চেনা মানুষের মাঝে ফিরে যেতে চাই

ঘুম ভাঙলো সকাল ১১টার দিকে। বেশ ঠান্ডা লাগছে। আজকেও দেরী করে ঘুম ভাঙলো। মুঠোফোনের আবহাওয়া সংবাদ চোখ বুলিয়ে দেখি বৃষ্টির সম্ভাবনা। তাপমাত্রাও ১৪ ডিগ্রী সেলসিয়াসে নেমে এসেছে। চোখ ডলতে ডলতে ফ্রিজ খুলে দেখি ওটমিল, দুধ, এবং চকোলেট সিরাপ দিয়ে বানানো আমার প্রায় নিত্যদিনের নাস্তাটি নেই। তাহলে ওটা স্বপ্ন ছিল। এবার নিজের উপর বিরক্ত হবার পালা। গতকাল রাতে মাইকেল ক্রাইটনের বেস্টসেলার ‘প্রে’ (Prey) পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। ন্যানোটেকনোলজির অনিয়ন্ত্রিত ভবিষ্যত কল্পনা করে লেখা উপন্যাসটি বেশ ভালই লাগছে। ডিম ভাজা, পিনাট বাটার মাখানো পাউরুটি আর কলা নিয়ে ল্যাপটপের সামনে বসলাম। আরো দশটা হলে কিংবা ছোট এপার্টমেন্টে থাকা ছাত্রের মত আমারো বিছানার আশেপাশের কক্ষপথে ল্যাপটপ, টেবিল ফ্যান, হাতঘড়ি, মুঠোফোন চার্জার ইত্যাদি অবস্থিত।

ফেবুর কোন এক পোস্টে আড্ডা চলছে। সেখানে দেশে থাকা সাহেদ ভাইয়ের (পকক, ৯৫) কাছে জানতে পারলাম আজকে নাকি তারিখ রেখার এপারে চাঁদরাত। ফেবুর সামগ্রিক কর্মকান্ডে ইদানিং চোখ কম রাখছিলাম, তাই দিন তারিখের হিসাব থাকলেও দিনের তাৎপর্যের হিসাব নেই। মনে পড়ল আগামী ১৫ আগস্ট দেশ ছাড়ার ঠিক এক বছর পূর্তি। ঈদের ঠিক দুদিন আগেই চলে এসেছিলাম মার্কিন দেশে। আত্মীয়-স্বজন বন্ধুবান্ধবের নিষেধ সত্বেও দেশে ঈদ করে আসিনি। আমার চোখে তখন টেক্সাস ও উতাহ এর বন্ধুর কাছে ঘুরতে যাবার রঙীন দিবাস্বপ্ন। ঘোরার পেছনে সময় ব্যয় করে সময়মত বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পৌঁছাতে হলে ঈদ ছেড়ে দিতে হবে। ছেড়েও দিয়েছিলাম। অতিউৎসাহী ছেলের উদ্ভট চিন্তাভাবনাকে কখনো প্রশ্নবিদ্ধ করেনি আমার মা। এবারো করলেন না। মাথায় আসেনি যে বিদেশে পাড়ি জমানো দ্বিতীয় ছেলের সাথে আরো একবার ঈদটা কাটানোর একটা সুপ্ত বাসনা এই ইস্পাতসম, ভাবলেশহীন মহিলার থাকতে পারে। দুদিন পরে আমি বন্ধুর গাড়িতে টেক্সাসের আন্তঃরাজ্য মহাসড়ক দাবড়ে বেড়াচ্ছি। ঈদের দিন ফোন করতে রাত করে ফেলেছিলাম। বড় ভাই জানালেন মা চিন্তিত হয়ে আছেন কারণ ডালাস এসে নামার পর কথা হবার পর কেটে গিয়েছে তিনটি দিন। এই কাজ যাতে ভুলেও না করি। খুব একটা পাত্তা দেইনি। আমার তখন বিদেশ আসার মধুচন্দ্রিমা পর্যায় চলছে। এরপরে উতাহ ফয়সালের (মকক, ০৪) ওখানে আরো দিন পাঁচেক থেকে এসে পড়লাম মিশিগানে। ব্যস্ততা, খামখেয়ালি সব মিলিয়ে বড় অনিয়িমিত বাসার সাথে আমার যোগাযোগ। মাসের ব্যবধানও গিয়েছে একবার। শেষে বড় ভাই একদিন বড়সড় ধমক দিলেন। সাথে সাথে কথা বললাম মায়ের সাথে। কন্ঠে স্পষ্ট উদ্বিগ্নতার ছাপ। এবার ঘোষনা দিয়ে ডুব দেয়া শুরু করলাম। অদ্য … ইং তারিখ হতে … ইং তারিখ পর্যন্ত আমাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। জানতে পারলাম তারা ক্যালেন্ডারে দাগ কেটে রাখতেন। এটা সম্ভবত এ বছরের শুরুর দিকের কাহিনী। বিমর্ষ গলায় মা একদিন জানালেন বাসায় আসলে ভালমন্দ রান্না করা হয় না। কাকা নাকি বারণ করেন। দুই ছেলে দেশের বাইরে। ভালমন্দ রান্না করার কোন প্রয়োজনীয়তা নাকি নেই। হঠাৎ সময় দেখি সাড়ে এগারটা বাজে। এমনেই দেরী করে ফেলেছি আজকে। চিন্তায় ডুবে আধা ঘন্টা সাবাড় করে দিলাম। এক ঝটকায় উঠে জামা জুতা পরে নিলাম।

