তেরছা হয়ে বাঁধা মশারিটা সকালে জানিয়ে দিল, এরকম অযত্নে টাঙানো হলে সে কালকে থেকে ধর্মঘট শুরু করবে। আমি সব শুনে একটু নিরুপায় বোধ করছি। ভাবলাম, দাবি-দাওয়া মেনে নেই; রাতে মশা খুব জ্বালায়। ঘরের কোণে কোণে খুঁজে পেতে কয়েক টুকরা দড়ি পেলাম। সেগুলো হাতে পায়ে জুড়ে দিতেই মশারির মুখে কী বিগলিত হাসি! আমারও ভালো লাগলো, যাক বাবা। এবারে খুশি, হলো তো?
এরকম ভেবে পা ডুবিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। একটু এগুতেই দেখা গেল দরজার কোণে গতরাতে রহিমার ছড়িয়ে দেয়া সাদা চকের মত বিষে মুখ ডুবিয়ে দুটি কিশোর-তেলাপোকা মরে আছে। তাদের ঊর্ধ্বমুখী ছয়-ছয়টি পা নির্দেশ করছে একটা গুরুতর প্রোপাগাণ্ডা: পতিতার মেলে ধরা উরুর মত ব্যক্ত হয়ে গেছে জীবন আর কৈশোরের আকুল কৌতূহল। আমার খারাপ লাগে। আচমকাই গলার মাঝে খট করে একটা দলা আটকে যায়। ইদানীং এই বাজে ব্যাপারটা ঘটছে। বেশ আগে, একটা সময়ে খারাপ লাগার ব্যাপারগুলো আমার অনুভূতিকে দেউলিয়া করে দিতো আর সেসময়ে নানামুখী ব্যস্ততায় আমি সেই বিপন্নতা ঢেকে ফেলতাম। আজকাল সেটা হচ্ছে না (কিছুটা স্বস্তিকর ব্যাপার। সর্বদা ঢাল-তলোয়ারে প্রস্তুত থাকাটা কষ্টের), আবার এহেন উটকো গলায়-আটকে-থাকা দলার প্রকোপও বাড়ছে। আমি বেশ দুশ্চিন্তায় থেমে থাকি কিছুক্ষণ।
কিশোর তেলাপোকাদের ঠেলে সরিয়ে দিই একটু। পৃথিবীর পাঠ চুকেছে, এখন পিঁপড়েরা আসবে ভূরিভোজের আহার্য নিয়ে যেতে। আমি সেই ফিস্টের হাট-বাজার একটু স্থানান্তরে পাঠিয়ে ঘটিয়ে ভুলে থাকতে চাই যে আমার গলায় একটা কিছু আটকে আছে।
সামনে এগিয়েও পিছনে ফিরে যাওয়া যেতে পারে। যেমন আমি নীল দানাদার কলয়েডীয় পেস্ট টেনে নিই, শিশ্ন টেপার মতো বের করে আনি সরস মাজক, এরপরে ব্রাশে লাগিয়েও কিছু সময় নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকি!
পরে ফিরে এলে দেখি চৌকো চৌকো আলোবাক্স ঘরের মাঝে অ্যাসেম্বলি বসিয়েছে। বসে পড়তে পড়তে তারা খিক করে হাসে, ঠ্যালা দেয় একে অপরকে, দুলে ওঠে সম্মোহনে। আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখেই তারা জোরে চেঁচিয়ে ওঠে, “ওমা! তুমি তো পুরাই নগ্ন! হে হে হি হি হু হু!”
