আগের পর্বগুলোঃ ১ ২ ৩ ৪ ৫ ৬ ৭ ৮
১৭।
জুন, জুলাই এবং আগস্ট, ১৯৭১।
প্রশিক্ষণের প্রথম মাসে আক্ষরিক অর্থেই ওদের চোখের জল এবং নাকের জল এক হয়ে গেল। এতটা শারীরিক পরিশ্রম করার অভিজ্ঞতা ওদের বেশিরভাগই ছিল না, ফলে স্বাভাবিকভাবেই অনেকে মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়ল। প্রায় দেখা যেত দুই একজন করে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাচ্ছে বা বমি করছে। অবশ্য প্রতিটি সপ্তাহ অতিক্রান্ত হবার সাথে সাথে ওদের স্টেমিনা বাড়তে থাকল। একমাস পর প্রায় সবাই শারীরিকভাবে যথেষ্ট ফিট হয়ে উঠল।
অন্যদের চেয়ে অনিকের তুলনামূলক একটু কম কষ্ট হল। নিয়মিত খেলাধুলা করার কারণে শরীর এমনিতেই ফিট ছিল, তাছাড়া শেষের দিকে সুনীলদা ওকে অতিরিক্ত চক্করে পাঠাতেন বলে ওর স্টেমিনাও বেড়ে গিয়েছিল। মনে মনে ও সুনীলদাকে অনেকবার ধন্যবাদ জানিয়েছে ঐ রকম উপকারী ‘শাস্তি’ দেবার জন্য।
ট্রেনিং এর পাশাপাশি ওরা সবাই-ই নিয়মিত দেশের খবর শুনত। বিশ্রাম বা অবসরের যেটুকু সময় পেত পুরোটাই কাটত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে অনুষ্ঠান শুনে। ২৫ মে রেডিওটি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করেছে। কলকাতার বালুগঞ্জের সার্কুলার রোডের ৫৭/৮ নং দোতলা বাড়িটিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি এবং অন্যান্য মন্ত্রীদের আবাস কক্ষের সাথের একটি কক্ষ থেকে রেডিওটির সম্প্রচার চলছে। জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ওরা জানতে পারল দেশে নাকি মেট্রিক এবং ইন্টার পরীক্ষা শুরু হয়েছে। যদিও পরীক্ষার্থীদের উপস্থিতি শূন্যের কোটায়, তবুও সরকার জোর করে প্রমাণ করতে চাইছে দেশের অবস্থা ‘স্বাভাবিক’ রয়েছে!
দেশের এই পরিস্থিতিতে বোর্ড পরীক্ষা নামক প্রহসন হওয়া নিয়ে ওদের ক্যাম্পে প্রায়ই হাসাহাসি করা হত। যারা কিছুটা বয়স্ক ছিলেন তারা মাঝে মাঝেই অনিক, রতনসহ যাদের এবার পরীক্ষা দেবার কথা ছিল তাদেরকে পড়তে বসতে বলত! বড় ভাইরা কপট রাগ দেখিয়ে বলতেন, ‘এসব যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা বাদ দিয়ে পড়তে বসতে পার না, তোমাদের তো বোর্ড এক্সাম চলছে!!’ এরপর ওরা সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ত!
ক্যাম্পে থেকেই বিভিন্ন উৎসের মাধ্যমে প্রতিদিনই ওরা যুদ্ধের খবরা-খবর পেতে থাকল। যেদিন মুক্তিবাহিনীর কোন সাফল্যের কথা শুনত সেদিন ক্যাম্পের সবারই মন প্রফুল্ল থাকত, ওদের প্রশিক্ষক বা ‘ওস্তাদ’ রাও মজা করতেন। অপরপক্ষে যেদিন খারাপ খবর পেত সেদিন সবাই মনমরা হয়ে থাকত, পারতপক্ষে কেউ কথাই বলত না। এমনিভাবে একের পর এক দিন কেটে যেতে লাগল, ওদের কঠোর অনুশীলনও চলতে লাগল। ইতোমধ্যে প্রশিক্ষণার্থীর সংখ্যা কমে ১০৩ জন হয়ে গেছে। কয়েক জনকে অসুস্থতাজনিত কারণে ক্যাম্প থেকে সরিয়ে অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত করা হয়েছে, বাকিরা কষ্ট সহ্য করতে না পেরে নিজেরাই নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছে।
এর মাঝে ওরা চমকপ্রদ একটি খবর পেল। জুন মাসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রী পরিষদের বৈঠকে যুদ্ধ পরিস্থিতির সার্বিক পর্যালোচনা করে সুষ্ঠু প্রশাসনিক ব্যবস্থার অধীন যুদ্ধ-অঞ্চল বা সেক্টর গঠনের সিদ্ধান্ত হয় এবং এই লক্ষ্যে জরুরী ভিত্তিতে সমন্বয় সভা আয়োজনের জন্য কর্নেল ওসমানীকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেয়া হয়।
