১।
এবার বিশ্বকাপে জার্মানি প্রথম রাউন্ডেই বাদ পড়ায় আমরা বেশিরভাগই উল্লসিত হয়েছি। আর্জেন্টিনা (’৯০ ও ২০১৪ ফাইনালে পরাজয়) বা ব্রাজিলের (২০১৪ সালের কুখ্যাত ১-৭ পরাজয়) সমর্থকের তাও কিছুটা কারণ আছে, অন্যান্য দেশের সমর্থকদের উল্লসিত হবার কারণ কী? পরবর্তী রাউন্ডে সহজ প্রতিপক্ষ পাবে এই ভেবে? হ্যাঁ, এটি একটি যুক্তি। কিন্তু যুক্তিটি তেমন জোরালো নয়।
মূল কারণ হচ্ছে Schadenfreude, পরিহাসের মত শোনালেও শব্দটি জার্মান। আসলে দু’টি জার্মান শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। Schaden যার অর্থ ‘damage, harm’, এবং Freude যার অর্থ ‘joy’। পুরো শব্দটির বাংলা অর্থ অনেকটি এমন: অন্যের দুঃখ-কষ্ট, ব্যর্থতা বা লজ্জাজনক ঘটনায় সুখ পাওয়া! বিশেষ করে সেই ‘অন্য’ যদি নামকরা কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান হয়, তাহলে তো কোন কথাই নেই! ডাবল মজা!
এটি কিন্তু কোন দোষ বা খারাপ মানুষের লক্ষণ নয়, বরং একটি নিতান্তই অতি স্বাভাবিক মানবিক বৈশিষ্ট্য। অন্যের ক্ষতি দেখে কোন কোন সময় মস্তিষ্কের ডর্সাল স্ট্রিয়াটাম অংশ থেকে এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ নির্গত হয়, যা আমাদের মনে প্রশান্তির অনুভূতি যোগায়। আমরা খুশি হয়ে উঠি।
২।
কিছুদিন ধরেই ফেসবুকে ক্যাডেট কলেজের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে মনের মাধুরী মেশানো একটি লেখা ঘোরাঘুরি করছে। নবযুগ ডট অর্গ নামক এক ব্লগে ‘আপনার সন্তানকে ক্যাডেটে দেবেননা’ শিরোনামে লেখাটি পড়ে অনেক প্রাক্তন ক্যাডেটই মনে আঘাত পেয়েছেন বলে জানতে পেরেছি। সাধারণ যুক্তি বলে এই ধরণের লেখাকে মোটেও পাত্তা না দিয়ে না দেখার ভান করে থাকা। কেননা, এটি একটি ক্লাসিক এটেনশন সিকিং পোস্ট।
যে ভদ্রমহিলা পোস্টটি লিখেছেন তিনি নিজেকে একজন মনোবিজ্ঞানের ছাত্রী, শিক্ষক ও অভিভাবক উল্লেখ করে পোস্টের আপেক্ষিক গুরুত্ব বাড়াবার চেষ্টা করেছেন। অথচ তার পোস্টে ফ্যাক্টস, পরিসংখ্যান, প্রমাণ কিছুই নেই। আছে শুধু ঢালাওভাবে ক্যাডেট কলেজের বদনাম এবং হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা। এমনকি ক্যাডেটদের অভিভাবকদের অত্যন্ত নিম্নমনের পরিচয় দিয়ে হীনভাবে আক্রমণ করতেও তিনি দ্বিধা করেন নি। তার মতে-
‘প্রায় সবক্ষেত্রে ছেলেমেয়েদের ক্যাডেটে পড়তে আসার পেছনে দায়ী তাদের মা-বাবার লোভ। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্বল্পতম সময়ে (উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করলেই) সন্তান গেজেটেড অফিসার হয়ে যায়। ছয় বছরের ক্যাডেট জীবনে অনেক সুযোগ আসে এখান থেকে চলে যাওয়ার। কিন্তু বাবামা রাজি হননা।‘
৩।
তার পোস্টটি শুরু হয়েছে তুবা নামক ফেনী গার্লস ক্যাডেট কলেজের একজন ক্যাডেটের দুর্ভাগ্যজনক অকাল মৃত্যুর কারণে। মৃত্যুর কারণ আত্মহত্যা হলেও পোস্ট লেখিকার ধারণা তাকে খুন করা হয়েছে কিংবা আত্মহত্যা করতে প্ররোচিত করা হয়েছে! অর্থাৎ তিনি একটি প্রতিষ্ঠিত আদালতের সিদ্ধান্তকে না মেনে নিয়ে নিজের ইচ্ছেমত রায় দিয়েছেন।
ঘটনা এই পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকলেও কথা ছিল, ব্যাপারটিকে নিহত মেয়েটির জন্য শোকাক্রান্ত একজন হিতৈষীর শোকসন্তপ্ত অপলাপ বলে চালিয়ে দেয়া যেত। কিন্তু না, ওটা ছিল মাত্র শুরু। এরপরই তিনি চট করে ক্যাডেট কলেজ শিক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিষোদগার শুরু করেছেন। অর্থাৎ,নিহত হতভাগ্য মেয়েটির কথা শুরুতে উল্লেখ করে তিনি পাঠকের সমবেদনা পাবার একটি চাল দিয়েছেন। তার আসল উদ্দেশ্য অন্য! মনোবিজ্ঞানে তার যথেষ্ট দক্ষতা আছে-স্বীকার করতেই হয়!
