ক্লাশ সেভেনে আমদের রুমমেট, বেস্টফ্রেন্ড আর কিছু ক্লাশমেটের কথা :
আমার রুমমেট দিয়েই শুরু করি। আমাদের কলেজের রুমগুলি পুরাতন ক্যাডেট কলেজের মতো নয়। রুমগুলো ছোট ছোট এবং এক রুমে তিনজন করে থাকতে হতো। আমার রুমমেট ছিল মোঃ খালেকুজ্জামান জর্জ( ১২৭) এবং মোঃ রেজাউল হক ( ১৪৯)। নতুন ক্যডেট কলেজ হবার সুবাধে আমরা কেউ ইংরেজীর চর্চা করতাম না। জর্জ সুযোগ পাক না পাক ইংরেজীতে কথা বলার চেষ্টা করতো এবং ক্যাডেট কলেজ সম্পর্কে অনেক কিছু আগে থেকে জানতো, অন্যদিকে রেজাউল হক ছিল জ্ঞাণী প্রকৃতির আমরা তাকে সক্রেটিস বলতাম। কারন তখন আমদের ইংরেজী সিলেবাসে Wise Man of the Old নামে একটা প্রবন্ধ ছিল যেখানে এই নামে একজন জ্ঞানী লোক ছিলেন। জর্জ ছিল ঠাকুর গাঁ এর আর সক্রেটিস ছিল রংপুরের গঙ্গাচরার। সবচেয়ে মজার ব্যাপার আমাদের কোন সিনিয়র রুমমেট বা রুম লিডার ছিল না। আমরা নিজেরাই রুম লিডার। একই ক্লাশের হওয়ার জন্য প্রায়ই গায়ে মানে না আপনি মোড়ল টাইপের ঘটনা ঘটতো।
আমাদের ব্যাচের বিশাল এক গ্রুপ ছিল রংপুর জিলা স্কুলের। তখন ক্যাডেট কলেজে একাধিকবার বা দুএক বছর নীচে নেমে অর্থাৎ নবম বা অস্টম শ্রেণী থেকে পরীক্ষা দেয়া যেত। তাই জিলা স্কুলের সপ্তম এবং অস্টম উভয় শ্রেণীর ছাত্র আমাদের ক্লাশে ছিল। জিলা স্কুল ছাড়াও রংপুরে ছাত্রই ছিল সবচেয়ে বেশি। আনুমানিক ৩০ থেকে ৩২ জন ছিল গ্রেটার রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া এই বেল্টের, ১২ থেকে ১৫ জন ছিল ঢাকা, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা এলাকার, বাকী ৩ বা চারজন ছিল অন্য এলাকার। আমদের একান্ন নম্বর ক্যাডেট ছিল কাসেম। ওর হঠাত যক্ষা ধরা পরে। তখনকার দিনের কথা ছিল,”যার হয় যক্ষা, তার নাই রক্ষা” রংপুর সি এম এইচ এ অনেকদিন থাকার পর বেচারা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এল। অতিরিক্ত দুর্বল হবার কারনে ক্যাডেট নম্বর ইস্যু হবার পুর্বে ও চলে যায়। ক্লাশ সেভে্নেই একটা উইকেট পরে গেল। পরবর্তিতে অরো কত উইকেট পরলো। এগুলু গল্প সময় এলেই বলবো।
বিভিন্ন এলাকার হওয়ার জন্য সবার ভিতরে নানারকম আঞ্চলিকতার টান ছিল। আমি যদিও রংপুরে এছেছি বছরখানিক হলো কিন্তু এর পুর্বে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত পাবনায় থাকার কারনে আমার মধ্যে অত্যাধিক পাবনাইয়া টান ছিল, আর শব্দ চয়ন গুলো আলাদা ছিল যেমন খাতাম, যাতাম, গেদা, ছাউয়াল ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করতাম। রংপুরের ছেলেরা কথায় কথায় বলতো,” দূর ঘন্টা” অর্থাত “দূর ছাই”, কেনাকাটাকে তারা বলতো খরচ করা, বগূড়ার যারা ছিল তারা কেমন যেন একটা ভাষা ব্যবহার করতো,” আসিচ্ছি, করিচ্ছি” টাইপের। তখনও কথায় কথায় শিট শব্দটা কেউ ব্যবহার করতো না। ঢাকা থেকে আগত যারা ছিল সবচেয়ে বেশী স্মার্ট এবং পোঙ্কটা। তারা আমদের আঞ্চলিকতার দুর্বলতা নিয়ে আমাদের শুধু খেপাতো। কি আর করা ? কুষ্টিয়ার শহিদুজ্জামান সবচেয়ে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতো। আমদের ব্যাচের দিনাজপুরের গ্রুপ একটু সাইজে বড় হবার সুবাদে লিডার গোছের ছিল। তাদের