এরপর ১০ থেকে ১৭ জুলাই কলকাতায় সেক্টর কমান্ডারদের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই সম্মেলনেই নির্ধারণ করা হয়, বাংলাদেশকে কয়টি সেক্টরে ভাগ করা হবে, কে কে সেক্টর কমান্ডার হবেন, কয়টি ব্রিগেড তৈরি হবে, কোনটার কমান্ডার কে হবেন। ১১ জুলাই মুজিবনগরে উচ্চপদস্থ ও সামরিক কর্মকর্তাদের বৈঠকে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধাঞ্চল ও যুদ্ধকৌশল সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সেখানে কর্নেল আতাউল গনি ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক নিয়োগ করা হয়। লেঃ কর্নেল আবদুর রব সেনা প্রধান ও গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ.কে. খন্দকার উপ প্রধান নিযুক্ত হন। এই সম্মেলনে বাংলাদেশের সমস্ত যুদ্ধাঞ্চলকে ১১ টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। প্রতিটি সেক্টরের নেতৃত্বে ছিলেন একজন সেক্টর কমান্ডার। ১০ম সেক্টরটি সর্বাধিনায়কের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়। এই সেক্টরের অধীনে ছিল নৌ কমান্ডো বাহিনী এবং সর্বাধিনায়কের বিশেষ বাহিনী।
সেক্টর এবং সেক্টর কমান্ডার ভাগ করে দেবার পর মুক্তিযুদ্ধ যেন নতুন গতি পেল। মুক্তিযোদ্ধারা আগের চেয়ে অনেক সুসংগঠিত এবং পরিকল্পিতভাবে পাক হানাদার বাহিনীর মোকাবেলা করা শুরু করল। দ্রুত এর সুফলও আসা শুরু করল। এর আগে মাঝে মাঝে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি হত এবং ‘সেইম সাইড’ হচ্ছিল, তা বন্ধ হল। সবচেয়ে বড় কথা, ধীরে হলেও দুই পক্ষের মধ্যে ব্যবধান কমে আসা শুরু হল। দেশের প্রায় সকল যুদ্ধে-ক্ষেত্রেই পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলার দামাল মুক্তিযোদ্ধাদের সমান তালে লড়াই চলতে থাকল। একই সাথে বাড়তে থাকলো উভয় শিবিরেই হতাহতের সংখ্যা।
মে মাস থেকে বাংলাদেশসহ পশ্চিমবঙ্গের বেশিরভাগ এলাকায় শুরু হওয়া বর্ষাকালের মৌসুমি জলীয় বাষ্পের প্রভাবে জুন মাসেও প্রচুর বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকল। এতে করে দেশের মুক্তিবাহিনীর কিছুটা উপকার হল, কেননা পাক সৈন্যরা এরকম বৃষ্টি এবং কাদার মধ্যে চলাচলে অভ্যস্ত ছিল না। খাল, বিল, নদী-নালা পানিতে ভরে যাওয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের চলাচল এবং লুকিয়ে থাকার সহজ উপায় তৈরি হল। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এসব পানি বেষ্টিত অঞ্চলে ঢোকার সাহস পেত না। তবে, বৃষ্টির ফলে অনিকদেরও কষ্ট বেড়ে গেল। একে তো ক্যাম্পে থাকার সমস্যা ছিল, তার উপর প্রবল বৃষ্টিতেও ওদের প্রশিক্ষণ বন্ধ থাকত না। মাঝে মাঝেই ওদের মনে হত সব ছেড়ে পালিয়ে চলে যেতে। কিন্তু দেশের কথা, দেশের মানুষের কথা স্মরণ করে সকল কষ্ট সহ্য করেই ওরা প্রশিক্ষণ গ্রহণ জারি রাখল।
তবে, এই ক্যাম্পে একটি দিক দিয়ে ওরা বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল- খাওয়ার কষ্ট তেমন ছিল না বললেই চলে। বিশেষ করে ঘোষপুরের তুলনায় বলতে গেলে ওরা রাজার হালেই ছিল। এখানে সকলের জন্য পর্যাপ্ত খাবার, বিশুদ্ধ পানি এবং মোটামুটি মানের বাথরুম-টয়লেট ছিল। ক্যাম্পের পাশে বড় বড় বেশ কয়েকটি জলাশয় থাকার কারণে ওরা নিয়মিত গোসলও করতে পারত। অবশ্য, এরপরেও ওদের প্রায় সবার-ই চেহারা দিন দিন রুক্ষ হয়ে উঠতে লাগল। দীর্ঘদিনের না কাটা চুল, মুখ ভর্তি দাড়ি, নোংরা জামা কাপড়ের কারণে ওদের প্রত্যেকের চোখে-মুখে গুণ্ডা টাইপ ভাব প্রকট হওয়া শুরু করল। অবশ্য এটাই তো স্বাভাবিক, এত কঠোর পরিশ্রমে কেউই অভ্যস্ত ছিল না। তাছাড়া, এই ঝঞ্ঝাটপূর্ণ পরিস্থিতিতে নিজের যত্ন নেবার সময় কোথায়?
