ক্রিকেট ছিল আমার প্রথম প্রেম। ক্রিকেটের কারণে যত সময়, মেধা ও শ্রম নষ্ট করেছি সেসব আতশবাজির উপর প্রয়োগ করলে এত দিনে আমি রকেট বানানোর ইন্ডাস্ট্রি দিতে পারতাম।
কিন্তু ইদানিং সেই প্রেমে ভাটা পড়েছে। এর প্রথম ও প্রধান কারণ আমাদের অযোগ্য ও দুর্নীতিপরায়ন ক্রিকেট বোর্ড। এ রকম সুইসাইডাল বোর্ড ওয়েস্ট ইন্ডিজ ছাড়া পৃথিবীর কোথাও দেখতে পাওয়া যাবে না। তথাকথিত এই অভিভাবকের কারণে দেশের ক্রিকেট নিয়ে আমি ভীত ও শঙ্কিত। এজন্য ইদানিং খেলাও দেখতে ইচ্ছে করে না।
দ্বিতীয় কারণের নাম এড হকিন্স। বিভিন্ন পুরস্কারপ্রাপ্ত, ফ্রিল্যান্স এই ব্রিটিশ সাংবাদিক একজন বেটিং (বৈধ) বিশেষজ্ঞ। তাঁর লেখা Bookie Gambler Fixer Spy বইটি পড়ে ক্রিকেট দুনিয়ার অবৈধ জুয়ার জগত সম্পর্কে যা জেনেছি তা ক্রিকেট থেকে বিশ্বাস উঠিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। অবশ্য তিনি নিজেও এই ক্ষতির স্বীকার হয়েছেন। বই এর শুরুতেই সেটা লিখেও দিয়েছেন-
“…with every step on the long trip to cricket’s corrupt core, my confidence in the sport eroded It has now ceased to be.”
এবং
“The pessimist that I have become will never truly believe the game is pure. It cannot be.”
ঠিক করেছি বইটির দুইটি অধ্যায় আমার পরিচিত ক্রিকেটপ্রেমীদের জন্য অনুবাদ করব। ঠিক অনুবাদ নয়, ভাবানুবাদ। আকারে বেশি বড় হয়ে যাবার কারণে কিছু অনুচ্ছেদ আমি বাদ দিয়ে অনুবাদ করেছি।
যাই হোক, আজ সেটার প্রথম কিস্তি শেয়ার করছি। মনে রাখবেন স্পয়লার এলার্ট কিন্তু আগেই দিয়ে রাখছি। নিজ দায়িত্বে পড়বেন। কারণ ‘It will change the way you look at cricket!’
——————
পর্ব-১
তৃতীয় অধ্যায়
‘তুমি কি ম্যাচ ফিক্সিং করতে চাও?’
ম্যাচ ফিক্সিং এর ভয়াবহতা সম্পর্কে অবহিত করার জন্য আইসিসি’র আকসু নানা রকম সচেতনতামূলক প্রোগ্রামের আয়োজন করে থাকে। এসব প্রোগ্রামে ক্রিকেটারদের হুঁশিয়ার করে বলা হয় যে কুমতলবধারী লোকজন প্রথমেই ওদের সাথে বন্ধুত্ব করতে চাইবে। শারীরিক সুস্থতার ব্যাপারে খোঁজ-খবর নেবে, জানতে চাইবে শখের ব্যাপারেও। দেখা যাবে ‘দৈবক্রমে’ তার সাথে ক্রিকেটারের শখও মিলে গেছে!এরপর প্রশংসা করে আকাশে তুলবে এবং সবশেষে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসেবে কোন একটা উপহার দিতে চাইবে।
ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ব্যস্ত শিডিউলের চাপে হাঁসফাঁস করতে থাকা যে কোন ক্রিকেটার এই ফাঁদে সহজেই ধরা খেয়ে যেতে পারে। কোন কিছু না ভেবেই হয়ত সে এরকম লোকের সাথে ইমেইল, মুঠোবার্তা, ফেসবুক মেসেজ বা টুইট আদান-প্রদান শুরু করল। ‘সামান্য মেসেজ চালাচালি করলে কী সমস্যা?’ সহজ-সরল যে কোন খেলোয়াড়ের মনে এই ভাবনা আসতেই পারে!‘পার্থিব/বিনয়/জামাল তো খুব ভালো মানুষ।‘ ওর মনে নিশ্চয়ই অন্য কোন ধান্ধা নেই। ও তো শুধু বন্ধু হতে চেয়েছে। ঠিক?
নাহ! ভুল!
বেচারা সেই ক্রিকেটার যেটা জানে না তা হল এই পার্থিব/বিনয়/জামাল আসলে ভারতীয় বে-আইনি বাজিকর। বুঝবেই বা কী করে? ভারতের অপরাধ জগতের এসব রথী-মহারথী নানা প্রকার ছলনা ও মানুষ পটানোয় অত্যন্ত দক্ষ!সত্যি কথা বলতে এই সহজাত গুণ ছাড়া জুয়ার জগতে কেউ সফল হতেও পারবে না। মানুষ পটানোর এই পদ্ধতিকে আকসু নাম দিয়েছে গ্রুমিং (Grooming) বা পরিচর্যা পর্ব!
