ক্রিকেট ছিল আমার প্রথম প্রেম। ক্রিকেটের কারণে যত সময়, মেধা ও শ্রম নষ্ট করেছি সেসব অর্থনীতি বিষয়ে ব্যয় করলে এত দিনে আমি হয়ত দু’টো নোবেল প্রাইজ জিততে পারতাম। কিন্তু ইদানিং সেই প্রেমে ভাটা পড়েছে। আসলে কিছুই নেই। এর প্রথম ও প্রধান কারণ আমাদের অযোগ্য ও দুর্নীতিপরায়ন ক্রিকেট বোর্ড। এ রকম সুইসাইডাল বোর্ড ওয়েস্ট ইন্ডিজ ছাড়া পৃথিবীর কোথাও দেখতে পাওয়া যাবে না। তথাকথিত এই অভিভাবকের কারণে দেশের ক্রিকেট নিয়ে আমি ভীত ও শঙ্কিত। এজন্য, গত প্রায় চার বছর খেলাও দেখি না।
দ্বিতীয় কারণের নাম এড হকিন্স। বিভিন্ন পুরস্কারপ্রাপ্ত, ফ্রিল্যান্স এই ব্রিটিশ সাংবাদিক একজন বেটিং (বৈধ) বিশেষজ্ঞ। তাঁর লেখা Bookie Gambler Fixer Spy বইটি পড়ে ক্রিকেট দুনিয়ার অবৈধ জুয়ার জগত সম্পর্কে যা জেনেছি তা ক্রিকেট থেকে বিশ্বাস উঠিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট।
তৃতীয় কারণ শান্তনু গুহ রায় এর লেখা FIXED! Cash and Corruption in Cricket বই। এটা পড়ে জেনেছি আরও অনেক না জানা তথ্য এবং খবর। বুঝতে পেরেছি ক্রিকেট থেকে বেটিং, ফিক্সিং, দুর্নীতি দূর করা শুধু কঠিনই নয়, অসম্ভব। লাভের অংক অনেক দূর পর্যন্ত যায়। ফলে, ক্রিকেট দুর্নীতির বলার মত কোন তদন্ত, বিচার, শাস্তি কিছুই হয় না…মাঝে মাঝে যা হয়, সবই আইওয়াশ।
বছর দু’য়েক আগে ঠিক করেছিলাম বইটি অনুবাদ করব। কিন্তু কাজ একেবারেই এগোচ্ছে না। তাই ঠিক করেছি যেটুকু অনুবাদ করেছি সেটা কিস্তি আকারে প্রকাশ করতে থাকি…এভাবে হয়ত এক সময় পুরোটা শেষ করার অনুপ্রেরণা পেয়ে যাব।
Here we go…
————
FIXED! Cash and Corruption in Cricket
-SHANTANU GUHA RAY
————
”১ম পর্বঃ”
সূচনাঃ
২৪ জুন ২০১৫। দিল্লি।
ভারতের সাবেক প্রধান বিচারপতি আর এম লোধা এক সাংবাদিক সম্মেলনে ঘোষণা দিলেন বিশ্বের সবচেয়ে দামি ক্রিকেট ফ্রাঞ্চাইজি লিগ, ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (IPL) হতে দুই বছরের জন্য চেন্নাই সুপার কিংস (CSK) এবং রাজস্থান রয়েলস (RR) কে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
কথাটি শেষ হতে না হতেই শতাধিক টিভি রিপোর্টার মাইক্রোফোন হাতে তাঁর সামনে যাবার জন্য হুড়োহুড়ি শুরু করল। ওদিকে, উপস্থিত প্রিন্ট মিডিয়া, নিউজ এজেন্সি এবং অনলাইন পোর্টালের সাংবাদিকগণ সমস্বরে উচ্চকণ্ঠে প্রশ্ন করতে লাগল। সবাই এক সাথে কথা বলার কারণে এক পর্যায়ে সেটি তীব্র চিৎকারে পরিণত হল। উচ্চশব্দ থেকে বাঁচতে একটু পর পর লোধা হাত দিয়ে নিজের কান ঢেকে রাখছিলেন। শত শত মানুষের হাজারো প্রশ্ন! সবাই ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ জানতে উদ্গ্রীব।
কিন্তু তদন্তের স্বার্থে যুক্তিসঙ্গত কারণেই জনাব লোধা এই বিষয়ে আর বেশি কিছু বললেন না।
অবশ্য, খবরের শিরোনাম লেখার জন্য এর চেয়ে বেশি কিছুর দরকারও ছিল না। আইপিএল এর অন্যতম সফল দুই দলকে ‘খেলার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার দায়ে’ নিষিদ্ধ করাটাই বিশাল এক খবর! সম্মিলিতভাবে মোট তিনবারের শিরোপা জয়ী দুই দল বেশ কিছু দিনের জন্য আইপিএল থেকে ছিটকে পড়ল!
