সালতামামি ১৪২১

সালতামামি ১৪২১

ঋতুভেদে বাংলাদেশের রুপবৈচিত্র্য কেমন ? প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে পদ্য বা গদ্য নিয়ে সালতামামি ১৪২১ লেখলে কেমন হয় ? ভেবেছিলাম ১৪২১ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে। ওপর আলার রহমতে জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ় , শ্রাবণ ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ,ফাল্গুন , চৈত্র পেরিয়ে অবশেষে পৌছালাম আরেক বৈশাখে । বৈশাখ ১৪২২। বছরের প্রথম দিনেই সালতামামি প্রকাশ করার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু আলসেমিতে কাজটা হয়ে ওঠেনি। এদিকে কালবৈশাখী অজুহাতে লোডশেডিং আরও ঝামেলা তৈরী করছে। তবু শুরু করলাম । দেখা যাক আপনাদের কেমন লাগে।

পহেলা বৈশাখ ১৪২১। বছরের শুরুতে যথারীতি পান্তা ইলিশ বাতিক দয়া করে রাগ করবেন না। প্রচার মাধ্যম সৃষ্ট পান্তা-ইলিশ বিষয়টাকে খোঁচানর জন্যই লেখা। পান্তা ছোট বেলায় খেয়েছি পেঁয়াজ লবন কাঁচা মরিচ দিয়ে। কখনও পাকা আম দিয়েও । নব্য সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড আমাদের জাতীয় মাছের সাথে সাথে আরও অনেক কে ঝামেলায় ফেলেছে । চুপিচুপি বলে রাখি, এই বাঙাল তাদের একজন ।

পান্তা
আধপেটা বা সিকি পেটা যেদিন যেমন পাই
নুন আনতে পান্তা ফুরায়
পেঁয়াজ মরিচ নাই।
ইলিশ
বিপদে আপদে পান্তা খায়
চাপিলা হোক বা জাটকা
ইলিশ খেতে মন চায়।
বাতিক
ঘটা করে নাগরিক
বৈশাখী উদযাপন
বার্ষিক পান্তা ইলিশ ভক্ষন।

রাখে আল্লাহ মারে কে ? ভাগ্যিস উনি চন্দনা ও চাপিলা নামের দুটো প্রজাতি রেখেছেন। চন্দনা দিয়েই চালিয়ে দিলাম। হে হে হে। একি প্রকৃতির বৈচিত্র বর্ণনা করতে এসে নিজের মত খুব জাহির করছি। ছি ছি ছি। এ ভারী অন্যায়। কেউ যদি পান্তা ইলিশ খেয়ে ঐতিহ্য রক্ষার মহান ব্রত পালন করে আমোদিত হয় তাতে আমার কি ?! ১৪২১ এর বৈশাখ ছিল খুব গরম আর শুকনো। বৃষ্টির আশায় পোলাপান ব্যাঙের বিয়ে পর্যন্ত দিল।

ব্যাঙের বিয়ে
বৈশাখের জ্বর উঠেছে
সেলসিয়াসে চল্লিশ
ঢালতে হবে মাথায় পানি
পাচ্ছে না কেউ তার হদিস।
কেউবা সিন্নী মানত করে
কেউবা ব্যাঙের বাচ্চা ধরে
কলা গাছের পাল্কী নিয়ে
আলতা মেখে দিচ্ছে বিয়ে।
যাচ্ছে তারা বাড়িবাড়ি
কাদা বানায় উল্টে হাঁড়ি
সেখানে দেয় গড়াগড়ি
হয়ে যাবে ডাল খিঁচুড়ি।
দাও আল্লা দাও পানি
ধানের ভূঁইয়ে নাই পানি
তিলের ভূঁইয়ে হাঁটু পানি
ধানের ভূঁইয়ে নাই পানি
দাও আল্লা দাও পানি।

আসুন একটু পড়ুন বৈশাখ ১৪২১ । মিকাইল হুযুরকে পামপট্টিও দিছিলাম। হুযুর পাঠালেন কালবৈশাখী্