মধ্যে কেও কুংফু ক্যারাটে জানতো বলেও প্রচলন ছিল। কেও ছিল পলিটিশিয়ান, কেও ছিল মাতবর আবার কেউ আব্দুল এরকম আরো কত কি। আমরা সাইজে ছোট আর খাস মফস্বলের হবার জন্য ছিলাম পিছনের সারির। আমদের ব্যাচের বিশাল এক ট্যালেন্ট ছিল নাজমূল হূদা খান (নাহুখা নামে পরিচিত)। ওর ক্যডেট নাম্বার ছিল আমার পরেরটা অর্থাৎ ১৩২। ও কারেণ্ট এফেয়ার্সে ছিল অসাধারন এবং ওর সবচেয়ে বড় গুন ছিল ও কার্টুন লিখতো। তখনকার দিনে কার্টুন কি এটাই আমার বোঝার সাধ্য ছিলনা। আমদের মধ্যে ঢাকার পোলাপান উন্মাদ নামে একটা পত্রিকা আনত আর আমদের হাত বদল হতো। উন্মাদ পড়ার মজায় ছিল আলাদা।
রুমমেট সেটিং যায় হোক না কেন একসময় দেখা গেল এই রুমের এর সাথে ঐ রুমের এর পটে ভাল, এই হাউসের এর সাথে ওই হাউসের ওর পটে ভাল ইত্যাদি জাতীয় বিষয়। সবার বেস্ট ফ্রেন্ড অল্প কিছুদিনের মধ্যে সিলেক্ট হয়ে গেল। এতে কোন সমস্যা ছিলনা। কারন আমদের এক হাউস থেকে আর এক হাউসে যাওয়ার কোন নিষেধাজ্ঞা তখনো তৈরী হয়নি। আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু ছিল আমার হাউসের এবং রংপুরের মঞ্জুরুল হক সোহেল ( কিছদিন ডেইলী স্টার, ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের সাংবাদিক ছিল। এখন অন্য চাকুরী করে, নাম সোহেল মঞ্জুর)। তখন থেকেই ও একটু আঁতেল টাইপ ছিল। আর ওমর ফারুখ হাউসের ইমতিয়াজ হোসেন নাফিজ ছিল আমার জিলা স্কুলের বন্ধু। ও আমকে জিলা স্কুলে থাকতে প্রথম শিখিয়েছিল কিভাবে স্কুল ফাঁকি দিতে হয়।
আমাদের ব্লকে কোন সিনিয়র না থাকায় আমরা ছিলাম একগুচ্ছ স্বাধীন বান্দর, যাদের কাজ ছিল সারাদিন বান্দরামি করা আর এর ওর নাম দেয়া। আমি একটু বোকা গোছের হওয়াতে আমদের বন্ধুদের হাইট আলা কথার প্রায়ই মাথা মুন্ডু বুঝতামনা। আমি ছিলাম সারাজীবন টিউবলাইট।
আমরা থাকতাম দোতলায়। আমদের নীচে জাহাঙ্গীর হাউসের এলাকায় অর্থাৎ আমদের ঠিক নীচে কিছু কলেজের বেসামরিক ব্যাচেলররা থাকতেন। তাদের কে কি তা জানতাম না। একদিন আমি একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম,”এইযে ভাই, আপনি কে”। অমনি উনি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন,” এইযে ভাই কি? আমি তোমার ভাই নাকি?” ওনাদের ব্যাপারে আর কিছু মনে নেই। আমদের ঠিক উপরের ব্লকে থাকতো ওমর ফারুকের ক্লাস সেভেন। আমার উপরের রুমে থাকতো ইমতিয়াজ হোসেন নাফিজ(১২৩), এহতেশামুল হক(১২৪) আর নুর আলম সর্দার( ১৩৪)। নাফিজের কাম ছিল দুপুর নাই রাত নাই শুধু কাচের মার্বেল দিয়ে মেঝেতেঠক ঠক করা আর আমদের ডিস্টার্ব করা। নাফিজ আমার পূর্ব পরিচিত হওয়াতে আমার রুমমেটরা শুধু আমকে দোষারুপ করতো। আমি একদিন শুরু করলাম খাটের স্ট্যান্ড নিয়ে নিচ থেকে সিলিং এ ঠক ঠক। তাও নাফিজ থামেনা। আগে করতো একা এখন তিন রুমমেট মিলে। আস্তে আস্তে এটা ছড়িয়ে গেল পুরা ক্লাশ সেভেনে। নিচ আর উপর একসাথে সেভেন হলেই ঠক ঠক চলছে।
(চলবে)
১ম
আরো চাই 😀
এখন থেকে প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে একটা এই সিরিজের দেয়ার চেষ্টা করবো।
😀 =)) =))
আমি তবু বলি:
এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..
