‘হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক’-অভিজ্ঞান — (ডঃ অনাথবন্ধু মল্লিক)

ড. অনাথবন্ধু মল্লিক; মাত্র বছর দুয়েক (কিংবা কিছু বেশি) এই অসাধারণ শিক্ষকের সান্নিধ্য লাভ করেছিলাম। স্যার প্রায়শঃ একটা কথা বলতেন যার সারমর্ম ছিলো, “এমন চিন্তা, এমন কাজ করো; যাতে শুধু নিজের নয় অন্যেরো ভালো হয়।” আর তাই হয়তো নানা স্মৃতির ভীড়েও ঘুরেফিরে স্যারের উপদেশটুকু ভেসে ওঠে। তিঁনি একাধারে বাংলার অধ্যাপক, ভাষাবিদ, গবেষক, গীতিকার, সুরকার, সাহিত্যিক এবং নাট্যকার। উদার, নিঃস্বার্থ এবং অসম্ভব ভাষা-প্রেমী এই শিক্ষক খুব রেগে উঠতেন বাংলা বানানের ভুল চোখে পড়লে। সত্যি বলতে উঁনার অভিপ্রায়েই আমার এবং অনেকেরই বানানজ্ঞান যথেষ্ট সমৃদ্ধ হয়েছে; অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। আমাদের ধরে ধরে বাংলা উচ্চারণ শেখাতেন স্যার; সত্যি বলতে তখন কেমন যেন হাসি পেত। কিন্তু এখন বুঝি কত বড় উপকার করেছেন তিনি। স্যার বলতেন, “নিজের ভাষা যদি সঠিকভাবে বলতে না শেখো তবে আর মানুষ হলে কিভাবে!” এই অসম্ভব ভালো মানুষ শিক্ষাগুরুকে ভালো না বেসে; শ্রদ্ধা না করে কোন উপায় নেই।

হঠাৎ করেই ফেসবুকে চোখে পড়লো স্যারের একটা গবেষণামূলক প্রবন্ধের লিঙ্ক। সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতি বিষ্যক মাসিক পত্রিকা কালি ও কলমের নবম প্রকাশনায় (ভলিউম ৬) অক্টোবার ৯ তারিখে প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে। লিঙ্কটা শেয়ার করবার জন্য আসিফ ভাইকে (ঝকক’ ০৬) অসংখ্য ধন্যবাদ। প্রবন্ধটা সবার জন্য শেয়ার করছিঃ

(বি.দ্র.- লেখাটা কি এভাবে ব্লগে প্রকাশ করা যায় (কপিরাইটজনিত কোন কারণে) কি না সে ব্যাপারে সম্যক ধারণা নেই; যদি এটা নিয়ম পরিপন্থী হয়ে থাকে তবে সরিয়ে ফেলবার জন্য অনুরোধ রইলো। সরাসরি লিঙ্ক থেকে কপি করে এখানে পেষ্ট করা হয়েছে, তাই ফন্টজনিত কারণে বানান ভুল চোখে পড়লে জানাবার অনুরোধ রইলো। ধন্যবাদ)

‘হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক’-অভিজ্ঞান (ডঃ অনাথবন্ধু মল্লিক)

ধী-সমুজ্জ্বল সত্যান্বেষী ডক্টর মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান (৬ এপ্রিল ১৯৩৯ – ৩ সেপ্টেম্বর ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দ) কাব্যায়তনে, গীত-বৃত্তায়নে ছিলেন জননন্দিত। শ্রেয়োবোধ-সন্দীপনায় তাঁর অভিনিবেশও ছিল যথার্থ। বাঙালির অন্তর্চারিত্র্যের আলেখ্য-সন্দর্শনের প্রেক্ষাপটে তাঁর সুদৃঢ় অবস্থান ইতিহাস-বিধৃতির ঐশ্বর্যে লালিত।

বোদ্ধার চিন্তাবিভা – বাঙালিমনন মিশ্র সাংস্কৃতিক ঔজ্জ্বল্যের পাথেয়-সংগ্রাহক। দৈনন্দিন অশনবসন্ত তৃষ্ণা হরেক সঞ্চয়নের প্রগতির উচ্ছ্বাস বিভূষিত হয়ে আছে এ-জাতির অন্তর্দর্পণে। শাসক-শোষক-শোষিতের ব্যবহার-বিহারে, প্রথা-সম্পৃক্ত ধর্মায়োজনে, আর্থ-রাজনৈতিক চিত্র-সংশ্লেষণে এমন প্রামাণ্যের সূক্ষ্মসিদ্ধি সরলতা-সন্দীপ্ত।

মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বাঙালি জন-আত্মার সর্বৈব সমৃদ্ধির ফাগুনসৌন্দর্যে বিমোহিত হতে চেয়েছিলেন। তাই হিন্দু-মুসলমানের মৌলিক চারিত্র্য-সংহতির বিন্যাসকে তিনি আত্মস্থ করতে আগ্রহী হন। উল্লেখ্য, মানবীয় জন্মগ্রহণ সমপ্রদায়নিরপেক্ষ। সনাতন হিন্দুর সত্তাসজ্জায় হোক, মুসলমানের সত্তাসজ্জায় হোক, পরিপূর্ণ মনুষ্যত্বের গুণপরাগের সৌগন্ধ্যসম্ভার অপরিবর্তনীয়। বিজ্ঞজনের সত্যায়ন – সনাতন হিন্দুকৃষ্টিসত্য আর ইসলামকৃষ্টিসত্যের যৌক্তিক ও বিশুদ্ধ আচার-অভিনিবেশ মনুষ্যত্বের পূর্ণবিকাশ ও প্রকাশের সমতাপ্রজ্ঞার দিশাস্বরূপ। তবে, দেশকালপাত্রের অসম বিন্যাস – প্রবৃত্তিতাড়িত অস্তিরতা, অপস্বার্থান্ধ সীমাবদ্ধতা কীভাবে দৈনন্দিন জীবনপটে প্রভাব বিস্তার করে এবং অখণ্ড জাতিসত্তার অন্ত:সংবিধান ভঙ্গুর করে দেয়। তার প্রামাণ্য অনুভবস্তরে বাঙ্ময় হওয়া বাঞ্ছনীয়।