কালবৈশাখী

ধূলা বালি শিমুল তুলা
খড়কুটা ঝরা পাতা
শোঁ শোঁ শোঁ পাগলা হাওয়া
রাতকানা চোখে
খিচখিচে ধোঁয়া।
গুড় গুড় গুড় মেঘের ডাক
কড় কড় কড় বিজলীর হাঁক
মড় মড় মড়াত
কড় কড় কড়াত
ঘরের চাল গাছের ডাল
কলা বাগান পেপের ক্ষেত
জলে ভেজা বজ্রপাত
শেকড় বাকড় চিতপাত।

জ্যৈষ্ঠ মাসে অর্ক , আফতাব , তপন , সবিতা সবাই মিলে শুরু করল খাণ্ডব দাহন। শুধু আমার মত টাকলু নয় চুলুরাও অতিষ্ঠ। একজন তো বলেই ফেলল,” বস, মাথা ন্যাড়া করলাম মাথা ঠাণ্ডা করতে । কাজ হয়না। রাতে মনে করলাম স্বমেহনে একটু শান্তি পাব । সব চেষ্টা সার। কুনো কাম হয়না । খালি মেজাজ খিঁচলাড় “। জ্যৈষ্টের দুপুরে বৃষ্টিকে আহবান করলাম কিন্তু শালী সাড়া দিলনা।

জ্যৈষ্ঠের দুপুর ও বৃষ্টি আবাহন।
জ্যৈষ্ঠের দুপুর
করোটিতে সূর্যকিরণ
মগজ হলো কর্পূর
জ্যৈষ্ঠের দুপুর।
বৃষ্টি আবাহন
ডিম মুখে পিঁপড়ের দল চলছে সারি সারি
ঝালাপালা হলো কান ঝিঁঝিঁর কিরি কির কিরি।
গলা ফুলিয়ে কোলা ব্যাঙ
গাইবে শুধু ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ।
ঝমঝমিয়ে মুষলধারে নেমে আসুক বারি !

কি আর করা , তার অপেক্ষায় লিমেরিক অপেক্ষা লিখলাম।
অপেক্ষা
কাজল মেখে মুচকি হাসি
বললে শুধু আসছি আসি
দুপুর বিকাল
রাত সকাল
আসার আশা হল বাসি !
গরমে ঘামে ঘামাচিতে অতিষ্ঠ হয়ে লেখা হল-

সূর্য সন্তান
জন্ম নিলো হাজারে হাজার
যথেচ্ছ বলাৎকারে
সাদা আর লালচে
হলদে আর কালচে
বর্বর বাবা কাকাদের
দেখে আরও হিংস্র
হয়ে ওঠে ওরা।
আর সব বেজন্মাদের
থেকেও বেয়াদব
ক্রমাগত নখরাঘাতে
বিবস্ত্র করে জননীকে
রক্তের নেশায়।

আষাঢ় মাসের প্রথম দিনে নামল বিপুল ঢল। পুকুর খাল বিল পানি ভর্তি হয়ে উঠে আসলো কৈ, টাকি , শোল মাছ। কি আনন্দ যে করল লোকে। ঘাসের উপর উঠে আসা মাছ ধরার মজাই আলাদা। ইচ্ছা টাকে পাথর চাপা দিয়ে জানালায় বসে সব দেখলাম। পদবি, স্ট্যাটাস , সুশীলতার বা* ছালে পাছে লোকে কিছু বলে।লাভের মধ্যে-

আষাঢ়ে ছড়া
বৃষ্টি এলো রিমঝিমিয়ে
টিনের চালে ঝমঝমিয়ে
জলের পরে টুবটুবিয়ে
কৈ টাকি শোল খলবলিয়ে
যাচ্ছে চলে উজান পানে !
বৃষ্টি এলো ঝমঝমিয়ে
গাছের পাতায় ছিপছিপিয়ে
আকাশ ছেয়ে বাতাস বেয়ে
সব কিছুকে ভিজিয়ে দিয়ে
তবু ঘেমে উঠছি নেয়ে !

