষ্ট দেখে সুনীলদা বললেন,
-ঠিক আছে টুটুল, দেখি কত মারতে পারিস! তুই এবং নয়ন আর চার ওভার অর্থাৎ ২৪ বল খেলতে পারবি। এর মধ্যে ৫০ রান করতে হবে। দুজনে একটি করে লাইফ পাবি। এরপর আরেকবার আউট হলে আজকের মত ব্যাটিং শেষ। রাজি??
-ইয়েস স্যার! খুশিতে টুটুল ভাই স্কুলের বাচ্চার মতন চিৎকার করে বললেন। নয়নকেও দেখা গেল হাসিমুখে সায় দিতে।

সুনীলদা সবাইকে ফিল্ডিং এ অবস্থান নিতে বললেন। ঠিক হল, আসল ম্যাচের মত মাঠে ১১ জনই থাকবে। বাকিরা মাঠের বাইরে গিয়ে দাঁড়াল। একজন বোলার এক ওভারের বেশি বল করতে পারবে না।
-সবাই তৈরি? আম্পায়ারের জায়গায় দাঁড়িয়ে সুনীলদা জানতে চাইলেন।

শাহিন ভাই প্রথমেই বল তুলে দিলেন শারেকের হাতে।
প্রথম দুই বল দারুণভাবে ইয়র্কার লেন্থে করল ও। দুই ব্যাটসম্যানই কোন মতে ব্যাট দিয়ে ঠেকিয়ে সিঙ্গেল নিলো। আবার টুটুল ভাই স্ট্রাইকে। এবারে কিন্তু শারেকের বল ফুল-টস হয়ে গেল। সজোরে ব্যাট চালালেন তিনি। ছক্কা!! বিশাল ছক্কাটা মেরে শারেকের একেবারে সামনে গিয়ে হাত উঁচিয়ে নিজের পেশি দেখালেন। এটা দেখে শারেকের মেজাজ গরম হয়ে গেল, সজোরে মাটিতে পড়ে থাকার একটি ইটের টুকরায় লাথি মারল। সুনীলদা ওকে সাবধান করলেন,
-শারেক, বিহ্যাভ ইওর সেলফ!

এদিকে কেউ খেয়াল করেনি যে বলটি গড়িয়ে সার্কিট হাউজের একজন গার্ডের পায়ে লেগেছে। আজকের গার্ডগুলোর সবাই-ই পাকিস্তানী, বেশিরভাগই বিশাল মোচওয়ালা! বলটি বাউন্স খাবার পর বেশি খানিকটা গড়িয়ে পায়ে লেগেছে, ফলে ব্যথা পাবার কথা নয়- তবুও, সেই গার্ডটি চিৎকার করে কয়েকটি গালাগালি করল। টুটুল ভাই কিছু বলতে যাচ্ছিলেন দেখে সুনীলদা ডেকে থামালেন। ইশারা করলেন কোন কথা না বলতে।

যা হোক, বল আবার শারেকের হাতে ফেরত এল। চতুর্থ বলটি অফ স্ট্যাম্পের উপর ছিল, গুড লেন্থের। সমীহের সাথে ঠেকিয়ে দিলেন তিনি। মুখে বললেন,
-আউট করতে পারবি না রে, শারেক!! মু হা হা…

এবার শারেক দৌড়ে এসে বাউন্সার দিল। টুটুল ভাই আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলেন। পুল করে স্কয়ার লেগ দিয়ে ছক্কা মেরে দিলেন! বল বিশাল সার্কিট হাউজের মাঠ পেরিয়ে রাস্তায় চলে গেল। ৫ বলে ১৪ রান হয়ে গেল। ১৯ বলে আর ৩৬ রান লাগবে!

শারেকের শেষ বলটি আস্তে করে লং অনে ঠেলে দিয়ে একটি রান নিলেন টুটুল ভাই। বোঝাই গেল পরের ওভারে স্ট্রাইক ধরে রাখার জন্য রানটি নিলেন।

এবার অনিক বোলিং এ আসল। প্রথম তিন বলে তিনটি সিঙ্গেল হল, টুটল ভাই বা নয়ন কেউই মারার চেষ্টা করে নি। চতুর্থ বলে নয়ন এগিয়ে এসে মারতে গিয়ে স্ট্যাম্পড আউট হল। বলটি গুগলি ছিল, নয়ন পরাস্ত হতেই উইকেট-কিপার কাইয়ুম বল নিয়ে উইকেট ভেঙ্গে দিল। একবার আউট!

পঞ্চম বলে দারুণ কাভার ড্রাইভ করে চার মরল নয়ন। এমনকি অনিকও ‘গুড শট’ বলতে বাধ্য হল। ওভারের শেষ বলে আগে থেকেই হাঁটু গেড়ে সুইপ করতে গেল নয়ন, ব্যাটের কানায় লেগে বলটি কিপারের মাথার উপর দিয়ে পেছনের দিকে চলে গেল। শর্ট ফাইন লেগে দাঁড়ানো তন্ময় দৌড়ে ফিল্ডিং করার আগেই ২ রান হয়ে গেল।

১২ বলে ২৬ রান লাগবে!
ওদের হাতে আছে টুটুল ভাই এর এক লাইফ, অর্থাৎ ১ উইকেট।

এবার বল করতে আসলেন দীপ্তদা। এরপরের ব্যাটসম্যান ছিলেন তিনি, প্যাড-আপ করে ফেলেছিলেন। রোমাঞ্চের গন্ধ পেয়ে প্যাড খুলে বোলিং করতে চলে এসেছেন।