অস্ত্রের প্রশিক্ষণ শুরু হবার পর দেখা গেল রতন যে কোন আগ্নেয়াস্ত্রেই দারুণ সাবলীল। সবাই ওর অনেক প্রশংসা করতে লাগল। ও নাকি আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যাপারে পুরোপুরি ‘ন্যাচারাল!’ অনিকের পারফরমেন্সও খারাপ হল না। তবে, ওর সবচেয়ে পছন্দ হল হাত বোমা এবং গ্রেনেড নিক্ষেপ। গ্রেনেডের ওজন ক্রিকেট বলের চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেশি, তবুও ওর হাতের মধ্যে দারুণ মানিয়ে গেল। ওর মতন নিখুঁত আর কেউই ছিল না। প্রায় ৭০/৮০ গজ থেকেও ও লক্ষ্যের কয়েক ইঞ্চির মধ্যে ছুঁড়তে পারত!
জুন মাসে আরেকটি খবর শুনে ওদের সকলের বিশেষ করে অনিকের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। শুনতে পেল টেস্ট খেলার জন্য পাকিস্তান দল ইংল্যান্ড সফরে গেছে। পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ চলছে, লাখ লাখ মানুষ ভিটে ছাড়া হয়ে পাশের দেশে শরণার্থী হয়ে আছে, প্রতিদিন শত শত মানুষ মারা যাচ্ছে- আর ওদিকে ক্রিকেট দল গেছে ইংল্যান্ড সফরে! এটা শুনে যে কোন মানুষেরই মেজাজ খারাপ হবার কথা। জানতে পারল প্রতিটি ভেন্যুতেই প্রবাসী বাঙ্গালিসহ অনেক মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানের বর্বর হামলার বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিবাদ জানিয়েছে। এছাড়া তারা বিশ্ববাসীর কাছে বাঙালিদের সাহায্য করার জন্যও অনুরোধ জানিয়েছেন।
অবশ্য, পাকিস্তান দল ৩ টেস্ট সিরিজ শেষ পর্যন্ত ১-০ ব্যবধানে হেরেছে শুনে অনিক বেশ খুশি হল। বার্মিংহাম এবং লর্ডসের খেলাদুটো ড্র হয়েছে এবং লিডস এ অনুষ্ঠিত হওয়া শেষ টেস্টে পাকিস্তান ২৫ রানে হেরেছে। ভাবতে অবাক লাগে এই দলকেই এক সময়ে গলা ফাটিয়ে সমর্থন জানাতো এবং মনে মনে একদিন এই দলে খেলার জন্য স্বপ্নও দেখত! ঠিক করে ফেলল যদি দেশ স্বাধীন করতে না পারে, কোনদিন আর ক্রিকেটই খেলবে না। যদি খেলে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্যই খেলবে!
এ সময় খেলাধুলা সংক্রান্ত আরেকটি খবর ওদের ভীষণ অনুপ্রাণিত করল। ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’ গঠন করার জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এই দলটি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত অর্জন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যার্থে অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ভারতের বিভিন্ন স্থানে প্রদর্শনী খেলায় অংশ নেবে। প্রথমদিকে কয়েকজনকে রাষ্ট্রপতি নজরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত চিঠিতে দল গঠনের কথা জানিয়ে মুজিবনগরে হাজির কথা বলা হয়েছে। এখন পর্যন্ত প্রতাপ শংকর হাজরা, সাইদুর রহমান প্যাটেল, শেখ আশরাফ আলী সহ কয়েকজন উপস্থিত হয়েছেন। এরপর কলকাতা কেন্দ্রিক রেডিও আকাশবাণী থেকে ঘোষণাও দেয়া হল বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থানরত ফুটবলারদের মুজিব নগরে রিপোর্ট করার জন্য। সম্ভবত জুলাইতেই দলটি প্রথম প্রদর্শনী ম্যাচ খেলার জন্য তৈরি হয়ে যাবে। অনিকের মনে কিছুটা আফসোস হল। ‘স্বাধীন বাংলা ক্রিকেট দল’ নামে একটি দল করলে কি দারুণ ব্যাপারই না হত। হয়ত ও নিজেও খেলার সুযোগ পেত!
