১।
রুহুল আমিন সাহেবের কাছে ‘দৈনিক বলিষ্ঠ কন্ঠ’ নিজের সন্তানের মতনই। গত ঊনচল্লিশ বছর ধরে তিনি এই পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। ’৭২ সালে তিনি এবং তাঁর দুইজন বন্ধু মিলে এর যাত্রা শুরু করেছিলেন। স্থানীয় পত্রিকা হলেও এর কাটতি এবং গ্রহণযোগ্যতা অন্যান্য অনেক জাতীয় পত্রিকার চেয়েও বেশি। এই পত্রিকার জন্য তিনি অজস্রবার শারীরিক এবং মানসিকভাবে আক্রমনের শিকার হয়েছেন। কিন্তু এরপরও কোন অশুভ শক্তিই তাঁর মত প্রকাশের ক্ষেত্রে কখনো বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারে নি।
পত্রিকা প্রকাশের প্রথম দিন থেকেই তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে সোচ্চার রয়েছেন। প্রকাশের দিন তাঁর পত্রিকার শিরোনাম ছিল ‘এই সব জানোয়ারদের বিচার করতে হবে’। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ চল্লিশ বছর পরও কারো বিচার হয় নি। গত সপ্তাহেও এলাকার এমপি এবং বিশিষ্ট মন্ত্রী জনসমাবেশে ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এই বাংলার মাটিতে হবেই হবে…’ বলে ঘোষনা দিয়েছেন। কিন্তু কেন জানি আর কারো কথায় ভরসা করতে ইচ্ছে হয় না। ‘কিছু একটা করার দরকার’-এই তাগিদ থেকে ভেবেছিলেন এলাকার কুখ্যাত রাজাকার গোলাম কালাম সাইদীকে সামাজিকভাবে বয়কট করার আন্দোলন গড়ে তুলবেন। কিন্তু বিধি বাম! ব্যাটা গতকাল রাতে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছে!
রুহুল সাহেব ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না, তিনি খুশি হবেন নাকি দুঃখিত হবেন! ব্যাপারটা ভাল হয়েছে এই অর্থে যে, আর ঐ নোংরা পিশাচটার মুখ আর দেখতে হবে না। কিন্তু নরকের কীট ঐ বদমাশটা যে কোন প্রকার বিচার ছাড়াই চলে গেল, এটা তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না।
-‘নাহ্, ব্যাপারটা খুব খারাপ হয়ে গেল। এলাকার সবচেয়ে বদমাশ রাজাকারটাকে বিচারের আওতায় আনতে পারলে ছোটখাটগুলোর বিচার করাও অনেক সহজ হয়ে যেত।‘ নিজের মনে বলতে বলতে গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন রুহুল সাহেব।
২।
মাওলানা হাফিজুর রহমান। এলাকার সবচেয়ে বড় জামে মসজিদের ইমাম। গত ছাব্বিশ বছর ধরে তিনি ইমামতি করে চলেছেন। তাঁর মত ধর্মপ্রাণ এবং মহৎ মানুষ এই এলাকায় খুব কমই আছে। তবে আজ তিনি এমন একটি কাজ করতে চলেছেন যা তাঁর স্বভাব-চরিত্রের সাথে একদমই বেমানান।
মসজিদের পাশেই ছোট্ট দুই রুমের একটি বাসায় তিনি বসবাস করেন। স্ত্রী কিছুদিন আগে মারা গেছেন, আর একমাত্র ছেলে ঢাকায় পড়াশুনা করে। এই মুহূর্তে তিনি বাসার সামনে ছোট খোলা জায়গায় চেয়ারে বসে আছেন এবং তাঁর সামনে বসে আছে একজন যুবক।
-হুজুর, তাহলে এটাই আপনার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত?
-হ্যাঁ, বাবা। আমি জানি এতে সম্ভবত আমি গুনাহ্গার হব। আল্লাহর কাছে আমাকে জবাবদিহি করতে হবে। কিন্তু তারপরও আমি কিছুতেই তোমার বাবার জানাজা পড়াতে পারব না।
-দেখুন, আমি জানি তিনি খুব খারাপ মানুষ ছিলেন। বিশেষ করে একাত্তর সালে তার কর্মকান্ড কোনমতেই ক্ষমার যোগ্য না, কিন্তু তারপরও মৃতের সাথে কি একটু ভাল ব্যবহার করা উচিত নয়?
