পঁচিশ বছর পর …

(কিছুদিন আগে আমার স্বামীর ব্যাচের (বুয়েট-৮৭) রজত জয়ন্তী ছিল। সেই উপলক্ষ্যে এই নাটকটি লিখেছিলাম। অবশ্য নাটকের পাত্র-পাত্রী আপা এবং ভাই তাদের ব্যাচের মতো করে স্ত্রীপ্টটি বদলে নেন।)

দৃশ্য – ১

চারজন ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে হাতে চারটা পোস্টার হাতে নিয়ে মন্চের এ’মাথা থেকে ও’মাথা পররয্ন্ত যাবে। তারা চলবে তালে তালে। পেছনে মিউজিক বাজতে থাকবে। পোস্টারের মধ্যে লেখা থাকবেঃ
১। আর্কির চিপার চোথা
২। অটোঃ ক্রিকেট ফাইনালের সময় পরীক্ষা স্বৈরাচারী মনোভাব
৩। কমান্ডো লেকচারার পরীক্ষায় খালি বাঁশ মারে
৪। পিএল, নাইটফাইট, জিআরই আর ১০১ টা পড়ন্ত চুল

স্থানঃ ক্যাফের সামনে।
সময়ঃ ১৯৮৮
পাত্র-পাত্রীঃ সোমা আর সুমন

সোমা বসে আছে। সুমন এসে পাশে বসবে।
সুমনঃ কয়টা বাজে?
সোমাঃ তোর ঘড়ি নাই?
সুমনঃ আছে। তবে সময় দেখতে ইচ্ছে করছে না। শুনতে ইচ্ছে করছে।
সোমাঃ আসল কথা হলো আমার পাশে বসে কিছুক্ষণ গ্যাজাতে চাচ্ছিস।
সুমনঃ খারাপ কি? তোরও কিছুটা সময় ভালো কাটবে। আমারও।
সোমাঃ সময় হচ্ছে ত্রিশ মিনিট। বাস ছাড়তে মামু এক মিনিটও দেরী করে না।
সুমনঃ যা ভেবেছিলাম তার থেকেও তোর আইকিউ ভালো। গ্যাজানোর ডিউরেশনটা জানতে চাচ্ছিলাম। সময়টা নয়। ত্রিশ মিনিট হচ্ছে পারফেক্ট টাইম। শেষ হইয়াও শেষ হইলো না – এরকম একটা আমেজ নিয়ে দু’জনার পথ দু’টি দিকে বেঁকে যাবে। মানে দুইটি ভিন্ন বাসে উঠে পড়বো।
সোমাঃ তারপর বাসে উঠে রুমার পাশে বসে গল্প শুরু করবি। তাই না? তোর টাংকিবাজী স্বভাবটা গেল না।
সুমনঃ টাংকিবাজীকে খারাপ ভাবে নিচ্ছিস কেন? আমার তো মনে হয় বিষয়টা খুব হেলথ্দি এব্ং ম্যানলি। এর জন্য মাঝে মাঝে নিজেকে মাসুদ রানা বলে মনে হয়।
সোমাঃ যার পদে পদে বিপদ কিন্তু শেষ পররয্ন্ত ঠিকই সব মিশনে সফল হয়। তা তোর এবারের মিশনটা কি?
সুমনঃ অনন্তঃ তুই না।
সোমাঃ আমার হতে বয়েই গেছে (অভিমানের সুরে)। বাই দ্যা ওয়ে আমি না কেন?
সুমনঃ কারণ আমি এখনও তোর থার্ড চয়েস। তুই প্রথমে দুইটা ভ্যার্চ্যুয়াল ছ্যাক খাবি তারপর আমার কাছে আসবি।
সোমাঃ তুই জানলি কি করে? রুমা বলছে নিশ্চয়। রুমাটা আস্ত একটা বেঈমান।
সুমনঃ রুমা বলতে যাবে কেন? ডাস্টার স্যারের ক্লাসে ডাস্টার ছুঁড়ে মারার দিকে যেভাবে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকিস তা থেকে কি কিছু বোঝা যায় না?
সোমাঃ আস্তে বল। ডাস্টার ছোঁড়ার কথা শুনলে অন্য ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্টরা কী মনে করবে? ওরা তো আর দেখতে পারছে না স্যার কি আর্টিস্টিক ভাবে ডাস্টারটা ছুঁড়ে মারে। গায়ে লাগে, কিন্তু কোন ব্যাথা লাগে না।