১২টার মাঝে অফিসে এসে কাজে বসলাম। গতকাল ফাঁকি দিয়েছি তাই আজকে কাজ এগিয়ে নিতে হবে। আসলে আজকে চাঁদরাত জানলে হয়তো কালকে ফাঁকি দিতাম না। সেটা কালকের জন্য রেখে দিতাম। আসলে ঘরের রসদপাতি শেষ হয়ে গিয়েছিল। বাজারে না গিয়ে উপায় ছিল না। তবে কালকে ঈদ জেনে থাকলে কি ফাঁকি দিতাম? আমার মনে হয় না। চারটি ঘন্টা কাজ করলে বেশকিছু ডলার যোগ হবে নিশ্চিত। নিজের থিসিসের বিষয় নির্বাচন নিয়েও মাছের মত খাবি খাচ্ছি ইদানিং। দ্রুত সিদ্ধান্তে আসাটা জরুরী। উপরন্তু বিশেষ কোন কারণ ছাড়াই এলাকার গুটি কয়েক বাঙালীকে আমি এড়িয়ে চলি বা তারা আমাকে এড়িয়ে চলে। এছাড়া বাসায় বসে থাকাটা খুব বিরক্তিকর হয়ে দাঁড়াবে। আসলে ঈদ উদযাপনের কোন মন মানসিকতা আমার নেই। নিজেকে অপরাধী মনে হয় ইদানিং। মধুচন্দ্রিমা পর্যায় ছেড়ে বাস্তবতায় আছড়ে পড়েছি বেশ কয়েকমাস হলো। ঠিক খাপ খাওয়াতে পারি না। পড়াশুনা করছি, ঘুরে বেড়াচ্ছি, আড্ডা দিচ্ছি, ছবি তুলছি তারপরেও প্রতিদিন অদ্ভূত এক শূন্যতা। কি যেন নেই। কে যেন নেই। গত বসন্তকালীন ছুটিতে আবার গিয়েছিলাম ফয়সালের ওখানে ঘুরতে। সেখান থেকে লাস ভেগাস। আনন্দের সীমা ছিলনা। কথা প্রসঙ্গে বলেছিল শীতপ্রধান এলাকায় থাকার কারণেই আমার মাঝে এরকম হতাশা ও বিমর্ষতা। অস্বীকার করতে ক্ষেপে গিয়েছিল সে। আমি আর পাল্টা যুক্তি দেখাইনি। আরো তিন বছর আগে থেকেই মার্কিন দেশে অবস্থান করা একটা মানুষ অবশ্যই এ ব্যাপারে আমার চেয়ে ভাল জানবে। কিন্তু আমার মাঝে সেই শূন্যতা ঘুরে ফিরে আসতেই থাকল। চেনা মানুষের মাঝে না থাকার শূন্যতা। একটা ইয়ামাহা আর ওয়ান হাওয়ার বেগে উড়ে যেতে দেখে পাশে আসিফকে (মকক, ০৫) না দেখার শূন্যতা। জিন্সের বোতামটা ক্ষয়ে খুলে আসলে স্কুলের বন্ধু মার্চেন্ডাইজার ইমরানকে ফোন করে (ফ্রি তে) বাজে পন্য গছানোর জন্য গালি না দেয়ার শূন্যতা। মিরপুর ডিওএইচএস এর ব্যাকট্রলের সামনে মুখ অসাড় করে দেয়া মিষ্টি মালটোভা চাতে চুমুক দিতে না পারার শূন্যতা। