ইঁদুর মারার বিষ!

১।

শামীম এবং সূচীর বিয়ে হয়েছে প্রায় ছ’মাস হল। লাভ ম্যারেজ নয়, পারিবারিকভাবে সেটল্‌ড ম্যারেজ। বিয়ের পর তারা আলাদা বাসা নিয়ে বর্তমানে মোহাম্মদপুরে মোটামুটি ভাল মানের একটি ফ্ল্যাটে থাকে। আপাত দৃষ্টিতে এই দম্পত্তিকে সুখী মনে হলেও দুইজনের মধ্যে এখনো ঠিক সত্যিকারের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে নি। অথচ এমন নয় যে ছেলে হিসেবে শামীম কম যোগ্য বা অযোগ্য। বরং সে ব্যক্তিজীবন এবং কর্মজীবনে যথেষ্ট সফল। একজন সফল মানুষ এবং স্বামী হবার জন্য যেসব গুণাবলী থাকার প্রয়োজন তার সবই শামীমের মধ্যে বিদ্যামান।

অপরপক্ষে সূচিও অনেক গুণবতী এবং সুন্দরী। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে সে একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে বেশ ভাল বেতনের চাকুরি করে। তবে চাকুরীর কারনে সংসার করার কোন সমস্যা তার হয় না। বরং তার অনেক বান্ধবীর চেয়ে ভালো মতনই সংসার সামলায়।

এদের সংসারে হয়ত দম বন্ধ করা প্রাচুর্য বা বিলাসিতা নেই, কিন্তু অভাবও নেই। মোটকথা, সুখী হবার যত উপকরণ লাগে তার সবই এই দম্পত্তির আছে। তবুও কি এক অদৃশ্য কারনে আজ ছ’মাস ধরে অসুখী জীবনযাপন করে চলেছে।

২।

শামীম

অফিস থেকে বের হয়ে বাসায় ফেরার জন্য সিএনজি নেবার আগ মুহুর্তে মনে পড়ল ইঁদুর মারার বিষ কিনতে হবে। ইদানিং বাসায় ইঁদুরের উপদ্রপ বেড়েছে। সম্ভবত পাশের ফ্ল্যাট থেকে ইঁদুরের আগমন হয়েছে। গত সপ্তাহেই ওরা এই বাসায় উঠেছে। লিফট দিয়ে যখন বিশাল বিশাল বাক্স তুলছিল, তখনই শামীমের চিন্তা হচ্ছিল। গতকাল সূচীর কথায় বুঝল ওর ভয় অমূলক ছিল না।

সিএনজি’তে ওঠার পর ইঁদুরের বিষের প্যাকেট হাতে নিয়ে আজব এক চিন্তা মাথায় এল। ‘এই বিষ খেয়েই অনেকে আত্মহত্যা করে! আচ্ছা, আত্মহত্যা কারা করে? কেন করে? অসুখী মনোভাবই কি মানুষকে আত্মহত্যার পথে নিয়ে যায়?’

নিজের জীবনের কথা ভাবল শামীম। কত রঙ্গিন স্বপ্নই না ছিল মনে! বিশেষ করে বিয়ে-পরবর্তী জীবন নিয়ে। রূপকথার ‘অতঃপর তারা সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে লাগিল’ টাইপ না হলেও আর পাঁচটা সুখী মানুষের মতন বিবাহিত জীবনের কথা ভেবেছিল। কিন্তু…

বন্ধুরা মজা করে বলেছিল বাসর রাতেই বিড়াল মারতে। কিন্তু সারাদিনের ক্লান্তি, নতুন জীবনের অনিশ্চয়তা, কিছুটা সংকোচ- সব মিলিয়ে বিড়াল আর মারা হয়ে ওঠেনি। পরবর্তীতে একাধিকবার বিড়াল মারার চেষ্টা করেছে, কিন্তু সবকিছুর পর মনে হয়েছে বিড়ালটা সম্ভবত মরে নি। উলটো ধীরে ধীরে ওদের সম্পর্কের মধ্যে এক অদৃশ্য দেয়াল তৈরি হয়েছে।

