জলের ডাক।

ইউটরেক্ট সেন্ট্রাল স্টেশন থেকে আরও প্রায় মাইল চারেক দূরের পথ, অবিবেচক শীত কিংবা নিদারুণ বৃষ্টি-বাদলে কখনো নিয়মের ব্যত্যয় ঘটে না। প্রকৃতির যাবতীয় খেয়ালীপনা আর রং বদলের অভ্যেসটাকে সে হয়তো তুচ্ছ করার চেষ্টায় নেমেছে। একটা মাউথ অরগ্যান আর ফ্যাকাসে ধূসর রং এর গীটার কাঁধে এ এলাকার লোকেদের বিরক্ত করা ছাড়া, তাঁকে কখনও অন্য কোন কাজ করতে দেখিনি। একই গান সে ঘুরেফিরে বার বার গায়, সামনে ফেলে রাখা হ্যাটটায় তাই সিকি কিংবা আধুলি সেন্ট জমে কালে ভদ্রে। এক ইউরোর কোন কয়েন পড়লে লোকটার চোখ গাঢ় উজ্জ্বল হয়। তবে সে আনন্দ হয়তো দিনে কদাচিৎ আসে। লোকটার অদ্ভুত ভাষার অদ্ভুত সে গান শুনে গায়কের জন্য যে কারও করুণা জন্মায়না- সেটা আমি ঠিক ঠিক বলে দিতে পারি।

এ পথে আমার যাতায়াত প্রায় বছর দুই হতে চললো। মাঝে মাঝে ফিরতে বেশ রাত হয়। ক্লাস থেকে ফিরতি পথে সেন্ট্রাল স্টেশনের কাছাকাছি আসার পর, হাতের বা দিকের মোড়ে সে লোকটিকে দেখা যায়। তার গান এখন বন্ধ হয়েছে। ব্যস্ত হাতে কৌটা থেকে তামাক বের করে পাতলা কাগজে সিগরেট মুড়তে দেখা যায়। সিগরেটের তৃষ্ণা সংক্রমিত হতে বোধহয় খুব কম সময় নেয়। সেদিন হয়েছিলও তাই। আমি লাইটার খুঁজে পাচ্ছিলাম না। গানওয়ালা স্মিত হেসে ওর সিগরেটের আগুনটুকু এগিয়ে দিয়েছিল।

তবে যেদিনটায় ওর সাথে আমার প্রথম কথা হয়েছিল সেদিন ভীষণ উচ্ছৃঙ্খল বাতাস শহরজুড়ে। অসুরকালো মেঘের ছায়া পড়েছে লেকের পানিতে। বাড়ির পথের তখনও মেলা বাকী। গানওয়ালা তার আগের জায়গাতেই। সেই চিরচেনা দুর্বোধ্য গানটা গেয়ে চলছে অবিরত। অন্যসব দিনের মতে আজকেও ওর সামনের হ্যাট প্রায় ফাঁকা। সিকি- আধুলি সেন্ট কিছু খুব দুর্বলভাবে তাদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। আমি সামনে এগিয়ে যাই। বলা যায়, কিছুটা কৌতূহল থেকেই এগিয়ে গেলাম।

-ভাল আছ?

উত্তরে সে ছোট একটা হাসিতে ওর নাম জানিয়ে বললো, সম্বোধোনহীন লোকেদের সাথে কথা চালিয়ে যাওয়া কঠিন। তুমি চাইলে আমার নাম ধরে ডাকতে পার। আমার নাম- ‘ইউসেফ।‘