অতি আবেগের বশেই কি না কে জানে, প্রথম বলটি ফুলটস হয়ে গেল। টুটুল ভাই আবার সজোরে হাঁকালেন, এবারে আগের চেয়েও জোরে। বল সোজা আগের গার্ড বরাবর যেতে লাগলে। গড়িয়ে চলার পথে ঠিক গার্ডের সামনে থাকা গিয়ে কোন ইটের টুকরো বা ঘাসের কোণায় লেগে হঠাৎ করে লাফিয়ে উঠল এবং পশ্চাৎদেশে গিয়ে লাগল! ব্যাঙের মতন লাফ দিয়ে উঠল লোকটি! মাঠের সবাই হো হো করে হেসে উঠল। সুনীলদা চুপ করাতে গিয়েও ব্যর্থ হলেন। এমন দৃশ্য দেখে হাসি থামানো আসলেই কঠিন কাজ।

বল হাতে সেই ‘ব্যাঙ গার্ড’ এবং বিশাল মোচওয়ালা আরেকজন এগিয়ে এল। ঝামেলা হতে যাচ্ছে দেখে সুনীলদাও এগিয়ে গেলেন। প্রথমেই ‘ব্যাঙ’ মুখ খুলল,
-সালে বাঙ্গাল কো আওলাদ…
-এই ব্যাটা, মুখ সামলায়ে কথা বল! টুটুল ভাই হাতের ব্যাট উঁচিয়ে বললেন।

গার্ড মনে হয় একটু থতমত খেয়ে গেল। এরকম জবাব আশা করে নি। পাশের গার্ড ভাঙ্গা বাংলায় বলে উঠল,
-বল তুম জান বুঝকে মেরেছ, তাই না?

এবার সুনীলদা কথা বললেন,
-কি বলছেন এসব? জেনে-শুনে কেন মারতে যাবে?
-তো ফের পরপর দোবার লাগলো কেমন করিয়া? ও ভি একজন আদমির গায়েই?
-এটা কাকতাল ছাড়া আর কিছুই নয়। এভাবে জেনে-শুনে কেউ যদি লাগাতে পারে, তাকে আমি ১ লাখ টাকা পুরষ্কার দেব। এটা তো মাজিদ খান বা মুশতাক মোহাম্মদও পারবে না!
-ইয়ে লোগ কন হে?
-বল কি? জাতীয় দলের ক্রিকেটারদেরকে চেন না। এরা তো তোমাদের পশ্চিম পাকিস্তানেরই।
-জো ভি হে, তোমাদের খেলা বান্‌ধ কর। আজ অর কোয়ি খেলা হবি না।
-ফাজলামি নাকি? সার্কিট হাউজের মাঠে খেলা আমরা খেলতে পারব না??
-জ্বি হা। হামারা অফিসারদের মিটিং চালরাহাহে। আগার তোমরা চাও, ওদের ডেকে আনতে পারি।

সুনীলদা ওদিকে তাকিয়ে দেখলেন আরও কয়েকজন গার্ড এগিয়ে আসছে। সবাই সশস্ত্র!
-ঠিক আছে। আমরা চলে যাচ্ছি। সুনীলদা থমথমে মুখে জানালেন।
-সুনীলদা! কি বলছ এসব?? টুটুল ভাই, শাহিন ভাই, দীপ্তদা সহ সবাই একসাথে চিৎকার করে উঠল।
-যা বলছি, শোন। চল, সবাই জিনিস-পত্র গুছিয়ে নিয়ে ক্লাবে যাই। ওখানেই কথা হবে।

ব্যাঙ আর মোচুয়া ওদের পোস্টে ফিরে গেল।

নিরস বদনে সবাই গুছিয়ে নিয়ে ক্লাবের দিকে চলল। এর মাঝেও কাইয়ুম মজা করতে ছাড়ল না।
-তাহলে সুনীলদা, টুটুল ভাই আজকে জিতল নাকি হারলো?

সবাই এক চোট হেসে উঠল। থমথমে পরিস্থিতি কিছুটা হলেও হালকা হল। তবে, দীপ্তদা এখনো রেগে আছে।
-ভগবানের কিরে শালাদের যদি বোম মেরে উড়িয়ে না দিয়েছি!!
-চুপ কর, একদম চুপ! সুনীলদা ধমকে উঠলেন। তুই নিজেও মরবি, আমাদেরও মারবি! দেশের পরিস্থিতি এখন কতটা খারাপ তোদের কোন আন্দাজ আছে? ওদের সাথে ঝামেলা করতে গেলে গুলি মেরেও বসতে পারে, জানিস?
-গুলি মারবে? এতই সোজা!
-জ্বি, এতই সোজা। দেশের তো কোন খোঁজ রাখিস না, তাই এত অবাক হচ্ছিস। এরচেয়ে ছোট কারণেও ওরা গুলি চালিয়েছে…
-তাই বলে এসব মেনে নেব? শাহিন ভাই বললেন।
-টুকু মামাকে বলে দেখবো নাকি? নয়ন ছোট্ট করে জিজ্ঞাসা করল।
-টুকু তোর মামা? সুনীলদা কিছুটা অবাক হলেন মনে হল।
-হ্যাঁ, আপন না অবশ্য…দূর সম্পর্কের মামা।
-খবরদার ওকে কিছু বলতে যাবি না। যে মাথা গরম লোক, গার্ডদের মারতে চলে যেতে পারে। পরে বড় গ্যাঞ্জাম তৈরি হবে। এরচেয়ে বরং আজকে কারও কিছু করার দরকার নেই। খুলনার ডিসি সাহেব আমার পরিচিত। আমি কালকে গিয়ে তার সাথে দেখা করে সব খুলে বলব। আশা করি, তিনি সুন্দর একটি সমাধান করতে পারবেন।
-তারমানে, আমাদের প্র্যাকটিস আপাতত বন্ধ? অনিক মুখ কালো করে জিজ্ঞাসা করল।
-বন্ধ হবে কেন। তবে আগামী কিছুদিন আমরা শুধু ফিল্ডিং এবং বোলিং প্র্যাকটিস করব। সাউথ সেন্ট্রাল রোডে একটি ছোট মাঠ আছে না? ওখানে খোঁজ নিস তো…আপাতত ওখানেই প্র্যাকটিস করা যাবে।