‘ধুশ শালা, ইঁদুরের বিষ খেয়ে এই জীবন শেষই করে ফেলব নাকি?’ ভাবনাটা মাথায় আসতেই নিজের অজান্তেই হেসে ফেলল শামীম। সমস্যা দেখে পালানো ওর স্বভাবে নেই। কি করা যায় ভাবতে ভাবতে সিএনজি করে বাসার দিকে এগোতে থাকল।

৩।

সূচী

গতকাল শামীমের আনা ইঁদুরের বিষ রান্না ঘরের কোনায় দিতে দিতে আপন মনে নিজের কথা ভাবছে ও। বান্ধবীরা তাদের দাম্পত্য জীবন নিয়ে কত গল্প, খুঁনসুটি করে। সূচী ওদের কথায় শুধু হাসি দিয়েই অংশ নেয়, এবং একথা-ওকথা বলে আলোচনা থেকে নিজেকে পাশ কাটিয়ে নেয়।

‘আমি কি সুখী?’ নিজেকে প্রশ্ন করে ও কোন সদুত্তর পায় না। এমন নয় যে ও শামীমকে পছন্দ করে না। বরং ওর ধারনা শামীমকে ও ভালবাসতে শুরু করেছে। শামীম লোকটাই এমন যে ওকে ভাল না বেসে পারা কঠিন। সূচীর প্রতি তো বটেই সংসারের সবকিছুর প্রতিই ও অনেক কেয়ারিং। এমনকি ঘরের কাজ, রান্নার সময়ও সাহায্য করে। ওদের বাসার বুয়া এক বেলা- সকালে কাজ করে। তবে রান্না সূচী নিজেই করে। রাতে খাবার পর বাসন-পত্র পরিষ্কার করার সময় শামীম ওকে সাহায্য করে। অনেক বলেও সূচী ওকে নিবৃত্ত করতে পারে নি।

কখনো কখনো মনে হয়, ও সম্ভবত শামীমের যোগ্য নয়। এ কারনেই ওরা সুখী হতে পারছে না। শামীমের হাসি হাসি মুখের আড়ালে লুকিয়ে থাকা কষ্ট দেখে দূরে কোথাও পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে।

বাসার সব ঘরে ইঁদুরের বিষ দেবার পর অনেকক্ষণ ধরে ও বিষের বোতলের দিকে তাকিয়ে রইল।
মাথার ভেতর এক অলুক্ষণে চিন্তা এসেছে। চিন্তাটা নিয়ে আরো চিন্তা করার আগেই কলিং বেল বেজে উঠল। চমকে উঠে বোতলটা রান্না ঘরে রেখে দরজা খোলার জন্য ছুটল।

৪।

সেইদিন রাতের কথা।
শামীম রান্না ঘরের সিংক- এর সামনে দাঁড়িয়ে বাসন ধুচ্ছে, আর সূচী চুলা দুটো মোছায় ব্যস্ত। হঠাৎ সূচী ‘ও মাগো’ বলে লাফ দিয়ে শামীমের দিকে গেল। শামীম হাতের বাসনটা ফেলে দিয়ে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে সন্ত্রস্ত কন্ঠে জিজ্ঞাসা করল,
-‘কি হয়েছে???’

সূচী প্রায় পনের/বিশ সেকেন্ড মতন কোন কথা না বলে চোখ বন্ধ করে ওকে জড়িয়ে ধরে থাকল। এরপর ধীরে ধীরে চোখ খুলে আস্তে করে বলল,
– ‘ঐ কোনায় একটা ইঁদুর, ইয়া বড়…’

শামীম স্বস্তির হাসি দিয়ে ওকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
-‘ভয় কিসের? আমি আছি না???’