আমি একটু ঝামটে উঠি, কিংবা সেখানেও আমার গলায় আটকে থাকা দলাটি সরে যায় না বলে আমি নীরবই থাকি। “সরো সরো, জায়গা দাও দেখি!” আমি বললেই তারা সরে যাবে এমনটাও ঘটে না। আমাকে অনেক কিছু করতে হবে এখন। সাদা-রঙিন জামা জড়াতে হবে, এবং ভুলে যেতে হবে যে একটু আগেই নগ্নতা আমাকে আরাম দিচ্ছিল। আলোবাক্সেরা গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছিল হেসে কুটি কুটি, সেটা এখন পারবে না, এই সত্য মেনে নিতে নিতে আমি আরো একবার হেরে যাই। আমাকে আরো প্রসাধনে চর্চিত হতে হবে, চুল আঁচড়ে নিপাট ভদ্রলোক সেজে বেরুতে হবে বাইরে। এসকল নিছক স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রণা মেখে আমি পথে নামি।
রোদ চিরে যেতে থাকে যেভাবে তাতে আমি আরাম পাই। জামার অশ্লীলতা ভেদ করেও সুস্থ রোদ আমাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে এমনটা ভাবি, ভাবতে ভাবতেই একরাশ ধুলো জুতোর ওপরে এসে পড়ে। ফুটপাতের পাশে অলস-শয্যাবাসী ধুলো। মনে পড়ে যায় জুতোটার চামড়ার গর্তে গর্তে কত অজ্ঞাত ধুলো জমছে রোজ। দুয়েকদিন পর পর আমি কালি মেখে দিলে গর্তে বসবাস করা ধুলোরাও হোলি খেলে, কালো হোলি! তারপরে আবার নীরবতা, নতুন অতিথিরা আসে, গল্প জুড়ে দেয়, কুশল বিনিময়, হাপিত্যেশ! অতঃপর পুনরায় হোলি। চক্রাকারে আমি আর ধুলো একটা সম্পর্ক স্থাপন করেছি পরষ্পরের সজাগ সম্মতি ছাড়াই। সেই কথাও মনে পড়ে।
ফুটপাতের পাশে নগর-রূপায়কেরা রেলিং দিয়েছে, সার সার রূপালী রেলিং। রোদ মেখে ঝিকিয়ে উঠছে চিৎকারে। আমি একটু ছুঁয়ে দিতেই আঙুলে ফালা ফালা তড়িতের মতো তাপ ঢুকে পড়ে। আমি কৌমার্য হারানোর মতোন হতাশা আর বেকুবি আর হা-হুতাশ আর গ্লানি আর অসহায়ত্ব টের পাই। সিদ্ধান্ত নিই, এবারে হাত রাখা যায় রেলিং সঙ্গমে। এবারে ঘর্মাক্ত হওয়া যায়, অবসন্ন হওয়া যায়। এবারে রেলিংকে ভেতরে টেনে ঢুকিয়ে বীর্যহীন করে দেয়া যায়। আমি উল্লাসিত হই!
তারপরে আমি লম্বা পা ফেলি সামনে। মনে পড়ে যায় তেলাপোকা কিশোরদ্বয় আমার মতোই বেরিয়েছিল, আমার ঘরের কালো-পথে ওরা হাঁটতে হাঁটতে মিশে গেছে পা ছড়িয়ে। মনে পড়ে চৌকো আলোবাক্সগুলোকে, ওরা নিশ্চয়ই এখন জমাট রুলটানা ঘরে বাসর সাজিয়ে ফেলেছে। মনে পড়ে একটা নীলবীর্য-শিশ্ন রেখে এসেছি মুখ না লাগিয়েই, ওখানে এখন স্বতঃস্ফূর্ত নিঃসরণ হবে, ভিজে যাবে ক্রমশই আমার বেসিন, টাইলসের খাঁজ, চৌকাঠ, কার্পেট, আলোবাক্সের কাফেলা!
***
[নোটিশঃ আজ আমার লেখা ছাপা হয়েছে বইমেলাতে। একটি লিটল-ম্যাগাজিন-এ। ম্যাগাজিনটির নামঃ ‘জোনাকরোড’। সেখানে আমার তিনটি কবিতা আর একটি গ্রন্থালোচনা ছাপা হয়েছে। এই প্রথম মেইনস্ট্রিমে কোথাও আমার লেখা ছাপা হলো। একটা জড়বৎ অবস্থায় আছি। ঠিক বলে বুঝাতে পারবো না কেমন লাগছে! বইমেলা গেলে সবাইকে বইটি কিনে পড়তে অনুরোধ করবো। আমি যা লিখি তারচেয়ে ঢের ভালো কিছু লেখা ওখানে আছে (মতামতের জন্যে আমিই দায়ী, অর্থাৎ ভালো না লাগলে আমাকে বলবেন।)! ‘জোনাকরোড’ পাওয়া যাচ্ছে লিটল ম্যাগাজিন চত্বরে, ‘লোক’, ‘মেঘ’, ‘ব্যাস’ ইত্যাদি স্টলে।]
আপনার ভাষার উপর যে পরিমান দখল তা আমাকে সবসময়ই অবাক করে আর আপনার প্রতি শ্রদ্ধাবনত হই। :boss:
অনেক অনেক শুভকামনা রইল। মুলধারার লেখক হিসেবে আবির্ভাব ঘটায় আপনি হয়ত আমাদের অনেক পরিচিত মুখকে ছাড়িয়ে যাবেন। আমরা তখন আপনার কথা বলে ভাব মারব।
আরে আমিতো দেখি ১ম 😀
অনেক অনেক শুভাশিষ নাও শার্লী! আমি মূলধারাতে সবে ঢুকলাম। সামনে কী হবে এখনও জানি না। শুধু কামনা এটুকুই , যা লিখবো, বলবো, করবো, তাতে যেন নতুনত্ব আর সৌন্দর্যটুকু থাকে। এই...