যাই হোক, পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী জুলাই মাসের মাঝামাঝি ওদের চূড়ান্ত প্রশিক্ষণ শুরু হল। ততদিনে বাংলাদেশ সরকার থেকে ওদের ক্যাম্পে নির্দেশ এসেছে গেরিলা যুদ্ধের কৌশলের উপর জোর দিতে। কেননা, সরকারের অনেকেই আশংকা করছেন এই যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদী রূপ নিতে পারে। সম্মুখযুদ্ধে প্রচুর মুক্তিযোদ্ধা হতাহত হওয়ায় এবং অস্ত্রের অপ্রতুলতার কারণে গেরিলা যুদ্ধই ওদের জন্য আদর্শ-পন্থা হবে।
১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবসে স্থানীয় রাজনীতিবিদগণ এবং নেতৃবৃন্দ ওদের জন্য ভোজের ব্যবস্থা করলেন। ফলে, অনেকদিন পর ওরা ভাল-মন্দ খাওয়ার সুযোগ পেল। সেদিন অনিকের চিত্তের কথা খুব মনে পড়ছিল, কেননা ও খেতে খুব পছন্দ করে। এই ক্যাম্পে আসার পর চিত্ত এবং সাব্বিরের ওরা আর কোন খোঁজ নিতে পারেনি। ওরা কোথায় আছে, কেমন আছে- কিছুই জানার উপায় নেই। তবে অনিক এবং রতন দুজনেই মনে মনে আশা করতে থাকল- ওরা যেখানেই থাকুক, ভাল থাকুক।
————-
দেখতে দেখতে ওদের ট্রেনিং শেষ হয়ে এলো। এতদিন ধরে যেসব ওস্তাদ ওদের সাথে নির্মম আচরণ করেছেন, অমানুষিক পরিশ্রম করিয়ে নিয়েছেন, তাদের আচরণও অনেক নরম হয়ে আসতে লাগল। এতদিনের বলা কড়া কথার বদলে ওদেরকে শোনাতে লাগলেন নানা রকম অনুপ্রেরণা মূলক কথা এবং পরামর্শ। এর মধ্যে ওরা শুনতে পেল শেষ দিনে ওদের সাথে দেখা করতে সরকারের উচ্চপদস্থ মন্ত্রীগণ আসতে পারেন। অবশ্য ওদের প্রশিক্ষণের মাঝেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ সফর করে গেছেন। এই তো সেদিনও একাধিক সেক্টর কমান্ডার আসলেন। ওদের ভাল-মন্দ জিজ্ঞাসা করেছেন, কোন সমস্যা আছে কি না -জানতে চেয়েছেন। গত মাসে এসেছিলেন বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী জনাব এম মনসুর আলী। ওদের সকলের সাথে কথা বলেছেন, হাত মিলিয়েছেন। তাঁর সাথে কথা বলে ওরা সবাই দারুণ উজ্জীবিত বোধ করেছিল।
২ সেপ্টেম্বর ছিল ক্যাম্পে ওদের শেষ দিন। আগের দিন ওদের প্রশিক্ষণ আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়েছে। আবহাওয়া খারাপ থাকার কারণে শেষ পর্যন্ত সরকারের কোন প্রতিনিধি আসতে না পারলেও ক্যাম্প কমান্ডার এবং অন্যান্য প্রশিক্ষকবৃন্দ ওদের উদ্দেশ্যে দারুণ অনুপ্রেরণামুলক কথা বললেন। সবশেষে জানালেন ওদের সাথে কাজ করতে পেরে তারা সবাই অনেক গর্বিত। তারা বিশ্বাস করেন ক্যাম্পের প্রত্যেকেই একেকজন দারুণ যোদ্ধা প্রমাণিত হবে এবং দেশের নাম উজ্জ্বল করবে।
অনিক, রতন সহ ওদের ক্যাম্পের প্রায় অর্ধেক সদস্যকে ৮ নং সেক্টরে বরাদ্দ করা হয়েছে। এই সেক্টরের কমান্ডার প্রথমে মেজর আবু ওসমান চৌধুরী ছিলেন। ১৪ আগস্টের পর থেকে কমান্ডারের দায়িত্বে আছেন মেজর এম এ মঞ্জুর। ৮ নং সেক্টরের মোট ৭ টি সাব সেক্টর রয়েছে-অনিক এবং রতনের জায়গা হল লালবাজার (অনেকে বেতাইলাল বাজারও বলে থাকে) সাব সেক্টরে। ওদের প্রধানের নাম ক্যাপ্টেন এ আর আজম চৌধুরী।
ঐ দিন দুপুরেই ওরা যার যার বরাদ্দের অস্ত্র, গোলাবারুদ এবং টাকাপয়সা নিয়ে ওরা মেহেরপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হল। ৪ দিনের মধ্যে ওদেরকে যার যার সাব-সেক্টর কমান্ডারের কাছে রিপোর্ট করতে বলা হয়েছে। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও অত্যন্ত ব্যস্ততার কারণে ওরা রতনের পিসির বাসায় যেতে পারল না। ফলে চিত্ত এবং সাব্বিরের খবর নেয়াও সম্ভব হল না।
