জিজিনহোঃ ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের বিস্মৃত কিংবদন্তী

নান্দনিক ও ঐতিহ্যময় ফুটবলের দেশ ব্রাজিলের সর্বকালের সেরা খেলোয়াড় পেলেকে যিনি মহানায়ক হবার ব্যাপারে অনুপ্রাণিত করেছেন তিনি হলেন জিজিনহো। আর এটা তাঁরই গল্প!

“জিজিনহো হয়ত পেলের চেয়ে শ্রেয়তর ছিল না, তবে খুব বেশি পিছিয়েও ছিল না!”
-ফ্ল্যাবিও কস্তা, ব্রাজিল কোচ, ১৯৫০ বিশ্বকাপ।

ব্রাজিলের কথা উচ্চারিত হলে প্রথমেই আমাদের মনে হয় ফুটবলের কথা, এরপর তাদের ফুটবল পাগল ভক্তদের কথা যারা প্রতিটি ম্যাচ ঘিরেই উৎসবের আবহ তৈরি করে ফেলে এবং মনে পড়ে দেশটির সোনার ছেলেদের কথা, যারা হলুদ জার্সি পড়ে গত প্রায় একশ বছর ধরে বিশ্ব ফুটবলে অভাবনীয় দাপটের সাথে খেলে চলেছে।

পেলে, গারিঞ্চা, ডিডি, ভাভা, জর্জিনহো, কার্লোস আলবার্তো, টোস্টাও, রিভেলিনো, জিকো, সক্রেটিস, ফ্যালকাও, রোমারিও, বেবেতো, কাফু, রবার্তো কার্লোস, রিভাল্ডো, রোনাল্ডো, রোনাল্ডিনহো, কাকা প্রমুখ…প্রমুখ…লিস্টটি এত বড় যে সবার নাম লেখার জায়গা এখানে হবে না! আমাজন নদীর পানিতে সিক্ত এবং সবুজে ঘেরা দেশটি একজন বা দু’জন নয়, অগণিত ফুটবল তারকার জন্ম দিয়েছে। যা অন্য কোন দেশ কল্পনাও করতে পারবে না!

তাঁদের একজন হচ্ছেন টমায সোয়ারেস দা সিলভা, অবশ্য তিনি জিজিনহো নামেই বেশি পরিচিত। পেলে, গারিঞ্চার আগে এবং লিওডিনাস দা সিলভা’র পর তিনিই ছিলেন ‘কানারিনো’দের সবচেয়ে বড় তারকা।

শুরুর কথা

১৯৩৯ সালে রিও ক্লাবের একটি প্র্যাকটিস ম্যাচে দশ মিনিটের মাথায় তারকা খেলোয়াড় লিওডিনাস এর বদলে মাঠে নামলেন কিশোর জিজিনহো। ম্যাচে তিনি দুই গোল করেন এবং ক্লাবের পেশাদার খেলোয়াড় হিসেবে চুক্তিবদ্ধ হন। সেই থেকে শুরু, এরপর পুরো ’৪০ এর দশক তিনিই ছিলেন রিও’র মধ্যমণি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফিফা ১৯৫০ সালের বিশ্বকাপের জন্য ব্রাজিলকে মনোনীত করে। ততদিনে জিজিনহো হয়ে উঠেছেন আরও পরিণত-শারীরিক, মানসিক এবং ফুটবল নৈপুণ্যের দিক দিয়ে। স্বাগতিক হবার কারণে পুরো ব্রাজিল প্রথমবারের মত বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন দেখা শুরু করে। অবধারিতভাবে তাদের স্বপ্নের জাল বোনা শুরু হয় জিজিনহোকে ঘিরেই। অবশ্য তিনি ছিলেন না, দলে ছিল এডেমির, জাইর, ব্যালথাজার, জুলিনহো এবং আরও অনেকে- প্রত্যেকেই দুর্দান্ত ফাস্ট, অ্যাক্রোব্যাটিক এবং অবশ্যই হাসি-খুশি মেজাজের আমুদে ফুটবলার।