তুমি ভালো থেকো।
অভিনন্দন আন্দালিব ।
আমি সত্যি তোমাকে নিয়ে গর্বিত।
আমার ধারনা আমাদের সিসিবির সবাইও আমার মতো। :thumbup:
আমি প্রায় প্রতিদিনই মেলায় যাই। অবশ্যই তোমার লেখাটি পড়বো। 🙂
দেখছ, কুটনৈতিক কথা কয়। আরে ব্যাটা কয়, বইটি কিনব এবং পড়ব।
পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না
হা হা হা! কামরুল ভাই, ম্যাগাজিনটার দাম মাত্র ৫০ টাকা। কিনে রেখে দিয়েন প্লিজ। খুব ভাল লাগবে!
ফয়েজ ভাই, কামরুল ভাই বললেও আমি জানি উনি কিনেই পড়বেন। আপনি কিন্তু বললেনও না! (মজা করলাম, জানি আপনিও পড়বেন)
:thumbup: :thumbup: :thumbup:
অভিনন্দন আন্দালিব ।
Life is Mad.
অনেক ধন্যবাদ সায়েদ ভাই। আপনাদের সাথে অল্পদিনেই যে আত্মিক যোগাযোগ, তা অনেক উৎসাহ দেয়, সাহস দেয়। অনুপ্রেরণা পাই। অনেক অনেক ভালো থাকুন!
আন্দালিব, তোমার লেখাগুলোর বিভাগে এখন আর শুধু জেসিসি দেবার কোন মানে হয় না...উচিৎ সিসিবি দেয়া... :-B
তুমি আমাদের সবার গর্ব... :clap: :clap: :clap:
ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ
ভাল কইছ, তুমি আমাদের সবার, শুধু জেসিসি আপ আপ কইলেই আমরা মানব নাকি? কক্ষোনোনা? 😀
পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না
ঠিক আছে, এখন থেকে জেসিসি, সিসিবি দুইটাই দিমুনে!
আন্দালিব,
বরাবরের মতো আবারের লেখাটাও বেশ ভাল লেগেছে। সিসিবিতে যেসব লেখা পড়ি তার মধ্যে তোমার লেখা সবসময়ই আমার কাছে আনকমন বা অসাধারণ মনে হতো। আজ জেনে খুব ভাল লাগল যে তুমি তোমার এই সুপ্ত প্রতিভার পূণ বিকাশ ঘটাতে যাচ্ছ। দোয়া করি তুমি অনেক বড় মাপের লেখক হও। তুমি হবে আমাদের সবার গর্ব। অনেক অনেক শুভকামনা রইল :boss: :boss: :boss:
আপনার শুভকামনা আমার অনেক কঠিন সময়ের পাথেয় হয়ে থাকবে রহমান ভাই! অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
অভিনন্দন আন্দালিব । দেশে থাকলে অবশ্যই কিনে পড়তাম । তোমার উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করছি ।
বুঝতেছি আদনান ভাই। জানি, থাকলে আমার বলাও লাগতো না সেটা। দেশে আসেন, নাহয় আমার বইটাই আপনাকে ধার দিবোনে!
বৃক্ষ তোমার নাম কী, ফলে পরিচয় 😛 😛
আন্দালিব ভাইকে, অনেক অনেক অভিনন্দন :hatsoff: :hatsoff:
আমি তবু বলি:
এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..
আন্দালিবকে গরম চা দে রকিব :grr:
আবার জিগায়! আসেন আসেন, সবাই বৃক্ষের চা-পান অবলোকন করুন এবং এই কুদরতী কারবারের দর্শন লাভ করে অশেষ নেকি অর্জন করুন! হা হা হা!
অনেক অভিনন্দন আন্দালিব।
অবশ্যই কিনবো জোনাকরোড, তালিকায় টুকে নিয়েছি। 🙂
শুভেচ্ছা।
www.tareqnurulhasan.com
অনেক ধন্যবাদ নূরুল ভাই!
অই আন্দালিব তুমি যখন অনেক বিখ্যাত লেখক হবা, তখন আমারে/আমাদেরকে ভুইল্ল্যা যাইও না কিন্তু কইলাম।
পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না
:thumbup: :thumbup:
সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!