সুমনঃ তোর আর্টিস্টিক জ্ঞান নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ হচ্ছে। কিছুক্ষণ আগে ক্যাফের সামনে ক্রিকেট খেলায় আমার ঘুগলি থ্রো গুলি যদি দেখতিস তাহলে আর্ট কাকে বলে বুঝতিস।
সোমাঃ আমাকে এতো পটাতে চাচ্ছিস কেন? আমি কি তোর ফার্স্ট চয়েস নাকি?
সুমনঃ আমরা ছেলেরা অবশ্য ফিলিপ’স টপ’টেন লিস্ট নিয়ে ঘোরাফেরা করি। এই লিস্টের মধ্যে আইটেম নাম্বারগুলো সবসময়ই আপ-ডাউন হচ্ছে। তবে তুই লিস্টে আছিস। এটা শুধু বলতে পারি।
সোমাঃ প্রেম-ভালবাসা এই সব সংবেদনশীল রোমান্টিক অনুভূতিকে কিরকম নাম্বারের মধ্যে নিয়ে আসছিল। না, তুই খুবই স্থূল মনের মানুষ।
সুমনঃ ম্যাডাম, নাম্বারিং কিন্তু আপনিও করছেন। শুধু আমি করলেই দোষ! মেল শভেনিস্ট পিগ, পুরুষবাদী। ইত্যাদি, ইত্যাদি। আর তাছাড়া আমরা হবু ইন্জিনিয়ার। চাকরিতে কাস্ট্মার আমাদের কাছে সবসময় নাম্বার শুনতে চাইবে।
সোমাঃ তোর শেষ যুক্তিটা গ্রহণযোগ্য। তাই তোর স্থূল চিন্তাভাবনাকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখলাম। আপেক্ষিক তত্ব না বুঝেও ই ইক্যুয়ালটু এম*সি*স্কয়্যার জানা থাকলে অংক মেলানো যায়। আর চোথা কমন পড়লে তো কথাই নেই।
সুমনঃ একদিন কবিতাও নাম্বার দিয়ে লেখা হবে। এই চলটা এখন শুরু হলে সাব্বিরের হাত থেকে বাঁচতাম।
সোমাঃ সাব্বির কি দোষ করলো?
সুমনঃ সমস্যা হলো সাব্বিরের আমার রুমমেট। প্র্তিদিন একটা করে কবিতা লেখে। আর ভাব নিয়ে বলে যে ইন্জিনিয়ারের থেকে কবি পরিচয়ে সে বেশি গর্ব বোধ করে। আমি তাকে বলি যে ঢাকা শহরে দু’টো ঢিল ছুঁড়লে একটা কবি আর আরেকটা কাকের মাথায় পরবে।
সোমাঃ কথাটা মোটেই পছন্দ হলো না। আমি কিন্তু মাঝে মাঝে কবিতা লিখি।
সুমনঃ আমিও কাকদের পছন্দ করি।
সোমাঃ কোনটা বেশি পছন্দ? ওদের কা কা ডাক না ডাস্ট্বিনের পাশে ঘুরে বেড়ানো?
সুমনঃ কাকদের আসলে আমার এই দেশের জনগনের মতো মনে হয়। কষ্টটা ওরা করবে কিন্তু সব প্রশংসা কোকিলদের।
সোমাঃ আসলেও কি কাক কোকিলের ডিমে তা দেয়?
সুমনঃ জানি না।
সোমাঃ এই প্র্শ্নের উত্তরটা বোধহয় নাম্বার দিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়।
সুমনঃ মনে হচ্ছে।
সোমাঃ তাহলে কবিতাও টিকে থাকবে। ম্যাট্রিক্স হয়ে যাবে না।
সুমনঃ হয়তবা।
সোমাঃ ত্রিশ মিনিট শেষ। মামু ডাকছে।
সুমনঃ হয়ত এমন এক্দিন আসবে সেখানে নাম্বার বলে কিছু থাকবে না। সময় অফুরন্ত। কোন ত্রিশ মিনিটের ব্যারিয়ার নেই।
সোমাঃ হয়তো। এখন বিদায় বন্ধু।