দুই মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বিগত ষাটের দশকে বাঙালিসত্তার দ্বিবিধ শৌর্যবর্তনী হিন্দু-মুসলমানের অন্তর্জ্যোতিরুদ্ভাসনার দায়িত্বে সুদৃঢ় হন। আধুনিক কাব্যায়তনিক পরিসরে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের রূপশ্রী অন্বেষণে ব্রতী হন। তাঁর ধ্যানসম্পন্ন গবেষণাগ্রন্থ আধুনিক বাংলা কাব্যে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের (১৮৫৭-১৯২০ খ্রি.) [প্রথম প্রকাশ, ঢাকা, বাংলা একাডেমী, ১৯৭০] অন্ত:শ্রীপটে মুখবন্ধ, অবতরণিকা ও ভূমিকাসহ চারটি পরিচ্ছেদের কারুকাজ।

অবতরণিকায় মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের ঋজু কথকতার সঞ্চারণা। ১৮৫৭ থেকে ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত আধুনিক বাংলা কাব্যে বর্ণিত হিন্দু-মুসলমান সমপ্রদায়ের ঐতিহাসিক সম্পর্কের আনুপূর্বিক চিত্রদীপ্তি ধারণ করে আছে গ্রন্থটি। মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান যথাযথই উল্লেখ করেছেন :

ক. সমাজজীবনে এ-সম্পর্কে যেমন দ্বিধায় ও দ্বন্দ্বে, সৌহার্দ্যে ও সন্দেহে চিহ্নিত, সাহিত্যেও তেমনি তা ঘৃণায়, বিদ্বেষে, প্রীতিতে ও প্রত্যাখ্যানে সমন্বিত। (অবতরণিকা, পৃ ৩)
খ. আধুনিক বাংলা কাব্যে আধুনিকতার প্রধান প্রধান গুণ – দেশাত্মবোধ, ইতিহাস-চেতনা, সমাজ-সচেতনতা, মানবতাবোধ প্রভৃতি – সমাজজীবনে জটিলতাপ্রাপ্ত হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের দ্বন্দ্বে অভিনব শক্তিতে ও দুর্বলতায় চিহ্নিত। আধুনিক বাংলা কাব্যের এই বৈশিষ্ট্যের পরিচ্ছন্ন উন্মোচন ও বিশ্লেষণ বর্তমান গবেষণার বিশেষ লক্ষ্য। (ওই, পৃ ৪) যুক্তিনিষ্ঠ চারুবাক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ভূমিকায় ঐতিহাসিক সত্যের ঔজ্জ্বল্য সমৃদ্ধ করেছেন। তিনি ত্রয়োদশ শতকের বর্ণাশ্রমপীড়িত অনুজ হিন্দুজনগোষ্ঠীর গভীর-গহন অন্তরাত্মার আলেখ্য অঙ্কন করেছেন। উচ্চবর্ণের হিন্দুশ্রেণি কর্তৃক নিপীড়িত নিম্নবর্গের হিন্দুদের ইসলাম-বরণের সংবাদ পরিবেশন করেছেন। সুদীর্ঘকাল একত্রে বসবাস-হেতু পারস্পরিক অন্তরবিভূষণা, সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণ সুবদ্ধ হয়েছে। মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের পর্যবেক্ষণ :

ক. ১৭৫৭ খ্রি. থেকে ১৮৫৭ খ্রি. – কোম্পানি শাসনের এই একশ বছর – লুণ্ঠন ও উৎপীড়নের কাহিনী। (ওই, পৃ ১৪)
খ. হিন্দু-মুসলমান … জনসাধারণের সমর্থনপুষ্ট সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ দীর্ঘকাল (১৭৬০ খ্রি.-১৮০০ খ্রি.) কোম্পানীর শিরঃপীড়ার কারণ হয়। (ওই, পৃ ১৫)
গ. ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে, কিছু কিছু দাঙ্গা-হাঙ্গামা সত্ত্বেও হিন্দু-মুসলমান মোটামুটি অন্ধ-বিদ্বেষহীন শান্তিকামী প্রতিবেশী। (ওই, পৃ ১৩)
ঘ. সাঁওতাল বিদ্রোহ (১৮৫৫ খ্রি.-১৮৫৭ খ্রি.)-এও স্থানীয় মুসলমান তাঁতীরা সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করে। (ওই, পৃ ১৬)

তিন ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ˜সিপাহী বিদ্রোহ€ অখণ্ড ভারতবর্ষের হিন্দু-মুসলমান জন-আত্মার সম্মিলনী উত্থানস্বরূপ। তা পরিচালিত হয়েছিল ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে। মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান এমন জাতীয়তাবোধ-সঞ্চারণার ভিত্তিরূপমার ঐতিহ্য সংগ্রহ করেছেন পরম যত্নে। তিনি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৮২৭-৮৭ খ্রি.) পদ্মিনী উপাখ্যানে (১৮৫৮ খ্রি.) তাঁর স্বাধীনতার কামনা, পরাধীনতার বেদনা, দেশপ্রীতি এবং বিদেশাগত মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষের ভাব প্রকাশিত হয়েছে। যদিও ইংরেজ-বিরুদ্ধাচরণের প্রেক্ষাপটে তাঁর বহু-উদ্ধৃত, বহু-প্রশংসিত বলিষ্ঠতম রচন (ঐ, পৃ ৭৩) নিম্নরূপ :

স্বাধীনতা-হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে
কে বাঁচিতে চায়!
দাসত্ব শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে
কে পরিবে পায়!