বস্, ভলোনের কোনই চান্স নাই। আর আমি বিখ্যাত হইতেও চাই না। এক বছরে তিনটা পাত্র কবিতা বের করছি। তাইলেই বুঝেন আমি কিরাম আইলসা! আমারে ঠেইলাও বিখ্যাত বানান যাইবো না। আর চামে দিয়া বামে যদি হইয়াও যাই, তবে সিসিবি-কে ভুলা কোনদিনই সম্ভব না! আমি চরম শিকড়প্রেমী (হাজার হউক, গাছ তো!)। যে দুটা জায়গা থেকে আমার লেখালেখির বেড়ে ওঠা, সেই জায়গা গুলোকে ভোলা সম্ভব না আমার পক্ষে!!
ভুলোনের*, মাত্র* (মরার typo)
অভিনন্দন দোস্ত।
এই উইকে আবার কবে মেলায় যাবি জানাইস।
আমি শুক্রবার যাব নিশ্চিত! দেখা হবে।
আপনি যে মানের লেখক, তাতে আপনার লেখা আরো আগেই ছাপা হওয়া দরকার ছিল। বস, আপনাকে নিয়ে আমরা গর্বিতে। :hatsoff:
উপরে একবার বলেছি রে ভাই, আমি চরম অলস মানুষ। লেখা ছাপানোর হাজার তাগিদ আমাকে ঠেলা দিয়েও একচুল নাড়াইতে পারে না। আর কোন লেখাকেই আমার 'ফিনিশড্ প্রোডাক্ট' মনে হয় না বলে সেটা ছাপানোর উদ্যোগেও গড়িমসি চলে। এটা যে ঘটলো অবশেষে, তার জন্যে ঘ্যান ঘ্যান কারী সম্পাদকের ভূমিকা অনেক বেশি ছিল!
পুরাই তোর লেখার সাথে তোর আলসেমি যায়। মানে বড় টাইপের লেখকরা এইরকম সম্পাদকের গুতা না খাইলে কোন লেখা লেখে না। বস বইটার বিক্রিবাটা শেষ হইলে টাকা উশুল হয়ে গেলে তারপর পারলে একটা ই-বুক ভার্সন এখানে দিস।
অনেক অনেক শুভকামনা। বইটি কিনব এবং পড়ব। 🙂
ধন্যবাদ রায়হান তোমাকেও!
আন্দালিবরে একটা :salute: দেই
সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!
অসাধারণ!
আন্দালিব,
আবারো বলি, তোমার লেখার যেইটুকু বুঝি, তাতেই পুরা পাংখা...পুরাটা বুঝলে জানি কি হইতো :hatsoff:
"আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস"
অনীক আন্দালিব, জোনাকরোড - এ আপনার লেখা প্রকাশিত হওয়ায় আপনাকে অভিনন্দন।
লিটল ম্যাগাজিন বা ছোটকাগজকে আপনি মূলধারা বলছেন কি করে?! এইটা তো বরং "মূলধারার" বাইরের প্রবহমান ধারা। আসলে মূলধারায় যা করা দুষ্কর বা যা কখনো করা যায় না, সেটাই লিটল ম্যাগাররা করার চেষ্টা করে থাকেন, বা করে দেখান।
এইখানে আপনি "মূলধারা" শব্দটি দিয়ে সম্ভবতঃ বোঝাতে চেয়েছেন 'ভার্চুয়াল মাধ্যমের' বাইরে যে গোটা "মুদ্রণ-মাধ্যম" রয়েছে, তার কথা। এটুকু ঠাহরবিদ্যা প্রয়োগে বুঝে নেবার চেষ্টা করছি।
সেযাক, লেখালিখি জারি থাকুক।
আন্দালীব ভাই, আপনি এই ব্লগে এসে আমার লেখা পড়ছেন বলে খুব খুশি হলাম!
জোনাকরোড- এ লেখা ছাপা হওয়াটা সম্ভবত আমার জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ তিন-চারটা ঘটনার মধ্যে একটা। এবং লিটলম্যাগের গুরুত্বকে আমার কাছে মূলধারার চাইতে বেশি বলে মনে হয়। আপনি যে পার্থক্যটা বের করেছেন, সেটা আমি খেয়াল করে বলিনি। আমার কাছে ভার্চুয়ালের বাইরের মাধ্যমকেই মূলধারা মনে হয়েছে।
আর প্রথাগত 'মূলধারা'র ব্যাপারে আমার opinion তো আপনি জানেন-ই!
ভাল থাকবেন বস!