‘ইউসেফ’ কে এই গল্পে আমরা ইউসুফ বলে চিনবো। বয়স ষাট পেড়িয়েছে। বাদামী কোঁকড়া চুলে শেষ কবে কারও হাত পড়েছে বলা কঠিন। বেগুনী রংএর জ্যাকেটের মালিক- ইউসুফের জ্যাকেট একটাই। পথের ধূলা, গত জানুয়ারি’র পাতা চুইয়ে নীচে পড়া তুষারের শেষ তুলো আর নভেম্বরের শুরুর দিকের ঝড়া পাতার চিহ্ন সেখানে খুঁজলেই পাওয়া যায়। জ্যাকেটের সাথে মিলিয়ে পড়নের জুতো জড়াও দারুণ প্রাগৈতিহাসিক। লোকে যদি বলে- ইউসুফের এই জুতোজোড়া তার প্র- প্রপিতামহের বাবা ভালোবেসে ওকে দিয়েছে- বিশ্বাস না করে উপায় নেই।
ইউসুফের সাথে আমার ঠিক কি কারণে বন্ধুত্ব হয়েছিল- ব্যাপারটা এখনও অজ্ঞাত। দীর্ঘদিন এ পথে আমার যাতায়াত। এই লোকটির চোখে আমার অনিয়ত দৃষ্টি পড়েছে বছরে অন্তত দুশো’টি দিন। এটা একটা কারণ হতে পারে। আবার এও হতে পারে আমিই সে বছরের একমাত্র জন যে, আগুন চাইতে গিয়ে ওর মত দিনহীনকে সেদিনের দাতা বানিয়ে দিয়েছি। ভাঙ্গা ইংরেজিতে ওর সাথে কথা বলতে গিয়ে ওর কণ্ঠের ম্রিয়তা বলে দিচ্ছিল- বহুকাল সে এ ভাষায় কিছু বলেনি।

– সারাদিন ধরে যে গান’টা গাও- এটা কোন ভাষায় গাওয়া গান ? কিছুই তো বোঝা যায় না।

ইউসুফ হাসে।

-দুই একটা ডাচ গান শিখে নিলেই পার। তোমার হ্যাট ভরে না উঠলেই, এখনকার মত খালি থাকবে না- নিশ্চিত।

ইউসুফ হাসে আবার। উদ্দেশ্যহীন সে হাসির মর্ম উদ্ধার করা দুরহ- ভীষণ।

ইউসুফ আবার ওর দুর্বোধ্য গান শুরু করেছে। কর্ণকুহরে সে গান বিষ ঢালার আগেই সরে পড়ার পরিকল্পনা ছিল। বাঁধ সাধলো বৃষ্টি। আকাশ তখন অঝোর ধারায় শহরের উপর ভেঙে পড়েছে। ঘোলা চারদিক। কান পাতলে দূর থেকে জলের ডাক ভেসে আসে।

স্টেশনের ছাউনির নীচে মিটার খানেক দূরে দাঁড়িয়ে ততক্ষণে ইউসুফ বিরক্তি ঢেলে চলেছে। ওর দুর্বোধ্য বিশ্রী গানটা থামলে কিছুটা সুখ পাওয়া যেত- সেটা হচ্ছে না। চোখেমুখে বিরক্তি লুকিয়ে রাখা আমার জন্য কঠিন ছিল। মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলাম। আঘাতের কোন উদ্দেশ্য যদিও’বা ছিল না, তবে ইউসুফ সেদিন কষ্ট পেয়েছিল। শিল্পীর কাছে তাঁর গান সন্তান। এই সন্তানের ভাল- খারাপ, বোধ্য- দুর্বোধ্যতা নির্বিশেষে তার শিল্পী বাবা- মা তাকে ভালোবাসবে। হয়েছিলও তাই। খেয়াল করলাম ওর চোখ এক সময় ছোট হয়ে আসছে। ঘোলা সে চোখের দৃষ্টি নিয়ে ষাটোর্ধ লোকটা সেদিন এগিয়ে আসে।

প্রিয় পাঠক, ঘোলাটে সেদিনের অনিয়ত মেঘ-বিকেলে এই বৃদ্ধ লোকটির একটি গল্প ছিল। গল্পের বাকী অংশটুকু তাঁর। আমরা সে গল্পের শ্রোতাসকল।

সাল ১৯৭০

শীতের শুরুর দিকের সাগরে যাওয়া জেলে নৌকাগুলো ফিরেছে একে একে। মার্চ পর্যন্ত চলবে- এভাবেই। প্রতিদিন ওদের জেলে পাড়ার কোন না কোন ঘর সন্ধ্যায় জেগে উঠছে বিপুল হুল্লোড়ে। উঠোনে আগুন জ্বালিয়ে ঘিরে আসা উৎসব চলছে মাঝরাত অবধি। নারকেলের পাতায় শিষ কেটে চলা বাতাস আর দূরের বাতিঘরের স্মিত আলো সে উৎসবের আলোতে ছায়া ফেলতে পারে না। স্বজন ফিরে আসার এ উৎসবের ডাক শোনা যায়- ভারত মহাসাগরের মাঝ থেকে।