ভারাক্রান্ত মনে সবাই ক্লাবের দিকে এগিয়ে গেল।

৫।

ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১

আজ যশোর জাগরণী ক্রীড়া চক্রের সাথে অনিকদের রয়েল বেঙ্গল ক্রিকেট ক্লাবের প্রীতি ম্যাচটি হবে। জিলা স্কুলের মাঠে সবাই সমবেত হয়েছে। দেখা গেল অনেক উৎসুক দর্শকও হাজির হয়েছে। ছুটির দিন বলে ছেলে-বুড়ো অনেককেই দেখা গেল। গতকালই চুন দিয়ে গোল করে মাঠের সীমানা, পপিং ক্রিজ, ওয়াইড মার্ক ইত্যাদি ঠিক করে রাখা হয়েছে। আজকে সীমানা বরাবর ছোট ছোট কিছু রঙ্গিন পতাকাও পোতা হল। যাতে করে দূর থেকেও ভাল করে সীমানা বোঝা যায়।

জিলা স্কুলের স্কোর বোর্ডটা ধার করে নিয়ে আসা হয়েছে। ছোট ক্লাসের কয়েকজন ছাত্র আগ্রহভরে সেটার পাশে বসে আছে। ওরাই বোর্ডটা নিয়ন্ত্রণ করবে। সীমানার এক পাশে সামিয়ানাও টাঙ্গানো হয়েছে। সেখানে বেশ কিছু স্টিলের চেয়ার রাখা, গণ্যমান্য কেউ আসলে এখানেই বসে খেলা উপভোগ করতে পারবে।

আজকের ম্যাচের দুজন আম্পায়ারই বেশ অভিজ্ঞ। মঞ্জুরুল ইসলাম এবং আল মাসুদ। দুজনেরই দ্বিতীয় শ্রেণির ক্রিকেট পরিচালনা করার অভিজ্ঞতা আছে।

শুরুতেই দুই আম্পায়ার এবং দুই দলের ক্যাপ্টেনের উপস্থিতিতে টস হয়ে গেল। ওদের দলের ক্যাপ্টেনের নাম ফাহিম। সুনীলদা আগের দিন যে দুইজন দারুণ ব্যাটসম্যানের কথা বলেছিলেন, ফাহিম তাদের একজন। অন্যজনের নাম বিকাশ দাশ।

ফাহিম টসে জিতে প্রথমেই ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নিলো। আগেই ঠিক হয়েছে যে ৩৫ ওভারের খেলা হবে। একেকজন বোলার সর্বোচ্চ ৭ ওভার বল করতে পারবে। দুই ইনিংসের মধ্যে ৩০ মিনিটের বিরতি দেয়া হবে।

দর্শকদের তুমুল করতালির মধ্যে অনিকরা মাঠে প্রবেশ করল। অল্প সময়ের মধ্যে সবাই যার যার ফিল্ডিং পজিশনে পৌঁছে গেল। সুনীলদার কথা মত অনিক পয়েন্টে দাঁড়াল। সবাই নিজ নিজ জায়গায় কয়েকবার লাফিয়ে শরীরের জড়তা কাটাবার চেষ্টা করল। শীতের সকাল বলে এখনো বেশ ঠাণ্ডা রয়েছে।

এরই মাঝে ওদের দুই উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান এবং দুই আম্পায়ারও মাঠে প্রবেশ করলেন। দেখা গেল, জাগরণী ক্রীড়া চক্রের ক্যাপ্টেন ফাহিম উদ্বোধনী ব্যাটসম্যানদের একজন। দ্রুত দুই ব্যাটসম্যান দুই প্রান্তে দাঁড়িয়ে গার্ড নিয়ে নিলো।

খেলা শুরু হয়ে গেল।

প্রথম ৬ ওভারে শারেক এবং টুটুল ভাই দারুণ বল করলেন। ৬ ওভার শেষে ওদের স্কোর ২২/১। ফাহিম এখনো অপরাজিত থাকলেও অপরজন আউট হয়ে গেছে। এখন নেমেছে বিকাশ। অর্থাৎ ওদের দলের দুই সেরা ব্যাটসম্যান এখন ক্রিজে!

শাহিন ভাই বোলার বদল করলেন। কিন্তু, পরের ৫ ওভারে সুমন এবং দীপ্তদা চাপ ধরে রাখতে পারল না। উলটো বেশ কয়েকটি বাজে বল করল। ফলে ফাহিম এবং বিকাশ বেশ চড়াও হয়ে খেলা শুরু করল। সুনীলদা ঠিকই বলেছিলেন, এরা দুজনেই চমৎকার ব্যাটসম্যান। মাঠের চারিদিকে শট খেলে দর্শকদের মাতিয়ে তুলল। ১১ ওভার শেষে ওদের স্কোর হল ৬২/১!

অবশেষে শাহিন ভাই আক্রমণে স্পিনার আনা সিদ্ধান্ত নিলেন। অনিক বল করার জন্য নিজের রান আপ মেপে নিলো। প্রথম বলটি কিছুটা ফ্লাইট দিয়ে করল। অফের বেশ বাইরে পড়ে আরও বাঁক খেয়ে বেরিয়ে গেল। ওয়াইড!
পেছন থেকে কিপার কাইয়ুম উৎসাহ দিল,
-কাম অন, অনিক। সেই বলটা কর…

এবারের বলটি বেশ ভাল হল। ফাহিম পা নিয়ে রক্ষণাত্মক ভঙ্গিতে খেলল। পরের বল অফ স্ট্যাম্পের উপর কিছুটা ফুল লেন্থের ছিল, পা নিয়ে দারুণ ভাবে স্কয়ার ড্রাইভ করে চার মারল ও। অসাধারণ শট! পরের দুই বলও অনিক একই জায়গায় করল এবং একই পরিণতি হল! অর্থাৎ টানা তিনটি চার! উপস্থিত দর্শকরা চুপ হয়ে গেছে! শাহিন ভাই কিছুটা এগিয়ে এসে অনিকের সাথে কথা বললেন,
-কি রে? এরকম হচ্ছে কেন?
-ইচ্ছে করে এমন করছি!! ফিসফিস করে জানাল অনিক!

