১। যে আমলের কথা বলছি তখন ‘মিথ্যাবাদী রাখাল’ গল্পটি খুব বেশি মানুষ জানত না। একবার এক বিদ্বান ব্যক্তি কিছু ছাত্র-ছাত্রীকে এই গল্প শুনিয়ে তাদের কাছে জানতে চাইলেন তারা এই গল্প থেকে কী শিক্ষা পেল। সবাই জবাব দিল-‘মিথ্যা বলা খুব খারাপ, মজা করেও মিথ্যা বলতে হয় না। মিথ্যার পরিণাম ভাল হয় না’।
তিনি একই গল্প এরপর শোনালেন কিছু রাজনীতিবিদকে এবং যথারীতি গল্পটির শিক্ষা জানতে চাইলেন। রাজনীতিবিদদের বেশিরভাগেরই উত্তর ছিল-‘একই মিথ্যা বারবার বলতে হয় না, মাঝে মাঝে ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে বলতে হয়। এতে করে ঐ মিথ্যার কার্যকারিতা দীর্ঘদিন বজায় থাকে’!!
এর বেশ কিছুদিন পর সেই বিদ্বান ব্যক্তিটি কিছু গবেষককে গল্পটি শোনালেন। গবেষকগণ কী শিক্ষা পেলেন? তারা জানালেন- বাঘকে যতটা চালাক ভাবা হয় আসলে তারচেয়েও অনেক বেশি চালাক। বাঘেরা সম্ভবত হিউম্যান সাইকোলজিও খুব ভাল বোঝে। এ কারণে সেইদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে যতদিন না মানুষজন রাখালের উপর বিশ্বাস হারিয়েছে! এবং ঠিক তারপরই বাঘটি রাখালকে আক্রমণ করেছে!
সুতরাং, একই গল্প বা ঘটনা থেকে কে কোন শিক্ষা নেবে তার কোন নির্দিষ্ট মাপকাঠি নেই। মানুষটি ব্যক্তিগতভাবে কেমন, তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, স্বভাব, পারিবারিক কাঠামো, বয়স- ইত্যাদি অনেকগুলো ফ্যাক্টরের উপর নির্ভর করে।
২। কাজী কাদের নেওয়াজ রচিত ‘শিক্ষকের মর্যাদা’ কবিতায় যে বাদশাহ আলমগীরের কথা বলা হয়েছে তাঁর পুরো নাম (সত্যিকারের পুরো নাম নয়, পদবীসহ আসল নাম প্রায় এক মাইল লম্বা!) আবুল মুজাফফর মুহী-উদ্-দ্বীন মোহাম্মদ আওরঙ্গজেব।
জ্বি, ইনিই সেই মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব এবং কবিতায় যে শাহজাদা’র কথা বলা হয়েছে তিনি ছিলেন বাহাদুর শাহ।
ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায় বাহাদুর শাহ তরুণ বয়সেই একাধিকবার বাবাকে হটিয়ে রাজত্ব দখলের ষড়যন্ত্র করেছেন। কিন্তু কখনোই সফল হতে পারেন নি। উলটো এই অপরাধে তাকে বেশ কয়েক দফায় বন্দিত্ব পর্যন্ত বরণ করতে হয়েছে।
৩। ‘শিক্ষকের মর্যাদা’ কবিতা পড়ে আমরা শিক্ষা পেয়েছিলাম যে শিক্ষককে মর্যাদা দিতে হবে, তাদের সম্মান করতে হবে। কিন্তু এটা তো আমাদের মতন সাধারণ মানুষের শিক্ষা। কোন রাজা-বাদশাহও কি একই শিক্ষা দেখতে পেতেন? মনে হয় না। কেননা, দেখা যাচ্ছে বাদশাহ আলমগীর (আওরঙ্গজেব) যে শিক্ষককে এত মর্যাদা দিলেন কার্যত তিনি শাহজাদাকে ভাল কিছুই শেখাতে পারেন নি।
আওরঙ্গজেব নিজেও অসুস্থ বাবা মুঘল সম্রাট শাহজাহানকে হটিয়ে রাজা হয়েছিলেন। কিন্তু, বাহাদুর শাহই প্রথম মুঘল শাহজাদা/সম্রাট যিনি অল্প বয়স থেকেই ক্ষমতা দখলের মোহে বাবার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র লিপ্ত ছিলেন। সেই শিক্ষক বাহাদুর শাহ’কে কী শিখিয়েছিলেন কে জানে!
৪। বাংলাদেশে এমন কিছু পরিবার আছে যারা রাজা-বাদশাহ’র চেয়ে কম শক্তিশালী নয়। ফলে, তাদের পরিবারেও রয়েছে ষড়যন্ত্র, দ্বন্দ্ব, ক্ষমতা দখল ইত্যাদি অর্থাৎ বিভিন্ন রাজকীয় ব্যাপার-স্যাপার!
ফলে, ইদানীং কালের আলোচিত বিশিষ্ট ‘রাজকীয়’ পরিবারটি শিক্ষকের উপর কেন ক্ষিপ্ত তা সহজেই অনুমেয়! তাছাড়া এইসব পরিবারের সন্তানদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষারই বা দরকার কি! রাজার ছেলে রাজা হবে, এমপি’র ছেলে-মেয়ে এমপি। খুব বেশি প্রয়োজন হলে বিদেশ থেকে টাকার বিনিময়ে একটি ডিগ্রী কিনে এনে বাপের ব্যবসা দেখাশুনা করবে! ব্যস!
শিক্ষকদের গোণার সময় তাদের কোথায়??
অল্প কথায় চমৎকার একটা বক্তব্য রেখে গেলে, জুনায়েদ।
শিক্ষকদের গোণার সময় তাদের কোথায়?? - শুধু তাদের কেন? কারোরই তো নেই মনে হয়। তা না হলে এ সমাজে তারা এত অবহেলিত কেন? বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী নিয়ে একজন শিক্ষক তার প্রথম বেতন যেটা পান, তা একজন এইট পাশ ড্রাইভারের বেতনের প্রায় কাছাকাছি।
বাহাদুর শাহ আসলো কিভাবে?
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