বলের বদলে গ্রেনেড (৬ষ্ঠ পর্ব)

আগের পর্বগুলোঃ

১১।

গত তিন দিন ধরে অনিক প্রায় আক্ষরিক অর্থেই শুয়ে বসে সময় কাটাচ্ছে। ‘প্রায়’ এজন্যই বলা কেননা মাঝে মাঝে জোর করে হলেও পড়তে বসছে। ইন্টার পরীক্ষার তো আর বেশি বাকি নেই। ক্লাস হোক বা না হোক-দেখা গেল পরীক্ষার তারিখ ঠিকই দিয়ে দিয়েছে-প্রস্তুতি না থাকলে তখন বিপদ হয়ে যাবে! এবার প্রায় ছয় মাস পর ও গোপালগঞ্জে আসল। গত কোরবানির ঈদ খুলনায় চাচার সাথে পালন করার কারণে বাড়িতে আসা হয় নি, ফলে বিরতিটা একটু বেশি বড় হয়ে গেছে।

জন্মের পর থেকে ক্লাস এইট পর্যন্ত গোপালগঞ্জের থাকলেও গত চার বছর ধরে খুলনায় থাকার কারণে অনিক এখন অনেকটাই ‘বহিরাগত’। ছোট বেলার বেশিরভাগ বন্ধুদের সাথেই এখন আর তেমন যোগাযোগ নেই। দেখা হলেও ‘হাই, হ্যালো’র বেশি কথা হয় না। ফলে, সারাদিন ঘরেই থাকছে।

অবশ্য, আজকে বিকালে শাওনের সাথে বাড়ির সামনের গলিতে কিছুক্ষণ ক্রিকেট খেলেছে। যদিও দুইজনের খেলাকে ক্রিকেট না বলে শুধু ব্যাটিং-বোলিং ই বলা শ্রেয়। বেশিরভাগ সময় অনিকই বল করেছে, শাওন ব্যাট করেছে। বিকেলে খেলার সময় মনে মনে ঠিক করে ফেলেছে গোপালগঞ্জে যতদিন আছে এর মধ্যে ফ্লিপার নিয়ে কাজ করবে। কিছুদিন আগে সুনীলদা ওকে কিছু বিদেশি ক্রিকেট ম্যাগাজিন এবং বই দিয়েছিলেন। ওগুলোর মধ্যে লেগ স্পিনের উপর অনেকগুলো ফিচার আছে। বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়ার সাবেক ক্রিকেটার রিচি বেনো’র একটি বড় আর্টিকেল আছে, যেটাতে লেগ স্পিনের বিভিন্ন বৈচিত্র্যপূর্ণ বোলিং এর ব্যাপারে টিপস দেয়া আছে। ফলে, আশা করছে ওগুলো পড়ে এবং নিয়মিত প্র্যাকটিস করে ফ্লিপারটা শিখে নিতে পারবে। শাওন থাকায় প্র্যাকটিস করতে সুবিধে হবে। একা একা এসব করা কোন মতেই সম্ভব হত না।

অন্যান্য দিনের মতন সন্ধ্যার পর সবাই মিলে রেডিও শুনতে লাগল। এমনিতে এখন শাওনের পড়তে বসার কথা, তবে গত কিছুদিন ধরে চলা অসহযোগ আন্দোলন এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে স্কুল বন্ধ আছে বলে পড়াশুনায় ফাঁকি দিচ্ছে। বাবা-মা-ও তেমন কিছু বলছেন না। ক্লাস সিক্সের বাচ্চা পড়াশুনায় একটু ফাঁকি দিলেও কোন সমস্যা নেই, পরে পুষিয়ে নিতে পারবে!

রেডিওতে নতুন কোন খবর নেই। জানা গেল আগের মতনই ইয়াহিয়ার সাথে শেখ মুজিবের বৈঠক চলছে। তবে কিছুটা নতুনত্ব হল এই যে, গতকাল থেকে জুলফিকার আলী ভূট্টোও আলোচনায় অংশ নিয়েছেন। অর্থাৎ ত্রি-মুখী আলোচনা শুরু হয়েছে। এদিকে সারা দেশ জুড়েই বিক্ষোভ-মিছিল চলছে। একই সাথে চলছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বাড়াবাড়ি রকমের বাঁধা দেয়া এবং ধর-পাকড়।