শাহিন ভাই প্রথমে কিছুটা অবাক হলেন। পরে মুচকি হেসে নিজের জায়গায় ফেরত গেলেন।
-কাম অন বয়েজ, এটাক! চিৎকার করে শাহিন ভাই সবাইকে চাঙ্গা করার চেষ্টা করলেন।

অনিক আবার একই জায়গায় বল ফেলল, তবে এবারের ডেলিভারিটি গুগলি করল। ফাহিম আবার পা নিয়ে ড্রাইভ করতে গেল। কিন্তু বলটি বাঁক নিয়ে এবার ভেতরে ঢুকল, ক্লিন বোল্ড!!
-ইয়েস!!! অমানুষিক চিৎকার করে উঠল অনিক।

ওদিকে ফাহিম কিছুটা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। অনিক ওকে ফাঁদে ফেলে এভাবে বোকা বানাবে কল্পনাও করে নি! মাথা নিচু করে প্যাভিলিওনের দিকে হাঁটা ধরল।

উপস্থিত সবাই যেন আনন্দে ফেটে পড়ল। সব খেলোয়াড় দৌড়ে এসে অনিককে জড়িয়ে ধরল। কাইয়ুম তো প্রায় ওর গায়ের উপর চড়েই বসল। ভার সইতে না পেরে দুজনেই মাটিতে পড়ে গেল!

এরপর ঐ ওভারে আর কোন রান হল না। পরের ব্যাটসম্যান সব বল ঠেকিয়ে দিয়ে ওভারটা শেষ করে দিল। এবার অন্য প্রান্তে লেফট আর্ম স্পিনার হাসান বল করতে এল। দেখা গেল বিকাশও এখন আর আক্রমণাত্মক খেলা খেলছে না, দেখে শুনে এক-দুই করে রান নিতে শুরু করল।

সাবধানে খেলার পরেও ওদের নিয়মিত উইকেট পড়তে থাকল। চাপ ধরে রাখার জন্য অনিক এবং হাসান টানা বল করতে লাগল। এক প্রান্তে বিকাশ রয়ে গেলেও উইকেট পড়তে থাকায় সে-ও বেশি সুবিধে করতে পারছিল না। ২৩ ওভার শেষে ওদের সংগ্রহ হল ১০৯/৬, বিকাশ ৩৬*। ইতোমধ্যে অনিক আরও ৩ টি উইকেট নিয়েছে, হাসান ১ টি এবং অন্যটি রান আউট। শাহিন ভাই এর সরাসরি থ্রো’তে ওদের আলম নামের একজন ব্যাটসম্যান রান আউট হয়েছে।

দলের ২৪ তম এবং নিজের শেষ ওভার করার জন্য এগিয়ে গেল অনিক। স্ট্রাইকে শামীম নামের একজন কমবয়সী খেলোয়াড়। বল করার আগে আলতো করে অনিক নিজের কানের লতি চুলকে নিলো। উইকেট কিপার কাইয়ুম বুঝতে পারল এবার ‘আগুন’ আসছে! অনিকের কাঁধে অনেক জোর বলে ও অল্প রান আপেই বেশ দ্রুতগতির বল করতে পারে। স্পিনারদের মধ্যে এরকম কুইকার আর কেউ দেয় বলে ওদের জানা নেই। কাইয়ুম মজা করে এই বলের নাম দিয়েছে আগুন! ছোট্ট করে লাফ দিয়ে অনিক আগুন ছাড়ল। ব্যাটসম্যান কিছু বুঝে ওঠার আগেই বলটি অফ স্ট্যাম্প গুঁড়িয়ে দিল। বোল্ড! আবার উইকেট, আবার উল্লাস, আবারও দর্শকের হর্ষ ধ্বনি!

নবম ব্যাটসম্যান নেমে ওকে খেলার কোন চেষ্টাই করল না। সব বল নিচু হয়ে ব্যাট দিয়ে ঠেকিয়ে দিল। বোঝা গেল অনিকের শেষ ওভারটা ওরা পার করতে পারলেই বাঁচে!

শেষ পর্যন্ত অনিকের বোলিং বিশ্লেষণ হল ৭-১-২৯-৪ উইকেট! নিঃসন্দেহে দলের সেরা বোলিং নৈপুণ্য!

পরের ওভারে হাসানেরও কোটা শেষ হয়ে গেল। ফলে, শাহিন ভাই আবার পেস বোলারদের আক্রমণে নিয়ে আসলেন। এবারে সুমন, দীপ্তদা সহ সবাই বেশ ভাল বল করতে লাগল। ফলে স্লগ ওভারে ওরা তেমন রানের গতি বাড়াতে পারল না। শেষের দিকে বিকাশ কিছু বাউন্ডারি মেরে আপ্রাণ চেষ্টা করলেও সঙ্গীর অভাবে শেষ পর্যন্ত খেলতে পারল না। জাগরণী ক্রীড়া চক্র ৩৩.৫ ওভারে ১৪৩ রানে অল আউট হয়ে গেল। ওদের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান বিকাশ শেষ পর্যন্ত ৫৬ রানে অপরাজিত ছিল।

সুনীলদাকে দেখা গেল বেশ খুশি হয়ে আছেন। বোঝাই যাচ্ছে ছাত্রদের নৈপুণ্যে তিনি বেশ সন্তুষ্ট হয়েছেন। অনিকসহ সবাইকে অভিনন্দন জানালেন। যশোর দলের কোচ নাহিদ স্যারও ওদের অনেক প্রশংসা করলেন, বিশেষ করে অনিকের। ওর বোলিং এর মান নাকি অনেক উঁচু পর্যায়ের, ভবিষ্যতে অনেক নাম করবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করলেন।

যাই হোক, অনিকদের লক্ষ্য ৩৫ ওভারে ১৪৪। সবকিছু চিন্তা করলে লক্ষ্য তেমন কঠিন নয়। তবে গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা ক্রিকেট, আগ বাড়িয়ে কিছুই বলা যায় না!