সকল টেলিভিশন চ্যানেলে এক যোগে ব্রেকিং নিউজ দেখানো শুরু হল। আদালতের এই রায় ভারত তথা পুরো ক্রিকেট বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। তিন সদস্য বিশিষ্ট্য তদন্ত কমিটি চেন্নাই ও রাজস্থানকে শাস্তি দেয়ার পাশাপাশি দল দু’টির অন্যতম দুই শীর্ষ কর্মকর্তা যথাক্রমে গুরুনাথ মায়াপ্পন এবং রাজ কুন্ড্রকে আজীবনের জন্য ক্রিকেটে অবাঞ্চিত ঘোষণা করেছে। অর্থাৎ, তারা আর ক্রিকেট সংক্রান্ত কোন রকম কার্যক্রমে অংশ নিতে পারবে না। তদন্তে এই দুজনের বিরুদ্ধেই খেলা নিয়ে বাজি ধরা এবং ম্যাচের তথ্য বাজিকরদের কাছে পাচার করার প্রমাণ মিলেছে!
ইন্ডিয়ান সিমেন্ট লিঃ কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর গুরুনাথ মায়াপ্পন এর আরেক পরিচয় সে সাবেক ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল এর সাবেক চেয়ারম্যান এবং ভারতের ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড এর প্রেসিডেন্ট এন শ্রীনিবাসন এর জামাই। ওদিকে রাজ কুন্ড্র একজন নামকরা ব্যবসায়ী এবং রাজস্থান রয়েলস এর ১১.৭ ভাগ অংশের মালিক। উল্লেখ্য, সে বলিউডের প্রখ্যাত অভিনেত্রী শিল্পা শেঠি’র স্বামী।
আবার সাংবাদিক সম্মেলনে ফিরে যাই। বিচারপতি লোধা রায়ের সারাংশ পড়া শুরু করলেন। দুই পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন কমিটির বাকি দুই সদস্য- বিচারপতি অশোক ভান এবং বিচারপতি আর ভি রভিন্দ্রন। ক্রিকেটকে এমনভাবে কলঙ্কিত করা হয়েছে যে সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে যে খেলাটি আদৌ পরিচ্ছন্ন আছে কী না। গুরুনাথ ছিল সিএসকে’র অবিচ্ছেদ্য অংশ ফলে, জুয়ার সাথে তার সংশ্লিষ্টতা কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না।
২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে গঠিত হওয়া তদন্ত কমিটির রিপোর্ট শেষ হলো এই কথার মাধ্যমে যে, যদিও কুন্ড্র’র বিরুদ্ধে ম্যাচ ফিক্সিং এর কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নি, তবুও ফ্র্যাঞ্চাইজি দলের একজন মালিক হিসেবে সে খেলার উপর কালিমা লেপন করেছে। এগুলো তাদের ব্যক্তিগত কর্মকান্ড এবং দল কোনমতেই দায়ী নয়- বলে পার পাওয়া যাবে না।
প্রায় ছ’মাস তদন্ত করার পর কমিটির দেয়া রায়ই চুড়ান্ত এবং নড়চড় হবার তেমন কোন সুযোগ নেই। জনাব লোধা নিজেই সেটা ব্যাখ্যা করলেন- সুপ্রিম কোর্ট থেকে বলা হয়েছে ন্যায়বিচারের স্বার্থে তারা আমাদের রিপোর্টে হস্তক্ষেপ করতে পারে। অর্থাৎ, অভিযুক্তদের আপিল করার অবশ্যই সুযোগ আছে। তবে, যেহেতু আমরা তিনজন জ্যেষ্ঠ্য বিচারপতি মিলে রিপোর্ট তৈরি করেছি, সেহেতু কোন কোর্টের এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
