১৫।
দিলু মামার বাসা খুঁজে পেতে বেশি বেগ পেতে হল না।
বাবার নির্দেশমতো মহেশপুর বাস স্ট্যান্ডে নেমে কিছুটা হেঁটে ওরা শ্রীরামপুর বাজারে উপস্থিত হল। সেখানে এক বড় দোকানে জিজ্ঞাসা করতেই ওরা মামার বাসা দেখিয়ে দিল।
মামার বাসায় ওরা যখন উপস্থিত হল ততক্ষণে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। দরজায় কড়া নাড়তেই ভেতর থেকে একজন জিজ্ঞাসা করল,
-কে?
-আমি আশরাফ আহমেদের ছেলে অনিক। গোপালগঞ্জ থেকে এসেছি…
কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে মধ্যবয়সী লোক বের হলেন। অনিক কখনো দিলু মামাকে দেখে নি, তবে মামা ওকে দেখা মাত্রই চিনতে পারলেন। পরে জানিয়েছিলেন বাবার সাথে অনিকের চেহারার অনেক মিল আছে বলে তিনি চট করে ওকে চিনে ফেলেছিলেন।
-অনিক? তুই???
-জ্বি মামা। আমি। সাথে আমার কয়েকজন বন্ধু আছে।
মামা দ্রত ওদেরকে নিয়ে বাসার ভেতরে ঢুকলেন। ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে প্রথমেই অনিক মামার সাথে ওর বন্ধুদের পরিচয় করে দিল। এরপর ওদের আসার উদ্দেশ্য জানাল।
-তোরা অক্ষত অবস্থায় কিভাবে এত দূর পৌঁছতে পারলি তা আমি ভাবতেও পারছি না! শুনেছিলাম এই পথের অবস্থা বেশ খারাপ। তোদের কপাল অনেক ভাল বলতে হবে!
-কপাল তো ভাল ছিলই, আমরাও সাবধানে ছিলাম। তবে, কোটচাঁদপুরে আরেকটু হলেই ধরা পড়ে যাচ্ছিলাম। কিছু লোক আমাদের পিছু নিয়েছিল।
-হুম। পাকিরা আক্রমণ করার পর থেকেই এই এলাকায় ওদের অনেক চ্যালা বের হয়েছে। এদিকে আসা সব লোকদের নানাভাবে জ্বালিয়ে মারছে। অনেকের কাছ থেকেই টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নিচ্ছে, অনেককেই ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছে।
-তাহলে আমরা বর্ডার পার হব কিভাবে?
-আমি থাকতে তোদের কোন সমস্যা হবে না। অনেকদিন ধরেই আমি ‘এক্সপোর্ট-ইম্পোর্ট’ এর ব্যবসা করি তো, এলাকার সবাই আমাকে মোটামুটি ভাল করেই চেনে। তবুও কারও দৃষ্টি আকর্ষণ না করেই কাজ সারতে হবে। তোরা এক-দুই দিন বিশ্রাম কর, আমি একটা ব্যবস্থা করে ফেলব। মামা মুখে ‘এক্সপোর্ট-ইম্পোর্ট’ বললেও ওদের বুঝতে অসুবিধা হল না আসলে তিনি কি ধরনের ব্যবসা করেন। অবশ্য সীমান্তবর্তী এলাকায় এটা খুবই সাধারণ ঘটনা! ওরা কেউ কিছু মনে করল না।
ওদের কথার মধ্যে মামী উঁকি দিয়ে দেখলেন। অনিক দাঁড়িয়ে সালাম দিতেই বাকিরাও ওর দেখাদেখি উঠে দাঁড়ালো। এবার মামাই সবার সাথে এক এক করে পরিচয় দিলেন। এমন সময়ে মামার একমাত্র পিচ্চি ছেলেটাও হাজির হল। কথা বলে জানা গেল ওর নাম সজীব, ক্লাস টু তে পড়ে। খুবই দুষ্টু বাচ্চা। এরই মধ্যে অনিকের ব্যাগ ধরে টানাটানি শুরু করে দিল। ওকে থামাতে অনিক ব্যাগ থেকে ক্রিকেটের একটি ম্যাগাজিন বের করে ওর হাতে দিল। খুশিতে লাফাতে লাফাতে সজীব ম্যাগাজিন হাতে নিয়ে বাসার ভেতরে চলে গেল।