পরদিন সকালে অনিক বাবার সাথে বের হল। বাবার প্রেস এবং বই এর দোকান আছে। কয়েকদিন ধরে দোকান বন্ধ রাখলেও প্রেসের কাজ পুরোদমে চলছে। জেলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে প্রতি দিনই শত শত পোস্টার, লিফলেট ছাপা হচ্ছে। বাবা নিজেই প্রেসে গিয়ে সেগুলোর তত্ত্বাবধায়ন করেন।

প্রেসে গিয়ে অনিক অবাক হয়ে গেল। পোস্টার, লিফলেটের ভাষা একেবারে খুলনার মতনই। সেই স্লোগান, সেই দাবী, সেই প্রতিরোধের সংকল্প! এটা কি কাকতাল নাকি পরিকল্পনা করে করা? মনে মনে ভাবল অনিক। কারণ যাই হোক, ধীরে ধীরে পুরো দেশের মানুষ যে এক সূত্রে গাঁথা হচ্ছে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

প্রেসে প্রচুর লোকজনের সমাগম দেখতে পেল। রাজনৈতিক এবং অরাজনৈতিক-উভয় শ্রেণির মানুষই আছেন! ডাঃ ফরিদ আহমেদ, এডভোকেট কাজী আব্দুর রশিদসহ বেশ কয়েকজনকে চিনতে পারল ও। পোস্টারের বড় বান্ডিল প্রস্তুত হওয়ার সাথে সাথে সেগুলো কর্মীদের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে। তারা রিকশা, ভ্যান, সাইকেলে করে দ্রুত বের হয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই এগুলো বিভিন্ন দেয়ালে সাঁটা হবে। একই সাথে বাসে বা নৌপথে পাঠানো হবে টুঙ্গীপাড়া, কোটালিপাড়াসহ আশপাশের এলাকাগুলোতেও।

অনিককে দেখে ডাঃ ফরিদ চাচা চিনতে পারলেন। এগিয়ে এসে বললেন,
-আরে অনিক? কবে এলে?
-স্লামালিকুম চাচা। এই তো কয়েকদিন হল এসেছি…
-খুব ভাল! অনেকদিন পর তোমাকে দেখলাম। পড়াশুনা কেমন চলছে? এবার তো ইন্টার দেবে, তাই না?
-এই তো চলছে চাচা! তবে ক্লাস হচ্ছে না তো, তাছাড়া খুলনার পরিস্থিতিও ভাল না-তাই বড় চাচা বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন।
-রাশেদ যা করার বুঝে শুনেই করবে, আমারও মনে হয় ও সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছে। ভাল কথা, রাশেদ-নাহার…ওরা কেমন আছে?
-জ্বি, চাচা-চাচী দুজনেই ভাল আছেন।
-তোমাদের বন্ধু-বান্ধবরা তো সব কায়েদে আযম কলেজে ট্রেনিং নিচ্ছে…গিয়ে দেখতে পার!

বাবার দিকে তাকাতেই তিনি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলেন। সবাইকে সালাম জানিয়ে ও বিদায় নিলো। ওদের প্রেস থেকে কলেজ বেশিদূরে নয়। হেঁটে যেতে খুব বেশি হলে দশ মিনিট লাগবে। ফরিদ চাচা ওর সাথে একজন কমবয়সী ছাত্র-লীগ কর্মীকে যেতে বললেন। পরিচিত লোক না দেখলে গেট না-ও খুলতে পারে, তাই এই ব্যবস্থা, দুজনে দ্রুত পায়ে হেঁটে এগিয়ে যেতে লাগল।

কলেজের ভেতরে ঢুকে অনিক আবারও খানিকটা বিভ্রান্ত হয়ে গেল, নিজেকে চিমটি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করল ও স্বপ্ন দেখছে, নাকি সত্য! এটা কি খুলনা, নাকি গোপালগঞ্জ? একেবারে খুলনার মতনই এখানেও ডামি রাইফেল নিয়ে প্রশিক্ষণ চলছে। জানতে পারল নিকটবর্তী হিজলাবাড়ি স্কুল মাঠ এবং যুগ শিখা ক্লাবেও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।