৪।
ভদ্রমহিলার মতে “…ক্যাডেটরা অসামাজিক, তারা অন্যদের সাথে মিশতে পারে না,জুনিয়র ক্লাসে থাকতে নিজেরা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের স্বীকার হয় এবং সিনিয়র হয়ে জুনিয়রদের উপর একই কৌশল প্রয়োগ করে। বাবা-মা থেকে দূরে থাকার কারণে নানা বিকৃত যৌনাচারে লিপ্ত হয়, অনেকটা মাদ্রাসা এবং এতিমখানাগুলোর মতন। ক্যাডেটরা অসহায়, একাকী ও কষ্টকর জীবন পার করে।” তার লেখা থেকে কিছুটা উদ্ধৃতি করছি-
প্রায় সব ক্যাডেট ব্যক্তি জীবনে হয় চরম অসামাজিক, ডিপ্রেশনের রোগী, মা-বাবার প্রতি প্রতিশোধ-পরায়ণ, এলকোহলিক ইত্যাদি। বয়োঃসন্ধিকালের সময় থেকেই তারা মা-বাবাকে শত্রু ভাবতে শুরু করে।
এ পর্যায়ে তিনি উদাহরণ দিয়েছেন হিন্দি ‘তারে জামিন পার’ সিনেমাটির। মজার ব্যাপার হচ্ছে সিনেমাটির উদাহরণ তিনি আরও একবার দিয়েছেন। অর্থাৎ তার লেখার সবচেয়ে বড় প্রুফ বা বড় যুক্তি একটি হিন্দি সিনেমা। উল্লেখ্য সিনেমাটি একটি বাচ্চা ছেলের উপর নির্মিত, যে কী না ডিজলেক্সিয়া রোগে আক্রান্ত। এলাকার স্কুলের শিক্ষকমণ্ডলী পড়াতে ব্যর্থ হবার পর বাবা-মা তাকে আবাসিক স্কুলে পাঠায় এবং সেখানকার এক শিক্ষক (আমির খান) বাচ্চাটির সমস্যা ধরতে পারে এবং তাকে বিশেষ যত্ন নিয়ে পড়ানো শুরু করে। কিছুদিনের মধ্যেই ছেলেটি অভূতপূর্ব সাফল্য পেয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়। বাড়ি থেকে, বিশেষ করে মা এর কাছ থেকে দূরে থাকার কারণে ছেলেটির মানসিক কষ্ট পাবার অংশটিও সিনেমায় উঠে এসেছিল।
অবশ্য, তার লেখার সাথে সিনেমাটি দারুণ মিলে যায়। সবগুলো যুক্তিই একেবারে বাচ্চাদের মতন লেখা!