দৃশ্য – ২
চারজন ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে হাতে চারটা পোস্টার হাতে নিয়ে মন্চের এ’মাথা থেকে ও’মাথা পররয্ন্ত যাবে। তারা চলবে তালে তালে। পেছনে মিউজিক বাজতে থাকবে। পোস্টারের মধ্যে লেখা থাকবেঃ
১। মিড্লাইফ ক্রাইসিস
২। ফেসবুক টাইমপাশ ঃ) ফেসবুক স্টক ঃ(
৩। পে-চেক, সুপারভাইজার, মর্ট্গেজ
৪। স্ট্রেস, ডিপ্রেশন, মেদ-ভূঁড়ি কি করি

স্থানঃ স্যান ফ্র্যানসিসকো এয়ারপোর্ট।
সময়ঃ ২০১৩
পাত্র-পাত্রীঃ সোমা আর সুমন

সুমনঃ আমাদের আবার কতো বছর পর দেখা হলো?
সোমাঃ আমাদের প্রথম দেখা হয়েছিল পঁচিশ বছর আগে। আগস্টের দশ তারিখ।
সুমনঃ শেষ দেখা বোধহয় বিশ বছর আগে।
সোমাঃ অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে আমাদের সবসময় স্টপেজে দেখা হয়। বুয়েটে থাকতে দেখা হতো বাস স্টপেজে। আজকে এয়ারপোর্টে।
সুমনঃ কয়টা বাজে?
সোমাঃ মিটিং ডিউরেশন মাত্র ত্রিশ মিনিট। তারপরই আমাকে বোডিং পাস নেওয়ার জন্য উঠতে হবে।
সুমনঃ আচ্ছা আমাদের কোন এজেন্ডা ছিল?
সোমাঃ কাকতলীয় মিটিঙ্গে কোন এজেন্ডা থাকে না। তোর কথা, তোমার বউ-বাচ্চার কথা দিয়ে শুরু করতে পারিস।
সুমনঃ আমি ভালো আছি। নো কোরেস্টরেল, নো ব্লাড প্রেসার এন্ড নো সুগার। আর ছেলেমেয়ে-বৌএর কথা হলো প্রথমটা কখনই ছিল না, পরেরটা ছিল কিন্তু এখন নেই। তোর খবর কি।
সোমাঃ তোরই মতো। ভাল আছি এব্ং একা। না, ঠিক একা নই। আসলে আমিই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড কিনা, তাই ঠিক একাকীত্বটা অনুভব করি না। আচ্ছা থাক, এই এজেন্ডা এখানেই শেষ। নেক্স্ট কি?
সুমনঃ কাজ কেমন যাচ্ছে?
সোমাঃ ব্য্স্ত। আগের চাকরিটা বদলালাম। ঠিক বদলালাম বললে ভুল হবে। অফিসে লাল বাতি জ্বলতে শুরু করেছিল। কয়েক ধাক্কা পররয্ন্ত টিকে ছিলাম। তারপর লে-অফের কোপে পড়লাম।
সুমনঃ ইকোনমিক ডাউন টার্মে মনে হয় আমাদের হৃদয়টাকে নিয়ে স্টীম রোলার খেলা করছে।
সোমাঃ চাকরি না থাকলে রিটার্মেন্ট, ক্রেডিট কার্ডের বিল আর বাড়ির মর্টগেজের কি হবে? সেভিংসে হাত দিতে হবে।
সুমনঃ স্ট্ক মার্কেটটাও বড্ড বেশি ভোলাটাইল। এপল কিনলে গুগল বাড়ে। আর গুগল কিনলেই তা সুর সুর করে কমতে থাকে।
সোমাঃ আমি তো ফেসবুক কিনে ধরা।
সুমনঃ তবে জুকারনাইন একটা জিনিষ বানিয়েছে বটে। গতরাতে এক ঘন্টার নোটিসে তোকে খুঁজে বের করলাম।