তবে, খুলনার সাথে গোপালগঞ্জের পার্থক্য হচ্ছে এখানে অনেকটা খোলামেলা ভাবেই সবকিছু চলছে। বঙ্গবন্ধুর নিজের এলাকা হবার কারণে এখানকার আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী, স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদসহ সবার সাহস ও আত্মবিশ্বাস একটু বেশিই।

প্রশিক্ষণ শেষে সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া হল আগামীকালের পাকিস্তান দিবস প্রত্যাখ্যান করা হবে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী লাহোর দিবস পালন করা হবে। কেউ কেউ পরামর্শ দিল এর নাম বদলে বাংলাদেশ দিবস রাখা যেতে পারে! যাই হোক, ঠিক করা হল আগামীকাল সকালেই প্রতিটি বাসা, স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালতে উত্তোলন করা হবে বাংলাদেশের পতাকা! একই সাথে গাওয়া হবে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি।

কলেজ থেকে বের হবার সময় রতনকে দেখতে পেল অনিক। রতন ওর ছোটবেলার বন্ধু, ক্লাস এইট পর্যন্ত একই স্কুলে পড়াশুনা করেছে। ওর বাবা-মা নেই। খুড়োর কাছে মানুষ হচ্ছে। অবশ্য, ভারতেও ওদের কিছু আত্মীয়স্বজন আছে, কিন্তু ও এদেশে থাকতেই আগ্রহী। ওকে দেখে রতনের মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল।
-অনিক, তুই? কবে আসলি? কেমন আছিস?
-এই তো, আছি আর কি…দুই দিন হল এসেছি, তুই কেমন আছিস?
-আমিও ভাল আছিস। চল সামনের দোকানে গিয়ে চা খাই। চা খেতে খেতে গল্প করা যাবে…কতদিন পর তোকে দেখলাম!
-চল।

কলেজ থেকে বের হয়ে সামান্য হেঁটে মোড়ের এক চা এর দোকানে গিয়ে বসল ওরা। আশপাশে আরও প্রচুর মানুষের সমাগম। ঘুরে ফিরে সবার মুখেই একই আলোচনা- দেশের ভবিষ্যৎ। ওরা দুজন চুপচাপ কিছুক্ষণ চা খেতে লাগল। বহুদিন ধরে যোগাযোগ না থাকার কারণে দুজনেই প্রথমে কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। অনিক মনে মনে ভাবছিল কি নিয়ে আলোচনা শুরু করা যায়, এমন সময়ে রতনই মুখ খুলল-
-তোর পড়াশুনা ভাল হচ্ছে?
-এই হচ্ছে আর কি…তোর?
-আর পড়াশুনা! দেশের যা অবস্থা!
-কিন্তু ইন্টারের তো আর দেরি নেই!
-রাখ তো ইন্টার। এর আগেই কাহিনী শুরু হয়ে যাবে…
-মানে?
-পাকিস্তান থেকে প্রতিদিন শত শত সৈন্য আসছে, জানিস? অনেক শহরে নাকি ওরা ট্যাংকও নামিয়েছে! এদিকে শেখ সাহেবও নাছোড়বান্দা, কোন কিছুর বিনিময়েই তিনি ন্যায্য দাবী আদায়ের আন্দোলন থেকে পিছপা হবেন না। ফলে লড়াই মোটামুটি অনিবার্য!
-হুম!
-আগামীকাল সকালে কলেজে চলে আসিস। বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের অনুষ্ঠানে আমরা সবাই যাব। পোলাপান তোকে দেখে অনেক খুশি হবে।
-আচ্ছা, ঠিক আছে।
আরও কিছুক্ষণ গল্প করে ওরা একে অন্যের কাছ থেকে বিদায় নিলো। রতন ওর বাসার দিকে গেল, অনিক চলল বাবার প্রেসের দিকে। দুজনে মিলে একসাথে বাসায় যাবে।

২৩ মার্চ সকালে বাসা থেকে বের হয়ে খুশিতে অনিকের চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল। দু-একটি ছাড়া বেশির বাড়িতেই বাংলাদেশের পতাকা দেখা যাচ্ছে। এমনকি অনেক সরকারি অফিসেও পাকিস্তানের বদলে বাংলাদেশের পতাকা দেখতে পেল। লাল-সবুজের ভেতরে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকাটি দেখে অদ্ভুত এক প্রশান্তি এবং একই সাথে দারুণ অনুপ্রেরণা অনুভব করল। বাবার প্রেশার একটু বেড়ে গেছে বলে তিনি বাসা থেকে বের হলেন না। অনিক একাই কলেজের দিকে রওনা হল।