৫।
ক্যাডেট কলেজ মূলত: বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দ্বারা পরিচালিত একটি সামরিক স্কুল এবং কলেজ। ফলে শিক্ষক-শিক্ষিকাগণ (সকলেই নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানের সাথে উত্তীর্ণ) বেসামরিক হলেও এখানকার অনেক রীতি-নীতি, নিয়ম-কানুন এবং পোশাকেও সামরিক বাহিনীর প্রভাব আছে। হ্যাঁ,এখানে অপরাধ করলে শাস্তিরও বিধান আছে। যা শুধু ক্যাডেট কলেজই নয়, দেশের যে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমনকি যে কোন পরিবারের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বাড়িতে কোন ছেলে-মেয়ে অপরাধ করলে তাদের অভিভাবক কি শাস্তি দেয় না? বড় ভাই-বোন শাস্তি বা ধমক দেয় না? অবশ্যই দেয়। আসলে যে কোন প্রতিষ্ঠানের চেইন অব কমান্ড বজায় রাখার জন্য শাস্তি জরুরী। বিশেষ করে সামরিক কায়দায় পরিচালিত প্রতিষ্ঠানসমূহে এটা খুবই সাধারণ ঘটনা। তবে, একটি ব্যাপার অত্যন্ত শক্ত হাতে নিশ্চিত করা হয়- কোন ম্যানহ্যান্ডলিং অর্থাৎ গায়ে হাত তোলার ঘটনা যেন না ঘটে।
আর এভাবেই গত ৬০ বছর ধরে অত্যন্ত সুনাম এবং সাফল্যের সাথে ক্যাডেট কলেজ শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের দেশে বিদ্যমান রয়েছে। ক্যাডেটদের সাফল্য এবং অবদানের কথা উল্লেখ করতে গেলে লেখাটি মহাকাব্যে পরিণত হবে বলে সেদিকে আর যাচ্ছি না। শুধু বলতে চাই – বাংলাদেশ স্বাধীন হবার আগে মাত্র ৪ টি ক্যাডেট কলেজ থাকলেও মাত্র দেড় দশকে সংখ্যাটি ১০ এ উন্নীত হয়। বর্তমানে ক্যাডেট কলেজের সংখ্যা ১২ টি। সুতরাং এ কথা সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে ক্যাডেট কলেজ শিক্ষা ব্যবস্থা শুধু বিংশ শতক নয় বরং একবিংশ শতকের চ্যালেঞ্জ নিতেও প্রস্তুত।
৬।
ক্যাডেট কলেজের মূল লক্ষ্য সামরিক বাহিনীর জন্য ক্যাডেট তৈরির পাশাপাশি সমাজের সকল পর্যায়ে নেতৃত্ব দান করার জন্য নেতা তৈরি করা। এজন্য সাবেক ক্যাডেটদের মধ্য থেকে শুধু জেনারেলই নয়, বরং ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, ব্যারিস্টার,সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা, শিক্ষক, কবি, সাহিত্যিক, ব্যবসায়ী, ব্যাংকার, কর্পোরেট জগতের হর্তা-কর্তা এমনকি রাজনীতিবিদও তৈরি হচ্ছে।
আলোচ্য পোস্টের লেখিকা উল্লেখ করেছেন ক্যাডেট কলেজ থেকে পাশ করেই অধিকাংশ ক্যাডেট স্বল্পতম সময়ে ফার্স্ট ক্লাস গেজেটেড অফিসার হয়। কথাটি সত্য নয়। প্রতি ব্যাচের খুব বেশি হলে শতকরা ২৫ থেকে ৩০ ভাগ সামরিক বাহিনীতে যোগদান করে (ব্যাচ ভেদে অনুপাত ভিন্ন হয়)। ফলে অধিকাংশ ক্যাডেট স্বল্পতম সময়ে ফার্স্ট ক্লাস গেজেটেড অফিসার হবার প্রশ্নই আসে না। বরং তারাও অন্যান্য উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের মত ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষা অর্জনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এবং দুই-একজন বাদে এরা সকলেই ক্লাস ও ক্যাম্পাসের অন্যান্য সকলের সাথে স্বাভাবিকভাবেই মেলামেশা করে থাকে।
৭।