-আমার বাবা একাত্তর সালে এই মসজিদেরই ইমাম ছিলেন। আমার বয়স তখন ছিল এগার/বার বছর। সেপ্টেম্বর মাসে বাবা কিছু মুক্তিযোদ্ধাকে মসজিদে এক রাত কাটানোর সুযোগ করে দিয়েছিলেন। পরদিন তোমার বাবা তাঁকে আমার সামনে মেরে ফেলেছিল। তাও কিভাবে জান? তাঁর দুই হাত একটি গাছের সাথে বেঁধে দুই পা বেঁধেছিল একটি আর্মি জীপের সাথে। এরপর জীপটি জোরে চালানোর ফলে বাবার দুই হাত কাঁধ থেকে ছিঁড়ে যায়। জীপের ড্রাইভার ছিল তোমার বাবা। প্রচন্ড ব্যথায় বাবা যখন চিৎকার করে কাঁদছিলেন, তোমার বাবা তাঁকে বেওনেট দিয়ে খুঁচিয়ে মেরে ফেলার আদেশ দেয়। এরপর তারা বাবার দেহকে নদীতে ছুঁড়ে ফেলে। এবার বল আমি কিভাবে তোমার…পাষন্ড পিতার জানাজা পড়াই??? জানাজা পড়াতে গেলে তার শাস্তি মওকুফের জন্য দোয়া করতে হবে, যা আমার দ্বারা সম্ভব নয়…খোদার ওয়াস্তে আমাকে ক্ষমা কর…
-হুজুর, আমি দুঃখিত! আমি আসলে এত কিছু জানতাম না…আমিও মনে প্রাণে আমার বাবাকে ঘৃণা করতাম, কিন্তু হাজার হলেও তিনি আমার জন্মদাতা…আচ্ছা, ঠিক আছে আমি তাহলে চলি…আসসালামু আলাইকুম…
মাওলানা সাহেব চোখ মুছতে মুছতে অস্পষ্ট স্বরে সালামের জবাব দিলেন।
৩।
কে বলে আমরা সহজে সব কিছু ভুলে যাই? কে বলে আমরা খুব সহজেই সবকিছু ক্ষমা করে দিই? ওসব হচ্ছে রাজনীতিবিদদের চাল। তারা ভুলে যাবার ভান করে, ক্ষমা করে দেবার ভান করে। ব্যক্তি স্বার্থের নিকট সবকিছুই তাদের কাছে মূল্যহীন। কিন্তু সাধারণ মানুষ ঠিকই ইতিহাস মনে রাখে, ঠিকই সুযোগ পেলে সবাইকে তার প্রাপ্য বুঝিয়ে দেয়।
যদিও গোলাম কালাম সাইদী’র জানাজার নামাজ শেষ পর্যন্ত হয়েছে, কেননা একটি বিশেষ দলের প্রতি তার আনুগত্য ছিল-যে দলে নামাজ পড়ানোর অনেক লোক আছে। কিন্তু কোন সাধারণ মানুষ সেই নামাজে অংশ নেয় নি। উলটো তারা এলাকার কবরস্থানে তার লাশ দাফন করতে দেয় নি। নিরুপায় হয়ে তার পরিবারের লোকেরা তাকে বাসার সামনের ফাঁকা জায়গায় দাফন করেছে। সবচেয়ে আশ্চর্য্যের ব্যাপার হল এমনকি পরিবারের কাউকেও কোন প্রকার শোকের বহিঃপ্রকাশ করতে দেখা গেল না!
৪।
রুহুল আমিন সাহেব সকালে নিয়ম করে হাঁটা-হাঁটি করেন। হাঁটতে হাঁটতে গোলাম কালাম সাইদী’র বাসার সামনে আসতেই দেখলেন তার কবরস্থানটি অযত্ন-অবহেলায় পড়ে রয়েছে। খুব সম্ভবত বাসার লোকজনও ওর মৃত্যুতে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে এবং ওকে নিজেদের জীবন থেকে চিরতরে বিদায় দিয়েছে। হঠাৎ কোথা থেকে একটি নেড়ি কুকুর এসে জলত্যাগ করতে উদ্যত হল। তিনি কুকুরটাকে সরিয়ে দিতে গিয়েও দিলেন না, বরং পকেট থেকে মোবাইল সেট বের করে ক্লিক করে কয়েকটি ছবি তুলে নিলেন।
পরদিন ‘দৈনিক বলিষ্ঠ কন্ঠ’র প্রথম পাতায় সেই ছবি এল। ক্যাপশনে লেখা থাকল ‘বাংলার মাটিতেই ওদের বিচার হবে…’
পুনশ্চঃ ব্যক্তিগত ভাবে আমি চাই না কোন যুদ্ধাপরাধীই বিচার ছাড়া, শাস্তি ছাড়া দুনিয়া ছেড়ে চলে যাক। কিন্তু কেন জানি ভরসা হয় না। তারপরও আশায় বুক বেঁধে আছি যেন এই বাংলার মাটিতে ঐ জানোয়ারদের বিচার দেখতে পারি…
আল্লাহ এই জানোয়ারগুলার হায়াত বাড়ায়ে দিক।একটাও যেন বিনা বিচারে না মরে।
"আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস"
বিচার হওয়া উচিত। আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা এখনও পর্যন্ত এমন পরিস্থিতি নিশ্চিত করতে পারিনি।
অ. ট. : কোন ইমাম সাহেব বা আলেম কোন একজনের জানাযার নামায পড়াতে অস্বীকার করতেই পারেন। এটা তাঁর অধিকার। এতে গুনাহগার হওয়ার কিছু নেই। আমাদের নবীও কোন কোন ব্যক্তির ক্ষেত্রে এমন করেছেন।
হুম। বিচার আসলে হবে কিনা আমার সন্দেহ হয়। হলেও সেটা যে নামকাওয়স্তে হবে সিগন্যালগুলোই সেরকমই।
আমার বন্ধুয়া বিহনে
অসাধারণ :boss:
বাংলার মাটিতে যেন এভাবেই ওদের বিচার হয়
জুনায়েদ
আমার কেন জানি মনে হয় বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে এদের বিচারকার্য করবেনা শেষমেষ। কারণ নানা মহলের নানা হিসাব নিকাশ রয়েছে।
আমরা সাধারণ মানুষ যদি চাপসৃষ্টি না করতে পারি, কেউ একফোঁটা গা করবেনা।
এই গল্প কেমনে মিস করে গেলাম? যাই হোক, চমৎকার জুনাভাই।
সহমত।