কায়েদে আযম কলেজে যখন পৌঁছল ততক্ষণে মানুষের সমাগম অনেক বেড়ে গেছে। ভিড়ের মধ্যে রতনকে খুঁজে পেল না। এরই মধ্যে পতাকা উত্তোলন শুরু হয়ে গেল। সবাই এক সাথে গাইতে শুরু করল ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি…’। খেয়াল করে দেখল অনেকের চোখেই পানি চলে এসেছে। শত শত মানুষ একসাথে স্যালুট দিয়ে আছে এবং গান গাইছে! এত আবেগের মাঝে নিজেও আবেগাপ্লুত হয়ে গেল, চোখে দুটো আর্দ্র হয়ে উঠল। সাথে সাথে ঠিক করে ফেলল বাসাতেও পতাকা টাঙ্গাবে। পকেটে অল্প কিছু টাকা থাকলেও তা দিয়ে দারুণ একটি পতাকা কিনে ফেলল।

বাসায় ফেরার পথে দেখতে পেল যে অল্প কিছু বাড়িতে কিছুক্ষণ আগেও পাকিস্তানের পতাকা উড়ছিল, সেগুলো আর নেই। কে বা কারা সেগুলো নামিয়ে ফেলছে। সাবাস!

রাতের খবরে জানতে পারল শুধু গোপালগঞ্জেই নয় ঢাকা, খুলনা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ সারাদেশেই জনগণ পাকিস্তান দিবস প্রত্যাখ্যান করে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছে। খোদ পাকিস্তান প্রেসিডেন্টের উপস্থিতিতেই এই বলিষ্ঠ কর্মসূচী প্রমাণ করে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ আর মাথা নত করে থাকতে রাজি নয়। শুধু তাই নয়, জুলফিকার আলী ভূট্টো যে হোটেলে ছিল সেই ইন্টারকন্টিনেন্টালের ছাদেও স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়ানো হয়!

২৪ তারিখে সৈয়দপুর, রংপুর, চট্টগ্রামের সাধারণ জনতার বিক্ষোভ-সমাবেশে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী গুলি চালায়, এতে করে বহু লোক হতাহত হয়। সরকারি হিসেবে কম দেখানো হলেও জানা যায় প্রায় হাজারখানেক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এ রকম উত্তপ্ত পরিবেশে ঐ দিনের আলোচনা শেষে শেখ মুজিব দেশের সবাইকে যে কোন ধরণের পরিস্থিতির জন্য তৈরি থাকতে বলেন এবং চলমান আন্দোলন আরও বেগবান করার আহবান জানান।

২৫ মার্চ দিনের বেলা হঠাৎ করেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আলোচনা বন্ধ করে দিলেন। রেডিওতে গোপালগঞ্জে বসে অনিকসহ সবাই শুনতে পেল আলোচনা সফল হয়েছে। ওরা জানতে পারল সকল ইপিআর সদস্যকে অস্ত্র জমা দেবার নির্দেশ দেয়া হল। যুক্তি দেখানো হয়েছে যেহেতু আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে, সেহেতু তাদের কাছে অস্ত্র রাখার আর প্রয়োজন নেই। একদিনের মধ্যেই সেনাবাহিনীর বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদেরকে সরিয়ে অবাঙালি অফিসারদের নিয়োগ দেয়া হয়। সব মিলিয়ে সবাই বুঝতে পারে আলোচনা মোটেই সফল হয় নি। এ সবই ষড়যন্ত্রের অংশ। গুজব ছড়িয়ে পড়ল যে কোন সময়ে কারফিউ জারি হতে পারে।

ঢাকার মানুষদের গভীর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সুদূর গোপালগঞ্জের থেকেও অনিকদের মাঝেও ছড়িয়ে পড়ল।

১২।

২৫ শে মার্চের রাতটি কি অন্যান্য রাতের চেয়ে বেশি অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল? নিম্ন শ্রেণির প্রাণির মত মানুষও কি সামনে কোন ভয়াবহ ঘটনা আগে থেকেই আঁচ করতে পারে? এরকম না হলে ঢাকা থেকে শত কিলোমিটার দূরে থাকা গোপালগঞ্জের মানুষ কিভাবে তা অনুভব করল! কেন সবার মনে হচ্ছিল আজকের রাতটি অত্যন্ত অশুভ?

