যোগাযোগ

জানালার কাচের ওপর আমি ডান হাত রেখে বসে আছি। আমার পাশে একটা কালো কাচ। কাচের তাপমাত্রা খুব কম। হাতের আঙুলে ঠাণ্ডা লাগছে। বাইরে শিশির পড়ছে। কে বলেছিলো কাচ আসলে তাপ কুপরিবাহী? তাহলে আমার শীত লাগছে কেন! আমি হাত সরিয়ে নেয়ার কথা ভাবলেও সরাই না। আঙুলের ডগা কেমন অবশ হয়ে আসতে থাকে। হঠাৎ কী হলো, আরেকটা হাত এসে কালো কাচটার ওপাশে ঠিক আবার হাতের মধ্যে এসে পড়লো। আগেই বলেছি, কাচটা একেবারে কুচকুচে কালো, তাই আমি ঠিক মতো দেখতেও পারছি না ওপাশে কে আছে। খালি অন্ধকারের মাঝ থেকে একটা সাদা হাত দেখা যাচ্ছে। সেটার আঙুলের সাথে আমার আঙুলগুলো জড়িয়ে যাচ্ছে। আমার মনে হলো আমার হাতে আবার সাড় ফিরে আসছে।

আমি পিয়ানোর রীডে বাজনার মতো আঙুলগুলো নাড়ালাম। টুং টাং। কোনো শব্দ নেই তবুও আমার মনে হলো কিছু একটা সুর বেজে উঠলো, কোনো টান টান তারে স্পন্দন জাগলো, চকিতে উপ্ত হলো কোনো আলতো উচ্চারণ। শব্দ এক প্রকার শক্তি যা বায়ু, তরল ও কঠিন মাধ্যমের সাহায্যে চলাচল করে। কাচ এবং আমার আঙুলের মাঝে তেমন কোনো সম্পর্কই ছিলো না একটু আগে। ওপাশে হাতের পরশ এসে দাঁড়ালো আর সুরগুলো, কথাগুলো সশব্দ হয়ে উঠলো। আমার টুং টাং দেখেই কি না জানি না, ওপাশের আঙুলগুলোও নড়ে উঠলো। খুব অল্প সময়ের জন্যে। নাকি আমি ভুল দেখছি? টিং টি টি টুং! টিং টি টি টুং! জগতে কতো আশ্চর্য ঘটনাই না ঘটে! এই যে আমি একা একা বসে ছিলাম, আমি আর আমার হাত, আর একটা শান্ত শীতল কাচ। আর কেউ ছিলো না, এখনও তেমন কেউ নেই। তবু একটা নাম-পরিচয়হীন হাত এসে আমার সাথে মিশে গেছে। এখন কেমন অপার্থিব শ্রবণ-মধুর সুর বেজে উঠছে। মনোটোনাস একাকিত্বের মাঝে সিঙ্গেল টোন…!

একটু অপেক্ষা করে আমি হাতের ভাঁজ মুঠো করলাম। তেলোর অংশ তখনও কাচের ওপরে লেগে আছে। ওপাশের হাতটি মনে হয় একটু বিভ্রান্ত হলো, একটু ভেবে-চিন্তে তার দুটো আঙুল ভাঁজ হয়ে এলো। অনামিকা আর কনিষ্ঠা। বাকি তিনটে আঙুল একা একা নড়তেই লাগলো, দুলে দুলে। আমার ভালো লাগছিলো হাতটির এমন খুশি খুশি নাচ দেখে। ওভাবে কাচের ওপরে ঝুলে থেকে এমন নাচ আমি আগে দেখিই নাই কখনও! সে’ও হয়তো একটু ক্লান্ত হয়ে পড়ছে, দেখলাম কব্জির নিচে সবুজ রগ দুটো ফুলে ফুলে উঠছে কেমন অশান্ত ঘোড়ার মতো। সাদা ধবল বকের মতো হাত, তার মাঝে সবুজ ঘাসের মতো দুটো রগের আভাস। ওপরে লালচে তালু আর চিকন তিনটে আঙুল নাচছে তাথৈ। আমার যেনো হঠাৎ করেই অনেক ভালো লাগতে থাকলো। মন ফুরফুরে হয়ে হালকা পালক হয়ে গেলো। সেই একলা ঘরের ভেতরে প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াতে লাগলো। আমি খুশিতে মুঠো খুলে সেই তিনটা আঙুলকে ধরতে চাইলাম, ছুঁতে চাইলাম। কাচের কালো রঙ হুমকি দিলো, খবরদার! ওকে স্পর্শ করার কোনো অধিকার তোমার নেই!