-তোমরা হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও। মামী বললেন। আমি কিছুক্ষণের মধ্যে চা-নাস্তা দিচ্ছি।
চিত্ত’র মুখে বিশাল হাসি দেখা গেল। যে কোন খাওয়া-দাওয়ার কথা শুনলেই ও খুশি হয়ে যায়। অবশ্য ওরই বা দোষ কি, ওদের সবারই কমবেশি ভীষণ ক্ষুধা লেগেছে। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ও সবার আগেই বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেল। এমন ভাব সবার আগে হাতমুখ ধুলে ওকে হয়ত বেশি নাস্তা দেয়া হবে! মুচকি হেসে অনিক মামার সাথে গল্প করা শুরু করল।
পরের তিনদিন ওরা মহেশপুরেই কাটালো।
প্রথম দিন ঘর থেকে বের না হলেও দ্বিতীয় দিন বিকেলে সবাই মিলে বাজারে চা খেতে বের হল। রতন এবং সাব্বিরের সিগারেটের বদভ্যাস আছে। বের হবার ব্যাপারে ওদের তাড়াই বেশি ছিল। মামা বাসায় ছিলেন না, ফলে মামীকে বলে ওরা ঘর থেকে বের হল।
ওরা যেখান চা খেতে বসল সেখানকার দোকানদার বেশ বয়স্ক, প্রচুর কথা বলেন। কথায় কথায় জানালেন এই এলাকার মানুষও পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে বেশ ভাল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। ২৬ শে মার্চের আগেই এখানে সবাই যে কোন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিল। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর এলাকার ডাক্তার নামে পরিচিত ডাঃ নিয়ামত আলীর নেতৃত্বে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়েছিল। ১৩ মার্চ আব্দুল মতিন নামের এক বাঙালি দারোগা সাথে আরও কিছু লোকজন নিয়ে মহেশপুর থানার অস্ত্রাগার ভেঙ্গে ২২ টি রাইফেল এবং প্রচুর পরিমাণে গুলি দখল করেন। পরে সেগুলো সংগ্রাম পরিষদের সদস্যদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। এই সব অস্ত্র দিয়েই তারা কিছুদিন আগে আসা পাক বাহিনীর মোকাবেলা করেছেন। অবশ্য সে প্রতিরোধ বেশিদিন টেকে নি। যাই হোক, মহেশপুরবাসীর জন্য সুখবর এই যে সীমান্তবর্তী এলাকা বলে পাকিস্তানীরা বেশিদিন এখানে অবস্থান করে নি। তবে ওদের অনেক অনুচর এখনো বেশ সক্রিয় আছে।
বাকিরা কেউ রাজি না হওয়ায় চা খাওয়ার পর অনিক একাই হাঁটার সিদ্ধান্ত নিলো। শরীর ফিট রাখার জন্য হাঁটা অনেক জরুরী, তাছাড়া এতে এলাকাটা সম্বন্ধেও ভাল ধারনা জন্মাবে। কে জানে পরে হয়ত কাজেও লেগে যেতে পারে।
বেশ কিছুদূর হাঁটার পর দু’জন মানুষ ওর কাছে এসে পরিচয় জানতে চাইল। দুজনের মুখেই ছাগলের মতন দাঁড়ি। নাম বলার সাথে সাথেই ওদের একজন অনিকের প্যান্টের পকেটের উপর হাত দিল। এবং প্রায় সাথে সাথেই চিৎকার করে উঠল,
-ইন্না লিল্লাহ! এর পকেটে তো বোমা!!