৫ সেপ্টেম্বর ওরা বর্ডার পেরিয়ে মেহেরপুর এলাকায় ঢুকে পড়ল।
১৮।
সেপ্টেম্বর, ১৯৭১।
অনিকদের সাব সেক্টর প্রধান ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরীর বাড়ি রাজশাহী। ভদ্রলোক বেশ স্মার্ট এবং সুদর্শন। চেহারায় আভিজাত্যের ছাপ রয়েছে, দেখেই বোঝা যায় বনেদি বংশের ছেলে। একটি ব্যাপার লক্ষ্য করে ওরা বেশ অবাক হয়ে গেল-স্যার অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলেন, কোন প্রকার সমস্যা ছাড়াই। কিন্তু বাংলা বলার সময় কথা কিছুটা জড়িয়ে যায়! আজব ব্যাপার!
ক্যাপ্টেন আজম নবাগতদের প্রাথমিকভাবে শুধু টহলের কাজে নিয়োজিত করলেন। ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে ওরা লালবাজারের আশপাশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোয় পাহারা দেয়া শুরু করল। প্রহরার কাজগুলো সাধারণত রাতের বেলাতেই হত। ওদের উপর কড়া নির্দেশ ছিল সন্দেহজনক কিছু দেখলে সরাসরি ক্যাম্পে রিপোর্ট করার জন্য, কেউ যেন কোন প্রকার ‘কনট্যাক্ট’ না করে অর্থাৎ আগ বাড়িয়ে ওদের ওদের সাথে লড়াই না করে। যাই হোক, রাতগুলো টহল দিলেও দিনের বেলা সময় কাটত যুদ্ধের নানা কলা-কৌশল, পরিকল্পনা এবং স্বাধীন বাংলা বেতারের অনুষ্ঠান শুনে।
মেহেরপুর আসার পর প্রথম সপ্তাহেই অনিক নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেল। একদিন রাতে ওরা চারজন মেহেরপুর-কুষ্টিয়া মহাসড়কে টহল দিচ্ছিল। ওদের দলনেতা আব্দুল মতিন পাটোয়ারী, তিনি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সুবেদার ছিলেন। রাত ১১ টার দিকে ওরা এক সাথে হাঁটছে এমন সময় দূর থেকে ‘হল্ট’ নির্দেশ ভেসে এলো। চারজনেই চমকে উঠলো! ওরা বুঝতে পারল পাকিস্তানী সেনাদের সামনে পড়েছে, কেননা এভাবে ভারী গলার নির্দেশ ওরাই দেয়। আব্দুল মতিন সাহেবের কাছে এল এম জি ছিল, তিনি ঘুরেই গুলি করার চেষ্টা করলেন। তবে জ্যাম হয়ে যাবার কারণে কোন গুলি বের হল না। এতে ওরা প্রাণে বেঁচে গেল, কেননা ঠিক সেই মুহূর্তে ওরা দেখতে পেল দুই দিক থেকে দুটো দল এগিয়ে আসছে। ঘুটঘুটে অন্ধকার হবার কারণে ওদেরকে পাকি সৈন্যরা খুঁজে পেল না, কেননা ততক্ষণে ওরা মূল রাস্তা থেকে নেমে ঝোপ-ঝাড়ের মধ্য দিয়ে নিরাপদ স্থানে সরে গেছে। ঐ সময়ে যদি মতিন সাহেবের এল এম জি থেকে গুলি বের হত তাহলে কয়েকজন পাকিস্তানী সৈন্য হয়ত মারা যেত ঠিকই, ওরাও নিশ্চিতভাবে মারা যেত। দুই দিক গুলি করলে ওরা কোন মতেই বেঁচে ফিরতে পারত না।
ক্যাপ্টেন আজম এই ঘটনা জানতে পেরে পাহারায় লোকবলের সংখ্যা আরও বাড়িয়ে দিলেন। কয়েকদিনের মধ্যে পাকিস্তান বাহিনী ওদের মুখোমুখি ঘাঁটি তৈরি করল। ওদেরকে প্রতিহত করার জন্য নদীর অপর পাড়ে ক্যাপ্টেন আজমের নেতৃত্বে ওরাও অবস্থান নিলো। অনিকের মত যারা প্রথমবারের মতন যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুর মোকাবেলা করছে, তারা ভীষণ উত্তেজিত হয়ে রইল। শরীরের মধ্যে অ্যাড্রেনালিন যেন ঝড়ের বেগে শিরা-উপশিরায় ছুটে চলেছে। প্রত্যেকের হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল। মনে হচ্ছে ওটা বুকের বাইরে লাফিয়ে বের হয়ে আসবে!