হ্যাঁ, এ কথা সত্যি যে ক্লাস সেভেনের যে ছেলেটি বাবা-মা’কে ছেড়ে ক্যাডেট কলেজে যায় তার জন্য প্রথম কিছুদিন অত্যন্ত কষ্টকর মন হয়। নতুন পরিবেশ, নতুন বন্ধু, নতুন নিয়মে মানিয়ে নিতে কিছুটা সময় লাগে বৈ কি! কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সে হয়ে ওঠে একজন আত্মনির্ভরশীল, স্মার্ট এবং আত্মবিশ্বাসী কিশোর। শারীরিক ও মানসিক উভয় দিক দিয়েই সে বেড়ে উঠতে থাকে।
ক্যাডেট কলেজে যে কিছু বাড়াবাড়ির ঘটনা ঘটে না, তা নয়। মাঝে মাঝে শারীরিক নির্যাতন, মানসিক নির্যাতন কিংবা ক্যাডেটদের মধ্যে মনোমালিন্য-ঝগড়াঝাঁটির ঘটনা ঘটতে পারে। এগুলো নেহায়েতই বিচ্ছিন্ন ঘটনা। তাছাড়া বাড়িতে থাকতে কি ছেলেমেয়েরা বাড়াবাড়ি করে না? দুর্ঘটনার শিকার হয় না? শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের শিকার হয় না? তাহলে শুধুমাত্র ক্যাডেট কলেজকে দোষারোপ করা কেন? যারা ক্যাডেট কলেজের পরিবেশের সাথে একেবারেই মানিয়ে নিতে পারে না তারা কিন্তু ঠিকই কলেজ ছেড়ে বাইরের স্কুল, কলেজে গিয়ে ভর্তি হয়! প্রায় প্রতি ব্যাচেই এই উদাহরণ আছে।
সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে ভদ্রমহিলা ক্যাডেটদের সমস্যা এবং কষ্টকে মাদ্রাসা, এতিমখানা কিংবা অন্যান্য আবাসিক স্কুল-কলেজের সাথে তুলনা করলেও সেগুলো বন্ধ করার কথা বলেন নি। বলেন নি যে আপনার সন্তানকে কোন আবাসিকেই দেবেন না’, বলেছেন ‘আপনার সন্তানকে ক্যাডেটে (আসলে ক্যাডেট কলেজ হবে। ক্যাডেটে বললে বিষয়টি পরিষ্কার হয় না!) দেবেন না!’
ফলে, তার মোটিভ সন্দেহজনক বৈ কি!
৮।
আলোচ্য ব্লগ লেখিকার উদ্দেশ্য যদি মহৎ কিংবা সত্য হত তিনি ক্যাডেট কলেজ ও ক্যাডেটদের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার না করে বরং ক্যাডেট কলেজগুলোকে কী করে আরও নিশ্ছিদ্র এবং নিরাপদ করা যায় সেই পরামর্শ দিতেন। কেননা, দীর্ঘদিন ধরে চলে আসলেও যে কোন আর দশটি সিস্টেমের মত ক্যাডেট কলেজ শিক্ষা ব্যবস্থাকেও বর্তমান সময়ের সাথে পরিবর্তিত হতে হচ্ছে। তবুও ভুল-ত্রুটি থাকা স্বাভাবিক। বর্তমান এবং প্রাক্তন ক্যাডেটদের সাথে আলোচনা করে ক্যাডেটদের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা ও উন্নতির জন্য একজন মনোবিজ্ঞানী হিসেবে তিনি অনেক সু-পরামর্শই দিতে পারতেন। অথচ সেটি না করে তিনি নেতিবাচক ও ঘৃণার পথ বেছে নিয়েছেন। এ থেকে প্রমাণিত হয় তিনি হয়ত কোন কারণে ক্যাডেট কলেজ বা ক্যাডেটদের প্রতি ক্ষিপ্ত কিংবা শুরুতে উল্লেখ করা ফেনী ক্যাডেট কলেজের হতভাগা তুবার কোন নিকটাত্মীয় যে এখনও ওর মৃত্যুকে মেনে নিতে পারেন নি।
অবশ্য, তার লেখা এবং কুযুক্তি পড়ে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা হচ্ছে তিনি এ Schadenfreude এ ভুগছেন। তুবার অকাল মৃত্যুর পর ক্যাডেট কলেজ শিক্ষাব্যবস্থাকে দুঃখিত ও বিব্রত হতে দেখে তিনি মনে মনে প্রশান্তি লাভ করছেন!
আশার কথা হচ্ছে- ক্যাডেট কলেজের সুনাম এবং গ্রহণযোগ্যতা এত বেশি যে তার লেখায় সেটার কিছুই এসে যাবে না। বরং একাডেমিক সমাজে তিনি নিজের গ্রহণযোগ্যতা হারাবেন।
আমি তার মানসিক সুস্থতা কামনা করছি।
খুব ভালে লিখেছো।আামার মেয়ে fgcc তে পড়ে। তুবার ই classmate. কেউ যদি এভাবে না বুঝে কাউকে blame দেয় সেটা তার বড় problem.thanx.
মহিলার অধিকাংশ কথাই সঠিক। আমার জীবনের সাথে অনেকটাই মিলে গেছে।