সবশেষে তিনি জানালেন এই বিষয়ে আরো তদন্ত চলবে এবং পরবর্তীতে তিনি আরেকটি রিপোর্ট পেশ করবেন। যা শেষ পর্যন্ত তিনি জমা দেন ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে।
ওদিকে সাবেক বিচারপতি মুকুল মুড়গালও আইপিএল এ বেটিং এবং ম্যাচ ফিক্সিং নিয়ে আরেকটি তদন্ত পরিচালনা করেছিলেন। সেই তদন্তের রিপোর্ট তিনি জমা দেন ২০১৫ সালে।
দিল্লি এবং দিল্লি ক্রিকেট এসোসিয়েশনের (DDCA) বিরুদ্ধে নানাবিধ দুর্নীতির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় আম আদমি পার্টি পরিচালিত রাজ্য সরকারের উদ্যোগে মুড়গাল তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তবে, সন্দেহের মূল তীরটি ছিল তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এবং ডিডিসিএ’র দীর্ঘদিন ধরে সভাপতির পদে থাকা অরুন জেটলি। আম আদমি পার্টি হতে তার বিরুদ্ধে ডিডিসিএ’র ব্যাপক দুর্নীতির প্রভাবক হিসেবে অভিযুক্ত করা হয় এবং বলা হয় সে ‘এসোসিয়েশনের নানা স্ক্যান্ডাল ও দুর্নীতি দেখেও না দেখার ভান করেছে!’ এসব অভিযোগের পর ক্ষুব্ধ জেটলি নিজে সরাসরি কিছু না করলেও ঝানু সাংবাদিক রজত শর্মা’র মাধ্যমে আইনি ব্যবস্থা নেয়। রজত শর্মা আম আদমি পার্টির বিরুদ্ধে দিল্লি কোর্টে ১০০ কোটি টাকার মানহানি মামলা ঠুকে দেয়।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, মুড়গাল রিপোর্টের বক্তব্য কিন্তু আম আদমি পার্টির অভিযোগের সাথে মিলে যায় এবং পাশাপাশি আরো বিস্তৃত অপরাধের আলামতও পাওয়া যায়। দিল্লি হাইকোর্ট থেকে ২০১৫ সালে নিযুক্ত মুকুল মুড়গালের দায়িত্ব ছিল ভারত বনাম দক্ষিণ আফ্রিকার চতুর্থ টেস্টের তদন্ত করা। তদন্ত শেষে ২৭ পৃষ্ঠার রিপোর্টে তিনি ডিডিসিএ’র বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি উত্থাপণ করেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো- কাজে স্বচ্ছতার অভাব, হিসেবে গড়মিল, টাকা-পয়সা লেনদেনে গড়িমসি এবং দুর্বল ব্যবস্থাপনা।
ভেতরের সর্বশেষ খবর বিস্তারিত জানার জন্য আমি আমার এক সোর্সের সাথে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিই। উভয়ের সম্মতিক্রমে আমরা বসি ‘চকো লা’ নামক ছোট এক ফাস্ট ফুড দোকানে যেটি দিল্লির খান মার্কেটে অবস্থিত। নির্দিষ্ট সময়ে সেখানে প্রথমে আমি পৌঁছাই এবং এর কিছুক্ষণ পর তিনি হাসিমুখে উপস্থিত হলেন। আলোচনার শুরুতেই তিনি বললেন, ‘ভেবো না যে আম আদমি পার্টি যেসব অভিযোগ করেছে শুধু সেগুলো নিয়েই সমস্যা, ভেতরে আরো অনেক ঘটনা রয়েছে!’