এসব আগে থেকেই জানা ছিল বলে যেদিন বুঝলাম আমার তিন টুইটার ‘বন্ধু’: মুম্বাই এর পার্থিব,ভোপাল এর বিনয় এবং দিল্লির জামাল,আসলে ভারতীয় বাজিকর তখন মোটেই অবাক হই নি। ওদের একজন সবসময় আমার কুশলাদি জিজ্ঞাসা করত। তিনজনই ক্রিকেটপাগল, ঠিক আমার মতনই। সবচেয়ে বড় কথা- ওরা বাজি ধরতে ভালবাসত। ওটাই সবচেয়ে বড় ক্লু!
আমি ছিলাম অবশ্যম্ভাবী ‘টার্গেট’, কারণ আমার টুইটার হ্যান্ডেলের নাম ছিল @cricketbetting। সে সময় আমি ফ্রিল্যান্স ক্রিকেট জার্নালিস্ট হিসেবে কাজ করতাম। টার্গেট গ্রুপের কাছে আমার গ্রহণযোগ্যতা বাড়াবার জন্য ইচ্ছে করেই অমন নাম বেছে নিয়েছিলাম। যে কোন ম্যাচের বিভিন্ন বাজির হিসেব-নিকেশ নিয়ে আমি নিয়মিত লিখতাম। সৌভাগ্যক্রমে, আমার টিপসগুলো বেশিরভাগই কাজে লাগত। অবশ্য,বাজির ক্ষেত্রে সফলতা পাবার জন্য খুব বেশি কিছু প্রয়োজন হয় না, সবচেয়ে জরুরী পরিসংখ্যানের ব্যাপারে নিখাদ আগ্রহ থাকা এবং নিজের আবেগকে দূরে সরিয়ে রাখা!
প্রতিটি ম্যাচ বিশেষ করে আন্তর্জাতিক ম্যাচের আগে একটি বিশদ প্রিভিউ লিখে আমি টুইটারে সেই লিংক পোস্ট করতাম। প্রিভিউতে থাকত প্রতিটি দলের শক্তিমত্তা ও দুর্বলতা, পিচ ও আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্য, বাজির দর এবং খেলোয়াড়দের সাম্প্রতিক ফর্ম সংক্রান্ত নানা তথ্য। খেলার মাঝেও অনেক টুইট করতাম; বাজি সংক্রান্ত তো বটেই, পাশাপাশি ‘খেলায় কী হতে চলেছে’ টাইপ টুইটও করতাম। ঝড়ে বক মরা হোক আর যাই হোক-আমার বেশ বড় সংখ্যক টুইটার ফলোয়ার জুটে গেল!
পার্থিব আমার ফলোয়ারদের একেবারে শুরুর প্রথম কয়েকশ’ জনের একজন ছিল। ওর প্রোফাইল পিকচার হেব্বি ভাবের সাথে তোলা- লেদার জ্যাকেট, সানগ্লাস পরে কোন এক দরজার সাথে হেলান দিয়ে তুলেছে। যে কোন মেসেজ/কমেন্টের আগে সব সময় ‘ব্রো’, ‘ড্যুড’ বলে শুরু করত। এসব দেখে বুঝতে কষ্ট হয় না সে বেশ কমবয়সী, সম্ভবত বিশের সামান্য বেশি হবে। আমার প্রায় সব টুইটেই সে কমেন্ট করত, যতটা সম্ভব তথ্য আদায় করতে চাইতো। আমি নতুন কোন টুইট না করলে সে নিজে থেকেই নানা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করত। ‘খেলা দেখে কী মনে হচ্ছে, ব্রো?’ অথবা ‘কত রান করলে চেজ করা কঠিন হয়ে যাবে, ড্যুড? ইত্যাদি।
অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত ২০১০-১১ মৌসুমের অ্যাশেজ ম্যাচ যখন কিছুটা ম্যাড়ম্যাড়ে হয়ে যেত, তখন দীর্ঘ, ঠাণ্ডা রাতের ঘুম তাড়াতে পার্থিবের একের পর এক খেলোয়াড় ও খেলার সংক্রান্ত প্রশ্ন আমাকে দারুণ সাহায্য করত! ঐ সিরিজে বাজি ধরে পার্থিব অনেক টাকা কামিয়েছিল এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে একটুও কার্পণ্য করে নি। আমাকে উপহারও কিনে দিতে চেয়েছিল! ‘আমার এক বন্ধু ইলেক্ট্রনিক স্টোরে কাজ করে…আমি তোমাকে একটি আইপ্যাড পাঠিয়েছি। প্লিজ, আমার পক্ষ থেকে উপহার হিসেবে এটি গ্রহণ করবে। U r great m8!’