দুই পক্ষের মধ্যে এখন শুধু ভৈরব নদী। দ্রুত ভারি মেশিনগান এবং মর্টার বসিয়ে ওরা প্রস্তুত হয়ে গেল। বোঝাই যাচ্ছে যে কোন সময় আক্রমণ শুরু করবে। পরদিন ভোরবেলা থেকে ওরা মর্টার থেকে গোলা নিক্ষেপ শুরু করল। প্রথমে গোলাগুলো বিক্ষিপ্তভাবে এদিক-ওদিক পড়লেও ধীরে ধীরে ওদের খুব কাছে পড়া শুরু হল। ফলে ভয় পেয়ে ওরা কিছুটা পিছিয়ে আসতে গেল।
এটা দেখে ক্যাপ্টেন আজম রেগে আগুন হয়ে গেলেন। তিনি কিছুটা পেছনে ছিলেন, চিৎকার করে উঠলেন। কথাগুলো বাংলায় বলার কারণে কিছুটা জড়িয়ে গেল,
-যে পি পি পিছিয়ে আসবে, তাকে ন ন নদীতে ছুঁড়ে মারব!!!
ওরা প্রায় ৬০ জন পড়ল উভয় সংকটে। সামনে পাক বাহিনীর মর্টার, পেছনে ক্যাপ্টেন আজম। কোনদিকে যাবে? অবশেষে সামনে এগোতে থাকল। কেননা পাকিস্তানীদের মর্টার থেকে ওরা হয়ত বেঁচে যাবে, কিন্তু পিছিয়ে গেলে আজম চৌধুরীর হাত থেকে বাঁচার কোন উপায় থাকবে না। সত্যিই হয়ত নদীতে ছুঁড়ে মারবেন! যাই হোক, ওরা সামনে এগিয়ে নদীর পাড়ে থাকা বিশাল আমগাছ গুলোর পেছনে অবস্থান নিলো। ততক্ষণে মুক্তিবাহিনীর মর্টারগুলোও নদীর পাড়ে নিয়ে আসা হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যে ওরাও গোলা নিক্ষেপ করা শুরু করল। প্রথম ১০ মিনিটের মধ্যেই মুক্তিযোদ্ধারা ওদের একটি মেশিনগান ধ্বংস করতে সক্ষম হল। এবার পাকিস্তানীরা পিছিয়ে যাওয়া শুরু করল। এটা দেখে ওদের মনোবল বেড়ে গেল। আক্রমণের ধার ওরা আরও বাড়িয়ে দিল।
এমন সময়ে হঠাৎ করে একটি গোলা অনিক এবং তার কিছু সঙ্গী যে গাছের নিচে অবস্থান নিয়েছিল তার একেবারে মগডালে এসে বিকট শব্দ করে আঘাত করল। আম গাছের বিশাল কয়েকটি ডাল ওদের গায়ের উপর ভেঙ্গে পড়ল। কিছু স্প্লিন্টারও ওদের গায়ে বিঁধল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে একটি ডাল এসে সরাসরি অনিকের মাথায় আঘাত করলো। সাথে সাথেই ও অজ্ঞান হয়ে গেল।
প্রায় চার ঘণ্টা পর অনিকের জ্ঞান ফিরল। জ্ঞান ফেরার পরে নিজেকে ক্যাম্পে আবিষ্কার করল ও। পুরনো একটি স্কুল ভবনকে ওরা ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করছে। এর মধ্যে একটি রুমকে বানানো হয়েছে অস্থায়ী ‘হাসপাতাল’! এই রুমে মোট চারটি বেড রয়েছে, এই মুহূর্তে ওরটি বাদে বাকি সবগুলোই খালি রয়েছে। প্রথমে ধাতস্থ হতে সময় লাগল, চট করে মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করার পর সব কিছু মনে পড়ল। মাথায় হাত গিয়ে দেখল ব্যান্ডেজ লাগানো রয়েছে। এমন সময়ে হুড়মুড় করে রতন ঘরে ঢুকল।
-কিরে চ্যাম্প, কেমন আছিস?