শ্রাবণ মাসে নিদেনপক্ষে গোটা তিনেক শ্রাবণীর জন্ম হল। শ্রাবণের প্রচণ্ড বৃষ্টি দেখে প্রথম শ্রাবণী। তখন জানতাম শ্রাবণী মানে শ্রাবণ ঢল । এটি কিন্তু আমার দোষ নয়। ডিফারেন্ট টাচের একটা গান আছে- ” শ্রাবণের মেঘগুলো জড় হল আকাশে”। তার পর একরাতে সুপার মুনের জোসনায় ফেসবুক ঝলমল করছে। অভিধান খুলে দেখি শ্রাবণী মানে শ্রাবণ মাসের জোসনা ! তা হলে দুইটা হল । প্রকৃতির শ্রাবণী দেখে আরেক শ্রাবণী জন্ম নিল আমার কলমে। আমার মন চকোর হয়ে চন্দ্রালোক পান করতে চেয়েছিল। মাঝে মাঝে মনে হয় রূপকথা যদি সত্যি হত!

শ্রাবণী

চকোর হতে চাইছে এ মন
চল উড়ে যাই আকাশে
কোথায় পাবি জোসনা এমন
শ্রাবণ রাতের বাতাসে।

ভাদ্র মাস যথারীতি প্রচণ্ড গরম আশ্বিন ও তাই। মেঘ যেন কাশফুল………
গুমট আশ্বিন
মেঘ যেন কাশফুল একেবারে শুকনা
প্রাণবায়ু যায় বুঝি তবু পাতা নড়ে না
শারদীয় গরমে
মাথা ভরা ঘামে
আশ্বিনে ঝকাসটা এলো না।

কার্তিক – অগ্রহায়ণ

কার্তিকের ঘুঘু
পাকুড়ের শিখরে
ঘুঘু ডাকে ঘু ঘু করে
ডাকে তার সাথীরে
মাঠে ঘন দুধ জমে
কাঁচা পাকা ধানে
আয় ঘুঘু ঘু ঘু করে
ঘুঘু ডাকে ঘুঘুরে
নিয়ে আয় খড়কুটো
বাসা গড়ি দুজনে
ঘুঘু ডাকে ঘু ঘু করে
ডাকে তার সাথীরে
চরে চরে চরে চরে
চল ঘরে ঘুঘুরে
ঘুঘু ডাকে ঘু ঘু করে
কার্তিকের দুপুরে।
অগ্রহায়ণ
আবছা কুয়াশায় ঘুঘুর গান
মাঠে কাঁচা পাকা ধান
এল মিঠে অঘ্রাণ!

তার পর এল পৌষ মাস। কুয়াশা… খেজুর রস…

পৌষালী
গরম ঘুমে ঘুমিয়ে ছিল আদ্যিকালের বুড়ো
মেঘ মুলুকে থাকে সে তো হিমালয়ের খুড়ো
আগুন মাসের নতুন ধানে
উঠলে মেতে উৎসবে
সুবাস গিয়ে ঘুম ভাঙ্গে
তার হাড় কাঁপানর মচ্ছবে
খেজুর পাতা খুঁচপাতাড়ি
চুইয়ে নেমে ভরবে হাঁড়ি
একলা খেলে পৌষে পিঠে
তোমার সাথে আড়ি।

পৌষের পর ঘন কুয়াশা যেন মেঘ মাটিতে নেমে এসেছে। থারমোমিটারের পারদ গেল হাইবারনেশনে।

হিমপাত

হিমপাত
সাদা আঁধার মেঘ ঠাসা
হিম চুমে শীত ঘুমে
ডুব দেয় থারমো পারা।
Winter Falls
Down came the clouds
With arctic touch
Winter falls.
শীতে
বাঘে কাঁপে মাঘের শীতে
মেঘে নেমে এলো মাটিতে
খলসে পুঁটি মাছের ঝোল
জমে গেল বাটিতে ।

ফাল্গুন মাসে সরষে ফুলে মৌমাছির গুঞ্জন, হালকা হাওয়ায় হলুদ সবুজের ঢেউ । আহা সরষে ফুলে মৌমাছি

