ফিক্সড! ক্যাশ এন্ড করাপশন ইন ক্রিকেট (২য় পর্ব)

বাজির সকল কর্মকাণ্ড অত্যন্ত গোপনীয় এবং জটিল নেটওয়ার্কের সমন্বয়ে গঠিত। উদাহরণ হিসেবে তাদের কর্মস্থলের কথা বলা যায়। পুলিশের চোখে ধুলো দেয়ার জন্য ভারতীয় বুকিরা সব সময় চরম বিলাসবহুল এবং ব্যতিক্রমধর্মী স্থান নির্ধারণ করে। কেউ প্রত্যন্ত গ্রামীণ পরিবেশে স্যাটেলাইট ফোনের মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনা করে, আবার কেউ পুলিশকে ঘুষ দিয়ে ম্যানেজ করে একেবারে স্টেডিয়ামের পাশেই অফিস খুলে বসে। আবার অনেকে আছে যারা বিলাসবহুল ফাইভ স্টার হোটেলের টপ ফ্লোরে বসে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে, কেননা সেখানে সাধারণ মানুষের আনাগোনা নেই বললেই চলে। সাম্প্রতিক সময়ে মুম্বাইতে দুটো কেস পাওয়া গেছে যেখানে ইনভেস্টমেন্ট ফোরামের আলোচনা অনুষ্ঠানের কথা বলে জনসমক্ষে বুকিদের মিটিং এর আয়োজন করা হয়েছিলো! ‘মুম্বাই শহরের রিয়েল এস্টেট ব্যবসার রুগ্নদশা থেকে পরিত্রাণ লাভের উপায়’- বিষয়ক সেমিনারের আড়ালে আলোচনা হয়েছে অবৈধ বাজি, কালো টাকা লেনদেন, কে কোন দল বা খেলোয়াড় নিয়ে ফিক্সিং করবে ইত্যাদি নিয়ে। এটি ২০১৪ সালের আইপিএল এর ঠিক আগের ঘটনা এবং অনুষ্ঠানের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলো খোদ মুম্বাই পুলিশ বাহিনী!

বুকিদের জগত পুরো পৃথিবী জুড়ে বিস্তৃত। নিখুঁত পরিকল্পনা এবং সেগুলোর সুষ্ঠু বাস্তবায়নের ফলে বাজির কাজ চলে একেবারে নতুন কেনা মেশিনের মত সাবলীল ও নিঃশব্দে। প্রতিটি কাজ ভাগ করা থাকে এবং প্রত্যেক ক্ষেত্রেই রয়েছে একাধিক ব্যাকআপ। ফলে, ব্যর্থতার কোন সম্ভাবনাই নেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লিখিত কিছু ব্যবহৃত হয় না, যাতে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে যাবার মত কোন প্রমাণ না থাকে। লিখিত কিছুর দরকারও পড়ে না। কারণ, এটি এমন এক জগত যেখানে মুখের কথাতেই শত শত, হাজার হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয়।

পিরামিডের মত সবার উপরে থাকে গুটিকতক প্রবল প্রতাপশালী ব্যক্তিবর্গ যারা একটি শহরের বা রাজ্যের নির্দিষ্ট এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে। উদাহরণ হিসেবে ভারতের কথাই ধরা যাক। ভারতকে প্রথমে পাঁচটি অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে-পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চল। এই পাঁচটি অঞ্চলের আবার প্রত্যেকটির দু’টো করে মিনি-অঞ্চল আছে। এখানেই শেষ নয়। প্রতিটি মিনি অঞ্চলকে ভাগ করা হয়েছে তিনটি করে সাব-মিনি অঞ্চলে! নির্দিষ্ট এলাকার কাজের নির্দেশনা, তথ্য, বাজির দর আসে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের উপরে থাকা নেতার কাছ থেকে। ফলে, এক অঞ্চলের সাথে আরেক আরেক অঞ্চলের তথ্যের বা বাজির দরের কোন মিল থাকে না। একে তো কাগজে কলমে এর কোন অস্তিত্ব নেই, তার উপর সমস্ত কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় স্বতন্ত্র্য অঞ্চল ও ভিন্ন ভিন্ন স্তর ভিত্তিক, ফলে কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে বাইরে থেকে পুরো চিত্রটি দেখার কোন উপায় নেই। এই কারণে মূল হোতারা সব সময় ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই রয়ে যায়।
উপরের কথাগুলি আমাকে জানিয়েছিলেন প্রবীন রঞ্জন নামক এক পুলিশ অফিসার। তিনি দীর্ঘদিন দিল্লি পুলিশ এবং সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (CBI) -এ কর্মরত ছিলেন। সবশেষে ইনপেক্টর জেনারেল হিসেবে তাঁর পোস্টিং হয়েছিল পুড়ুচেরিতে (সাবেক পন্ডিচেরি)।