অনিক ভীষণ চমকে উঠল! বলে কি?? সাথে সাথে মনে পড়ল পকেটে অভ্যাসবশত ক্রিকেট বলটা রয়ে গেছে। এই বেকুবটা সেটাকে বোমা ভেবে ভুল করেছে।
ও কোন জবাব দেবার আগেই আশপাশ থেকে আরও দু’জন এসে ওর হাত চেপে ধরল। অনেক জোরাজুরি করেও ও হাত ছাড়াতে পারল না। ধস্তাধস্তির মাঝেই ও বলে উঠল,
-এটা বোমা না, ক্রিকেট বল!
ওর কথা কেউ বিশ্বাস করল না। সেই প্রথম ছাগল দাঁড়ি খুব সাবধানে পকেটে হাত দিয়ে বলটা বের করে আনল। চোখের সামনে নিয়ে ভাল করে দেখে নিশ্চিত হতে চাইল ওটা আসলে কি! একে একে বাকিরাও হাতে নিয়ে অবশেষে বুঝতে পারল অনিক সত্য কথাই বলেছে। ফলে, ওর হাত ছেড়ে দিল।
প্রথম ছাগল দাঁড়ি মনে হয় ওদের নেতা টাইপ কেউ। সে ঝাড়ি মেরে উঠল,
-এভাবে কেউ পকেটে ক্রিকেট বল নিয়ে বের হয়? তাও আবার এই গণ্ডগোলের মধ্যে?
-আমি নিয়মিত ক্রিকেট খেলি তো, বলটা সবসময় সাথে রাখার অভ্যাস হয়ে গেছে। মনের ভুলে পকেটে নিয়েই বের হয়েছি। আমি সত্যিই দুঃখিত! ভাল কথা, আমি দিলু খানের ভাগ্নে। কলেজে ক্লাস হচ্ছে না তো, তাই কয়েকদিন থাকার জন্য এখানে এসেছি।
-সেটা আগে বলবে তো! শুধু শুধু আমরা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম!
দিলু মামার নাম শুনে ওরা অনিককে আর ঘাটাল না। অনিকও দ্রুত ঐ জায়গা থেকে সরে গিয়ে শ্রীরামপুর বাজারের দিকে ফিরে গেল। কেউ কিছু না বললেও ও বুঝতে পেরেছে ঐ ছাগল দাঁড়ি পার্টি পাকিস্তানীদের চর ছাড়া আর কিছুই নয়। জলদি বাকিদের খুঁজে নিয়ে ওরা বাসায় ফিরে গেল।
রাতের বেলা মামা এই ঘটনা জানতে পেরে কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়লেন,
-ওটা সম্ভবত ইদ্রিস ছিল। কালীগঞ্জ ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতা। পাকিস্তানীদের সাথে হাত মিলিয়ে মহেশপুরে স্বেচ্ছাসেবক দল বানিয়েছে। ওদের লক্ষ্য যে কোন মূল্যে পাকিস্তানকে রক্ষা করা। শালারা সব ক’টা একেকটি বেঈমান! মুখে ধর্মের নাম বলে, অথচ ঠিকই সব ধরনের অনৈসলামিক কাজ করে! কথাগুলো বলতে বলতে মামার মুখ রাগে লাল হয়ে গেল।
কিছুক্ষণ পর কিছুটা সামলে নিয়ে মামা আবার মুখ খুললেন,
-ওদের সামনে আর যাওয়ার দরকার নেই। আমার আত্মীয় শুনে কিছু করার সাহস না পেলেও পরে ঝামেলা করতে পারে। সত্যি কথা বলতে কি, তোদের আপাতত ঘর থেকেই বের হবার দরকার নেই। কিছু লাগলে আমাকে বলবি।
-ঠিক আছে, মামা। অনিক জানাল।
-ভাল কথা, তোদের যাবার ব্যাপারে একটি বন্দোবস্ত করে ফেলেছি। মদনপুর থেকে নদী পথে করে হোগলডাঙা গ্রাম হয়ে তোরা সীমান্ত পার হতে পারবি। এপার-ওপার দুইখানেই আমি কথা বলে রেখেছি। অন্য কারও সাথে কোন কথা বলার দরকার নেই। কেউ আগ বাড়িয়ে কথা বলতে গেলেও পাত্তা দিবি না। আমার এক লোক তোদেরকে বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত নিয়ে যাবে। ওখান থেকে সরাসরি বাসে করে সহজেই ঘোষপুর চলে যেতে পারবি।
-আমরা কবে রওনা হতে পারব?