এসব ব্যাপারে বিনয় অনেক সাবধানী ছিল। সত্যি কথা বলতে- সপ্তাহে একবারের বেশি কখনও সে আমার সাথে যোগাযোগ করেছে বলে মনে পড়ে না। খেলার খুঁটিনাটি বিষয়ের চেয়ে ভেন্যুর পিচ এবং আবহাওয়ার ব্যাপারে তার আগ্রহ বেশি ছিল। আমি তাকে কয়েকটি নির্ভরযোগ্য ওয়েবসাইটের লিঙ্ক ধরিয়ে দিয়েছিলাম, পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়ার এক বাজিকরের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম যিনি এসব ব্যাপারে মোটামুটি বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের জ্ঞান রাখেন।
বিনয়ের সবচেয়ে বেশি আগ্রহ ছিল ডাকওয়ার্থ-লুইস মেথডের ব্যাপারে। বৃষ্টি বা অন্য কারণে খেলা বিঘ্নিত হলেই সে প্রশ্ন করত, ‘বন্ধু, ডিএল টার্গেট কত? আমি কিভাবে এটা বের করব?’ বা পরের দিকে ‘সম্ভবত আমি ধরতে পেরেছি। টার্গেট ২১৬, ঠিক?’ ইত্যাদি মেসেজ পেতাম। অবশ্য, ডিএল সংক্রান্ত কয়েকটি সফটওয়্যারের খোঁজ দেয়ার পর ওর মেসেজের সংখ্যা অনেক কমে এসেছিল।
জামাল ছিল বিনয়ের একেবারে বিপরীত। কথায় আদবের ছোঁয়া মাত্র থাকত না, মাঝে মাঝে উদ্ধত আচরণও করত। সবসময় ভুল ইংরেজিতে তাগাদা দিয়ে প্রশ্ন করত! বাক্যের মধ্যে অবধারিতভাবে আপত্তিকর শব্দ থাকত এবং সম্ভবত সে ক্যাপসলক এর ব্যবহারই জানত না। সবসময় ক্যাপিটাল লেটারে মেসেজ লিখত! রিপ্লাই না পেলে আরও অস্থির হয়ে যেত। ‘WHO WIN THIS FUCKING GAME? U SAY NOW. THX.’ রিপ্লাই দেয়ার আগেই আবার মেসেজ! ‘WHY U NO REPLY MESSAGE? I SHIT HEAVY LOSSES. HELP.’
২০১০ এর মাঝামাঝি সময়ে আমি প্রথমবারের মত বিনয়, পার্থিব ও জামালের আসল পরিচয় জানতে পারি। এর আগ পর্যন্ত ভেবেছিলাম ওরা দারুণ ক্রিকেটপ্রেমী যারা টুকটাক বাজি ধরে ভারতের অবৈধ বুকিদের কাছ থেকে কিছু টাকা কামিয়ে নিচ্ছে। আমি স্বপ্নেও ভাবি নি যে ওরা নিজেরাই অবৈধ বুকি!!
ওদের আসল পরিচয় জানার অনেক আগে থেকেই আমি ক্রিকেটের সম্ভাব্য দুর্নীতির ব্যাপারে অনুসন্ধান করা শুরু করেছিলাম। পাশাপাশি ভারতের অবৈধ বাজির ব্যবসা কিভাবে পরিচালিত হয় সেটাও জানার চেষ্টা করছিলাম। স্বীকার করতেই হয় আমার অনুসন্ধান খুব বেশি দূর এগোতে পারে নি। ফলে, অন্য বেশিরভাগ সাধারণ ক্রিকেটপ্রেমীর মত আমিও বিশ্বাস করা শুরু করেছিলাম ক্রিকেটের দুর্নীতি হয়ত বেশিরভাগটাই দূর হয়ে গেছে। হ্যান্সি ক্রোনিয়ে এবং আজহারউদ্দীনের ঘটনা প্রকাশ হবার মাধ্যমেই এর ইতি হয়ে গেছে। আইসিসি আকসু গঠন করেছে, যা কী না শুধু ক্রিকেটই নয়, যে কোন ক্রীড়ার ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমনের উদ্দেশ্যে গঠিত প্রথম সংগঠন। ক্রিকেটই সর্বপ্রথম ফিক্সিং সমস্যার অস্তিত্ব স্বীকার করে একে নির্মূল করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। কিন্তু পাকিস্তানের স্পট ফিক্সিং (বাট, আমিরদের) ঘটনা তো বটেই অন্যান্য আরও কয়েকটি কারণে আমার সেই বিশ্বাস টলে গিয়েছিল।
(চলবে)
এসব সম্বন্ধে নিশ্চিত না হয়েও একটা সন্দেহ আমার মনে থেকেই যেত, ক্রিকেটারদের কিছু অস্বাভাবিক এবং অপরিণামদর্শী আচরণ দেখে।
লেখাটি বেশ আগ্রহ নিয়ে পড়লাম। কোয়াইট ইন্টারেস্টিং!