সোমাঃ ফেসবুক তো জুকারনাইনের একটা চোথা মারা প্রজেক্ট। অনেকটা বিল গেটস আর স্টিভ জবেসর মতো। তুই কি এখন আগের কোম্পানিতেই আছিস?
সুমনঃ হু, তবে প্রায়ই ট্র্যাভেলের মধ্যে থাকতে হয়।
সোমাঃ আচ্ছা চাকরি-বাকরি বিষয়-আশয় ছাড়া আমাদের কি আর কোন কথা বলার টপিক নেই?
সুমনঃ আসলে আমাদেরকে এখন ঐসব বিষয়গুলোই নিয়ন্ত্রণ করে। একটা সময় লাটাই হাতে ঘুড়ি উড়াতে চাইতাম। এখন নিজেই ঘুড়ি হয়ে গেছি।
সোমাঃ তাই হবে। এখন আর মনে করতে পারি না আগে কিভাবে কথা বলতাম।
সুমনঃ আগে আমাদের কোন এজেন্ডা থাকতো না। কাক কিম্বা কবিতা যে কোন জায়গা থেকে কথা শুরু করে টাইম মেশিন কিম্বা ম্যাট্রিক্স দিয়ে শেষ করতে পারতাম।
সোমাঃ ত্খন তুই ভাবতি কবিতা মাট্রিক্স হয়ে যাবে। তা কিন্তু হয়ে যায়নি। তবে কবিতারা এখন হলমার্কের গায়ে সেঁটে গিয়ে ভালই বিক্রয়যোগ্য পণ্য হয়ে গেছে।
সুমনঃ আর আমরা হয়ে গেছি ম্যাট্রিক্স। গাড়ির সংখ্যা, বাড়ির সংখ্যা, পে-চেক, কোম্পানি পজিশন – এরকম কতগুলো সংখ্যা আমাদের পরিচয় গ্রাস করছে।
সোমাঃ আমরা এখন য্ত্র-তত্র আমাদের কথা বলার টপিক্গুলো বদলে ফেলতে পারিনা।
সুমনঃ কিম্বা কবিতা নিয়ে আর ফাজলামী করি না।
সোমাঃ কেন?
সুমনঃ কেন?
সোমাঃ বোধহয় আমাদের এখন সময়মতো বোডিংপাশ হাতে নিয়ে রিপোর্ট করার তাড়া থাকে।
সুমনঃ তোর বোডিঙ্গের সময় কখন জানি?
সোমাঃ জানি না।
সুমনঃ গুড অ্যানসার। মাঝে মধ্যে কিছু জানতে না চাওয়া আমাদের মনে করিয়ে দেয় সময় আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে না বর ং আমরা সময়কে নিয়ন্ত্রণ করি।

(মিউজিক)

৩,৬২২ বার দেখা হয়েছে

১৮ টি মন্তব্য : “পঁচিশ বছর পর …”

  1. রায়হান

    সত্যি লেখাটা পড়ে মনে হল আমি যেন নাটক দেখতেসি । এত অসাধারণ ! আপনার অনেক লেখা আমার ভাল লাগে । কেন জানি না কমেন্ট করতে সংকোচ হয় । তবু এই সুযোগে আপনার লেখা যে ভাল লাগে তা জানাতে পেরে ভালোয় লাগসে ।

    জবাব দিন
  2. সামিয়া (৯৯-০৫)

    লেখাটা পড়ে মজা পাইছিলাম আপা। অন্য কোনখান থেকে জানি পড়সিলাম, পরে কমেন্ট করতে গেসি ভুলে। আজকে হঠাৎ ব্লগে আপনাকে দেখে মনে পড়লো। তবে আমার কক্ষণো এইরকম অবস্থা হবে না আশা করি, মূল কারণ আমি প্রচন্ড অলস। 😀 তাই চাকরি কখনই আমাকে খেতে পারবে না। আমি প্রচন্ড ভাবে বিশ্বাস করি, দেখি বিশ বছর পরে কি হয়। B-)

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।