সরষে ফুলে মৌমাছি
ঝাপসা মোটেই নয়কো বাতাস
মাঘের শীতে কনকনে
রোদের আলোয় পষ্ট বটে
নয়তো মোটেই গনগনে।
আমোদেতেই আছেন তারা
আলসে মোটেই নয়কো যারা
নাই অজুহাত
মাঘ বোশেখে
কাঠফাটা রোদ
কিংবা শীতে
চপল হিমে
কিংবা ঘামে
সদাই যেন চনমনে
জানতে পেলুম গুঞ্জনে।
ফুলে পাতায় জমাট শিশির
হীরের মত ঝলমলে
শীতল হাওয়ায়
ঢেউ খেলে যায়
হলদে সবুজ মখমলে।
চুমুক দিয়ে সরষে ফুলে
মৌমাছিদের দলবলে
উঠলো গেয়ে গুনগুনিয়ে
গুনগুনিয়ে গুঞ্জনে
আহা মধু বেঁচে আছি
তুমি আমি আমরা
সবাই মিলে।

ফাল্গুনের এক কুয়াশা ঢাকা সকালে মুঠোফোনে শিমুল ফুলের ছবি তুলি। আমার কভার ফটো। মনে হচ্ছিল কোকিলের গানে আগুন লেগেছে যা রক্তের মত লাল ( পলাশ এর মত)। কিংশুক- শুক পাখির ঠোঁটের মত রক্তবর্ণ।

ফাগুনে।
পাতা ঝরা কাঁটা ভরা
শিমুলের ন্যাড়া ডালে
সাজলো রে কুহুতানে
কিংশুক লাল রঙে।

কালবৈশাথী এতদিন বৈশাখ মাসেই হত। ১৪২১ ব্যতিক্রম। চৈত্র মাসেই তার আগমন ঘটল সন্ধ্যা রাতে। খাণ্ডব তাণ্ডব যেন-

ঝড়ের রাতে
ঈশান কোনের পাগলা হাওয়া
কালবোশেখীর অকালবোধন
আসমানি ধমকে চমকে
বিজলির পলায়ন।
বাস্তুচ্যুত মশকদল উল্লাসে
মাতে শোণিত আগ্রাসনে।
ঘুমের রাজ্য দিশেহারা
কালচৈতির খাণ্ডব তাণ্ডবে।

এই ছিল ঋতুবৈচিত্র্য বঙ্গাব্দ ১৪২১

৩,৪৯০ বার দেখা হয়েছে

১৮ টি মন্তব্য : “সালতামামি ১৪২১”

  1. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    সারা বছর ধরে এইভাবে নিষ্ঠার সাথে ছন্দে-শব্দে-বর্নে লেগে থাকতে পারাটা বিরাট একটা গুন।
    অনেক অভিনন্দন এই রেজিলিয়েন্স দেখানোর জন্য।
    প্রায় সবই আগে পড়া।
    একসাথে পড়তে গিয়ে অনেক নতুন জিনিষ আবিষ্কার করলাম।


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন
  2. সামিউল(২০০৪-১০)

    অসাধারণ একটা কাজ করেছেন ভাই।
    পুরো ব্লগে মনে হয় একমাত্র আপনিই এভাবে সারাবছর ধরে লিখে গেছেন।
    স্যালুট ভচ!!


    ... কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!

    জবাব দিন
  3. সাবিনা চৌধুরী (৮৩-৮৮)

    🙂 🙂 🙂 🙂

    বর্ণিল লেখা তোমার ভাইয়া! পড়তে পড়তে ঘুরে এলাম যেন দেশ থেকে।

    পান্তা থেকে খেজুর গুড়ের সুবাস সেই সাথে ঘুঘুর আচ্ছন্ন ডাক অথবা কৈ টাকি শোলের খলবলানো এক সাথে পাওয়া সহজ নয় মোটে।

    জবাব দিন
  4. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    দারুন কাজ হয়েছে মোস্তাফিজ ভাই, এভাবে ছন্দে ছন্দে সালতামামি নিঃসন্দেহে ইউনিক 🙂


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।