-যে ছেলেটা নৌকা চালিয়ে নিয়ে যাবে ও আগামীকাল এখানে আসবে। তোরা পরশু ভোরে রওনা হতে পারবি।
-খুব ভাল খবর! মামার কথা শুনে অনিক খুশি হয়ে গেল। এভাবে অনিশ্চিত পথ চলা আর সহ্য হচ্ছে না। মনে এখন একটাই চিন্তা-কবে ইয়থ ক্যাম্পে পৌঁছবে!
দুইদিন পর ভোর বেলা ওরা নৌকায় করে রওনা হল। এর মাঝে একটি খারাপ ঘটনা ঘটল। একেবারে শেষ মুহূর্তে আকাশ-পাতাল জ্বর এবং বমির কারণে সুব্রত ওদের সাথে আসতে পারল না। মামা কথা দিয়েছেন ও একটু সুস্থ হলেই ঘোষপুর ইয়থ ক্যাম্পে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করবেন। সেটা সম্ভব না হলে ওকে নিজ দায়িত্বে গোপালগঞ্জে পাঠিয়ে দেবেন।
দিলু মামা মদনপুর নদীর ঘাট পর্যন্ত ওদের এগিয়ে দিলেন। নৌকার মাঝি আকরামকে আরেকবার সব বুঝিয়ে দিয়ে ওদের বিদায় দিলেন। বিদায় নেবার আগে অনিককে আশ্বাস দিলেন তিনি যেভাবেই হোক ওদের বাসায় নিরাপদে ভারতে পৌঁছানোর খবরটি জানিয়ে দেবেন। নৌকায় উঠে ওরা চারজন ছই এর ভেতরে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ল। এভাবে ওরা ঘুমাতেও পারবে, আবার অন্যদের নজর থেকেও দূরে থাকবে।
দুপুরের আগেই ওরা ভারত সীমান্তের একেবারে কাছে হোগলডাঙা গ্রামে পৌঁছল। নৌকা থেকে নেমে মামার লোককে খুঁজে পেতে সময় লাগল না। তিনি সাথে থাকার কারণে কোন সমস্যা ছাড়াই ওরা ভারতের মধ্যে প্রবেশ করতে পারল। সীমান্ত পার হবার পর বিভিন্ন অলি-গলি দিয়ে ওরা আরও প্রায় বিশ মিনিট হেঁটে চলল। দেখতে পেল ওদের সাথে আরও অনেক মানুষ ভারতে আশ্রয় নেবার জন্য লাইন ধরে এগোচ্ছে। খানিকক্ষণ পর ওরা একটি খালি টেম্পু পেল। সেটাতে করে বনগাঁও বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত গেল। সেখান থেকে মামার সেই লোকটি ওদেরকে ঘোষপুরের বাস দেখিয়ে দিয়ে বিদায় নিলো।
টিকিট কাউন্টার থেকে চারটি টিকিট কেটে সবাই মিলে দ্রুত বাসে উঠে যার যার সিটে গিয়ে বসল। অবশেষে ওরা সত্যিই গন্তব্যের খুব কাছে চলে এসেছে! অনিক এবং রতন একে অন্যের দিকে তাকিয়ে স্বস্তির হাসি দিল। কিছুক্ষণের মধ্যে চারজনই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।
১৬।
ঘোষপুর ইয়থ ক্যাম্পে ওদেরকে দুই সপ্তাহ থাকতে হল।
এর আগে বনগাঁও থেকে বাসে করে ঘোষপুর যাবার পর ওরা প্রথমে রতনের পিসির বাসায় উঠেছিল। পিসির বাসায় দুই দিন বিশ্রাম নেবার পর পিসির ছেলে ওদেরকে পথ চিনিয়ে ইয়থ ক্যাম্পে পৌঁছে দেয়। ছেলেটা ওদের চেয়ে বয়সে একটু ছোট হলেও দারুণ চটপটে।
ঘোষপুর ক্যাম্পে প্রথম দিনই দারুণ একটি মজার ঘটনা হয়েছিল।
অবশ্য সে সময়ে ওদের কাছে ততটা মজার লাগে নি। ক্যাম্প কমান্ডার ছিলেন রুহুল কুদ্দুস নামের একজন আওয়ামী লীগ নেতা। তাঁর সাথে আরও কয়েকজন সহকারী ছিল। ওদের নাম, ঠিকানা লেখার সময় বাড়ি গোপালগঞ্জ শুনে অনেক প্রশ্ন করছিলেন। কথায় কথায় অনিক জানিয়েছিল ও ক্রিকেট খেলে। লেগ স্পিনের পাশাপাশি মিডল অর্ডারে ব্যাট করে এবং ফিল্ডিং ও মন্দ করে না। ইন্টারের পর ঢাকা যাবার পরিকল্পনা ছিল সেটাও জানাল। সব শুনে কুদ্দুস সাহেব বললেন,
-বাহ! চমৎকার। এবার বল তোমার হাতের টিপ কেমন?