২০১৩ সালে নেয়া সেই সাক্ষাতকারে তিনি একটি ঘটনার বিবরণ দিয়েছিলেন। ঘটনাটি ঘটেছিল খোদ ভারতের রাজধানীতে! দিল্লিতে চাকুরিরত অবস্থায় একদিন এক ভদ্রলোক তাঁর সাথে দেখা করতে আসেন। তার স্কুলগামী ছেলে বাজির সাথে জড়িয়ে পড়েছিল। এক পর্যায়ে সে বেশ মোটা অংকের টাকা খুইয়ে ফেলে। বকেয়া টাকা পরিশোধের তাগিদ দিয়ে বাসায় হুমকি দেয়া শুরু হওয়ার পর ভদ্রলোক পুরো ঘটনা জানতে পারেন। ছেলেটি তখনও কলেজের গণ্ডী পার হয় নি- সেন্ট জর্জ স্কুলে পড়ত, সম্প্রতি বাজির অভিযোগে স্কুল থেকে বহিষ্কৃতও হয়েছে। শুধু তাই নয়, বাজিতে সে প্রায় ১৫ লাখ রুপি হেরেছিল! উপায়ন্তর না দেখে ছেলেটির বাবা প্রবীন রঞ্জনের কাছে সাহায্য চাইতে এসেছেন। পুলিশের মধ্যস্থতায় শেষ পর্যন্ত ঘটনাটির ‘শান্তিপূর্ণ’ সমাধান করা সম্ভব হয়। কিভাবে, কার সাথে কথা বলে বা কত টাকায় আপোষ হয়েছিলো- সে ব্যাপারে জনাব রঞ্জন বিস্তারিত কিছু জানান নি। তিনি বলেছিলেন- ঐ কেসটা আমার জন্য একেবারেই অন্যরকম অভিজ্ঞতা ছিলো, দুঃখজনক তো বটেই। এই ঘটনা এটাই প্রমাণ করে যে যারা বাজি ধরে তারা কত সহজে ভয়ানক এই জগতের সাথে জড়িয়ে পড়ে এবং সর্বস্ব খোয়ায়।

বেশ কয়েক বছর ধরেই বিভিন্ন পর্যায়ের ক্রিকেটে ম্যাচ ফিক্সিং নিয়ে অনেক অভিযোগ এবং প্রমাণও পাওয়া গেছে। তার মানে যারা জেতার আশায় বাজি ধরছে তাদের অনেকে জানেই না খেলা শুরুর আগেই তাদের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে আছে এবং তাদের টাকা নিশ্চিতভাবে মার যাবে।

কিন্তু, বাজির জগতের কলকাঠি কারা নাড়ে? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে একটি ঘটনার কথা মনে পড়ল। ঘটনাটি শুনেছিলাম দুবাইতে বসবাসকারী এক ইঞ্জিনিয়ারের কাছ থেকে, তার নাম অরুপ দত্ত। ভদ্রলোক ইঞ্জিনিয়ার হলেও ক্রিকেটের একনিষ্ঠ ভক্ত।

আপনাদের হয়ত মনে আছে যে ’৯০ দশকের শেষের দিকে ম্যাচ ফিক্সিং এর ঘটনায় পুরো ক্রিকেট দুনিয়া টালমাটাল হয়ে উঠেছিল। সে সময় একের পর এক অবিশ্বাস্য সব ঘটনা প্রকাশিত হচ্ছিল এবং ভারতীয় ক্রিকেটারদের নিয়েও অনেকগুলো লেখা এসেছিল। একই সময় অরুপ দত্ত একটি বই প্রকাশ করেছিলেন যা ছিল মূলত ভারতীয় রাজনীতিবিদ নরেন্দ্র মোদির বিভিন্ন সময়ের নানাবিধ ছবি নিয়ে। এক মধ্যে একটি ছবিতে মোদিকে দেখা যায় দুবাই এর বিলাসবহুল এক হোটেলে।