ফুটবল বিশ্বকাপ, ১৯৫০

মেক্সিকোকে ৪-০ গোলে হারিয়ে টুর্নামেন্টে ব্রাজিল উড়ন্ত সূচনা করে। নানা কারণে বিতর্কিত পরের ম্যাচটি ছিল সুইজারল্যান্ডের সাথে, যা ড্র হয়। গ্রুপের মহা গুরুত্বপূর্ণ শেষ ম্যাচ ছিল শক্তিশালী যুগোস্লাভিয়ার সাথে। কারণ নিয়ম ছিল গ্রুপ থেকে মাত্র একটি দল পরের রাউন্ডে যাবে। এবং প্রতি গ্রুপের একটি করে মোট চারটি দল পরের রাউন্ডে একে অপরের সাথে রাউন্ড-রবিন লিগ পদ্ধতিতে মোকাবেলা করবে। সব খেলা শেষে যার পয়েন্ট বেশি থাকবে সে-ই হবে জুলে রিমে ট্রফি জয়ী।

যুগোস্লাভিয়ার সাথে জিজিনহো নিজের জাদুকরী ফুটবল-শৈলী প্রদর্শন করলেন। মধ্যমাঠের নেতৃত্বে তো ছিলেনই, উপরন্তু উপরে উঠে গোলের সুযোগও তৈরি করতে লাগলেন। শুধু তাই নয়, নিজেও গোল করলেন। ব্রাজিল ম্যাচ জিতে নিলো ২-০ গোলে এবং গ্রুপের শীর্ষস্থান দখল করে পরের রাউন্ডে উত্তীর্ণ হল।
চূড়ান্ত পর্বে ব্রাজিল আরও অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠল। জিজিনহো পুরো মাঠ-জুড়ে যেন উড়ে বেড়াতে লাগলেন! মনে হচ্ছিল ৩-২-৩-২ ফরমেশনটির জন্মই হয়েছিল তাঁর খেলার স্টাইলের কারণে! রাউন্ড-রবিন লিগের প্রথম ম্যাচে তাঁরা সুইডেনকে উড়িয়ে দিল ৭-১ ব্যবধানে। স্ট্রাইকার এডেমির একাই ৪ গোল করলেন! বলা বাহুল্য বেশিরভাগ এসিস্ট ছিল জিজিনহো। পরের ম্যাচে স্পেনের বিরুদ্ধেও সেই ধারা অব্যাহত রইল। এবার এডেমির, জাইর এবং চিকোকে গোল করানোর পাশাপাশি নিজেও গোল করলেন। ফলাফল- সাম্বা বাহিনী ম্যাচ জিতল ৬-১ ব্যবধানে!

মারাকানায় হৃদয়-ভঙ্গ

ব্রাজিল এবং জিজিনহোকে অজেয় মনে হচ্ছিল। সবাই ধরেই নিয়েছিল এই দলকে হারানো কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। কিন্তু উরুগুয়ের মনে ছিল অন্য কথা। শেষ খেলায় উরুগুয়ের বিরুদ্ধে ব্রাজিলের দরকার ছিল শুধুই ড্র করা, তাহলেই তারা প্রথমবারের মত জুলে রিমে কাপে বিজয়ীর হাত রাখতে পারত। এস্তাদিও দো মারাকানা অর্থাৎ রিও ডি জেনেরো স্টেডিয়ামে রেকর্ড সংখ্যক দর্শকের (১৯৯, ৮৫৪ জন!) সামনে উরুগুয়ের গিজিয়া লক্ষ কোটি ব্রাজিলিয়ানের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিলেন, তাঁর গোলে ভর করেই উরুগুয়ে ম্যাচটি ২-১ ব্যবধানে জিতে নেয়!ম্যাচ শেষে কিছু দর্শক তো আত্মহত্যাই করে বসল, কয়েকজন শিকার হল প্রাণঘাতী হার্ট এটাকের!এত কিছুর মধ্যে দিয়ে উরুগুয়ে দ্বিতীয়বারের মত জুলে রিমে জিতে নিলো!

জিজিনহো চোখের পানিতে স্টেডিয়াম থেকে বিদায় নিলেন।
বাকি সবার মত তিনিও ছিলেন ভগ্ন হৃদয়ের জিন্দা-লাশ।