-ওর হাতের টিপ দেখলে আপনি অবাক হয়ে যাবেন! রতন পেছন থেকে বলে উঠল। ও বলে-কয়ে উইকেটে থ্রো করে লাগাতে পারে। আমি নিজেই কয়েকবার ওর হাতে রান আউট হয়েছি।
-তাই নাকি? তাহলে তোমার একটি টেস্ট নেয়া যাক। বলে তিনি আশপাশে তাকালেন।
ক্যাম্পটি যে স্থানে ছিল তার সীমানার ভেতরে কয়েকটি বিশাল আমগাছ ছিল। আমের মৌসুম প্রায় শেষের দিকে বলে গাছের দু-একটি বাদে সব আমই পেড়ে ফেলা হয়ে গেছে। এরকম একটি অনেক উঁচু গাছের একেবারে মগডালে ঝুলে থাকা একটি ছোট্ট আম দেখিয়ে বললেন,
-তুমি যদি ইট মেরে ঐ আম ফেলতে পার, তাহলে তোমাদের সবাইকে এনলিস্টেড করে নেব।
-আর যদি না পারি? শুকনো মুখে বলল অনিক।
-তাহলে তোমাদের সবাইকেই বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হবে।
-কিন্তু তা কেন? আমরা এত কষ্ট করে, এত দূর থেকে ট্রেনিং করতে আসলাম…সামান্য একটি আম পাড়ার উপর সবকিছু নির্ভর করবে?
-সামান্য কোন ব্যাপার নয়। বলতে পার এটাই তোমার টেস্ট। যুদ্ধের সময় পাকিদের উপর বোমা বা গ্রেনেড মারলে সেটা ঠিকমত লাগাতে পারবে কি না, সেটাও তো আমাদের দেখতে হবে। তাই না? তুমি কিন্তু মাত্র দুইবারই সুযোগ পাবে! শুরু কর।
ওদের কথোপকথন শুনে আশপাশ থেকে বেশ কয়েকজন এসে উপস্থিত হল। ওদেরকে ঘিরে ধরে দাঁড়িয়ে অনিক কি করে দেখতে লাগল। অনিক নিজের ব্যাগ নামিয়ে রেখে খুঁজে খুঁজে ইটের টুকরো বের করল। এর মধ্যে দুটো বাছাই করে উপরে তাকিয়ে মনে মনে হিসাব করে নিলো। এবার বড় বড় দুটো শ্বাস নিয়ে প্রথম ঢিলটি ছুঁড়ে মারল।
‘টং!’