রঙ্গলাল তাঁর সুরসুন্দরী (১৮৬০ খ্রি.) কাব্যেও হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কেও স্বরূপ উদ্ঘাটন করেছেন নিম্নোক্ত বাক্যভঙ্গিমায় :

তৈল যথা তোয় সহ সংমিলিত নহে।
ঘবী যথা অনল পরশ পেয়ে দহে।।
ভুজঙ্গের প্রতি যথা বিরাগী নকুল।
হিন্দু-মুসলমানেতে হেন ভাব প্রতিমূল।।

এ-কাব্যে রঙ্গলাল সম্রাট আকবরের হিন্দু-মুসলমান সম্মিলনের প্রয়াসের প্রশংসা করলেও একপর্যায়ে তিনি উচ্চারণ করেছেন :

সেই গুণসিন্ধু শাহ্‌ শ্যালকবচনে।
হিন্দু ধর্ম সংহারে প্রতিজ্ঞা করে মনে।
না থাকিবে ভারতে হিন্দুর স্বাধীনতা।
অসতী হইবে পুণ্যভূমি পতিব্রতা।

সত্য-অনুসন্ধিৎসু মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৮৩৮-১৯০৩ খ্রি.) কাব্যসজ্জায় সুস্পষ্ট মুসলমান-বিদ্বেষ উদ্ঘাটন করেছেন। তিনি ন্যায়তই উচ্চারণ করেছেন : মধ্যবিত্ত মানসিকতার দ্বিতীয় স্থর – সংকীর্ণ স্বার্থবুদ্ধি ও গোত্রপ্রীতির তিনি পুরোধা।(ওই, পৃ ১০০) হেমচন্দ্র তাঁর বীরবাহুতে (১৮৬৪ খ্রি.) ত্রিপদী ছন্দ-সংযোজনায় এমন সত্যের দীপ্তি :

ক. পাষাণ যবন দল বল আর কতকাল
নির্দয় নিষ্ঠুর মনে নিপীড়ন করিবে?
খ. আরে রে নিষ্ঠুর জাতি পাষণ্ড বর্বর
পুরাব যবন-রক্তে শমন-খর্পর।

ছায়াময়ী (১৮৮৪ খ্রি.) কাব্যে হেমচন্দ্র নবাব সিরাজদ্দৌলাকে পাপীরূপে বর্ণনা করেছেন :

অই পাপী নর আত্মা বিকট আকার
কৃষ্ণশ্মশ্রুধারী ছায়া ধরাতে ধরিলা কায়া
নিষ্ঠুর ভূপালবেশে যে নাম উহার
শুনিলে এখনি তুমি ঢাকিবে শ্রবণ…

চার নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র-রচিত (১৮২৯-৭৩ খ্রি.) একমাত্র কাব্য সুরধনী কাব্য (১৮৭১ খ্রি.) বিশ্লেষণ করতে গিয়ে মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান €˜মুসলিম জীবন ও চরিত্র-সম্পর্কে আবেগযুক্ত উষ্মা ও কৌতুকরসের প্রকাশ লক্ষ্য করেছেন। (ওই, পৃ ১১২) এ-কাব্যে দীনবন্ধু আওরঙ্গজেবের নিন্দা করেছেন এমন কথকতায় :

অপকৃষ্ট আরঙ্গজীব রাজা দুরাচার
প্রজার মনের ভাব না করি বিচার…
ভাঙ্গিয়া মন্দির তার মসজিদ গঠিল
প্রস্তর বিগ্রহে ধরে দূরে ফেলাইল।

মনীষী আবদুল লতীফ-সম্পর্কে কিন্তু গুণস্পন্দিত বাক্য উচ্চারণ করেছেন তিনি :

ওই দেখ আবদুল লতীফ ললিত,
বিচক্ষণ মুসলমান সভ্যতা-শোভিত,
বাড়াইতে বিদ্যা-ভক্তি স্বজাতির দলে,
স্থাপন করেছে সভা যতনে কৌশলে,
হতেছে তাহাতে দেখ অজ্ঞান-নিপাত,
যতন তরুতে ফল ফলে অচিরাৎ।

নবীনচন্দ্র সেনের (১৮৪৭-১৯০৯ খ্রি.) কাব্যমূর্তি দেশপ্রেমের ঔজ্জ্বল্যে দীপ্যমান। মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের সত্যসন্ধ দৃষ্টিপাত – নবীনচন্দ্র সেন তাঁর পলাশীর যুদ্ধ (১৮৭৫ খ্রি.) কাব্যে নবাব আলীবর্দীর প্রশংসাকীর্তন করে তুলনায় সিরাজদ্দৌলাকে ঘৃণিত কুক্কুর বলে বিশেষিত করেছেন :

বীরশ্রেষ্ঠ আলীবর্দ্দী, সমরে শমন…
জীবনের অ বসান, তথাপি উজ্জ্বল
ছিলো ভস্ম-আচ্ছাদিত বহ্নির মতন
প্রভায় সমস্থ বঙ্গ ছিল সমুজ্জ্বল।…
এখন বসেছে এক ঘৃণিত কুক্কুর!

মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের প্রণিধানযোগ্য বক্তব্য : নবীন সেনের কবি-কল্পনাও ইংরেজ অপেক্ষা মুসলমানদেরকে আপন বলে মনে হলেও একান্ত মনে হয়নি। (ওই, পৃ ১৩৭) তবে, নবীনচন্দ্রের ব্যক্তিক বক্তব্যও কিন্তু সম্বুদ্ধ, যৌক্তিক। তাঁর কথা : ধর্ম-সংস্থাপনের জন্য পৃথিবীর ধর্মগুরুসকল, যথা – শ্রীকৃষ্ণ, বুদ্ধ, খ্রীষ্ট, হজরত মুহম্মদ ও শ্রীচৈতন্য বিভিন্ন যুগে আবির্ভূত হইয়াছিলেন। অতএব, তাঁহারা সকলেই আমাদের নমস্য। আমাদের ধর্মান্ধতা শুধু ভ্রানি-মাত্র। (ভূমিকা, অমিতাভ) মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান পর্যবেক্ষণ করেছেন – কবি দুর্গাদাস সান্ন্যাল তাঁর মহামোগল কাব্যে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের দ্বৈত প্রতিভাস উদ্ধার করেছেন। মুসলমান সেনাদের দুর্বুদ্ধিজাত কর্মায়োজনকে তিনি নিম্নোক্ত পঙ্‌ক্তিমালায় সুবদ্ধ করেছেন :

হারিল কাফের হিন্দু গোলামের জাতি
কী জানে সমর তারা, ব্যবসা ডাকাতি
সর্বত্র বিজয়ী সদা রসুলের চেলা…
ভাঙিব এখন সব হিন্দুর মন্দির
সতীত্ব হরিব সব হিন্দু রমণীর…

মুসলমানদের সমুন্নত গুণের কথাও অনুল্লেখ্য নয় তাঁর কবিতাপটে :

সাহস উৎসাহ ঐক্য উদ্যোগ দৃঢ়তা
পঞ্চগুণে মুসলমান লভিল শ্রেষ্ঠতা।

মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান পৃথ্বিরাজ (১৩২২ বঙ্গাব্দ) ও শিবাজী (১৩২৫ বঙ্গাব্দ) কাব্যের রচয়িতা যোগীন্দ্রনাথ বসুও (১৮৫৭-১৯২৭ খ্রি.) হিন্দু-মুসলমান-সম্পর্কিত অনুভাবনা সমুদ্ধার করেছেন। পৃথ্বিরাজের উপক্রমণিকায় যোগীন্দ্রনাথ বসুর ইতিহাস-সন্নিধান :

ক. মুসলমানেরা এদেশে আসিয়াছিলেন বলিয়া হিন্দুর অধঃপতন হয় নাই। (পৃ ১)
খ. বিবেকানন্দ… বলেন, ভারতবাসীদিগের সর্বঃবিধ জ্ঞান যে সমপ্রদায়-বিশেষের মধ্যে আবদ্ধ ছিলো এবং তাঁহারা যে অপর সমপ্রদায়ের মধ্যে সেই জ্ঞান প্রচার করিতে উদাসীন, স্থলবিশেষে, পরিপন্থী ছিলেন, ইহাই ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পতনের কারণ। (স্বামী বিবেকানন্দ রচনাবলী, মায়াবতী মেমোরিয়াল সংস্করণ, তৃতীয় খণ্ড, পৃ ৬৫৩) শিবাজী (১৩২৫ বঙ্গাব্দ) কাব্যে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের শুদ্ধতা-সংরাগ :

পালি হিন্দু-মুসলমানে বুঝায়েছ তুমি
স্বধর্মানুরাগ নহে পরধর্মদ্বেষ
ছিলে রাজা কিন্তু দীন; সংসার সন্ন্যাসী…
(শিবাজীর মৃত্যুতে গুরু রামদাস)

পাঁচ মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ছিলেন জীবনতত্ত্ব-তথ্যপিয়াসী গবেষক। বাঙালি হিসেবে বাঙালির ধর্ম-বর্ণ-সমপ্রদায়নিরপেক্ষ দিব্যসত্তার অরুণকান্তি ছিল তাঁর প্রার্থিত। অতীত কাব্য-সংবেদনার অন্ত:সত্যরূপমার সংগঠনা জাতির শুদ্ধসত্তায় পরাগায়িত হোক – এমন কর্তব্যদায়েরই মগ্নায়তন তাঁর আধুনিক বাংলা কাব্যে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক গ্রন্থটি।

যুগসন্ধির কবি ঈশ্বরগুপ্ত-সম্পর্কে মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের সত্যাশ্রিত বক্তব্য :
ক. বাঙালী হিন্দুর নির্দোষিতা প্রমাণের জন্য ঈশ্বরগুপ্ত উচ্চকণ্ঠ। (ওই, পৃ ২১৮)
খ. অক্লান-ভাবে গদ্য-পদ্য রচনায় তিনি বিদ্রোহীদের নিন্দা ও ইংরেজানুগত্য প্রকাশ করেছেন। এবং বিশেষতঃ যবন নেড়ে-রাই যে ইংরেজ রাজত্বে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির প্রধান কারণ – এ-তথ্যও তিনি বারংবার উচ্চারণ করেছেন। (পৃ ওই)

ঈশ্বরগুপ্তের কবিতা-পঙ্‌ক্তি :
প্যাঁজখোর যারা তারা আহারে সন্তোষ।
লোম ছুঁড়ে গন্ধ ছুটে এই বড় দোষ।

কাহিনিকাব্যপটে কবি হেমচন্দ্রের ধর্মান্ধতা লক্ষণীয়, কিন্তু খণ্ড কাব্যপটে তিনি শুদ্ধতার প্রতীক। উল্লেখযোগ্য কবিতাপঙ্‌ক্তি :

আজি একপ্রাণ, হিন্দু-মুসলমান –
জাগাতে তোমায় জেগেছে দেশ।
ভারতনন্দন মহাম্মদীগণ
তাহারাও আজি জাগে মা বলে…

মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের উক্তি : রঙ্গলাল ও বঙ্কিমচন্দ্র (১৮৩৮-১৮৯৫ খ্রি.) বাংলা সাহিত্যে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের অবনতির দুই উৎস। (ঐ, পৃ ২৫১) যুগ-প্রেক্ষাপট বিচার করলে এ-বক্তব্যকে একেবারে অস্বীকার করা যায় না।