অনুপ্রেরণা

সেদিনের ম্যাচটির পর সাও পাওলো শহরে একজন মধ্যবয়সী মানুষ চোখে জলভরা অবস্থায় রেডিও সামনে থ মেরে বসে ছিলেন। তাঁর নয় বছরের ছেলে জড়িয়ে ধরে বলেছিল ‘বাবা, কথা দিচ্ছি একদিন আমি ব্রাজিলের জন্য বিশ্বকাপ জিতে আনব!’ ছেলেটির নাম ছিল এডসন আরান্তেস দো নাসিমেন্তো, যাঁকে সারা বিশ্ব পরবর্তীতে পেলে নামে চিনেছে। নয় বছরের কিশোর ছেলেটি জিজিনহোকে দেখেই পেশাদার ফুটবলার হবার অনুপ্রেরণা পেয়েছিল এবং উপরের ঘটনার আট বছর পর ঠিকই সে তাঁর কথা রেখেছিল। মারাকানোর দুঃসহ স্মৃতি এবং জিজিনহো ছিল পেলে এবং পেলের মত শত শত ফুটবলারের সামনে এগোবার অনুপ্রেরণা।

পেলে বলেছেন, “অন্য যে কারো চেয়ে জিজিনহো-কেই আমি আইডল মানতাম। তাঁর পাসিং, শুটিং এবং পজিশনিং ছিল ‘ভয়ঙ্কর’ সুন্দর! তিনি ছিলেন পরিপূর্ণ ফুটবলার। মধ্যমাঠ, আক্রমণভাগ কিংবা রক্ষণভাগেও খেলতে পারতেন। দুর্দান্ত হেড করতে পারতেন এবং ড্রিবলিং এ তাঁর চেয়ে ভাল খুব কমই ছিল। এসবের পাশাপাশি দলের প্রয়োজনে রাফ খেলতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধা করতেন না!”

ফিফা ডট কম এর মতে, জিজিনহো ভক্তগণ অনেকেই তাঁর সম্পর্কে লিখতে গিয়ে কবিতা এবং ছন্দের আশ্রয় নিত। ব্যাপারটা এমন যে তিনি কোন খেলোয়াড় নন বরং শিল্পী ছিলেন! দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে জিজিনহোর কোন ভিডিও ফুটেজ নেই। ফলে, তাঁকে স্মরণ করার জন্য তাঁর কীর্তি এবং ভক্তদের প্রশংসা বাণীই আমাদের একমাত্র সম্বল!

সম্ভবত ভিডিও ফুটেজ না থাকার কারণেই তিনি ফুটবলের ইতিহাসে তেমন জায়গা করে নিতে পারেন নি!

বিস্মৃত নায়ক

সবচেয়ে বড় কথা তিনি বিশ্বকাপ জিততে ব্যর্থ হয়েছিলেন এবং এমন একটি দলের অংশ ছিলেন যারা আজ পর্যন্ত ট্র্যাজিক হিরো নামেই অবিহিত করা হয়। ব্রাজিলিয়ান মানুষ ফুটবল পাগল হলেও তাঁরা বিজিতদের চেয়ে বিজয়ীকেই বেশি সম্মান করে, তাঁদের পূজো করে। আর এ কারণেই ১৯৫০ সালের প্রায় সর্বজয়ী দলকে কেউ মনে রাখে নি।

তবে, জিজিনহো কিছুটা ভাগ্যবান যে সাধারণ মানুষ তাঁকে খুব একটা দোষারোপ করে নি যতটা করেছে দলের গোলকিপার বারবোসা এবং রক্ষণভাগের খেলোয়াড়দের। তবুও জীবনের বড় একটি সময়-জুড়ে তিনি প্রতি বছর ১৬ জুলাই বাড়ির টেলিফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাখতেন। কেননা, সেদিন অনবরত তাঁর বাড়িতে ফোন আসত এবং সবাই জিজ্ঞাসা করত কেন ব্রাজিল ১৯৫০ সালের বিশ্বকাপ জিততে ব্যর্থ হয়েছিল!

১৯৫৮ সালের বিশ্বকাপ জয়ের পর ব্রাজিল ফুটবলের দুঃসহ রাত্রির অবসান হয়, কিন্তু জিজিনহোর মত কিংবদন্তী এবং ইস্পাত-কঠিন মানুষও ১৯৫০ এর সেই দুঃখ কখনোই ভুলতে পারেন নি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেই ক্ষত তিনি বুকে ধারণ করে ছিলেন। ২০০২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মাত্র পাঁচ মাসের জন্য ব্রাজিলের পঞ্চম শিরোপা দেখে যেতে পারেন নি! আরেকটি আফসোস!

১০ টি মন্তব্য : “জিজিনহোঃ ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের বিস্মৃত কিংবদন্তী”

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।