আজ থেকে শুরু হচ্ছে বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ডের তৃতীয় লেগের খেলা। আগের দুটি লেগের সাথে এর পার্থক্য হচ্ছে এবার একই গ্রুপের দুটি খেলা একই সময়ে শুরু হবে। কিন্তু কেন এই নিয়ম?! আসলে একটি ছোট বাচ্চাও এর উত্তর দিতে পারবে-ফিফা এই নিয়ম করেছে যাতে এক খেলার ফল দেখে অন্য খেলার দুই দল নিজেদের খেলায় কোন কৌশল বা কারচুপি করতে না পারে। যাতে করে কোন দুটি দল পরের পর্বে যাচ্ছে, কে গ্রুপের শীর্ষস্থান দখল করবে, সেক্ষেত্রে পরের পর্বে সম্ভাব্য কাকে মোকাবেলা করতে হতে পারে-এ ধরণের সিদ্ধান্তসমূহ আগে থেকেই কেউ বুঝতে না পারে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে ১৯৮২ সালের আগে ছোট বাচ্চা তো দূরের কথা কোন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মাথায়ও এসব চিন্তা আসে নি বা ফিফা নিয়ম বদলাবার প্রয়োজন বোধ করে নি। তখন গ্রুপের প্রতিটি খেলাই আলাদা দিন বা আলাদা সময়ে অনুষ্ঠিত হত। কী এমন হয়েছিল সেবার যাতে ফিফা নিয়ম বদলাতে বাধ্য হয়েছিল?
১৯৮২ সালের বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়েছিল স্পেনে, ২৪ টি দল অংশ নিয়েছিল। ৪ টি করে দল ৬ টি গ্রুপে ভাগ হয়ে প্রথম প্রথম পর্বে একে অপরের মোকাবেলা করেছে। গ্রুপ ২ এ ছিল ইউরো চ্যাম্পিয়ন পশ্চিম জার্মানি, শক্তিশালী অস্ট্রিয়া, চিলি এবং নবাগত আলজেরিয়া। গ্রুপের প্রথম ম্যাচ ছিল জার্মানি বনাম আলজেরিয়ার মধ্যে।
এই ম্যাচ ঘিরে জার্মানদের প্রতিক্রিয়া ছিল অত্যন্ত দৃষ্টিকটু। সাংবাদিক সম্মেলনে তারা নবাগতদের অবজ্ঞা করতেও ছাড়ে নি। একজন খেলোয়াড় বলেছিল, আমাদের ৭ নম্বর গোলটি স্ত্রীদের এবং ৮ নম্বর গোলটি আমাদের পোষা কুকুরকে উপহার দেবো! অন্য এক খেলোয়াড় ঘোষণা দিয়েছিল সে চুরুট মুখে নিয়ে মাঠে নামবে। এমনকি কোচ জাপ ডারভাল বলেছিলেন ম্যাচ হারলে সেদিনই ট্রেনে করে বাড়ী ফিরে যাবেন!
ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস ম্যাচটি আলজেরিয়া ২-১ ব্যবধানে জিতে নেয়। আলজেরিয়ার গতি ও ছন্দময় খেলার বিরুদ্ধে অতি-আত্মবিশ্বাসী জার্মানি লজ্জাজনক হার মেনে নিতে বাধ্য হয়! আজ প্রায় চার দশক পরও এই ম্যাচটিকে বিশ্বকাপের অন্যতম অঘটন হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। আলজেরিয়া প্রথম আরব দেশ হিসেবে বিশ্বকাপে ম্যাচ জয়ের গৌরব অর্জন করে। জয়ের পর আলজেরিয়ান খেলোয়াড় এবং সমর্থকগণ উল্লাসে মেতে ওঠে। সেই আনন্দ-উৎসব চলে পরবর্তী ম্যাচ পর্যন্ত। ফলে, পরের ম্যাচে তেমন কোন প্রতিরোধ ছাড়াই তারা অস্ট্রিয়ার কাছে ২-০ ব্যবধানে হেরে যায়।
শেষ ম্যাচে চিলির সাথে ৩-০ ব্যবধানে এগিয়ে গেলেও অভিজ্ঞতার অভাবে ম্যাচের প্রাধান্য ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়, অবশ্য দুই গোল খেলেও শেষ পর্যন্ত কোন রকমে ৩-২ ব্যবধানে জিতে নেয়। ৩ খেলা থেকে তাদের সংগ্রহ দাঁড়ায় ৪ পয়েন্ট (তখন জয়ের জন্য ২ পয়েন্ট এবং ড্র করলে ১ পয়েন্ট ছিল)। অস্ট্রিয়ার সংগ্রহ ২ খেলায় ৪, জার্মানির ২ খেলায় ২ এবং চিলির পয়েন্ট ছিল ৩ খেলায় শূন্য।
শেষ ম্যাচ অর্থাৎ অস্ট্রিয়া-জার্মানি ম্যাচের উপর নির্ভর করছিল পরের পর্বে কোন দুই দল যাচ্ছে। স্পেনের গিহনে অনুষ্ঠিত সেই ম্যাচে অস্ট্রিয়া-জার্মান সমর্থকদের পাশাপাশি প্রচুর আলজেরীয় দর্শকও দেখতে গিয়েছিল। সমীকরণ ছিল জলের মত পরিষ্কার-জার্মানি হারলে বা ম্যাচ ড্র হলেই বাদ পড়বে।
ম্যাচ শুরু হবার প্রথম মিনিট থেকেই জার্মান দল একের পর এক আক্রমণ করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত ১০ মিনিটের মাথায় তারা গোলের দেখা পায়। জার্মান ফরোয়ার্ড হর্স্ট রুবেশ গোল করে দলকে এগিয়ে নেন। উপস্থিত হাজার দর্শক এবং টিভির সামনে বসে থাকা বিশ্বের লাখো-কোটি দর্শক দারুণ এক ম্যাচের প্রত্যাশায় নড়ে চড়ে বসেন। কিন্তু এরপর আর কিছুই হয় নি…আক্ষরিক অর্থেই কিছু না। দুই দলের পরবর্তী রাউন্ড নিশ্চিত হয়েছে জেনে তারা খেলায় সম্পূর্ণ হাল ছেড়ে দেয়। সূচনা হয় বিশ্বকাপ ফুটবলের অন্যতম এক কালো অধ্যায়!