আমার কী যে হলো হঠাৎ, একা একটা ঘরে অনেক সময় থাকার কুফল মনে হয়, আমি খুব ক্ষেপে উঠলাম। রেগে গেলাম হুট করেই। তারপরে খুব জোরে কাচের গায়ে আঘাত করলাম। একটা ধপ করে শব্দ হলো বিদঘুটে। কিছুই বদলালো না। ওপাশের তিনটা আঙুল এখন বেঁকে মুচড়ে যাচ্ছে। কাচের কালো রং সেই আলতা লাল আঙুলের মাঝের দাগে ছড়িয়ে পড়ছে। ধীরে ধীরে তাকে গ্রাস করে নিচ্ছে! আমার বিপন্ন লাগছে আমার মাঝে দানা দানা ক্ষোভ জমা হচ্ছে। আমি আরো জোরে কাচের ওপর মুঠো দিয়ে মারলাম। আরো একবার। আরো একবার। আমার হাড়ের ভেতরে ব্যথার মাশরুম ফুটে উঠছে হলুদ হলুদ। আমার জেদ চেপে গেলো। ওপাশের আঙুলদের ছুঁতে না পারার অক্ষমতায় আমি কেমন যেন অপ্রকৃতস্থ হয়ে উঠলাম। নিঃশ্বাস বন্ধ করে আমি শেষবারের মতোন একটা ঘুষি দিলাম।

মনে হলো আমি আবারও হঠাৎ করেই হালকা হয়ে গেছি। নিজের হাতটাকে বেলুনের মতো নির্ভার মনে হলো। দেখলাম খুব স্লো-মোশন ম্যুভির মতো কাচের টুকরোর ফাঁক দিয়ে হাতের মুঠিটা বেরিয়ে গেলো। কব্জি আর চামড়ার ভেতরে কয়েকটা রাগী কাচের টুকরো ঢুকে গেলো, আর গলগল করে গরম রক্ত বেরিয়ে এলো। আমার কনুই আর পায়ের ওপরে স্রোতের মতো লাল নদী বইতে লাগলো। আমি কোনো ব্যথা অনুভব করছি না। কারণ দেখতে পাচ্ছি ভাঙা টুকরোর ওপাশে আমার লাল হলুদ আঙুলের সাথে কতোগুলো উষ্ণ আঙুল জড়িয়ে আছে। অপরিচিত সেই হাতটিকে সামনে টেনে নিতেই আমি যে মুখটি দেখি, সেখানে অনেক অনেক পুরোনো স্মৃতির ভোর আর দুরন্ত রোদ আমার দিকে খলখল করে হেসে দিচ্ছে।

****

২০.২.১০

****

১,৯০৭ বার দেখা হয়েছে

৩৩ টি মন্তব্য : “যোগাযোগ”

  1. ফয়েজ (৮৭-৯৩)
    খালি অন্ধকারের মাঝ থেকে একটা সাদা হাত দেখা যাচ্ছে

    খালি শব্দটা কট করে লাগছে, অন্য কিছু কি ব্যবহার করা যায়, এই যেমন "শুধু" বা অন্যকিছু, বা "আবছা" এইধরনের কিছু


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন
  2. আদনান (১৯৯৭-২০০৩)

    "তুই যে এক জটিল ধাঁধাঁ, অথই সাগর-জল,
    জানিস-ই তো অবুঝ আমি, সহজ করে বল;
    চাইনা আমি কথার তুড়ি, চাইনা আমি ছল,
    জানিস-ই তো অবুঝ আমি, সহজ করে বল।

    কথার ভেতর রাখিস কেন রহস্যের ভাজ?
    কোন পৃথিবী দেয় শিখিয়ে কথার কারুকাজ?
    চাইনা আমি কথার তুড়ি, চাইনা আমি ছল,
    জানিস-ই তো অবুঝ আমি, সহজ করে বল।