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের (১৮৬৩-১৯১৩ খ্রি.) কাব্যসৌন্দর্যে দেশাত্মবোধদীপনার অমৃতময় অলংকরণ। তাঁর ছন্দ-সৌকুমার্য চিত্তাকর্ষক। তবে, কেবল সনাতনী হিন্দু গৌরবমন্ত্রেরই সাধনা করে প্রেমের ভারতবর্ষে জেগে উঠতে চেয়েছিলেন তিনি, কিন্তু সেখানে ভারতীয় মুসলমানের জন্যে স্থান নির্দেশ করার কোনো প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি। মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান অবশ্য উল্লেখ করেছেন যে, আর্য-অধঃপতনে তিনি বেদনার্ত হয়েছিলেন, কিন্তু এর জন্যে তিনি যবনকে দোষারোপ করাকে অর্থহীন বলে মনে করেছিলেন। (ওই, পৃ ২৬৩)
ছয় কবীন্দ্র রবীন্দ্রনাথের কাব্যায়তনে মুসলমান-প্রসঙ্গ নাতিদীর্ঘ। ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দের বঙ্গভঙ্গ ও তার পরে রবীন্দ্রচিন্তাসম্পৃক্ততায় মুসলমান-প্রসঙ্গটি বিস্তৃত হয়েছে। মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের গবেষণার সার-অর্থ :

ক. রবীন্দ্রনাথ আন্তরিকতার অভাবকে, শিক্ষাভ্রষ্টতাকে, অন্ধ-আচারনিষ্ঠাকে, বিবেক ও বিচারবুদ্ধিহীনতাকে সকল বিরোধের মূল বলে নির্দেশ করেছেন। (ঐ, পৃ ৩০২)
খ. রবীন্দ্রনাথ পর্যবেক্ষণ করেছেন – সামপ্রদায়িক অনৈক্য যে মনুষ্যত্বের মিলটাকে চাপা দিয়েছে – এইটে বড়ো কথা। বিভিন্ন ধর্মকর্ম ও মত-বিশ্বাসের ভেদ থাকবেই, কিন্তু মনুষ্যত্বের খাতিরে পরস্পরের মিল হওয়া আবশ্যক। (ঐ)
পূর্ণমনুষ্যত্বের উদ্বোধক, বিশ্বালোকদ্রষ্টা, সত্যসংবিৎ-সম্পন্ন মহাবাগগেয়কার রবীন্দ্রনাথের কাব্যিক উচ্চারণ :

ক. যবন ব্রাহ্মণ
সে ভেদ কাহার ভেদ? ধর্মের… নয়।
অন্তরে অন্তর্যামী যেথা জেগে রয়
সেথায় সমান দোঁহে।…
(সতী™)

খ. বাঙালীর প্রাণ বাঙালীর মন
বাঙালীর ঘরে যত ভাইবোন
এক হউক এক হউক হে ভগবান।
(বিজয়া সম্মিলন)

গ. অহরহ তব আহ্বান প্রচারিত, শুনি তব উদার বাণী
হিন্দু বৌদ্ধ শিখ জৈন পারশিক মুসলমান খ্রীষ্টানী
পূরব পশ্চিম আসে তব সিংহাসন পাশে
প্রেমহার হয় গাঁথা।
(জনগণমন অধিনায়ক, সঞ্চয়িতা)

সাত ব্রিটিশ প্রশাসনিক বৃত্তের সাবজজ কবি ওসমান আলী ছিলেন হিন্দু-মুসলমান সমপ্রীতিকামী এক জীবনশিল্পী। তাঁর দেবলা (১৯০৯ খ্রি.) সুন্দর কবিত্বশক্তির পরিচয়বহ। (ওই, পৃ ৩০৯) কায়কোবাদই (১৮৫৭-১৯৫১ খ্রি.) প্রথম কাহিনিকাব্যকার, যিনি সাম্প্রদায়িক ক্ষুদ্রবুদ্ধিকে প্রশ্রয় দেননি। মহাশ্মশান (১৯০৪ খ্রি.) কাব্যে তাঁর সমন্বয়ী সম্পোষণা :

একই পিতার পুত্র হিন্দু-মুসলমান –
পরস্পর ভাই ভাই, নহে তারা পর…
জাতিভেদ ভুলে যাও, হিন্দু-মুসলমান
ঋারতের প্রিয়পুত্র – সবি একজাতি।

€˜হুসেনী ছন্দের উদ্ভাবক€™ সৈয়দ আবুল হোসেন তাঁর যমজ ভগিনী কাব্যের (১৩১২ বঙ্গাব্দ) কাব্য-সংলাপ :

হিন্দু মুসলমান, এই সমপ্রদায়দ্বয়ে, রাখিও বিভিন্ন সদা,
কুত্রাপি একত্র যেন না পারে হইতে। – ইহারা একত্র
মাগো হইবে যেদিন, সেদিন তোমারো শিরে উড়িবে গো
চিল কাক, কহিনু নিশ্চয়। (পৃ ৩০৪)

হিন্দু-বিদ্বেষ আর বঙ্কিম-নিন্দায় ভরপুর সৈয়দ আবুল হোসেনের কাব্যবৃত্ত। কিন্তু মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের ধী-সমুন্নত দিগ্‌নির্দেশনাও স্মরণযোগ্য। তাঁর দৃকপাত : হিন্দু-বিদ্বেষ সত্ত্বেও সমকালীন হিন্দু বুদ্ধিজীবী ও সমালোচকদের পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রশংসা-অর্জনে সমর্থ হন। (পূর্বোক্ত, পৃ ৩৫০) কবি গোলাম হোসেন (১৮৭৩-১৯৬৪ খ্রি.) ছিলেন হিন্দু-মুসলমান মিলনকামী। মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান কবির বক্তব্য উদ্ধার করেছেন। কবির উচ্চারণ :
দুই সমপ্রদায়ের পরস্পর পরস্পরের নিকট স্বরূপে পরিচিত না থাকাতেই এই সমস্ত বিবাদ-বিসম্বাদ ও দ্বেষ-হিংসার সূচনা। (ওই, পৃ ৩৫২-৩৫৩)

মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান কবি ইব্রাহিম আলীকেও সুশীল-সম্বুদ্ধ সম্মাননা জ্ঞাপন করেছেন। কবি ইব্রাহিম আলী তাঁর শ্রীহট্টবিজয় কাব্যের (১৯১২ খ্রি.) বিষয়-বিন্যাসে হিন্দু-মুসলমানকে ‘মিলিয়া মিশিয়া ভ্রাতৃভাবে’ ধর্মানুসরণ করার কথা বলেছেন।

মীর মশাররফ হোসেন (১৮৪৮-১৯১০ খ্রি.) তাঁর সঙ্গীত-লহরীতে (১৮৮৭ খ্রি.) হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য-সংস্থাপনের সম্ভাবনার বার্তা প্রকাশ করেছেন :
ভারতসভা জাতিসভা হচ্ছে দলে দলে রে।।
নাই ভেদাভেদ কোনো প্রভেদ হিন্দু-মুসলমান।
ক্রমে ক্রমে হইতেছে একদেহ এক প্রাণ রে।।

মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য-সম্ভূতির সম্পন্ন আধিকারিক। তিনি মীর মশাররফের আত্মজীবনীমূলক উদাসীন পথিকের মনের কথা (১২৯৭ বঙ্গাব্দ) থেকে উদ্ধৃত করেছেন :
হিন্দু-মুসলমানে এক ভাবা চাই। শত্রুতা বিনাশ করিতে একতা শিক্ষা করা চাই। একতাই সকল অস্ত্রের প্রধান অস্ত্র। জাতিভেদে হিংসা, জাতিভেদে ঘৃণা, দেশের মঙ্গলের জন্য একেবারে অন্তর হইতে চিরকালের জন্য অন্তর করা চাই। (পৃ ১২)

তবে মদিনার গৌরব (১৯০৬ খ্রি.) কাব্যে মশাররফ হিন্দু সমপ্রদায়কে €˜শয়তানের বংশধর€™ বলে চিহ্নিত করেছেন। মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান অনুসন্ধান করেছেন – গাজী মিঞার বস্তানীতে (১৮৯৮ খ্রি.) হিন্দু সুবিধাবাদী, হিন্দু আমলা মুসলমান জমিদারের সর্বনাশকারী… গাজী মিঞার হিন্দু বন্ধুদের আচরণে ভেড়াকান্তরূপী মশাররফ মানুষের ওপর বিশ্বাস হারিয়েছেন। সে-কারণে তিনি হিন্দুসমাজের ওপর বিদ্বিষ্ট হয়ে স্বীয় অসামপ্রদায়িকতা বিসর্জন দিয়েছেন। (ওই, পৃ ৩৬২-৩৬৩)

কায়কোবাদ তাঁর অশ্রুমালা (১৮৯৪ খ্রি.) কাব্যে হিন্দু-মুসলমানের ধর্মগত প্রভেদের চিত্র অঙ্কন করেছেন। মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের সত্যসন্ধ মন্তব্য :
ধর্মগত প্রভেদ এবং €˜দেশাচার€™ কবির প্রেমের ব্যর্থতার কারণ – একথা €˜প্রেমের স্মৃতি€™ ও €˜শৈশবস্মৃতি€™ কবিতায় উচ্চারিত হয়েছে। কবি কায়কোবাদ প্রধানত হিন্দু-মুসলমান সমপ্রীতিকামী ছিলেন। (ওই, পৃ ৩৬৫)
€˜ঊষাস্বপ্ন€™ কবিতায় প্রেমিক কায়কোবাদ লিখেছেন :

ক. তুমি ছিলে ব্রাহ্মণ কন্যা – আমি ছিনু মুসলমান
কে জানিত দোঁহের মাঝে এতোখানি ব্যবধান?
খ. এস ভাই হিন্দু এস মুসলমান
আমরা দু ভাই ভারতসন্তান
এস আজি সবে হয়ে এক প্রাণ
সেবি গো মায়ের চরণ দুটি।
[অমিয়ধারা কাব্য (১৯২৩ খ্রি.)]

জাতীয় মঙ্গলের কবি মোজাম্মেল হকের (১৮৬০ খ্রি.-১৯৩৩ খ্রি.) কবি-পরিচিতিকেও সমুজ্জ্বল করেছেন মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। মোজাম্মেল হক জাতীয় ফোয়ারার €˜জাতীয় কবিতা€™র (১৮৯২ খ্রি.-১৯০৮ খ্রি.) মাধ্যমে মুসলমান সমপ্রদায়কে নবপ্রেরণায় ও জাতীয় গৌরবে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। (মুহম্মদ এনামুল হক, মুসলিম বাঙ্গলা সাহিত্য, ঢাকা, ১৯৫৭ খ্রি., পৃ ৩১৩)
মোজাম্মেল হক ধারণা করতেন – আদর্শ-বিচ্যুতি মুসলমান সমপ্রদায়ের অধঃপতনের মূলে। হিন্দু লেখকদের রচনায় মুসলমান-চরিত্রের বিকৃতিতে পীড়িত বোধ করেছেন। ইসলাম সঙ্গীত কাব্যে তিনি উল্লেখ করেছেন :
একদেশে বাস হিন্দু-মুসলমান
শিরে বহে এক রাজার বিধান
হিন্দুরা উন্নত, তোরা অবনত
কেন হ’লি তাহা ভাব কি কখন?