৬।

ঠিক ৩৫ মিনিট পর রয়েল বেঙ্গল ক্লাবের দুই উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান ফয়সাল এবং শোভন মাঠে প্রবেশ করল। বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়গণ আগে থেকেই যার যার অবস্থানে চলে গিয়েছিল বলে খেলা শুরু হতে দেরি হল না।

প্রথম ৫ ওভার দুইজনে বেশ দেখে-শুনে খেলে ১৫ রান তুলল। ৬ষ্ঠ ওভারে গিয়ে ধৈর্য্য হারিয়ে তুলে মারতে গিয়ে শোভন আউট হয়ে গেল। এবার নামলেন ওদের সেরা ব্যাটসম্যান শাহিন ভাই। প্রথম তিন বলে পরপর তিনটি চার মেরে বুঝিয়ে দিলেন কেন তাকে দলের সেরা ব্যাটসম্যান বলা হয়। একই সাথে ওদের রান তোলার গতিও বেড়ে গেল।

এই জুটি দলীয় রান ৫৮ রান পর্যন্ত নিয়ে গেল। অফ স্পিনারের বলে হাঁটু গেড়ে সুইপ করতে গিয়ে ব্যাটে-বলে করতে না পেরে ফয়সাল এল.বি.ডব্লিউ আউট হল। অর্থাৎ, এখন পর্যন্ত যে দুই উইকেটের পতন হল তা পুরোপুরি ব্যাটসম্যানদের নিজের দোষেই! সুনীলদা প্যাভিলিয়নে বসে কিছুটা উষ্মা প্রকাশ করলেন।

২০ ওভার শেষে ওদের সংগ্রহ দাঁড়াল ৮৫/২। জেতার জন্য আরও লাগবে ৫৯ রান। হাতে আছে ১৫ ওভার এবং ৮ উইকেট। মনে হচ্ছিল জয়টা অনেক সহজ ভাবেই হবে, কিন্তু হঠাৎ করে যেন উইকেটে মড়ক লাগল। নয়ন, কাইয়ুম এবং টুটুল ভাই মাত্র ১৫ রানের মধ্যে আউট হয়ে গেলেন! দেখতে দেখতে স্কোর হয়ে গেল ১০০/৫!

এবার অনিক মাঠে নামল। দলের শেষ নির্ভরযোগ্য জুটি ওরা। অনিকের পর থেকে জেনুইন বোলার শুরু। অবশ্য হাসানকে পুরোপুরি টেলএন্ডার বলা ঠিক হবে না, দলের প্রয়োজনে উইকেট ধরে রাখতে কিংবা হাত খুলে মারতেও পারে। তবুও পরের ব্যাটসম্যানদের ভরসায় থাকলে জেতা কঠিন হয়ে যাবে। যা করার শাহিন এবং অনিককেই করতে হবে।

ক্রিজে নামার সাথে সাথেই শাহিন ভাই এগিয়ে আসলেন,
-অনিক আর যাই করিস, প্লিজ, উইকেট থ্রো করিস না।
-ঠিক আছে, শাহিন ভাই।
-ওদের বল ভাল হচ্ছে, কিন্তু মারাত্মক কিছু হচ্ছে না। প্রথমে একটু দেখে খেল। আর হ্যাঁ, বল একটু নিচু হয়ে যেতে পারে। এই ব্যাপারটা মাথায় রাখিস।
-আচ্ছা।

আম্পায়ার স্যারের কাছ থেকে মিডল স্ট্যাম্প গার্ড চেয়ে নিলো অনিক। চারিদিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল ফিল্ডারগণ কে কোথায় আছে। এবার কিছুক্ষণ ক্রিজে দাঁড়িয়ে হালকা শ্যাডো করল, উইকেট নিজের সাথে দ্রুত মানিয়ে নেবার জন্য এটা বেশ কাজের। তাছাড়া এতে করে চোখও সুর্যের আলোর সাথে মানিয়ে নিতে সক্ষম হয়।

অনিক স্ট্রাইকে আছে। বিপক্ষ দলের পেসার বিশালদেহী আলমগীর। পরপর দুই ওভারে দুই উইকেট নিয়ে আত্মবিশ্বাসের তুঙ্গে আছে। লম্বা রান আপ নিয়ে দৌড়ে এসে বল করল। দারুণ বল! একেবারে ইয়র্কার লেন্থে ছিল, অনিক কোন মতে ব্যাট নামিয়ে বলটি ঠেকালো! আরেকটু হলেই সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছিল! হার্টবিট অনেক দ্রুত হয়ে গেছে। বড় বড় নিঃশ্বাস নিয়ে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করল। ওদিকে শাহিন ভাই অনবরত জোরে জোরে কথা বলে ওকে আশ্বাস এবং অভয় দিয়ে চলেছেন।
-টেক ইট ইজি, অনিক। কোন ব্যাপার না…

পরের বলটি গুড লেন্থে ছিল। এবার বেশ দৃঢ়তার সাথে রক্ষণাত্মক শট খেলল। উপস্থিত দর্শকও অনবরত হাত-তালি দিয়ে ওদের সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে নিজের উপর আস্থা বেড়ে গেল ওর। এবারের বলটি লেগ স্ট্যাম্পের উপর হাফ ভলি পেয়ে অন ড্রাইভ করে সীমানা ছাড়া করল। দর্শনীয় বাউন্ডারি। ওভার শেষ!