আম থেকে মাত্র কয়েক ইঞ্চি পাশ দিয়ে মগডালে গিয়ে লাগল। উপস্থিত সবাই একসাথে ‘আহ’ করে উঠল। এবার রতন এগিয়ে এসে অনিকের কাঁধে হাত রেখে বলল,
-দোস্ত, রিল্যাক্স। কোন টেনশন করিস না। ঠাণ্ডা মাথায় মার, ঠিকই লেগে যাবে। আমি জানি তুই পারবি।
ওর দিকে তাকিয়ে অনিক একটু হাসি দিয়ে আবার সমগ্র মনোযোগ দিয়ে আমটাকে দেখে নিলো। সৃষ্টিকর্তার নাম স্মরণ করে দ্বিতীয় এবং শেষ ঢিলটি ছুঁড়ল।
ইটের দ্বিতীয় টুকরোটি এবার আরও কাছ দিয়ে গেল এবং আমের প্রায় ঘা ঘেঁষে চলে গেল! সবার মধ্যেই হতাশা দেখা গেল। একজন তো ‘ওহ নো’ বলে চিৎকারই করে উঠলেন। অনিক মুখ কালো করে রুহুল কুদ্দুস সাহেবের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
-কি, পারলে না? সামান্য একটু প্রেশার দিয়েছি তাতেই তথাকথিত বুলস আই অনিক হেরে গেল?
অনিক চুপ করে রইল।
-যুদ্ধের ময়দানে এর চেয়ে বেশি চাপের মুখে তোমাদের সবাইকে অপারেট করতে হবে। শত্রুপক্ষের গুলি চলবে, শেলিং চলবে, সহযোদ্ধাকে বাঁচাবার চাপ থাকবে, নিজের জীবন বাঁচাবার চাপ থাকবে। এত কিছুর মাঝেই গ্রেনেড মেরে বা গুলি করে লক্ষ্যভেদ করতে হবে। এক ইঞ্চি এদিক-ওদিকই হওয়াটাই জীবন-মৃত্যুর মাঝে ব্যবধান গড়ে দিতে পারে। পারবে সেই চাপ সামলাতে?
অনিক ধীরে ধীরে মুখ তুলে তাকাল। বুক চিতিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে এবং মুখ শক্ত করে দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
-জ্বি ভাইয়া, পারব!
এ কথা শুনে কুদ্দুস সাহেব হো হো করে হেসে উঠলেন। ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
-আমি জানি তুমি পারবে! এরকম দুই ইঞ্চির পাশ দিয়েও যদি তুমি গ্রেনেড মারতে পার, পাকি শালারা পালাবার পথ খুঁজে পাবে না। তোমাদের সাথে মজা করলাম। এত দূর থেকে তোমাদের এভাবে আসাটাই প্রমাণ করে তোমরা দেশের জন্য কতটা নিবেদিত প্রাণ, যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত। তোমাদের ফেরত পাঠাবার প্রশ্নই আসে না! যাও, বাকিদের সাথে গিয়ে সামনের ঐ লাইনে দাঁড়াও!
এতক্ষণ ধরে অনিক, রতন, সাব্বির এবং চিত্তের অন্ধকার মুখ অন্ধকার হয়ে ছিল। ক্যাম্প কমান্ডারের এই কথা শুনে খুশিতে ওদের সবগুলো মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
ক্যাম্পে ওদের করার মত কিছু ছিল না-সারাদিন গল্প-গুজব এবং রেডিও শুনে সময় কাটাতে লাগল। এর মধ্যে একদিন শুনতে পেল গোপালগঞ্জ শহর নাকি পাকিস্তানী বাহিনী দখল করে নিয়েছে। ক্যাপ্টেন হালিম, ক্যাপ্টেন মিলু, ক্যাপ্টেন শিহাবুদ্দিন সহ আরও অনেকেই নিজস্ব বাহিনী নিয়ে প্রাথমিকভাবে ওদের মোকাবেলা করেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই প্রতিরোধ বজায় রাখতে পারেন নি। গোপালগঞ্জ দখল করার পর পাকি হানাদাররা নাকি কায়েদে আযম কলেজের অধ্যক্ষ সন্তোষ কুমার দাশকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। একই সাথে বিভিন্ন গ্রামের প্রায় আড়াইশো জন মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধ সমর্থককে মেরে ফেলেছে। পুড়িয়ে দিয়েছে হাজার হাজার বাড়িঘর। এসব শুনে বাসার জন্য এবং বাবা-মা, শাওনের জন্য অনিকের ভীষণ দুশ্চিন্তা হতে লাগল। কিন্তু, আপাতত মনে মনে প্রার্থনা করা ছাড়া ওর আর কিছু করার রইল না।