    সহজ করে বলিস যদি, সহজ লাগে তোরে,
    না বুঝিলে মনের কথা, অনেক খানি পোড়ে।
    চাইনা আমি কথার তুড়ি, চাইনা আমি ছল,
    জানিস-ই তো অবুঝ আমি, সহজ করে বল।"

    --- বাপ্পা মজুমদার (এ্যলবাম - খেয়াল)

    জবাব দিন
    • আন্দালিব (৯৬-০২)

      এই গানটা মনে হয় রেডিওতে শুনেছি। সুন্দর গান।

      সহজ গল্প তো! একজন কাচের পাশে বসে আছে, হাত রেখে। দেখলো ওপাশে একটা হাত। সেটার সাথে কিছু খুনসুঁটি, কিছু হাস্য বিনিময়। তারপরে তার আকাঙ্ক্ষা আরো বাড়লে কাচ ভেঙে সেই হাতটা ধরার চেষ্টা করলো। সেজন্যে নিজের কিছু ক্ষয়ক্ষতি হলো বটে, তবু সাহস করে এই উদ্যোগ নিয়েছে বলে সেই অপরিচিত হাতটাই তার কাছে চলে এলো।

      এখন এর মাঝে অনেকগুলো মেসেজ দেয়া আছে। হয়তো আরো কয়েকবার পড়লে তোমার কাছেও সেগুলো ধরা পড়বে! 🙂

      জবাব দিন
  3. রকিব (০১-০৭)

    আপনার লেখা একটা বিশেষ কারণে হিংসে করি। তা হলো- উপমার ব্যবহারে আপনার পারদর্শীতা।
    কাঁচা পাঠকের একখানা প্রশ্ন-

    মনোটোনাস একাকিত্বের মাঝে সিঙ্গেল টোন…!

    এই দুটোর বাংলা করলেন না কেন?


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন
    • আন্দালিব (৯৬-০২)

      দূর্বলতায় হাত দিলে হে!

      আসলে এই লাইনটা লিখবো কি না, সেটা নিয়েই অনেকক্ষণ ভাবছিলাম। মনোটোন আর সিঙ্গেলটোন শব্দ দুটো এতো কাছাকাছি যে সেটা নিয়ে খেলা করার লোভ সামলাতে পারি নাই। আর এদের বাংলা করলে সেই মিলটুকু থাকে না বলেই ইংরেজি রাখলাম। 🙂

      জবাব দিন
  4. মিশেল (৯৪-০০)

    বরাবরের মতই এবারেরটাও দারুন। কিন্তু আমি ঠিক উপভোগ করতে পারলাম না। তবে দোষ তোমার না। তোমার লেখাগুলো খুব রিলাক্স মুডে পড়ি আমি। মাথায় এত টেনশন নিয়ে রিলাক্স হওয়া সম্ভব না। তবে দাগিয়ে রাখলাম। কিছুটা সময় পেলেই আবার পড়ব।

    অ. ট. বইমেলায় পরা বইগুলো নিয়ে একটা রিভিউ দেয়ার কথা ছিল। ভুলে যেও না কিন্তু।

    জবাব দিন
  5. রকিব বলে দিয়েছে তারপরও বলি; আপনার লেখা উপমার অসাধারন ব্যবহারে(যেমনঃ "সাদা ধবল বকের মতো হাত, তার মাঝে সবুজ ঘাসের মতো দুটো রগের আভাস" ) আমি বরাবরই ঈর্ষিত এবং আপনার লেখার একজন ভক্ত। খুব কঠিন কোন লেখা মনে হয় নি। মেসেজ একটা পেয়েছি, কিন্তু সেটা নিজের কাছে রাখাই শ্রেয় মনে করি। কারণ সবাই একই জিনিস বুঝবে একটা লেখা পড়ে এমন তো আর না।

    জবাব দিন
    • আন্দালিব (৯৬-০২)

      ঠিক। লেখার মেসেজ অন্তর্নিহিত থাকাই ভালো। যার যার মতো করে বুঝে নিবে।

      ধবল বক আর সবুজ ঘাস জীবনানন্দের খুব প্রিয় উপমা ছিলো। বারে বারে আসতো, অথচ বহুব্যবহারে জীর্ণ হতো না! ওনার মুনশিয়ানা এতোটাই। এখানে লেখার সময় তাঁর কথা মনে পড়ছিলো আর ভাবছিলাম একটু চৌকস মনের ভাব প্রকাশের জন্যে বড়ো লেখকদের দ্বারস্থ হতেই হয়! এজন্যেই তারা চিরজীবী।