-মনে হয় ভালই…তবে মাথায় ভীষণ ব্যথা করছে!
-আজব ব্যাপার। গুলি, শেলে কিছু হল না-আর তুই কিনা গাছের বাড়ি খেয়ে ধরাশায়ী হয়ে গেলি…
-যা ব্যাটা, ফাজলামি করিস না। তুই হলে ভর্তা হয়ে যেতি…
-আরে দূর…গুলি খেলেও আমার কিছু হবে না!
আরও বেশ কিছুক্ষণ ওরা গল্প-গুজব করল। রতন জানালো শেষ পর্যন্ত ওদেরকে পিছু হটতে হয়েছিল। আজম স্যার নিজেই ওদেরকে পিছিয়ে আসার নির্দেশ নিয়েছেন। অভিজ্ঞ লোক তিনি- ভাল করেই জানেন কখনো লড়তে হবে, কখন পিছিয়ে আসতে হবে।
আরও চারদিন ওকে পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হল। অনিকের কপাল ভাল যে মাথায় অভ্যন্তরীণ কোন ইনজুরি হয় নি। ফলে শুধু বিশ্রামেই ও সুস্থ হয়ে উঠল।
একদিন সকালে ওরা কয়েকজন ক্যাম্পে বসে গল্প করছে। আজম স্যার গাড়ি নিয়ে একটি ছোট গ্রুপ নিয়ে রাজাপুর গ্রামে পেট্রোলিং করতে গেছেন। ওদের মাঝে শান্ত নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বাড়ি পাবনা হলেও চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর এলাকা বেশ ভাল করে চেনেন। তিনি হঠাৎ বলে উঠলেন,
-এভাবে নদীর এপার থেকে ঢিলা-ঢিলি করে লাভ নেই। মজা হচ্ছে না। পাকি মারতে হলে আমাদের মাঠে নামতে হবে।
-কি করতে চাও তুমি? একজন বয়স্ক মুক্তিযোদ্ধা জানতে চাইলেন।
– গেরিলা একশনে যেতে হবে। ঝটপট আক্রমণ করে, চটপট সরে পড়তে হবে। ঢাকার ক্র্যাক প্লাটুন, টাঙ্গাইলের কাদের বাহিনী, ময়মনসিংহের আনসার বাহিনী, গোপালগঞ্জ এলাকায় হেমায়েত বাহিনী…এরা সবাই দারুণ কাজ করে চলেছে। আমরাও এরকম করতে পারি। আমরা এই এলাকাতেই নিজেদের বাহিনী গড়ে তুলতে পারি।
-কিভাবে করবে?
-আমি এই সপ্তাহেই আজম স্যারের সাথে কথা বলে বের হয়ে পড়ব। তোমরা যারা যেতে চাও আমাকে শুক্রবারের আগেই জানিয়ে দিও।
অনিক কি করবে ভেবে পেল না। ঠিক করলো রতন ফিরলে ওর সাথে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেবে। যারা পেট্রোলিং এ গিয়েছে তাদের মধ্যে রতনও আছে। আজকে রাতেই ওদের ফেরার কথা।
—————
রাতে ফেরার কথা থাকলেও ওদের ফিরতে ভোর হয়ে গেল। দুর্ভাগ্যের বিষয় ফেরার পথে ওরা পাকি সৈন্যদের অ্যামবুশের শিকার হয়েছে। দুই জন ঘটনাস্থলেই মারা গেছে এবং চারজন গুরুতর আহত। অনিক ঘুমিয়ে ছিল, খবর পেয়ে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে দেখল আহতদের মধ্যে রতনও একজন। ওর পেটে গুলি লেগেছে। জানতে পারল গুলি ওর পেট চিরে বেরিয়ে গেছে। সবাই ধরাধরি করে আহতদেরকে ‘হাসপাতাল’ এর বেডে শুইয়ে দিল। একজন পরীক্ষা করে জানালেন রতনের অবস্থা ভাল না, সম্ভবত ওর ক্ষুদ্রান্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, অপারেশন করতে হবে। দ্রুত হাসপাতালে না পাঠালে বাঁচার সম্ভাবনা ক্ষীণ। আজম স্যার দ্রত ওদেরকে বৈদ্যনাথতলায় পাঠাবার ব্যবস্থা করলেন। অবশ্য জায়গাটিকে এখন মুজিবনগরই বলা উচিত, কেননা ১৭ এপ্রিলে বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণের পর জায়গাটির নাম বদলে মুজিবনগর রাখা হয়েছে। ওখানে একটি মোটামুটি মানের হাসপাতাল তৈরি করা হয়েছে, অপারেশনেরও সু-ব্যবস্থা আছে।
আধা ঘণ্টার মধ্যে আহতদের মধ্যে তিনজনকে নিয়ে একটি গাড়ি রওনা হয়ে গেল। অনিক এক দৌড়ে ওর জিনিসপত্রের মধ্য থেকে ক্রিকেট বলটা বের করে এনে রতনের পকেটে ভরে দিল। এটা দেখে আজম স্যার কৌতূহলী হয়ে ওর দিকে তাকাতে ব্যাখ্যা করে বলল,
-স্যার, যুদ্ধের আগে থেকেই বলটি আমার কাছে আছে। ওটা আমাকে অনেক-বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করেছে। সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে রতনকে দিলাম। আশা করি ও সুস্থ হয়ে উঠবে!