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সাপ্তাহিক আড্ডায় সামিল হতে গুলশান দুইতে ফল-ইন হতে মুনতাসিরের (মকক, ০৪) ফোন না পাবার শূন্যতা। ফেরদৌস ভাইয়ের (ফকক, ৯৫) অফিসে গিয়ে আড্ডা ও টুকিটাকি ব্যবসায়িক কাজে সহায়তা করতে না পারার শূন্যতা। রাত করে বাড়ি ফিরে জেগে থাকা মায়ের চোখ রাঙানি না দেখার শূন্যতা। নরসিংদী স্টেশান থেকে যাত্রী ঠাসা ঢাকাগামী এগারোসিন্দুর ট্রেনের মাঝে নিজেকে সেধিয়ে না ফেলতে পারার শূন্যতা। কোন এক সন্ধ্যায় মেঘনার পাড়ে বসে দূরের ট্রলারগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে না পারার শূন্যতা। এই তালিকা আসলে শেষ হবে না। মা, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধবের সাথে দিনের পর দিন যোগাযোগ না রাখাটা অবশ্য এই অনুভূত শূন্যতার সাথে সাংঘর্ষিক। এই দ্বৈত চরিত্রের কারণ কখনো খুঁজে দেখা হয়নি। কয়েকদিন আগে মাস্টার্সের পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফেরত যাওয়া মারুফের (মকক, ০৪) ফেবু স্ট্যাটাস পড়ে খুব ভালো লেগেছিল। বিদেশে পড়াশোনা করতে থাকা যেকোন ছেলের মত তাকেও — কেন পিএইচডির জন্য চেষ্টা করছ না, কেন ইউরোপের কোন দেশে চাকুরী খুঁজে দেখছো না ইত্যাদি– বিব্রতকর প্রশ্নের সম্মূখীন হতে হয়ছিল, যার উত্তরে সে বলেছিল, “PhD can wait, job can wait but life will never wait.” কথা হচ্ছে জীবনের সংজ্ঞা এক এক মানুষের কাছে এক এক রকম। আমার জীবনের সংজ্ঞা কি? আমার শূন্যতা গুলোই আমার জীবনের সংজ্ঞা।