অন্য সব দিনের চেয়ে আজকে সন্ধ্যার আগেই গোপালগঞ্জের রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে গেছে। অনিকদের বাসার জানালার ফাঁক দিয়ে চোখ মেললে রাস্তার অনেকদূর পর্যন্ত চোখ যায়। বিবর্ণ রাস্তার আলোয় আজকে কোন প্রাণচাঞ্চল্যই চোখে পড়ল না। অনিকের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।

বাবা এমনিতেই রাতের খাবার সবার চেয়ে একটু আগে খেয়ে নেন। আজকে অনিক এবং শাওন-ও স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা আগেই রাতের খাবার খেয়ে নিলো। রেডিওতে অনেক গুঁতো-গুঁতি করে খবর শোনার চেষ্টা করেও কিছু শুনতে না পেয়ে অনিক খানিকটা আগেই শুয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নিলো। শোয়ার আগে কিছুক্ষণ ক্রিকেট বলটা শূন্যে লোফালুফি করে অবশেষে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

সকালে অনেক মানুষের সম্মিলিত হট্ট-গোলে অনিকের ঘুম ভেঙ্গে গেল। বাবা সক্রিয়ভাবে রাজনীতি না করলেও স্থানীয় সকল রাজনৈতিক দলের সাথে বাবার ভাল সম্পর্ক রয়েছে। তাদের বেশ কয়েকজনকে বাসার সামনে দেখা গেল। জানালা দিয়ে বাবাকে লুঙ্গি পড়া অবস্থায় বাসার বাইরে দেখে কিছুটা অবাক হল, এরকম কখনোই হতে দেখে নি। কোন খারাপ কিছু হয়েছে কি না ভাবতে ভাবতে বাসার সামনে এসে যা শুনল তাতে ওর ঘুম ঘুম ভাব মুহূর্তেই কেটে গেল। ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এক যোগে পাকিস্তানী সৈন্যরা নাকি হামলা চালিয়েছে!

শেখ মুজিব গ্রেপ্তার হয়েছেন নাকি মারা গেছেন সে ব্যাপারে কেউ নিশ্চিত নয়! গতকাল রাত থেকেই ঢাকার সাথে কোন টেলিফোন যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছিল না। তবে স্থানীয় ইপিআর ক্যাম্পের সদস্যগণ ওয়ারলেস মারফত ভাঙ্গা ভাঙ্গা কিছু তথ্য পেয়েছে! সেখান থেকেই সবাই জানতে পেরেছে যে গতকাল রাতেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানে চলে গেছে। এরপর রাত ১০-১১ টার দিকে পাকিস্তানী জল্লাদ বাহিনী ঢাকার ঘুমন্ত মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। বিস্তারিত কিছু এখনো জানা যায় নি, তবে শোনা গেছে কেবল ঢাকাতেই মারা গেছে কয়েক হাজার মানুষ! এ ছাড়া চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশোর, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর, সৈয়দপুর এবং সিলেটেও ওরা বর্বরোচিত হামলা চালিয়েছে। সব মিলিয়ে একরাতেই কমপক্ষে ৩০-৪০ হাজার মানুষ মারা গেছে! তবে, হতাহতের সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশিও হতে পারে, কেউ আসল খবর জানাতে পারছে না। অনিক নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারল না! এতটা নৃশংস হামলা কিভাবে কেউ করতে পারে?

দুপুরের মধ্যেই স্থানীয় আওয়ামী লীগ অফিসে জরুরী মিটিং তলব করা হল। মিটিং এ যোগ দিলেন ডাঃ ফরিদ আহমেদ, কামরুল ইসলাম রইস, নজির আহমেদ তালুকদার, আবুল হাশেম সমাদ্দার, এডভোকেট কাজী আব্দুর রশিদ, এডভোকেট সাইদুর রহমান, আক্তার হোসেন মোক্তার প্রমুখ। এ সময়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর আব্দুল হালিম গোপালগঞ্জে ছুটি কাটাচ্ছিলেন। তিনিও মিটিং এ যোগ দেন। ফলে সবার মনোবল আরও বেড়ে যায়। অবশ্য বঙ্গবন্ধু বা আওয়ামী লীগ থেকে সরাসরি কোন সিদ্ধান্ত না আশা পর্যন্ত কি করনীয়- সে ব্যাপারে কেউ নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারলেন না।