সূচী চোখ তুলে শামীমের চোখের দিকে তাকালো। ওদের চোখ এক নতুনভাবে একে অন্যকে দেখতে লাগল। ওরা নতুন করে একে অন্যকে চিনল, জানল। দুজনেই বুঝতে পারল পরস্পরকে ওরা কতখানি ভালবেসে ফেলেছে…

শামীম কিছুটা দুষ্টুমি ভরা হাসি দিয়ে বলল,
-‘এক কাজ করি চল-আজ আমরা ইঁদুর নয়, বরং বিড়াল মারি!’

সূচীর সলাজ হাসিময় মুখ দেখে বোঝা গেল এতে ওর কোন আপত্তি নেই। ভাঙ্গা বাসন, অর্ধমোছা চুলা- ওভাবেই রেখে ওরা বিড়াল মারায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল…

পরদিন ছুটির দিন থাকার কারনে ওরা বেশ বেলা করে ঘুম থেকে উঠল। ঘুম থেকে উঠেই প্রথম যে কাজটি করল তা হল ইঁদুরের বিষ এবং বোতল বাইরে ফেলে দিল। বাড়িতে দু-একটি ইঁদুর থাকলে এমন কোন ক্ষতি হয় না-ওদের দুজনেরই এখন এমন অভিমত।

৪,৯৪১ বার দেখা হয়েছে

১০৪ টি মন্তব্য : “ইঁদুর মারার বিষ!”

  1. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

    জুনা,
    গল্প ভালো ছিলো।

    অফটপিকঃ
    আহা রে,
    নিজের বিয়ের কথা নিজের মুখে কইতে না পেরে পুলাপাইন যে কত রকম ধান্দা করে!


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন
  2. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)
    ওভাবেই রেখে ওরা বিড়াল মারায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল…

    আমিও বিড়াল মারপো :(( :((
    অফ টপিক- অনেক দিন পর আমার এই ট্রেডমার্ক ডায়ালগটা ব্যবহার করলাম 😀

    ইয়ে,জুনাদা-বিড়াল কেমনে মারে??? আচ্ছা থাক বলা লাগবেনা ;;;

    জবাব দিন
  3. ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

    বাস্তবক্ষেত্রে সম্পর্ক উন্নয়নে ইঁদুরের কতখানি ভূমিকা তা প্রশ্নসাপেক্ষ হলেও গল্প, উপন্যাস, সিনেমাতে তা বেশ টার্নি পয়েন্টের কাজ করতে পারে। জুনা তুমি সিরিয়াসলি রোমান্টিক বাংলা ছবির স্ক্রিপ্ট লেখার কথা ভাবতে পার।


    “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
    ― Mahatma Gandhi

    জবাব দিন
  4. আছিব (২০০০-২০০৬)

    জুনা ভাই...এত সুন্দরভাবে কেমনে যে ফুটিয়ে তুলেন :boss: :salute:
    বুঝলাম,নিকট ভবিষ্যতে আপনি ২৪/৭ বাসায় ইঁদুর মারার বিষ রাখবেন,বিষ না রাখলেও বাসায় ইঁদুর রাখবেন :))
    ''পরিবার পরিকল্পনা'' ভালোই করতেছেন বস :thumbup: ;))

    জবাব দিন
  5. আশহাব (২০০২-০৮)
    ওভাবেই রেখে ওরা বিড়াল মারায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল…

    :shy: :grr: :grr: ;;;
    গল্পের নামটা "ইঁদুর মারার বিষ!" এর জায়গায় "বিড়াল মারার ট্রিক্স" দিলে দারুন জমতো :grr: :duel:


    "Never think that you’re not supposed to be there. Cause you wouldn’t be there if you wasn’t supposed to be there."
    - A Concerto Is a Conversation

    জবাব দিন
  6. ফয়েজ (৮৭-৯৩)

    হালকা চালের গল্প হিসেবে ঠিকাছে, কিন্তু শুরু থেকে মাঝামাঝি পর্যন্ত মনে হয়নি এটা একটা হালকা গল্প। সেক্ষেত্রে এটা একটা টুইস্ট হিসেবে ধরাই যায় কি বল 😉