এখনো আছি, ধীরে জ্বলি কিন্তু আলো বেশী দেই।
:no: :no: ঠিক না ঠিক না :no: :no: ।
Life is Mad.
এডিসন ভাইয়ের দেখি একেবারে ডিটেইলে অনেক কিছু মনে আছে :clap: :clap: :boss: :boss:
সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!
সবার ব্লগ পড়তে পড়তে অনেক কিছু মনে আসে।
গোপন সূত্রে খবর পেয়েছি ;;; যে এই সিরিজের টানা ২০ টা পর্ব চালানোর মতোন ম্যাটেরিয়াল প্রস্তুত আছে। কোমর বেঁধে বসে রইলাম সবগুলোর অপেক্ষায়।
Life is Mad.
ভাই আপনার ডিটেইলিং অসাধারন :clap: :clap:
আর ফুলাইয়োনা ভাই, সপ্তাহে একটার বেশী পারুম না।
আরো চাই 😀
আসবে তে বটেই। তবে কতোদিন জানিনা।
কিছু কিছু মিলে যাচ্ছে, যেমন, উপর থেকে ঠকঠক করে যন্ত্রণা করা :grr: :grr: :grr:
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
না মিলার কোন কারন নাই। বললাম না সবাই ছিলাম একগুচ্ছ বান্দর।তোমরা কি অন্য কিছু ছিলা নাকি? শিম্পাঞ্জি বা ঐ রকম কিছু।
😀 :)) 😀 :))
Life is Mad.
ওরে ভাইয়া, কত কিছু যে মনে পড়ে গেল,
আপনি শেষ করেন, দেখি আমিও একটু গোছাই।
পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না
অনেক লম্বা টাইপ করে ফেলছেন, নিশ্চয় আংগুল আগের চেয়ে ভাল।
পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না
এক্টা আঙ্গুলে ফ্রাকচার। হু কেয়ারস ?
ভাইয়া, আপনার লেখা পড়ে বেশ ভাল লাগছে।
ধন্যবাদ ভাই।
মন্তব্য করতে আমি আইসা পড়ছি। ঠক ঠক, ঠক ঠক 😀
শওকত তুই সোহেল মঞ্জুর আর শহীদুজ্জামানরে চিনিষ না। শহীদুজ্জামান নিউ এইজে আছে।
ঠক ঠক ঠক ঠক............... জানান দিয়া গেলাম। আমিও আছি। :grr:
"মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"
বড়ভাই মাথার উপর থাকলে ভয় নাই," ডানছের চোডে বাত্তি জ্বলে আর নেভে"
🙁 🙁 🙁
ক্লাস সেভেনে প্রথম সাতদিন রুম লীডার ছিল ক্লাস টেন, পরে ক্লাস নাইন... :((
ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ
আমরা পুরা ক্যাডেট লাইফে কোন সিনিয়র রুম মেট পাইনি।
:clap: :boss: :salute: :hatsoff: :guitar:
Life is Mad.
এডিসন ভাইয়ের দেখি একেবারে ডিটেইলে অনেক কিছু মনে আছে
স্যার আপনার এই ব্যাপারটা সত্যি অনুকরনীয়।
আপনি কোন কিছু করলে অনেক ডিটেইল এ করেন।
আপনার প্রতিতা পোস্ট এর পেছনে এর ডাটা তৈরি আর কেউ না জনলেও আমি জানি - আপনি রীতিমত পারফেকশনিস্ট। আমাদের দূর্ভাগ্য আপনি ইতিহাসের পাঠ্য কোন বই লেখেন নি।
:salute:
সৈয়দ সাফী
পরের পর্ব কবে হবে