গবেষক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান আহমদী (১৮৮৬ খ্রি.) পত্রিকার সম্পাদক কবি আবদুল হামিদ খান ইফসুফজয়ীর কবিতা বিশ্লেষণ করেছেন। কবি ছিলেন €˜হিন্দু-মুসলমান মিলনকামী€™। (পূর্বোক্ত, পৃ ৩৭১) ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠীর ভেদাভেদকে তিনি অস্বীকার করেছেন। তাঁর সমুন্নত কাব্যিক উক্তি :
নাইত বিভিন্ন ভেদ, কাফের মমিন
এইখানে কৃষ্ণ জিষ্ণু, এইখানে রাম
এইখানে ছোলেমান এইখানে দারা
এইখানে ইসা মুসা শুয়েছেন তাঁরা!!!
(শেষশয্যা)

€˜স্বাধীনতার অক্লান্ত সৈনিক ও মুসলমান পুনর্জাগরণের কবি€™ (ওই, পৃ ৩৭৪) ইসমাইল হোসেন শিরাজীর (১৮৭০-১৯৩১ খ্রি.) কবিতা সযত্নে বিশ্লেষণ করেছেন মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। হিন্দুদের শিক্ষাদাতার ভূমিকায় মুসলমানদের কৃতিত্বকথা কবি সগর্বে স্মরণ করেছেন এমন বাক্যবিন্যাসে :

ভারতে অনার্য আর্য হিন্দুগণে
দিয়া শিক্ষা দীক্ষা পরম যতনে…
শাসিল যাহারা হরষিত মনে!
হেরিয়া যাদের জ্ঞান বিদ্যা বুদ্ধি
হেরিয়া যাদের বীর্য শৌর্য ঋদ্ধি…
কৃতার্থ ভাবিত স্বকীয় জীবন…
(€˜মূর্চ্ছনা€™, অনলপ্রবাহ)

নবনূর-সম্পাদক সৈয়দ এমদাদ আলী (১৮৮০-১৯৫৬ খ্রি.) তাঁর পত্রিকার প্রথম সংখ্যাতেই ঘোষণা করেন, €˜ভারতের শুভাশুভ€™ হিন্দু-মুসলমানের €˜সম্মিলনের উপরেই€™ নির্ভরশীল এবং সাহিত্যই এই €˜মিলনের প্রশস্থ ক্ষেত্র€™। (নবনূর, সূচনা, বৈশাখ, ১৩১০ বঙ্গাব্দ) কিন্তু শেষাবধি তিনি ধৈর্যহারা হন। বাস্তব অভিজ্ঞতা-অনুসারে তিনি লেখেন :
মুসলমান সমাজ বুঝতে পারিয়াছে, €˜টহরঃবফ ওহফরধ’-র সুখস্বপ্ন চিরদিন স্বপ্নই রহিয়া যাইবে।… যাহাদের নিকট আমরা অবজ্ঞাত, তাহাদের কাছে কোনো কিছু ভালো আশা করা আর আকাশকুসুম রচনা করা আমাদের পক্ষে একই কথা। (নবনূর, অগ্রহায়ণ, ১৩১০ বঙ্গাব্দ)

আট কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬ খ্রি.) সাম্যবাদী আদর্শের বাস্তব রূপকার । উপমহাদেশীয় জন-প্রাণধারায় তাঁর জাগৃতি-সঞ্জীবনী কবিতালাপ সুসমন্বিত। তাঁর নির্মল সাংস্কৃতিক দর্শন, নিরপেক্ষ প্রচার-অবিব্যক্তি, তাঁর বৈষম্য-নিঃশেষণের বলিষ্ঠতা অপূর্ব এক শিল্পায়নের দিগবলয় সৃষ্টি করেছে। ঐতিহাসিক সত্যের দ্যুতি : প্রথম মহাযুদ্ধোত্তর বঙ্গভারতবর্ষের একদিকে সাম্যবাদ তরুণ সমাজের ধ্যান-মননকে উদ্দীপ্ত করে, অন্যদিকে খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক মঞ্চে হিন্দু-মুসলমান সমপ্রীতি সুদৃঢ় হয়। বাঙালি পল্টন-প্রত্যাগত হাবিলদার নজরুলের চিন্তাজগতে এই দুই মহাশক্তির সঞ্চয়ন ঘটে। মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের প্রণিধান :
সমকালীন হিন্দু-মুসলমান সমপ্রীতির পরিবেশে… সাম্যবাদী চিন্তা একটা ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদ (হিউম্যানিজম) কল্পনায় কবিকে উদ্বুদ্ধ করে। তাই কাজী নজরুল ইসলামের কাব্যে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের চিত্রণ তাঁর পূর্ববর্তী সকল কবির রচনাপ্রণালী থেকে ভিন্নমুখী। (ওই, পৃ ৩৭৯-৩৮০)

কবির অমিত উচ্চারণ :

ক. অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া জানে না সন্তরণ
কাণ্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তি পণ!
€˜হিন্দু না মুসলিম!€™ ঐ জিজ্ঞাসে কোন্‌ জন ?
কাণ্ডারী ! বলো, ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা€™র!
(€˜কাণ্ডারী হুঁশিয়ার€™ সর্বহারা)

খ. গাহি সাম্যের গান –
যেখানে আসিয়া এক হ€™য়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান
যেখানে মিশিছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান!
(€˜সাম্যবাদী€™, সাম্যবাদী)
বিশেষ দৃকপাত

সিপাহি বিদ্রোহোত্তর (১৮৫৭ খ্রি.) কবি ঈশ্বরগুপ্ত ও রঙ্গলাল থেকে প্রথম মহাযুদ্ধোত্তর (১৯১৪-১৮ খ্রি.) কবি কাজী নজরুল ইসলাম পর্যন্ত আধুনিক বাংলা কবিতাপটে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের সামাজিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্যের অনুপুঙ্খ ছবি সত্যায়িত হয়ে আছে। তবে, আধুনিক জীবনধারার মৌলিক বৈশিষ্ট্যসমূহ – ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠী-নির্বিশেষে পারস্পরিক সহাবস্থান, পরমতসহিষ্ণুতা, যৌক্তিক ও বিজ্ঞাননিষ্ঠ কল্যাণময় চিন্তাকর্মাভ্যাস যদি দৈনন্দিনতায় সংস্থিত না হয়, তবে প্রগতির সজ্জিত রূপশ্রী নিশ্চিহ্ন হবেই।
কাব্যসাহিত্যের জয়দীপনায় পরশ্রীকাতরতা, সামপ্রদায়িক গোঁড়ামি, কূপমণ্ডূকতা, হীনমন্যতা, কায়েমি শক্তিমত্ততা, অপপেশির সঞ্চালনা এবং বৈজ্ঞানিক সূত্র-প্রযুক্তির অপব্যবহার সক্রিয় হলেই সভ্যতার সবুজ বিনষ্ট হবে।