      জবাব দিন
    • আন্দালিব (৯৬-০২)

      প্লট বলতে তেমন কিছু এই গল্পে আসলেও নাই আপু। আমি একটু চেষ্টা করছিলাম প্রথাগতভাবে আমরা যাকে গল্প বা প্লট বলি, সেই গল্পবিহীন কোনো লেখা যায় কী না।

      এর পেছনে একটা দর্শনও কাজ করছিলো, সেটা হলো অর্থহীনতা বা নিরর্থকতা। আমাদের যাপিত জীবনের সবচেয়ে ধ্রুব সত্য যেটা। এই "কোনো কিছু হয়ে না ওঠা"টা নিয়েই হয়তো বিস্তর লেখালেখি করা সম্ভব।

      জবাব দিন
  6. ইদানীং খুব একটা নিয়মিত আসতে পারিনা ব্লগে।আর যখন এ সময় পাই এসে আমার প্রিয় লেখকদের লেখায় আগে চোখ বুলাই।লাস্ট একটা সপ্তাহে মনে হচ্ছিল কি যেন একটা নেই,আজ আপনার লেখাটা পেয়েই সেই অভাব পূরণ হয়ে গেলো ।
    আমি খুবই আনাড়ি একজন পাঠক,পড়তে গিয়ে হয়তো অনেক কিছুই বুঝিনা,কিন্তু তবুও আপনার ব্লগ পড়তে এত্তো ভাল লাগে!!

    জবাব দিন
  7. আদনান (১৯৯৪-২০০০)

    নারে আন্দা এ লেখাটা আমার মন ভরাতে পারলো না । তোর লেখা দেখেই এমন মন্তব্য করলাম। নিজেই স্বীকার করলি কোন প্লট ছাড়া লিখেছিস তাই এ নিয়ে আর অনুযোগ করবোনা । লেখনী ভাল হলেও কি যে বলতে চাইলি স্পষ্ট হলো না । তোর লেখাটা আমি প্রথম পড়ি ঘুমাতে যাবার আগে, কি লিখবো বুঝছিলাম না । তাই মন্তব্য না করেই ঘুমিয়ে পড়তে যাচ্ছি, এমন সময় শুয়ে শুয়ে মনে হলো হাত দুটো আসলে আমি । এখনকার আমি অন্য কোন আমাকে দেখছে কিন্তু কাছে যেতে পারছে না । কিছু ফ্যাকচুয়াল ভুল আছে মনে হচ্ছে, কালো কাঁচের ভিতর দিয়ে তো সাদা হাত বাইরে থেকে বোঝার কথা না । এ যায়গাটা খটকা যাগায় । আর কাচ হবে নাকি কাঁচ ? এবার একটা ফিকশন লেখ যেখানে আমাদের চারপাশের মানুষ গুলো উঠে আসবে । তোর গল্পে আরো কলেবর নিয়ে একটা মেয়ে চরিত্র আসার কথা ছিল, তাড়াতাড়ি লিখে ফেল ।

    জবাব দিন
    • আন্দালিব (৯৬-০২)

      এরকম লেখা আগে লিখি নাই, চেষ্টা করি নাই বলে হয়তো এটা তেমন ভালো হয় নি। মেসেজটাও স্পষ্ট করতে পারি নাই। ধন্যবাদ আদনান ভাই, এর পরের বার লেখার সময়ে এটা মাথায় থাকবে। 🙂

      ভুল নিয়ে- কাচ বানানটাই ঠিক। যদিও চন্দ্রবিন্দু দেয়ার লোভ হয়, তবু এই শব্দে সেটা নাই। এরকম আরেকটা বানান আমাকে লোভী করে- সেটা হলো কাদা (Mud)। লিখতে গেলেই টুক করে একটা চন্দ্রবিন্দু দিতে ইচ্ছা করে।

      কালো কাচের ওপাশ থেকে সাদা হাত রাখলে একটু দেখা যায়ই। অন্তত হাতের তালু, আঙুলগুলো দেখা যায়।

      জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।