ঘটনাটি ১৯৯৮ সালের। উক্ত হোটেলে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে অতিথিবৃন্দ সবে একে একে আসা শুরু করেছেন। হোটেলের সামনে রাখা একটি বিশাল ইলেক্ট্রিক স্ক্রিনে ‘স্বাগতম’ কথাটির নিচে বড় বড় অক্ষরে আগত অতিথিবৃন্দের নাম দেখানো হচ্ছিল। এক পর্যায়ে দেখা গেল দাউদ ইব্রাহিমের নাম। সাথে একজন লোক নিয়ে সে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হল। কয়েক সেকেন্ড পর সেখানে দেখা গেল ভারতীয় ক্রিকেটার মোহাম্মদ আজহারউদ্দিনকে। কিছুক্ষণ কুশল বিনিময় করার পর দাউদ ইব্রাহিমের সঙ্গীর কাছ থেকে একটি খাম নিয়ে আজহারউদ্দিন ঘটনাস্থল ত্যাগ করল।
এই ঘটনার দুই বছর পর, ৩১ অক্টোবর ২০০০ সালে সিবিআই এর ১৬২ পৃষ্ঠার এক তদন্ত রিপোর্টে জানা গেল আজহারউদ্দিন ও তার সতীর্থ একাধিক খেলোয়াড় ম্যাচ ফিক্সিং এর সাথে যুক্ত ছিল এবং তাদেরকে আজীবনের জন্য ক্রিকেট থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, পরবর্তীতে আজহারের আত্মজীবনী নিয়ে নির্মিত সিনেমায় ফিক্সিং সংক্রান্ত বিভিন্ন ঘটনা প্রকাশ করার ক্ষেত্রে সিনেমার পরিচালককে সে কোন বাঁধা দেয় নি।

যাই হোক, আমি মোটামুটি নিশ্চিত ক্রিকেটের সাথে সংশ্লিষ্ট লোকজনই ফিক্সিং এর ঘটনার সাথেও জড়িত। কারণ, তাদের নাকের ডগার সামনে অথচ তাদেরই অজান্তে ফিক্সিং করা কোনমতেই সম্ভব নয়। শুধু তাই নয়, অত্যন্ত ক্ষমতাবান লোকজনও এর সাথে জড়িত রয়েছে। যে কারণে, যতবারই কেউ ফিক্সিং এর তদন্ত করতে সামনে এগিয়েছে, বিভিন্ন মহলের চাপে তাকে পিছিয়ে আসতে হয়েছে।
উদাহরণ হিসেবে একটি ঘটনা উল্লেখ করছি। ২০১৫ সালের ৩১ মার্চ সকাল বেলা আইপিএল স্পট ফিক্সিং এর ব্যাপারে তদন্তে নিয়োজিত কর্মকর্তা বি বি মিশ্র জানতে পারলেন সুষ্ঠুভাবে কাজটি শেষ করার লক্ষ্যে তাঁর চাকুরির মেয়াদ বাড়ানোর যে আবেদন তিনি করেছিলেন তা নাকচ করা হয়েছে। উল্লেখ্য, তাঁকে মাদক নিয়ন্ত্রণ ব্যুরো থেকে তাঁকে ধার হিসেবে মুড়গাল তদন্ত কমিটিতে নেয়া হয়েছিল। আবেদন নাকচ হবার কারণ জিজ্ঞাসা করে কোন মহল থেকেই উত্তর পান নি। খোদ বিসিসিআই থেকেও কোন টু শব্দটি করা হয় নি। পুলিশে কর্মরত তাঁর বন্ধু-বান্ধব এমন কী দিল্লি পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণও কিছু বুঝতে পারছিলেন না।