ওভার শেষে শাহিন ভাই ওর দিকে এগিয়ে আসলেন।
-সাবাস ব্যাট! এভাবে খেলে যা। বেশি রক্ষণাত্মক বা আক্রমণাত্মক, কোনটাই খেলার দরকার নেই। বল অনুযায়ী খেলবি। আমি এক সাইড ধরে রাখছি। আর বেশি রান বাকি নেই…

আড় চোখে স্কোর বোর্ডের দিকে তাকিয়ে দেখল আর মাত্র ৪০ রান দরকার।
১০ ওভার হাতে আছে!

পরবর্তী ৬ ওভারে জাগরনী ক্রীড়া চক্র ওদের উপর নানাভাবে চেপে ধরার চেষ্টা করল। অনবরত বোলিং চেঞ্জ করল, ৭ জন ফিল্ডারকে ৩০ গজ দাগের মধ্যে এনে আক্রমণাত্মক খেলার চেষ্টা করল। কিন্তু কিছুতেই অনিক এবং শাহিনের রক্ষণব্যুহ ভাঙ্গতে পারল না। ইতোমধ্যে শাহিন ভাই এর অর্ধ শত পূরণ হয়ে গেছে।

ওদের জন্য সবকিছুই মসৃণ গতিতে চলছিল। কিন্তু, ৩.৩ ওভারে ১৩ রান লাগবে এরকম অবস্থায় একটি দুর্ঘটনা ঘটে গেল! ডিপ মিড উইকেটে বল মেরে দুই রান নেবার জন্য বলেছিলেন শাহিন ভাই, কিন্তু দ্বিতীয় রান নেবার সময় পিচের পাশের ঘাসে পা পিছলে ভারসাম্য হারিয়ে ফেললেন! মাঠের সবাই হায় হায় করে উঠল। অনিক কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। দেখতে পেল ইতোমধ্যে ফিল্ডার বল থ্রো করে শাহিন ভাই যেদিকে যাচ্ছেন সেদিকে মেরেছে। ক্ষণিকের সিদ্ধান্তহীনতায় না থেমেই ও দৌড়তে লাগল। অথচ শাহিন ভাইকে অতিক্রম না করে নিজের প্রান্তে ফিরে যাবার চেষ্টা করলে ও নিজে আউট হলেও শাহিন ভাই এর উইকেট বেঁচে যেত। যতক্ষণে এই ব্যাপারটি মাথায় এসেছে ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। ওদিকে শাহিন ভাই প্রাণপণ চেষ্টা করে বিশাল লাফ দিয়ে ক্রিজে পৌঁছবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু তার আগেই ফিল্ডার উইকেট ভেঙ্গে দিল। আম্পায়ার আঙ্গুল উঁচিয়ে আউট দেখালেন। শাহিন ভাই ৬৩ রান করে রান আউট হয়ে গেলেন!

জাগরনী ক্রীড়া চক্রের সবাই যেন আনন্দে দিশেহারা হয়ে গেল। শাহিন ভাই এর উইকেট পতনে ম্যাচ যে ওদের দিকে হেলে পড়েছে- এটা ওরাও বুঝতে পেরেছে। অনিক এগিয়ে গিয়ে শাহিনকে বলল,
-ভাই, আই এম সো স্যরি! আমার উইকেট স্যাক্রিফাইস করা উচিত ছিল…
-ঝামেলা হয়ে গেল রে, অনিক…তবে, তুই কিন্তু হাল ছাড়িস না। ম্যাচ বের করে তবেই ফিরবি।
-আমি জান-প্রাণ দিয়ে চেষ্টা করব, শাহিন ভাই!

ধীর পায়ে শাহিন ভাই মাঠের বাইরে চলে গেলেন। দেখেই বোঝা যাচ্ছে অনেক মুষরে পড়েছেন। দলের বাকি সবারও একই অবস্থা। এদিকে প্রায় একই সাথে পরবর্তী ব্যাটসম্যান হিসেবে হাসান মাঠে প্রবেশ করল।

-হাসান, তুই আর আমি মিলে ম্যাচ শেষ করব, ঠিক আছে?
-ঠিক আছে। মুখে বললেও হাসানকে তেমন আত্মবিশ্বাসী মনে হল না।

২০ বলে ১২ রান লাগবে! হাতে আছে ৩ উইকেট।

অনিক স্ট্রাইকে আছে বলে ফিল্ডাররা ছড়িয়ে পড়ল। স্ট্যাম্পের উপর গুড লেন্থের বল পেয়ে আলতো করে ঠেকিয়ে এক রান নিয়ে ও নন স্ট্রাইকে চলে গেল। হাসান বাম হাতে ব্যাট করবে বলে ফিল্ডারদের অবস্থানে পরিবর্তন হল। সবাই ওকে ঘিরে ধরেছে। অনিক চিন্তায় পড়ে গেল-‘হাসান মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পারবে তো?’ ওকে ডেকে ঠেকানোর ইশারা করে বুঝিয়ে দিল যে শেষ বলে কোন ঝুঁকি যেন না নেয়। হাসানও মাথে নেড়ে সায় দিল।

কিন্তু অফ স্ট্যাম্পের অনেক বাইরে পড়া বল দেখে ওর মাথা খারাপ হয়ে গেল! সজোরে ব্যাট চালালো। ব্যাটের কানায় লিগে বল সরাসরি স্লিপে দাঁড়ানো ফিল্ডারের হাতে! আউট! সপ্তম উইকেটের পতন। মাঠের বাইরে যেন পিনপতন নিরবতা নেমে এল। শুধু ফিল্ডারদের উল্লাস ধ্বনি শোনা যাচ্ছে।