এ কথা মোটামুটি সর্বজনবিদিত যে ২০১৩-১৪ সালে বিসিসিআই এর বেশ কিছু সংখ্যক কর্মকর্তার ফোনে আড়িপাতার জন্য লন্ডন-ভিত্তিক এক গোয়েন্দা সংস্থাকে নিয়োগ করা হয়েছিল। যাদের ফোনে আড়িপাতা হয়েছিল তাদের মধ্যে ছিলেন ২০১৩ সালের আইপিএল এর স্পট ফিক্সিং এবং জুয়া কেলেঙ্কারীর ব্যাপারে তদন্তকারী কর্মকর্তাগণও! তৎকালীন বিসিসিআই প্রধান শ্রীনিবাসন নিজে সেই গোয়েন্দা সংস্থাকে ১৪ কোটি রুপি খরচ করে নিয়োগ দিয়েছিলেন!
‘অমন বিপুল অংকের টাকা খরচ করে ফেউ লাগানোর কারণ কী?’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
‘সম্ভবত শ্রীনিবাসন জানতে চেয়েছিলো তার বিরুদ্ধে তারই নিজের লোকজন কোন ষড়যন্ত্র করছে কী না। পাশাপাশি তদন্তের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করাও হয়ত তার উদ্দেশ্য ছিল।‘
‘এ রকম ঘটনা কি আগে কখনো ক্রিকেট বোর্ডে ঘটেছে?’
‘না। এমন কী এক দশক আগেও বিসিসিআই’র পরিস্থিতি যথেষ্ট ভালো ছিল। কিন্তু এখন যারা বোর্ড চালায় তারা চায় তাদের অধীনস্ত সকল লোকজন যেন চোখ বন্ধ করে সব কিছু মেনে নেয়ার মত একান্ত বাধ্যগত হয়। কারো আনুগত্যের ব্যাপারে সামান্য সন্দেহ দেখা দিলেই তাকে সরিয়ে দেয়া হয়। অবধারিতভাবে প্রশ্ন ওঠে-শ্রীনিবাসন কেন মুড়গাল তদন্তের আওতার বাইরে ছিলেন? মুড়গাল এবং তাঁর সহকারীগণ অসংখ্য ক্রিকেটার এবং জুয়াড়িকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে, তাহলে যে লোকটা আপাতদৃষ্টিতে পুরো ঘটনার কেন্দ্রে অবস্থিত তার কথা একবারও কেন আসলো না?’
প্রশ্নটা শুনে আমি আরেকটু হলে চেয়ার থেকে পড়েই যাচ্ছিলাম! ‘আরে তাই তো! এই লাইনে তো চিন্তাই করি নি!’ কিছুক্ষণ ভাবার পর উপলব্ধি করলাম পর পর দু’টো উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত হবার পরও বেটিং, ফিক্সিং এর ব্যাপারে আসলে খুব বেশি কিছু জানা যায় নি। সামান্য কিছু তথ্য পাওয়া গেছে এবং দুই-একজন চুনো-পুঁটি ধরা পড়েছে। ব্যাস!
একই সাথে আরেকটি অস্বস্তিকর ভাবনাও আমার মনে জাগলো। আমরা সবাই জানি ভারতে ক্রিকেটকে অনেকটা ধর্মের মত মনে করা হয়। অথচ, ক্রিকেটের দুর্নীতি নিয়ে কোথাও তেমন আলোচনা হয় না, এমন কী আমাদের আইনসভাতেও এ ব্যাপারে কখনও কেউ কোনদিন প্রশ্ন তোলে নি। ক্রিকেটে স্পট ফিক্সিং এবং অবৈধ বাজি নিয়ে পুরো ক্রিকেট বিশ্ব টলে গেলো, কিন্তু সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে এ নিয়ে কোন আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক হলো না! ব্যাপারটা খুবই অস্বাভাবিক! মনে পড়ল মুম্বাই, কলকাতা, চেন্নাই, জয়পুর এবং দিল্লিতে পুলিশ বাহিনীর কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলার সময় তারা প্রায় সবাই একটি ব্যাপার আভাস-ইঙ্গিতে বোঝাতে চেয়েছিলেন, তা হলো- অবৈধ বাজির সাথে জড়িতরা অনেক ক্ষমতাবান লোকজনের সাথে যোগসাজস করা শুরু করেছে…
এই পর্যায়ে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক- অবৈধ বাজির এই অন্ধকার জগতের কার্যক্রম কিভাবে চলে?!
(চলবে)
মন্তব্য দেখা যায়না?
সাতেও নাই, পাঁচেও নাই