আজম স্যার আর কিছু বললেন না। এদিকে আহত অন্যজনের চিকিৎসা এখানেই করার ব্যবস্থা হল। তার হাতে এবং পায়ে গুলি লেগেছে, তবে জীবন-নাশের আশঙ্কা নেই।
অনিক এই ঘটনায় বেশ ধাক্কা খেল। বারবার রতনের মুখটা ওর চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকল। সাথে সাথে ঠিক করে ফেলল শান্ত ভাই এর গেরিলা বাহিনীতে যোগ দেবে। এই প্রথম অনিক কোন সহযোদ্ধাকে হারাল এবং আরেকটু হলেই হারাতে বসেছিল ছোট বেলার বন্ধুকে। অবশ্য, রতন এখনো আশংকামুক্ত নয়। কত দ্রুত ওর অপারেশন হবে এবং তা কতটুকু সফল হবে, তার উপর ওর জীবন নির্ভর করছে। মনে মনে সৃষ্টিকর্তার কাছে রতনের জন্য প্রার্থনা করতে থাকল।
যে দুইজন মারা গেছেন তারা উভয়ই মুসলমান ছিলেন। তাদেরকে মুসলিম রীতি অনুযায়ী জানাজা পড়িয়ে স্থানীয় এক কবরস্থানে দাফন করা হল।
ঐ দিন রাতেই বেশ কয়েক দুঃসাহসিক মুক্তিযোদ্ধা সাঁতরে ভৈরব নদীর ওপারে গিয়ে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে আক্রমণ করেন। ঘুমন্ত পাকিদের বাঙ্কারে গ্রেনেড মেরে এবং এক নাগারে গুলিবর্ষণ করে তারা বেশ কয়েকজনকে হত্যা করেন। গুলিতে ওদের যন্ত্রপাতি, অস্ত্র গোলাবারুদেরও বেশ ক্ষতি হয়। আকস্মিক আক্রমণের ফলে ওরা দিশেহারা হয়ে ছোটাছুটি শুরু করে দিয়েছিল। পরে সংঘবদ্ধ হয়ে পালটা আক্রমণ করার আগেই মুক্তিযোদ্ধারা সটকে পড়ে। পাক বাহিনীর অনেক ক্ষয়-ক্ষতি হলেও সৌভাগ্যক্রমে মুক্তিযোদ্ধাদের কেউই হতাহত হলেন না। ফলে এটাকে দারুণ সাফল্য বলা যায়। এর মাধ্যমে কিছুটা হলেও ওরা সহযোদ্ধা হারাবার প্রতিশোধ নিতে সক্ষম হল।
এই ঘটনার দুই দিন পর শান্ত ভাই ঠিকই আজম স্যারের সাথে কথা বলে গেরিলা অপারেশনের অনুমতি আদায় করে নিলেন। শেষ পর্যন্ত অনিক সহ ২১ জন শান্ত ভাই এর সাথে যোগ দিল। এক সপ্তাহের মাথায় বেশ কয়েকটি এল এম জি, চাইনিজ রাইফেল, প্রচুর পরিমাণে, গুলি, গ্রেনেড এবং ডিনামাইট নিয়ে ওরা লালবাজার ক্যাম্প থেকে গাংনীর দিকে যাত্রা শুরু করল। ওদের লক্ষ্য কুষ্টিয়ার দিকে এগিয়ে যাবে সেখানকার পাক বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। ওরা খবর পেয়েছে কুষ্টিয়া এলাকায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী প্রচুর হত্যাকাণ্ড এবং লুটতরাজ চালাচ্ছে।
শয়তানগুলোকে উচিত শিক্ষা দিতে হবে।