কিন্তু কীভাবে যেন সে বছরের মাঝের দিকটায় হঠাৎ করে সব কিছু বদলে গেল। আমাদের বোকা স্বজনে’রা পুরো দেশ জুড়ে দুভাগে ভাগ হল। পাঁচটি দ্বীপজুড়ে যে মানুষগুলো এক, যাদের গায়ের রং এক, যাদের সবার কথাগুলো এক ঐকতানে সঞ্চারিত হয়ে সুর হয়ে উঠতো- এরাও পর্যন্ত বদলে গেল! প্রতিদিন আমাদের শহরগুলো থেকে তরুণে’রা হারিয়ে যাচ্ছে। কারা, কোথায়, কীভাবে হারিয়ে যাচ্ছে- কেউ তা জানে না। প্রতিদিন দু-একটা নিখোঁজ সংবাদ আমাদের দিনগুলোতে জড়িয়ে যায়। তবে এ নিখোঁজ সংবাদে আমাদের নিজেদের অধিকাংশ বোকা মানুষদের কিছু আসলো- গেল না। তারা ফরাসীদের সাথে থাকতে চায়। তারা নির্ভেজাল থাকতে চায়। কিন্তু সে সময়ের তরুণে’রা তো এমন ছিল না। তাঁদের চোখে প্রতিনিয়ত নীল ঢেউের নৈবদ্য খেলে বেড়ায়।

শহর থেকে হারিয়ে যাওয়াদের দলে একদিন আমিও ভিড়ে যাই। ফরাসীদের সাথে আমরা থাকতে চাই না। আমাদের বোকা লোকে’রা নিজেদের মতই থাকুক। ওদের স্বজনে’রা আবার যখন সাগর থেকে যখন ফিরে আসবে, তখন পুরনো আনন্দ ওদের ছোট্ট কুটিরগুলোতে ছড়িয়ে পড়ুক। ওরা জেগে উঠুক। ওদের উঠোনের সামনে প্রজ্বলিত আগুনের কুণ্ডলী রাতভর জ্বলুক- ঠিক আগের মত। মধ্যরাতের আকাশে আগুনের লাল রংটুকু ছড়িয়ে পড়ুক। নিজেদের টিকে থাকার ঘোষণা দিক। গির্জার ঘণ্টা সময়ে অসময়ে বেজে উঠলে, যদি ওদের বুক কাঁপে- তাহলে সে বেঁচে থাকার কোন মানে নেই।

জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে এক রাতে আমার বাড়ি ঘেরাও করে আমাদেরই একদল লোকে’রা- যাদের গায়ে’র ভিনদেশী সুগন্ধি পাঁজরে ভয় জাগায়। ওরা যখন আমাকে মায়োত্তি’র তীরে- বন্দরে দাঁড়িয়ে থাকা ফরাসী জাহাজে তুলে দেয়- ঠিক সেদিন আমি জেনেছিলাম, আমাদের তরুণে’রা কোথায় হারিয়ে যায়! কারা এদের তুলে নিয়ে মাঝ সাগরে ফেলে আসে!

জুলাই-৬, ১৯৭০।

গত কয়দিন অবিশ্রান্তভাবে জলের ডাক শুনেছি। সম্ভবত জাহাজের সবচেয়ে নিচের ডেকের স্যাঁতস্যাঁতে প্রকোষ্ঠে আমাকে রাখা হয়েছে। মাথা তুলে দাঁড়ালে ছাদে মাথা ঠেকে যায়। গুমোট অন্ধকারে অনুভূতিশূন্য এক-একটা দিন। খাবার জুটেছে দিনে একবেলা। কখনও সেটাও না। কোন এক রাতে হয়তো হাত- পা- চোখ বেঁধে আমাকে সাগরে ফেলে দেওয়া হবে। আমিই প্রথম না। ফরাসী’রা আমার আগেও আমার দেশের শত তরুণকে এভাবে সাগরে ডুবিয়ে মেরেছে। আসন্ন বিদ্রোহ ঠেকাতে গিয়ে গুলির অপচয় করার চেয়ে সাগরে ডুবিয়ে মারা’কেই ফরাসি’রা ভাল মনে করেছে। ফরাসীদের বুদ্ধি আমাকে চমকিত করে। কেউ জানছে না, কিন্তু একটা দেশের একটা প্রজন্ম ধীরে ধীরে সাগরে হারিয়ে যাচ্ছে!