এ সময় মিশ্র সাহেবের একাধিক শুভাকাঙ্খী বাড়িতে এসে তার সাথে দেখা করেছে এবং তাদের অনেকেই সরাসরি সাবেক প্রধান বিচারপতি লোধা বরাবর চিঠি লেখারও পরামর্শ দিয়েছিল। উল্লেখ্য, সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারপতি টি এস ঠাকুর এবং ফকির মোহাম্মদ ইব্রাহিম খলিফুল্লার সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ প্রবল প্রতাপশালী এন শ্রীনিবাসনকে বিসিসিআই এর প্রধান পদ থেকে সরানোর যে ঐতিহাসিক রায় দিয়েছিল, সেটার পরবর্তী ধাপ নিয়ে কাজ করছিলেন জনাব লোধা এবং তাঁর দল। সেই রায়ে বলা হয়েছিল শ্রীনিবাসনকে ক্রিকেট বোর্ড অথবা চেন্নাই সুপার কিংস- দু’টোর মধ্যে যে কোন একটি বেছে নিতে হবে।

এক পর্যায়ে জনাব মিশ্র বুঝতে পারলেন তদন্তের কথা ভুলে সামনে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই। কেননা, বারংবার বলা সত্ত্বেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ইন্টিগ্রেটেড ফাইনান্স ডিপার্টমেন্ট (IFD) তার চাকুরির সময়সীমা বৃদ্ধির আবেদনের ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ নেয় নি, অর্থাৎ, তাকে ৩১ মার্চেই অবসরে যেতে হবে। অথচ, অতিরিক্ত সময় পেলে আইপিএল এর সাবেক সিওও সুন্দর রমন এর বিরুদ্ধে চলমান বিচারপতি লোধা কমিটির তদন্তে তিনি সাহায্য করতে পারতেন। উল্লেখ্য, মুড়গাল কমিটির রিপোর্টে রমন এর কথা উল্লেখ, ছিল কেননা সে ২০১৩ সালের আইপিএল চলাকালীন বুকিদের সাথে যোগাযোগ বজায় রেখেছিল।

অবশ্য, বুকিদের সাথে যোগাযোগ করার যত অভিযোগ মুম্বাই ও দিল্লি পুলিশ করেছে সেগুলো সুন্দর রমন জোরের সাথে অস্বীকার করেছে। এমনকি সে শপথ করে বলেছে জুয়ার সাথেই সে কখনও সংশ্লিষ্ট ছিল না। তবে, সুপ্রিম কোর্টে শুনানীর সময় তার উকিল যেসব বক্তব্য দিয়েছে, সেসব শুনে যে কারও মনে খটকা জাগবে। যেমন, তার উকিলের ভাষ্যমতে আইপিএল এ বুকিদের অনুপ্রবেশের কথা শুনে রমন নাকি নিজেই দুবাইতে অবস্থিত আইসিসি’র দুর্নীতি দমন ইউনিটকে সতর্ক করেছিল। অথচ, আইপিএল তো আইসিসি’র কোন ইভেন্ট নয়, নিতান্তই ভারতের একটি ঘরোয়া টুর্নামেন্ট। তাহলে সে বিসিসিআই’কে জানালো না কেন?

জিজ্ঞাসাবাদের সময় রমনকে যতবার প্রশ্ন করা হয়েছে ততবারই সে জানিয়েছে যে আইপিএল এর বিতর্কিত ব্যাপারগুলো সম্পর্কে সে অবহিত ছিল না। এ সময় সে আদৌ আইপিএল এর সিওও কী না বলে সন্দেহ প্রকাশ করা হলে সে চুপ মেরে ছিল। একইভাবে তাকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয় যে সিএসকে’র ঠিকানা দু’টো (একটি চেন্নাই, আরেকটি রাঁচির নতুন ক্রিকেট স্টেডিয়াম) কেন, রমন কোন জবাব দিতে পারে নি।

আসলে, রমন যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল বেশির ভাগ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পার পেতে। কিন্তু, সে জানত না মিশ্র সাহেব যথেষ্ট হোমওয়ার্ক করেই মাঠে নেমেছেন। তিনি রমন ও বিন্দু দারা সিং এর বিভিন্ন কথোপকথন থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। একই সাথে শুনেছেন সিং এবং সুনীল পান্টারের কল রেকর্ডও। উল্লেখ্য, দুবাইতে বসবাসকারী সুনীল ছিল ২০১৩ সালের আইপিএল এ বড় অঙ্কের জুয়ারীদের মধ্যে অন্যতম।

#ক্রিকেট #দুর্নীতি #ফিক্সিং #বেটিং #আইপিএল #আইসিসি
(চলবে)

১ম পর্ব

১টি মন্তব্য “ফিক্সড! ক্যাশ এন্ড করাপশন ইন ক্রিকেট (২য় পর্ব)”

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।