মনীষী বাঙালি ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌র পূত মনন-উদ্ভাসিত এ-বাণী সুসংহত হোক সর্বজনের প্রাণপুটে :
সাহিত্যে সামপ্রদায়িকতা বলতে আমি বুঝি সাহিত্যের ভিতর দিয়ে অন্য সমপ্রদায় বা ধর্মবিশেষের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা চালানো, কোনও জাতির ঐতিহাসিক চরিত্রকে বা কোনও ধর্মাবলম্বীর সম্মানিত পুরুষদের হীন বা বিকৃত করা। দেশের সামপ্রদায়িক বিবাদের মূলে এই সামপ্রদায়িক সাহিত্য। (মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌, €˜সাহিত্যে সামপ্রদায়িকতা€™, আমাদের সমস্যা, ঢাকা, ১৯৪৯, পৃ ২৩-২৪)

ডক্টর মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের মনস্বিতায় এমন সত্যশ্রীমণ্ডিত বাণীর সনাতনি আলপনা অঙ্কিত হয়েছিল। তাঁর অন্তরে পূর্ণাভ পুণ্যাভ হয়েছিল অখণ্ড বাঙালিসত্তার অমলিন সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক সত্যের দীপাবলি।

উৎসঃ কালি ও কলম মাসিক সাহিত্য পত্রিকা, ভলিউম ৬, নবম প্রকাশনায় ২০০৯ সালের অক্টোবার মাসে প্রকাশিত।

১৪ টি মন্তব্য : “‘হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক’-অভিজ্ঞান — (ডঃ অনাথবন্ধু মল্লিক)”

  1. স্যার ছিলেন একজন সত্যিকারের মানুষ যার সাথে আমার সবচেয়ে বেশি সময় কেটেছে, একদিন বলব সে সব কথা। অনেক ধন্যবাদ রকিব, পোস্টের জন্য। স্যারের কোনো ঠিকানা, ই-মেইল কি জানা আছে তোমার??

    জবাব দিন
  2. মেহেদী হাসান (১৯৯৬-২০০২)

    মল্লিক স্যারের নাম দেখেই পোষ্টে ঢুকে পড়লাম। আমার অন্যতম প্রিয় শিক্ষক। ছয় বছর ধরেই স্যার এর সান্নিধ্যে ছিলাম, যদিও সাহিত্যে আমার কখনোই দখল বা উৎসাহ কোনটাই ছিল না তবুও স্যার আমাকে যথেষ্ট স্নেহ করতেন। এমন শিক্ষক আজকাল দেখা যায় বলে আমার জানা নেই। স্যার এখন কোথায় আছেন জানি না, কেউ জেনে থাকলে জানাবেন প্লিজ... (মোবাইল অথবা ইমেইল)

    মূল লেখাটা এখন পড়তে পারলাম না, সময় করে পড়ে ফেলব শীঘ্রই। তবে আমি নিশ্চিত যে লেখাটা বুঝতে কঠিন হলেও সবার ভাল লাগবে...

    জবাব দিন
  3. আন্দালিব (৯৬-০২)

    অসামান্য! দুর্দান্ত একটা লেখা! আমি প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে পড়ছি। অদ্ভুত আলোচনা। এরকম নিষ্ঠা নিয়ে, কোনোরকমের বাতুলতাবিহীন এবং সিদ্ধান্তমূলকতা ছেড়ে নিরপেক্ষ লেখা মল্লিক স্যারকে দিয়েই সম্ভব।

    এই মানুষটা আমার কতো শ্রদ্ধার তা আমি বলে বোঝাতে পারবো না। আমি যতটুকু শিখেছি তাঁর কাছে, ততটুকু আমি আর কয়জনের কাছে শিখেছি? বাংলা বানান নিয়ে তিনি যা করতেন, সেটা দেখে দেখেই আমার বানান শেখা। এখনও কাউকে বানান শুধরে দিতে গেলে, বা নিজের কোনো বানান ভুল ধরা পড়লে আমি একবার স্যারের কথা মনে করি।
    আর তাঁর ভাষাজ্ঞান! একবার দেয়াল-পত্রিকার জন্যে তিনি লেখা দিয়েছিলেন, সেই লেখা পড়ে আমি বুঝেছিলাম যে এমন গভীর চিন্তা, এমন কোমল অথচ দৃঢ় বক্তব্য আমি আর কোনোদিন পড়বো না!

    এই লেখাটির অনেক কিছুই আমি জানতাম না। পুরোপুরি অজ্ঞ এবং নির্বোধের মতো পড়লাম। বলা চলে হাতড়ালাম। কবিতার পর কবিতা দিয়ে তিনি যে চিত্রটি তুলে ধরেছেন, হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের রাজনীতি বাদ দিয়ে সেটা কবিতা দিয়ে তুলে ধরা যায় সেটা আমার জানা ছিলো না। (একজন শিক্ষক কতো তীব্রভাবেই আমাদের কতকিছু শিখান!)

    স্যারের জন্যে শতকোটি কুর্ণিশ। রকিব, তুমি আমাকে ফেসবুকে মেসেজে পারলে স্যারের সাথে যোগাযোগের একটা পথ বাতলে দিও। তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ! অজস্র!

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।