মনে নেই ঠিক কবে- আমি আমার পাশে খুব পরিচিত কিছু শব্দগুচ্ছ খুঁজে পেলাম। জলের ডাক ছাপিয়ে সে শব্দগুলো রক্তে মিশে যেতে থাকে। সম্ভবত পাশে কিংবা উপরে কেউ আছে। ওর কমরোনিয়ান ভাষায় গাওয়া আমাদের খুব পরিচিত সেই গানটা ধীরে ধীরে আমার শিরদাঁড়াকে সচকিত করে।
-কেউ কি আছ? চিৎকার করে বলি।
খানিক নিস্তব্ধতা।
-কেউ কি আছ এখানে?
জবাব আসে, ওপর থেকে। কাঠের দেয়াল সে জবাবকে প্রায় খানিকটা স্তিমিত করে দেয়। শোনাই যায় না- এমন।
-তোমাকে এরা এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে। অদ্ভুত তো! ( হাসির শব্দ অনেকক্ষণ)
-তুমিও তো বেঁচে আছ।
-বেশিক্ষণ মনে হয় বেঁচে নেই। আজ রাতে আমাকে সাগরে ডুবিয়ে দেবে।
-কীভাবে জানলে?
– এরা সাগরে ফেলে দেবার আগে পায়ে শেকলটা খুলে দিয়ে, দড়ির বাঁধন দিয়ে যায়। আমার হাত- পায়ে এখন দড়ির বাঁধন।
কিছু বলার মত খুঁজে পাই না। বেশ খানিকক্ষণ আমাদের কোন কথা হয় না। এরপর ওপাশ থেকে আবার কথা ভেসে আসে।
-তোমাকে যখন এরা সাগরে ডুবিয়ে দেবে, তখন কিন্তু একদম ভয় পেও না। বাঁচার সুযোগ আছে!
আমি হেসে ফেলি। লোকটা ভীষণ বোকা।
-তুমি নিশ্বাস আটকে রাখবে কিছুক্ষণ। পানিতে দড়ির বাঁধন হালকা হয়ে গেলে, খুলে নিও। এরপর সাঁতরে তীরে চলে যাবে। বুঝেছ?
– তীর কি খুব কাছে?
-তুমি ভাবলে কাছে তো অবশ্যই!

আমাদের কথার এই পর্যায়ে হঠাৎ করে ফরাসী দ্বাররক্ষী’রা চলে আসে। পায়ের বাঁধন খুলে আমাকে জাহাজের ডেকে নিয়ে আসে ওরা। খানিক পড়ে আরেকজনকে আমার সামনে আনা হয়। দ্বিতীয় সে জনকে দেখে বড়সর একটা ধাক্কা খেলাম। নেহাত কিশোর বয়সী একটা ছেলে, যার অপরিণত হাতে শেকলের দাগ এখনও ভীষণ স্পষ্ট। বিশ্বাস করতে পারি না, এই ছেলেটাই আমাকে এতোক্ষণ সাগরে ফেলে দেওয়ার পর, কীভাবে বেঁচে থাকা যায়- সেই ব্যাপারটা শেখানোর চেষ্টা করছে। ছেলেটার চোখের গভীরতার কাছে সাগরকে আমার অগভীর মনে হয়।

সামনা- সামনি আমরা দুজন। আমাদের ঘিরে ফরাসী কারারক্ষী’রা সবাই ঘিরে দাঁড়িয়ে। আমার সাথে ছেলেটির কি কথা হয়েছে, সে ব্যাপারে ওরা জানতে চায়। ফরাসীদের ধারণা হয়েছে- আমরা দুজন মিলে গোপন বিদ্রোহের ছক কেটেছি। তাই আমরা এতোক্ষণ কি কথা বলেছি, সেটা ওদের জানা চাই। আমি কথা শুরু করার আগেই, ছেলেটা কথা শুরু করে।

