পোড়া পতাকার গন্ধ

আমার গায়ে এই যে জার্সিটা দেখছেন, সেটা খুব পরিচিত লাগছে, তাইনা? হুম, লাগতেই হবে। এশিয়া কাপে আমরা এই জার্সি পরে খেলেছি। ভারত আর শ্রীলংকাকে ঘোষণা দিয়ে হারিয়েছি। ফাইনালে পাকিস্তানকে হারিয়ে কাপ উঁচিয়ে ধরতে পারিনি। বরং সাকিব-মুশফিক-নাসিররা মাথা নিচু করে কেঁদেছে। বাঙালির চোখের নোনতা জলে ভিজেছে এই লাল-সবুজের জার্সি। জানেন, আমি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। খুব কষ্ট।

খুব বেশি কষ্ট পেলে আমি বারান্দায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি। আকাশ দেখি। মেঘ দেখি। দুপুরের রোদে কৃষ্ণচূড়ার ছায়া দেখি। মধ্যরাতে সোডিয়াম বাতির হলুদ আলো দেখি। নীরব বাতাস এসে আমার দুঃখ ছুঁয়ে যায়। আমি আনমনেই একা একা হেসে ফেলি। আমার মন ভালো হয়ে যায়।

কিন্তু সেদিন খেলা শেষে আমি মা-কে কল করলাম। জানেন, আমি কোনো কথাই বলতে পারছিলাম না। শেষমেষ ভাঙা গলায় আমতা আমতা করে খানিকটা কাঁদলাম। আর আমার মা খুব করে হাসলেন। বাবার সাথে ঠাট্টা করলেন। আমাকে ‘পাগল ছেলে’ আর ‘গাধা’ নাম দিয়ে পিঠে সিল মেরে দিলেন। ফোন কেটে দেয়ার আগে বললেন, ওরা পরেরবার জিতবেই।

হ্যাঁ, পরেরবার এই জার্সি পরে ওরা জিতেছিল। দেশের মাটিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে ওয়ানডে সিরিজ জিতেছিল। আমি আনন্দে আবারও ফোন করেছিলাম। মা আবারও খুব হেসেছিলেন। আর বলেছিলেন, শোন এরপর থেকে তুইও ওদের সাথে জার্সি পরে মাঠে নেমে যাবি।

পরদিন আমি গেলাম গুলিস্তানে। পাইকারি স্পোর্টস মার্কেটে এই জার্সি পেলাম না। পেলাম পুরনো সিরিজের জার্সি আর বিশ্বকাপের জার্সি। গেলাম নিউমার্কেটে। এখানেও পেলাম না। এবার গেলাম বসুন্ধরা সিটির তৃতীয় তলায়। পাঁচশো টাকায় পছন্দের ফুটবল ক্লাবের জার্সি কেনা এই আমি বারোশো পঞ্চাশ টাকায় কিনলাম বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমের জার্সি। অনেকের কাছেই এই জার্সির ডিজাইন পছন্দ হয়নি। তাদের কাছে নাকি এটা দেখতে তরমুজের মত। আমার কাছে কিন্তু খুব ভালো লেগেছে। এর আগে কোনো জার্সিতে লাল রঙ টা এতো টকটকে ছিল না।

এরপর অসংখ্যবার আমি এই জার্সি পরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থেকেছি। আকাশ দেখেছি। মেঘ দেখেছি। দুপুরের রোদে কৃষ্ণচূড়ার ছায়া দেখেছি। মধ্যরাতে সোডিয়াম বাতির হলুদ আলো দেখেছি। নীরব বাতাস এসে আমার দুঃখ ছুঁয়ে গিয়েছে। আমি আনমনেই একা একা হেসে ফেলেছি। আমার মন ভালো হয়ে গেছে।

আর কিছুক্ষণ পরেই নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের প্রথম ম্যাচে মাঠে নামছে বাংলাদেশ। চাচাতো ভাইকে বহু অনুরোধ করে একটা টিকেট ম্যানেজ করে দিয়েছে প্রেমিকা। আমি লাল-সবুজের জার্সি পরে মিরপুরের বাসে উঠেছি। আরও আধঘণ্টা লাগবে পৌঁছতে। হরতাল বলে রাস্তায় ভিড় কম। আমি পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করলাম। মাকে একটা কল করতে হবে। দোয়া চাইতে হবে। আমার মায়ের দোয়া কখনোই বিফলে যায় না। আজ বাংলাদেশ জিতবেই। জিততেই হবে। ফোন বাজছে। হ্যালো মা……

আচমকা কড়া ব্রেক কষল লোকাল বাসটা। সামনের সিটের পেছনে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে গেল হাতের মোবাইল ফোন। অনেকগুলো লোক হঠাৎ ঘিরে ফেলল আমাদের বাস। বাঁশ আর লাঠির আঘাতে ভেঙে গেল ড্রাইভারের সামনের গ্লাস। ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল জানালার কাঁচ। আমি জানালা দিয়ে বেরিয়ে যেতে চাচ্ছি। আমার সামনে একটা লোক বড় এক টুকরো ইট ছুঁড়ে মারছে ঠিক আমার দিকেই। কী হচ্ছে?? কী হচ্ছে এসব???

আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। কপাল থেকে গড়িয়ে নামা রক্তে চোখের দুই পাতার পাপড়ি একসাথে লেগে যাচ্ছে। আমি পড়ে আছি বাসের মেঝেতে। চারিদিকে প্রচণ্ড শব্দ আর হই চই। নিশ্চয়ই বাংলাদেশ খুব ভালো খেলছে, তাইনা? সাকিব খুব পেটাচ্ছে বুঝি?? নাকি তামিম আরও একটা ছক্কা মারল এখন?? মাশরাফি উইকেট পেল নাকি?? নাসির কি আবারও শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচ জিতিয়ে দিল আমাদের?? কী হল ভাই?? বলেন না কেউ!!

সব শব্দ ধীরে ধীরে দূরে কোথাও মিলিয়ে যাচ্ছে। আমার চারপাশে এখন অনেক আলো। এই আলোর রঙ লাল-হলুদ-কমলায় মেশানো। এই আলোতে অনেক উত্তাপ। আমার লাল-সবুজ জার্সি এই আলোতে পুঁড়ে যাচ্ছে। আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। আমি একটা গন্ধ পাচ্ছি। পতাকা পোঁড়া গন্ধ। আমার মায়ের শাড়ির আঁচল পোঁড়া গন্ধ।

যখন আমার শরীরের মাংস পুঁড়ছিল, দুই নেত্রী তখন ক্ষমতার দড়ি টানাটানি করছিল।

২,৫৯১ বার দেখা হয়েছে

১১ টি মন্তব্য : “পোড়া পতাকার গন্ধ”

  1. মোকাব্বির (৯৮-০৪)

    চমৎকার লাগলো। গল্প তবুও এমন যেনো আগামী কয়েকদিনে কারো না হয় সেই কামনা করি!


    \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
    অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

    জবাব দিন
  2. আসিফ খান (১৯৯৪-২০০০)

    রিফাত@ সমস্ত দূরাশাকে জয় করে এগিয়ে যাওয়া স্রোতের নামই জীবন, আর যে দলের সাথে মায়ের দোয়া আছে, ভাইয়ের উদ্দাম আবেগ আছে, বোনের আনন্দাশ্রু মিশে আছে, বাবার বকুনির আড়ালে খেলা দেখবার ছেলেমানুষি আছে তার জয়রথ চলবেই চলবেই।

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।