এবার নামল সুমন। ওর উপর কোন ভরসা নেই, মাথা গরম ছেলে। বল ঠেকাতে জানে না, দেখলেই মারতে যায়। কি হবে?-চিন্তা করতে লাগল অনিক। ১৮ বলে ১১ রান এমনিতে অনেক সহজ লক্ষ্য, কিন্তু ম্যাচ এমন অবস্থানে চলে এসেছে যে কি হবে বলা মুশকিল! তবে, সুবিধে হচ্ছে ও স্ট্রাইকে থাকবে।

মাথা ঝাঁকিয়ে সব চিন্তা দূর করার চেষ্টা করল। বল করতে আসছে ওদের স্ট্রাইক বোলার সাদিক। শুরুর স্পেলে তেমন ভাল করতে না পারলেও গত কয়েক ওভারে বেশ ভাল কাম-ব্যাক করেছে। দৌড়ে এসে বল করল সে। প্রথম দুই বলে কোন রান হল না। গুড লেন্থের বল ছিল বলে অনিক রক্ষণাত্মক ভঙ্গিতে খেলল।

এবারে সাদিক তৃতীয় বলটি করল। অফ স্ট্যাম্পের বাইরে ছিল। ব্যাটের ফেস ওপেন করে পয়েন্ট এবং থার্ড ম্যানের মাঝে দিয়ে বলটা মারল। চার না হলেও সীমানা থেকে বল ফেরত পাঠাবার আগেই ওরা দুই রান নিতে সক্ষম হল। ১৫ বলে ৯ রান। দর্শকদের সবাই এখন দাঁড়িয়ে গেছে, একজনও বসে নেই!

৪র্থ বলটি লেগ স্ট্যাম্পের উপর ছিল। ফ্লিক করে চার মারার আশায় অনিক ব্যাট চালালো, কিন্তু তাড়াহুড়ায় ব্যাটে না লেগে প্যাডে লাগল। দৌড়ে এক রান নিলো। আম্পায়ার পা তুলে লেগ বাই এর ইশারা করে দেখালেন। অনিক সামনে এগিয়ে সুমনকে বলল,
-দোস্ত, তোর দোহাই লাগে। মাথা গরম করিস না। এই দুই বল ঠেকিয়ে দে…
-আরে ব্যাটা, চিন্তা করিস না। আমি কি বুঝি না নাকি? হ্যাঁ!

৫ম বলটি ইয়র্কার করল সাদিক। সুমন চেষ্টা করেও ব্যাটে লাগাতে পারল না। আসলে ওর জন্য একটু বেশিই ভাল বল হয়ে গেছে! জোরালো আবেদন করল সবাই। আম্পায়ার কিছুক্ষণ চিন্তা করে আবেদন নাকচ করে দিলেন। অনিক বুঝতে পারল কোন মতে বেঁচে গেছে সুমন, আম্পায়ার ওকে বেনিফিট অব ডাউট দিয়েছেন। এতক্ষণ ধরে চেপে রাখা নিঃশ্বাসটা সশব্দে ছাড়ল ও।

ওভারের শেষ বলে আবারও ইয়র্কার করার চেষ্টা করল সাদিক। সব ভুলে সুমন সজোরে ব্যাট চালালো, কিন্তু বলে লাগাতে পারল না। আবারও ফিল্ডারদের জোরালো আপিল শোনা গেল। এবার আর আম্পায়ার সময় নিলেন না। আঙ্গুল তুলে সুমনকে আউট ঘোষণা করলেন। আবারও ম্যাচ কঠিন হয়ে গেল!

১২ বলে ৮ রান লাগবে। হাতে উইকেট মাত্র ২ টি!

অনিক সিদ্ধান্ত নিলো যা করার এই ওভারেই করতে হবে, শেষ ওভারের জন্য বসে থাকলে চলবে না। এদিকে অন্য প্রান্তে থাকা শারেকের উপরও ভরসা করা যাচ্ছে না, অর্থাৎ যা করার নিজেকেই করতে হবে! দেখতে পেল ৩৪ তম ওভারটি করতে আলমগীর এগিয়ে আসছে। ওর বলের গতিকে কাজে লাগাতে হবে, মনে মনে ভাবল ও।

প্রথম বলেই অনিকের বুক বরাবর বাউন্সার দিল আলমগীর। অনিক সজোরে পুল করতে গেল, কিন্তু ব্যাটের মাঝে না লেগে কানায় লেগে উইকেট কিপারের মাথার উপর দিয়ে সীমানার বাইরে চলে গেল। চার রান। অর্থাৎ ১১ বলে আর মাত্র ৪ রান লাগবে।

প্রতিপক্ষের দলনেতা ওদের সব ফিল্ডারকে পুরোপুরি ছড়িয়ে দিয়েছে। ওরা চাইছে অনিক যাতে এক রান নিয়ে নন-স্ট্রাইকে চলে যায়। কিন্তু অনিক ঠিক করে রেখেছে কিছুতেই এক রান নেবে না। দ্বিতীয় বলটি স্লোয়ার ছিল। শেষ মুহূর্তে সেটা বুঝতে পেরে আলতো করে লেগের দিকে ঘুরিয়ে দিল অনিক। শারেক পাগলের মতন দৌড় দিল। ‘নো ও ও’ অনিকের চিৎকার করে না বলাটা অনেক পরে শুনলো। কোন মতে ঘুরে আবার নিজের ক্রিজে ফেরার চেষ্টা করল। ততক্ষণে ফিল্ডার বল থ্রো করে ফেলেছে। অবশ্য ঝাঁপিয়ে পড়ে কোন মতে নিজেকে রক্ষা করল শারেক!

আম্পায়ারের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে অনিক ওর দিকে এগিয়ে গেল,
-কিরে? আমি তো কল দিই নি। তুই দৌড় শুরু করলি কেন?
-স্যরি দোস্ত, মাথা কাজ করছিল না! আর এরকম হবে না, প্রমিজ!
-মনে রাখিস, আমি কল না দিলে তুই ক্রিজ থেকে বের হবি না, ঠিক আছে?
-ঠিক আছে!
-কোন সিঙ্গেল না। হয় দুই রান নেব, নাহলে দৌড়াবোই না। বুঝলি?
-আচ্ছা!