ইয়থ ক্যাম্পের দুই সপ্তাহ ওদের ভীষণ কষ্টের মধ্য দিয়ে গেল। প্রতি সপ্তাহে শত শত নতুন ছাত্র, যুবক দলে দলে ট্রেনিং করার জন্য আসছে। এত জনের একসাথে থাকা, খাওয়ার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা এখানে ছিল না। সবার জন্য প্রতিদিন মাত্র দুই বেলা খাবারের ব্যবস্থা করা সম্ভব হল, সেটাও সবাই মিলে ভাগ-বাটোয়ারা করে খেতে হচ্ছে। অবশ্য কাউকেই কোন প্রকার অভিযোগ করতে দেখা গেল না। এখানে যারা এসেছে তারা প্রত্যেকেই সবকিছু জেনে-শুনেই এসেছে। সবচেয়ে বড় কথা দেশের লাখ লাখ মানুষ যখন অনিদ্রা, অনাহার এবং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিটি দিন অতিবাহিত করছে, সেই তুলনায় এইটুকু ঝামেলা তো কোন ব্যাপারই না।
যাই হোক, সবচেয়ে সমস্যা দেখা দিল পান করার বিশুদ্ধ পানি এবং মল-মূত্র ত্যাগ করার জন্য ভাল সুব্যবস্থা না থাকার কারণে। এর মাঝে পরপর কয়েকদিন টানা বৃষ্টি হবার কারণে যে অল্প ক’টি টয়লেট ছিল সেগুলোর অবস্থা আরও নাজুক আকার ধারণ করল। ফলে, দ্রুত ইয়থ ক্যাম্পের কমবেশি প্রায় সবারই পেটের পীড়া জনিত সমস্যা শুরু হল। অনেকে এতটাই কাহিল হয়ে গেল যে পার্শ্ববর্তী হাসপাতালে ভর্তি হতে হল।
অনিক এবং রতনের তেমন সমস্যা হল না। শারীরিকভাবে দুজনেই যথেষ্ট মজবুত বলে সব কিছু সহ্য করে টিকে রইল। কিন্তু চিত্ত এবং সাব্বির অসুস্থ হয়ে পড়ল। বিশেষ করে চিত্ত’র অবস্থা খুব খারাপ আকার ধারণ করল। মোটা চালের ভাত, অপরিষ্কার পানি, টয়লেটের সমস্যা মিলে ওর অবস্থা গুরুতর হয়ে উঠল। রুহুল কুদ্দুস ভাইকে বলে চিত্ত এবং সাব্বিরকে ওরা রতনের পিসির বাসায় রেখে আসল। পিসি ওদেরকে নিজের ছেলের মতনই বাসায় আশ্রয় দিলেন এবং সেবা-শুশ্রূষা করা শুরু করলেন।
চিত্ত এবং সাব্বিরকে পিসির বাসায় রেখে ঐদিনই ওরা ইয়থ ক্যাম্পে ফেরত গেল। পরদিন নির্দেশ আসলো ওদেরকে সবাই বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে ভাগ করে দেয়া হয়েছে। রতন এবং অনিককে দেয়া হয়েছে ঘোষপুর থেকে প্রায় ৬০ কিমি দূরের একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে, জায়গাটি বিখ্যাত কালীঘাট থেকে কয়েক মিনিটের হাঁটাপথ দূরত্বে অবস্থিত। ওখানেই ওদের দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। অসুস্থ দুই বন্ধুকে এভাবে রেখে যেতে খারাপ লাগলেও ওদের কিছুই করার ছিল না। পরদিন ভোরবেলায় রতন ও অনিকের দলটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের উদ্দেশ্যে রওনা হল।