ওর সাথে আমার কথা হল জেলে পাড়া নিয়ে। বিকেলের আলো গায়ে মেখে যে কিশোরীদের দল খিলখলিয়ে হাসে- তাদের নিয়ে। সন্ধ্যা বেলা যে ধুপের গন্ধে আমাদের জনপদের প্রতিটা ঘরে শুদ্ধ হবার মাদকতা ছড়িয়ে দেয়- সেটা নিয়ে। কোকো আর জলপাই বাগানের দিন মজুরদের নিয়ে। শহরের একমাত্র পানশালাটি নিয়ে। শহরময় ঘুরে বেড়ানো পাগল- এক সময়ের নাবিক ইয়ন’কে নিয়ে। রাত করে বাড়ি ফেরা যুবকদের নিয়ে। তাঁদের স্বপ্ন নিয়ে। বসন্তের শুরুতে আমাদের যে নৌকোগুলো আবার সাগরে যাবে- সেসব নিয়ে। আমাদের অসম্ভব সরল এক-একটা দিন নিয়ে। রাত নিয়ে। আলো নিয়ে। আঁধার নিয়ে। উৎসব নিয়ে। জীবন নিয়ে। ভালোবাসা নিয়ে।

আমরা খেয়াল করলাম- আমাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা ফরাসী’রা হতবিহবল হয়ে পড়েছে। ওদের চোখে আমরা ভীষণ ভয় ধরিয়ে দিয়েছি। ওরা আমাদের কথা একদমই বুঝতে পারেছে না। চাইলেই এখন যা ইচ্ছা বলতে পারি। হাজারো পরিকল্পনা আর গোপন সব নকশা আমাদের ভাষাতেই আঁকতে পারি।

নিজেদের ভাষায় বলা আমাদের ভীষণ সরল- বিদ্রোহহীন কথাগুলো যে কী ভয়ংকর ক্ষমতা ধারণ করে- সেটা আমি সেদিনই প্রথম টের পাই। আমরা বিচলিত হই না মোটেই। যেকোন মুহূর্তে আমাদেরকে হয়তো সাগরে ফেলে দেওয়া হবে। আসন্ন মৃত্যুকে পায়ে ঠেলে দিয়ে সেদিন নেহাত কিশোর বয়সী একটা ছেলের অদ্ভুত পাগলামিতে মেতে উঠলাম। কথার পর, কথা বলে যাচ্ছি। আমাদের কথা যেন শেষই হয় না। একটা কথার পর ধূমকেতুর বেগে দ্বিতীয় কথা আমাদের কণ্ঠে জড়িয়ে যায়। কথা যত বাড়ে, ফরাসী’রা তত ভয় পেয়ে যায়। নিজেদের ভাষায় বলা আমাদের খুব সাধারণ কথাগুলো ওদের বুক কাঁপিয়ে দিচ্ছিল। একটা সময় খেয়াল করলাম- সাগরের বিশাল সব গর্জন আমাদের কান পর্যন্ত পৌঁছুতে পারছে না। নামহীন এক আবেশে জড়িয়ে ফেলছে, আমাদের প্রতিটি শব্দ, এক- একটা ধ্বনি।

ফরাসী’রা অদ্ভুত এই স্নায়ুর যুদ্ধ খুব বেশিক্ষণ চালাতে পারেনি। এক সময় এরা হেরে গেল। ছেলেটাকে এরা ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে দেয়। ছেলেটার শেষ কথাটা আমার আর শোনার সুযোগ হল না। অতলে তলিয়ে যাবার আগে শেষবারের মত ওর মুখটা একবার দেখার সুযোগ হল। অবাক হয়ে খেয়াল করলাম- ওর কথা তখনও শেষ হয়নি।

সেদিন ছেলেটাকে ফরাসী’রা সাগরে ফেলে দিয়েছিল। কারণ ওকে বাঁচিয়ে রাখাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছিল না। ওর বয়সী কাউকে নির্মাণ শ্রমিক বানানো যায়না। আমি বেঁচে গেলাম। বয়স আমাকে বাঁচিয়ে দিল। নির্মাণ শ্রমিক হিসাবে নতুন ঠিকানা হল- প্যারিস।