ইতোমধ্যে ঢাকার পরিস্থিতি নিয়ে আরও নির্ভরযোগ্য কিন্তু হৃদয়বিদারক তথ্য জানা গেল। গতকাল রাতে পাক হানাদার বাহিনী ক্যান্টনমেন্ট থেকে জিপ, ট্রাক ইত্যাদি সৈন্য বোঝাই করে এবং একই সাথে ট্যাঙ্ক ও অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র নিয়ে বের হয়ে সারা শহরে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। এক যোগে আক্রমণ চালানো হয়েছে রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানায় অবস্থিত ই.পি.আর সদর দপ্তর, ফায়ার ব্রিগেডে। বাদ যায় নি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল এবং ইস্ট পাকিস্তান ইউনিভার্সিটি অফ সাইন্স এন্ড টেকনোলোজি ক্যাম্পাস। ইকবাল হল, জগন্নাথ হল এবং রোকেয়া হলে রুমে রুমে ঢুকে তল্লাশি করে মেরে মেলেছে অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রীকে। এমনকি ফুটপাথে শুয়ে থাকা দুস্থ ও অসহায় মানুষজনও ওদের হিংস্র থাবা থেকে মুক্তি পায় নি। পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে বেশ কয়েকটি সংবাদপত্রের কার্যালয়। বিদেশি সাংবাদিকদের আগেই দেশ ছাড়ার নির্দেশ দেয়া ছিল। যারা তখনো যেতে পারেন নি, তাদেরকে হোটেল থেকে বের হতে দেয়া হয়নি।

অবশ্য এর মাঝেও আশাব্যঞ্জক খবর হচ্ছে বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন। শুধু তাই নয়, পাকিস্তানীদের হাতে বন্দী হবার আগে তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা বলে গেছেন। তাজউদ্দীন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ আওয়ামী লীগের অন্যান্য শীর্ষ নেতাদের হদিস এখনও পাওয়া যায় নি, তবে অসমর্থিত সূত্র থেকে জানা গেছে তারা নিরাপদে আছেন এবং ভারতে চলে গেছেন বা যাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

২৬ শে মার্চ সন্ধ্যার পরে জানা গেল স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়েছে। অনেক স্থানেই নাকি ইপিআর, পুলিশ, ছাত্র-জনতা তাদের কাছে যা ছিল তাই দিয়েই পাকিস্তানী সৈন্যদের প্রতিহত করার চেষ্টা করেছে। এছাড়াও, লোকমুখে শোনা গেল দুপুরবেলা চট্টগ্রাম থেকে আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেছেন। অবশ্য, সেই ঘোষণা চট্টগ্রামের বাইরে কেউ শুনতে না পারার কারণে কিছুটা ধোঁয়াশা রয়ে যায়। পরেরদিন মেজর জিয়া নামের এক বাঙ্গালি অফিসার আবার ঘোষণাটি পাঠ করলে স্বাধীনতা যুদ্ধের সত্যতার ব্যাপারে সকল দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবসান ঘটল।

২৭ মার্চেই মেজর হালিম গোপালগঞ্জ এবং আশপাশের এলাকায় ছুটি কাটাতে থাকা বাঙালি সামরিক বাহিনীর এবং ইপিআর সদস্যদের একত্র করতে সমর্থ হন। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং গোপালগঞ্জ থানা থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে তারা ছোট আকারের একটি মুক্তিবাহিনী গঠন করেন। গোপালগঞ্জে কবে নাগাদ পাক বাহিনীর হামলা আসতে পারে সে ব্যাপারে সবাই উদ্বিগ্ন ছিলেন। মেজর হালিম অনুমান করেন পাকিস্তানী সৈন্যরা এদিকে আসতে চাইল যশোরের দিক থেকেই আসবে, ফলে তিনি তাঁর বাহিনী নিয়ে নড়াইলে এগিয়ে গিয়ে প্রাথমিক প্রতিরোধের সিদ্ধান্ত নেন। এদিকে গোপালগঞ্জে যারা থাকবেন তারাও প্রস্তুত থাকবেন, ফলে দুই স্তরের রক্ষণব্যুহ তৈরি হবে।