কথা শেষ করে আবার স্ট্রাইকে ফিরে গেল অনিক। সমস্ত চিন্তা বাদ দিয়ে সমস্ত মনযোগ দিয়ে বোলারের দিকে লক্ষ্য করতে লাগল। আলমগীর ততক্ষণে দৌড় শুরু করেছে। আম্পায়ারকে অতিক্রম করে বলটি ছুঁড়ে দিল। সম্ভবত ইয়র্কার করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু লেন্থ ঠিক রাখতে না পেরে ফুলটস হয়ে গেল। অনিক সজোরে ব্যাট চালালো। সময় যেন থেমে গেল। ওর মনে হল স্লো মোশনে সব চলছে! বল মিড উইকেটের দিকে ভেসে যেতে লাগল। শুনতে পেল বোলার সহ সব ফিল্ডার চিৎকার করছে, ক্যা অ্যা অ্যা চ ই ই ই ট…

অনিক চোখ বন্ধ করে ফেলল। ওদিকে শারেক সব ভুলে কল ছাড়াই দৌড় শুরু করেছে…

হঠাৎ করে ধাক্কা খেয়ে অনিকের যেন সম্বিত ফিরল! শারেক ওকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে উঁচু করে ফেলেছে এবং মুখে চিৎকার করছে, অনিক ইউ ডিড ইট। আমরা জিতে গেছি…হুর রে…!!

ভাল করে তাকিয়ে দেখল আম্পায়ার ছক্কার সংকেত দিচ্ছেন! অবশেষে মাথায় ঢুকল যে আসলেই জিতে গেছে!

ততক্ষণে মাঠের বাইরে থাকা সবাই দৌড়ে ভেতরে চলে এসেছে। সবাই মিলে অনিককে ধরে চ্যাংদোলা করে মাথার উপরে উঠিয়ে নিয়েছে। মুখে অনবরত থ্রি চিয়ার্স দিয়ে ওকে নিয়ে একেবারে মাঠের বাইরে থাকা সুনীলদা’র কাছে নিয়ে গেল।

সুনীলদাকে দেখে লাফ দিয়ে নেমে অনিক তাকে জড়িয়ে ধরল! সবাইকে অবাক করে দিয়ে অনিক বলে উঠল,
-সুনীলদা, আই এম সো স্যরি!

সুনীলদা মুচকি হাসি দিলেন।
-তুই নিজেই যখন বুঝতে পেরেছিস যে ভুল করেছিস তাই আর কিছু বলছি না।

দলের সবাই ওদেরকে ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিল। অনেকেই ঘটনা বুঝতে না পেরে একে অন্যের দিকে তাকিয়ে দেখছে! কাইয়ুম তো বলেই বসল,
-সুনীলদা, কাহিনী তো বুঝলাম না…অনিক স্যরি বলছে কেন?
-সেটা বলার আগে তোদের সবাইকে আগে একটি প্রশ্ন করি- আজকের ম্যাচ থেকে কি শিক্ষা পেলি?
-আমরা যে কোন দলকে হারাতে পারি। টুটুল ভাই এর দৃপ্ত উচ্চারণ!
-আমাদের ব্যাটিং নিয়ে আরও কাজ করতে হবে। এবার শাহিন ভাই যোগ্য ক্যাপ্টেনের মতই উত্তর দিলেন।
-শাহিন ভাই এই অঞ্চলের…না না, পুরো পূর্ব পাকিস্তানের সেরা ব্যাটসম্যান এবং আমার দোস্ত অনিক সেরা অলরাউন্ডার। কাইয়ুমও নিজের মতামত জানিয়ে দিল।
-তোদের কারো জবাবই সঠিক নয়। রান তাড়া করার সময় কিংবা শুরুতে ব্যাট করলেও উইকেটে সবসময় সেট ব্যাটসম্যান থাকা সবচেয়ে জরুরী। এজন্য, যদি আজকের মতন এমন কোন পরিস্থিতি হয় যে-কোন একজনকে উইকেট স্যাক্রিফাইস করতে হবে, যেভাবেই হোক সেট হওয়া ব্যাটম্যানের উইকেট বাঁচাতে হবে। অনিকের ঐ সময় উচিত ছিল নিজে রান আউট হয়ে শাহিনের উইকেট বাঁচিয়ে দেয়া। একে তো শাহিন সেট ব্যাটম্যান ছিল, তার উপর দলের ক্যাপ্টেন। মনে রাখবি, দলের ক্যাপ্টেন যদি ব্যাটসম্যান হয়- তার উইকেট সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। শেষের দিকে আমাদের এত কষ্ট করে জেতা লাগল কেন? শাহিন ক্রিজে থাকলে এত সমস্যা হত না। অন্যরাও অনেক আস্থার সাথে খেলতে পারত। বুঝেছিস সবাই? সারা জীবনের জন্য এই কথাগুলো মনে রাখিস!

সবাই মাথা নেড়ে জানালো তারা বুঝতে পেরেছে।

ততক্ষণে জাগরনী ক্রীড়া চক্রের সবাই ওদের কাছাকাছি চলে এসেছে। একে একে সবাই ওদের সাথে হাত মেলাতে শুরু করল। এদিকে দর্শকরাও চলে যেতে শুরু করেছে। সবার মুখে খুশির আভা দেখে বোঝা গেল তারা ম্যাচটি দারুণ উপভগ করেছে। নিঃসন্দেহে এই ম্যাচের কথা তাদের অনেক দিন মনে থাকবে!

৩ টি মন্তব্য : “বলের বদলে গ্রেনেড (৩য় পর্ব)”

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।