পৃথিবীতে এখনও যে অল্প কিছু সংখ্যক দেশে ফ্রেঞ্চ আধিপত্য বজায়ে আছে- আমার দেশ সে অল্প কিছু দেশের মাঝে একটা। হয়তো সেদিনের সে ছেলেটা, অথবা তাঁদের মত আরও যারা সাগরে হারিয়ে গিয়েছে- এরা থাকলে ব্যাপারটা অন্য রকম হতে পারতো। সে সুযোগ আমাদের হয়নি। কমোরিয়ান ভাষার যে গানটা তুমি প্রতিদিন এ পথে যাওয়ার সময় শুনে থাকো, সে গানটা আমার দেশে এখন আর যদিও’বা গাওয়া হয় না; কিন্তু এই গানটা আমি যখন গাই- তখন সে প্রজন্মের সবাই আমার চারপাশে ভিড় করে। তুমি হয়তো বিশ্বাস করবে না, কিন্তু এখানে নতুন একটা দেশ তৈরি হয়।

ইউসুফ ওর গল্পটা শেষ করে।

ততক্ষণে আঁধার নেমে এসেছে। সন্ধ্যা মিলিয়েছে অনেকটা সময় হল। আমার বাড়ির ফিরতি পথের তাড়া ছিল। সাইকেল ঘুরিয়ে বাড়ির পথ ধরার আগে শেষবারের মত ইউসুফের দিকে একবার চোখ পড়লো। অন্যসব দিনের মত স্বাভাবিক সব কিছু। ও ওর মত গান গাচ্ছে। মাঝ রাত পর্যন্ত এ গান চলবে। একই গান ঘুরে ফিরে বার বার। শেষ রাতের বাড়ি ফেরা’রা কেউ কেউ ভীষণ অবজ্ঞাভরে ওর দিকে তাকাবে। আমি নিশ্চিত সে গান কাউকে ছুঁয়ে যেতে পারবে না।

এই শহরের কেউ জানবে না, কীভাবে শহরের মাঝে একটা দেশের জন্ম হয়।

৩,৫০২ বার দেখা হয়েছে

২১ টি মন্তব্য : “জলের ডাক।”

  1. মোকাব্বির (৯৮-০৪)

    না দেখে থাকলে ব্যাটল অফ আলজিয়ার্স বইটা দেখে নিতে পারো। ফরাসি উপনিবেশের আরেকটি গল্প। তোমার গল্পটা পড়ার সময় হারিয়ে যাচ্ছিলাম বিভিন্ন অংশ কল্পনা করতে। ভারত মহাসাগর, ফরাসী কলোনি হিসেব মিলিয়ে মাদাগাস্কারের নাম মাথায় আনতে সময় লেগেছে বেশ কিছুক্ষণ। প্রিয়তে যোগ হলো। :boss:


    \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
    অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

    জবাব দিন
  2. সামিউল(২০০৪-১০)

    সিদ্দিক ভাই, বরাবরের মতই অসাধারণ। পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল কেমনে...............

    এই শহরের কেউ জানবে না, কীভাবে শহরের মাঝে একটা দেশের জন্ম হয়


    ... কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!

    জবাব দিন
  3. সানি রবিউস সানি (২০০৪-২০১০)
    "শীতের শুরুর দিকের সাগরে যাওয়া জেলে নৌকাগুলো ফিরেছে একে একে। মার্চ পর্যন্ত চলবে- এভাবেই। প্রতিদিন ওদের জেলে পাড়ার কোন না কোন ঘর সন্ধ্যায় জেগে উঠছে বিপুল হুল্লোড়ে। উঠোনে আগুন জ্বালিয়ে ঘিরে আসা উৎসব চলছে মাঝরাত অবধি। নারকেলের পাতায় শিষ কেটে চলা বাতাস আর দূরের বাতিঘরের স্মিত আলো সে উৎসবের আলোতে ছায়া ফেলতে পারে না। স্বজন ফিরে আসার এ উৎসবের ডাক শোনা যায়- ভারত মহাসাগরের মাঝ থেকে।"

    সত্যি কথা বলতে কি, সুনীল বা হুমায়ূন, দুজনের লেখার চেয়ে অনেক অনেক বেশি জীবন্ত মনে হল এই লেখাটাকে।

    ::salute::


    ওকে

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।