আমি কি তাহলে খাপ খাওয়াতে পারছি না নিজেকে? আসলে আমি নিজেকে খাপ খাওয়াতে চাইছিনা। কারণ আমি বাঁচতে চাই পরিচিত মানুষগুলোর মাঝে, পরিচিত গন্ধের মাঝে, পরিচিত দুঃখের মাঝে, পরিচিত আনন্দের মাঝে, পরিচিত বিপদের মাঝে, পরিচিত সাফল্যের মাঝে।

বিঃদ্রঃ- এত প্যাঁচালের পর একটা ঈদের শুভেচ্ছা না জানালে খারাপ দেখায় বিধায় সবাইকে ঈদ মুবারাক।

১,৮৪১ বার দেখা হয়েছে

২৬ টি মন্তব্য : “চেনা মানুষের মাঝে ফিরে যেতে চাই”

  1. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    সুন্দর লেখা।
    আমার খুব সম্ভবত ১৭ নাম্বার ঈদ গেলো দেশের বাইরে।
    খারাপ না, ভালৈ।
    ঐভাবে দেশকে মিস করি না।

    হয়তো দেশে গিয়ে একটা ঈদ করলে পরে বোধটা আবার ফেরত আসবে।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  2. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    পার্ট অব লাইফ...ব্যাপার্না...জাস্ট রিচার্ড গেরে (গিয়ার 😛 ) এর মতন মাটি গেঁড়ে বসে থাক- হয় সেট হয়ে যাবি, নয়ত পড়ালেখা শেষ করেই দেশে চলে আসবি...অল দ্যা বেস্ট... :thumbup:


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  3. সাবিহা জিতু (১৯৯৩-১৯৯৯)

    দারুন লিখেছো, মোকা।
    ইদানীং খালি পরবাসী মানুষগুলার একাকীত্ব আর হোম-সিকনেসের কাহিনী শুনছি, জানছি আর পড়ছি। তারপরও দেশের পরিস্থিতি, বাস্তবতা, জীবনের তাগিদ সবকিছু বিবেচনা করে বিদেশের হাতছানি এড়ানো কঠিন। দুখ হয় এই দুখিনী দেশটার জন্য আর প্রচন্ড হতাশ লাগে নিজেদের ব্যার্থতার জন্য। আমরা হয়তো পারতাম এই দেশটাকেও একটা উন্নত সফল দেশ হিসীবে প্রতিষ্ঠা করতে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের জীবনটা অনেক ছোট, আর সময় বয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। পরবর্তী প্রজন্ম যেখানে উপস্থিত, জীবনের এই পর্যায়ে এসে এখন নতুন করে ভিতর থেকে বৈপ্লবিক স্পৃহা অনুভব করতে গেলে রাজ্যের অনিশ্চয়তা এসে ভর করে। আমার কথায় অনেকেই হয়তো বিরক্ত হবেন, কিন্তু সত্যি হচ্ছে আমি সাহস হাড়িয়ে ফেলছি, মনের অজান্তে আমরা অনেকেই হয়তো সাহস হাড়িয়ে ফেলছি।
    ঈদ মোবারক।


    You cannot hangout with negative people and expect a positive life.

    জবাব দিন
    • মোকাব্বির (৯৮-০৪)

      অাপা বাংলাদেশ একটা সহনশীল দেশ। অনেক কিছু হজম করে ফেলে। নাহলে এতদূর অাসতে পারতো না। এতকিছুর পরেও দেখেন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ন্ত, রেমিট্যান্সের চমৎকার প্রবাহ, হয়তো বলতে পারেন টাকা সঠিক পথে ব্যয় হচ্ছে না, বা সঠিক মানুষের হাতে যাচ্ছে না, রাজনৈতিক চরমপন্থি মনোভাব চাঙা হয়ে উঠছে, মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নেই, অারো কত কিছু। তারপরেও দেশ কিন্তু চলে যাচ্ছে অাপন গতিতে। থেমে যাচ্ছে না। থামবেও না। অামি বিশ্বাস করি বিপ্লব কিংবা বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘোষণা দিয়ে অাসে না। এর মাঝেই পরিবর্তন হয়ে যাবে। কপালে থাকলে দেখে যাবেন, কপালে না থাকলে দেখতে পারবেন না। সাহস হারায়েন না, বিশ্বাস হারায়েন না। 🙂


      \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
      অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।