—–
নতুন ক্যাম্পে এসে ওরা প্রথমবারের মতন সামরিক জীবনের স্বাদ পেল। প্রথম দিনই জানিয়ে দেয়া হল আগামী তিন মাস ওদেরকে অত্যন্ত কঠোর অনুশীলনের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। সামরিক বাহিনীতে যেরকম ট্রেনিং সাধারণত দেড় বা দুই বছর ধরে দেয়া হয়, সেটাই ওদেরকে সংক্ষিপ্ত আকারে তিন মাসের মধ্যে দেয়া হবে।
রুটিন শুনে অনিক এবং রতন কিছুটা হলেও চমকে গেল। ভোরের আলো ফোটার আগেই উঠতে হবে। প্রথম একমাস প্রায় সারাদিনই ওদের বিভিন্ন শারীরিক এবং মানসিক এক্সারসাইজ করানো হবে। একই সাথে চলবে শত্রুকে খালি হাতে মোকাবেলা করার নানা কৌশল শেখা। দ্বিতীয় মাস থেকে শুরু হবে আগ্নেয়াস্ত্র চালনা এবং বোমা, গ্রেনেড নিখুঁত ও কার্যকরী ভাবে ছুঁড়ে মারার অনুশীলন। শেষ মাসে মাইন পোতা, ডিনামাইট ফাটানো ইত্যাদি এবং গেরিলা যুদ্ধের নানা কৌশলসহ আগের দুই মাসের সবকিছু একই সাথে চলতে থাকবে।
বর্তমান ক্যাম্পের কমান্ডারকে দেখে খুবই রাশভারী এবং বদমেজাজী মানুষ মনে হল। ক্যাম্পের একজন কর্মচারী জানালেন তিনি নাকি ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের প্রভাষক ছিলেন, ফলে সামরিক জীবনের সাথে বেশ ভাল ভাবেই অভ্যস্ত। প্রথম দিনই ওদের সবাইকে লাইনে দাঁড় করিয়ে অনেকক্ষণ কথা বললেন। অনেকটা হুমকির ভঙ্গিতে দিলেন শৃঙ্খলা এবং নিয়মানুবর্তিতার ব্যাপারে কোন প্রকার ছাড় দেয়া হবে না। এরপর ক্যাম্পে থাকা অবস্থায় কি কি করা যাবে এবং করা যাবে না-সে ব্যাপারে ব্রিফ করলেন। সবশেষে সবাইকে ক্যাম্পে স্বাগত জানিয়ে আগামী তিন মাসের প্রশিক্ষণের ব্যাপারে শুভ কামনা জ্ঞাপন করলেন।
ওদের প্রশিক্ষক হিসেবে থাকবে সেনাবাহিনীর বর্তমান এবং সাবেক সদস্যবৃন্দ। এই ক্যাম্পে ওরা সর্বমোট ১১৫ জন আছে। বেশিরভাগই যশোর, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া এবং মেহেরপুর এলাকার। ওদের মধ্যে ১৬ বছরের কিশোরের পাশাপাশি ৩৮ বছরের একজন মধ্য বয়সী লোকও রয়েছে।
বিভিন্ন বয়স, পেশার এবং এলাকার হওয়া সত্ত্বেও প্রত্যেকের লক্ষ্য এখন একটিই-পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে এদেশকে শত্রু মুক্ত করা। অনিক নিজের দুইপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর দিকে এক ঝলক দেখে নিলো। দীর্ঘ পথ চলায় প্রায় সবারই চেহারাই ক্লান্ত, মলিন দেখাচ্ছে। কিন্তু সবার চোখ যেন জ্বলজ্বল করছে। বুঝতে পারল বাকি সবার মনের অবস্থা এখন ওর মতই-দেশের প্রয়োজনে দাঁতে দাঁত চেপে সকল প্রকার কঠোর পরিশ্রম করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
হঠাৎ করেই মনের মধ্যে দারুণ আত্মবিশ্বাস জাগল। বিশ্বাস করা শুরু করল ওরা জিতবে, অবশ্যই জিতবে। যে কোন মূল্যে দেশকে স্বাধীন করে বিজয়ের পতাকা ছিনিয়ে আনবেই!
কে ভাই?
"মরনের বীথিকায় জীবনের উচ্ছ্বাস,
জীবনের যাতনায় মৃত্যুর মাধুরী"