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন
  7. জুনা ভাইয়া,বিড়াল মারার টেকনিকটা নিয়ে আরো বিস্তারিত লিখলে ভাল লাগতো 😀 😀
    চরম চরম :awesome: :awesome: (চ্রম চ্রম লিখতে মন চাইছিল,কিন্তু যুক্তাক্ষরের দিন তো শেষ :(( )

    জবাব দিন
  8. নাজমুল (০২-০৮)

    জুনা ভাই…এত সুন্দরভাবে কেমনে যে ফুটিয়ে তুলেন :boss: :salute:
    বুঝলাম,নিকট ভবিষ্যতে আপনি ২৪/৭ বাসায় ইঁদুর মারার বিষ রাখবেন,বিষ না রাখলেও বাসায় ইঁদুর রাখবেন :))
    ”পরিবার পরিকল্পনা” ভালোই করতেছেন বস :thumbup:

    জবাব দিন
  9. কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

    এত্ত সহজে কিছু হয়নাকি ব্যাটা, ধুর।
    যেরকম পরিস্থিতি বানাইছোস ততদিনে আর বিড়াল মাইরা পোষানির কথা না। একেবারে রয়েল বেঙ্গল না হোক, মিনিমাম চিতাবাঘ মারা ছাড়া রাস্তাতো থাকার কথা না 😉


    সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!

    জবাব দিন
  10. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    কিচ্ছু হয় নাই, ইদুঁর বা বিড়াল উভয় প্রানীকে মারার প্রকৃত প্রক্রিয়া, নিয়ম কানুন, কৌশল ইত্যাদি ইত্যাদি সম্পর্কে লেখক এড়িয়ে গিয়েছেন, এ সকল বিষয়ে দৃষ্টি দেবার দাবী জানাচ্ছি :-B


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  11. জুলহাস (৮৮-৯৪)

    দাদা, তুই বরং একটা দোকান দিয়ে দে..............................
    যে দোকানে শ্যাম্পু..........ইঁদুর........ইঁদুর মারার বিষ.......বিড়াল..................বিড়াল মারার নিয়মকানুন..............ক্যালেন্ডার এবং কলম (ছয় মাস ধরে........... নিশ্চয়ই কলম দিয়ে ক্যালেন্ডারের দিন কাটা লাগবে......ইত্যাদি...ইত্যাদি ) স--------ব পাওয়া যাবে!!!!!!!!!!!!!!!!!!!

    অঃ টঃ সজ্ঞানে ছোট ভাইয়ের বিবাহের প্রসং এড়িয়ে যাওয়ার জন্য আমারে ব্যাঞ্চাই 😛
    আবারও অঃটঃ বিড়াল মারবি......আগে তো সেইটা ম্যানেজ করা লাগবে !!!!!!!!!!! =)) =))
    আমার ভাইটার জন্য কেউ বিড়াল দেখলো না!!!!! :thumbdown: :thumbdown: :thumbdown:


    Proud to be an ex-cadet..... once a cadet, always a cadet

    জবাব দিন
  12. সামিয়া (৯৯-০৫)

    গল্প-কমেন্ট পড়ে হাসতে হাসতে মিরা গেছিলাম, আবার জীবিত হয়ে কমেন্টাইতেসি।
    জুনা ভাই কেমনে লেখেন এইসব??
    আহেম, বাসায় ট্রিগারিং ফ্যাক্টর হিসাবে ইঁদুর রাখতে মঞ্চায়।

    জবাব দিন
  13. সাবিহা জিতু (১৯৯৩-১৯৯৯)

    আমার প্রিয় ভাই ও বোনেরা, এতো লাফালাফি বা ফালাফালি কইরো না, এখন তো বিড়াল মারা নিয়ে কতো কতো রঙ্গীন স্বপ্ন দেখতাছ, বিয়াটা হউক, বছর কয়টা যাইতে দাও, তহন বলবা, আমিই কেন বিড়াল হইলাম না, কেউ আইসা আমারেই মাইরা যাও...প্লীজ!!!


    You cannot hangout with negative people and expect a positive life.

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।