পরবর্তী প্রায় ৮০ মিনিট ধরে মাঠের চলে ফুটবল খেলার নামে দুই দলের নির্লজ্জ অভিনয়। মাঝে মাঝে দুই একটি বিক্ষিপ্ত আক্রমণ ছাড়া বেশিরভাগ সময়ই বল পায়ে পায়ে ঘুরতে থাকে। উপস্থিত আলজেরীয় দর্শকগণ রাগে-দুঃখে টাকা পুড়িয়ে ক্ষোভ জানায়। শুধু তাই নয় নিরপেক্ষ স্প্যানিশ দর্শকগণও তাদের দুয়ো দিতে থাকে। তারা “Fuera, fuera” (“Out, out”), “Argelia, Argelia” (“Algeria, Algeria”), and “Que se besen, que se besen” (“Let them kiss, let them kiss”) ইত্যাদি বলে বিদ্রূপ করে ও প্রতিবাদ জানায়।
জার্মান টেলিভিশন চ্যানেল এআরডি’র ধারাভাষ্যকার এবারহার্ড স্টানজেক বাকি সময়টুকু কোন কথা না বলে চুপ করে থাকেন, ওদিক অস্ট্রিয়ান টিভি ধারাভাষ্যকার রবার্ট সিগার সকল দর্শককে খেলা না দেখে চ্যানেল বদলাবার আহবান জানান। একসময় তার কান্নাও শোনা যায়…স্থানীয় স্প্যানিশ পত্রিকা ‘এল কমারসিওন’ পরদিন এই খেলার রিপোর্ট ছাপে ‘ক্রাইম’ সেকশনে। বিশ্ব মিডিয়ায় নিন্দার ঝড় ওঠে, সবার কাছে এই খেলার নাম হয়ে যায় Disgrace of Gijón।
যাই হোক, এক সময় খেলা নামের প্রহসনটি শেষ হয় এবং ৪ পয়েন্ট নিয়ে গোল পার্থক্যের কারণে জার্মানি ও অস্ট্রিয়া যথাক্রমে গ্রুপের ১ম ও ২য় স্থান অর্জন করে। আলজেরিয়া বাদ পড়ে যায়। আসলে জোর করে বাদ দেয়া হয়। ম্যাচ শেষে আলজেরিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে ফিফার কাছে প্রতিবাদ জানায়। সাথে যোগ দেয় সারা বিশ্বের কোটি ফুটবল দর্শক ও সুশীল সমাজ। কিন্তু কোন লাভ হয় নি, কেননা, ফিফার মতে সেই ম্যাচে কোন ‘আইন ভঙ্গ’ হয় নি। তবে, একটি পরিবর্তন ঠিকই আনা হয়-এরপর থেকেই বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্যায়ের প্রতিটি দলের শেষ লেগের খেলা একই সময়ে শুরু হবার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
আজ ২৫ জুন, সেই কুখ্যাত ‘গিহন লজ্জা’র ৩৬ তম বার্ষিকী।
আমি আসলে ঘটনার সারমর্ম জানতাম। আলজেরিয়ার সাথে এই ঘটনা এইটা জানতাম না। ৮২ সালের জার্মানী দেখি নর্দমার কীটপতঙ্গ টাইপের ছিল দেখা যায়।
\\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\
‘গিহন লজ্জা’র ব্যাপারে আগে কিছুই জানতাম না। তোমার এ লেখাটার কল্যাণে অনেক তথ্যই জানলাম।
অনেক ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা!!!