সিদ্ধান্ত মোতাবেক ২৮ মার্চ মেজর হালিম প্রায় ৫০ জনের একটি দল নিয়ে নড়াইলের দিকে রওনা হলেন। এদিকে ডাঃ ফরিদ এবং অন্যান্যদের সহযোগিতায় কায়েদে আযম সরকারী কলেজে মুক্তিবাহিনীর জন্য ক্যাম্প তৈরি করা হল। রতন, অনিকসহ ওদের সমবয়সী বন্ধুরা স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করতে চাইলেও ওদেরকে সুযোগ দেয়া সম্ভব হল না। একে তো ওদের বয়স কম, তার উপর যথেষ্ট পরিমাণ অস্ত্র নেই। তাছাড়া ওরা যে সামান্য প্রশিক্ষণ করেছে তা সত্যিকার যুদ্ধে কতখানি কার্যকর হবে সে ব্যাপারে নেতৃবৃন্দ সন্দিহান ছিলেন।

এরপরের কয়েকটি দিন প্রচণ্ড উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে গেল। প্রতিদিনই পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর ধ্বংসলীলা এবং হত্যাযজ্ঞের খবর আসতে লাগল। একই সাথে জানতে পারল বাংলার অকুতোভয় আপামর সাধারণ জনগণের সাহসিকতার খবর। বিভিন্ন ইপিআর ক্যাম্প ও ইস্টে বেঙ্গল রেজিমেন্টের অসংখ্য বাঙালি সৈন্যগণ বিদ্রোহ করে সশস্ত্র প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছে। অস্ত্র ও গোলাবারুদের অপ্রতুলতা থাকলেও অদম্য সাহসের বলে তারা সমান তালে লড়াই করে চলেছে। এমনকি লাঠি, বল্লম নিয়ে সাধারণ জনতাও আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে লড়াই করছে!

অনিক এবং ওর বন্ধুদের দায়িত্ব পড়ল দিন-রাত শহর ও এর আশপাশের এলাকা পাহারা দেয়া। যাতে করে পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনী আসার আগেই খবর পাওয়া যায়। একই সাথে মুসলিম লীগের সমর্থক এবং পাকি-মনা বাঙালিরা যাতে কোন ঝামেলা করতে না পারে, সেদিকেও লক্ষ্য রাখা।

এর মাঝেই খবর এলো যশোরে প্রচণ্ড যুদ্ধ হচ্ছে। সেনাবাহিনী ও ইপিআর এর বিদ্রোহী বাঙালি সৈন্য-অফিসারগণ সেখানে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। স্থানীয় জনগণও তাদের সহায়তা করছে। শোনা গেল মেজর হালিম তাঁর বাহিনী নিয়ে নড়াইল থেকে যশোরের দিকে অগ্রসর হয়েছেন।

এদিকে যুদ্ধ শুরু হবার পর থেকেই প্রাণের ভয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ বেনাপোল হয়ে ভারতে যাবার চেষ্টা করছে। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এই সব নিরীহ মানুষের উপরও হামলা করছে। ছেলে, বুড়ো, নারী, শিশু কেউই ওদের আক্রমণ থেকে বাঁচতে পারছে না।

মোদ্দা কথা ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় ও অন্যান্য বড় শহরে শুরু হওয়া হত্যাযজ্ঞ মার্চ শেষ হবার আগেই সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ল। পুরো দেশটা কে ওরা নরক বানিয়ে ফেলার চেষ্টা করল। কিন্তু বাঙ্গালিও বীরের জাতি, বিনা লড়াইয়ে ছাড় দেবার নয়। প্রাথমিক ধাক্কার সামলে পালটা জবাব দেয়া শুরু হতেই যুদ্ধ আরও ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করল। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যথাযথ প্রস্তুতি, অস্ত্র গোলাবারুদ এবং সাংগঠনিক তৎপরতার অভাবে বেশিরভাগ প্রাথমিক প্রতিরোধ ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়তে লাগল। এ সময় পাক বাহিনী তাদের নির্মমতা আরও বহুগুণে বাড়িয়ে দিল। ফলে, প্রতিদিনই মারা যেত থাকল শত শত বীর বাঙালি।

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।