এ কেমন অভিভাবক?!

অভিধান বলছে অভিভাবকের অর্থ দেখাশোনা করে যে, রক্ষণাবেক্ষণকারী; তত্ত্বাবধায়ক; আশ্রয়দাতা।

বাংলাদেশের ক্রিকেটের অভিভাবক সংস্থা বিসিবি কি এমন? খোদ বিসিবি সভাপতিই কি প্রধান অভিভাবক হবার যোগ্য?

১। ”অস্ট্রেলিয়ায় তখন চলছে ২০১৫ বিশ্বকাপ। ব্রিসবেনে এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ দলকে সংবর্ধনা দিচ্ছিল স্থানীয় বাঙালিরা। নিজের বক্তৃতায় দল নিয়ে কথা বলতে গিয়ে এক পর্যায়ে বিসিবি প্রধান নাজমুল হাসান রসভরা কণ্ঠে বললেন, “আমাদের ‘বুম বুম তামিম’ তো এখন ‘ঘুম ঘুম তামিম’ হয়ে গেছে!’’

পুরো হলরুমে হাসির হুল্লোড় উঠল। ক্রিকেটাররা সবাই স্তব্ধ। তামিম ইকবাল চেষ্টা করেছেন স্বাভাবিক থাকতে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে যেন মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। সেদিন রাতে হোটেলে ফিরে হাউমাউ করে কেঁদেছেন তামিম। ঘনিষ্ঠজনদের বলেছেন, ক্রিকেট খেলার ইচ্ছাটাই মরে গিয়েছিল তাঁর। পরে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা রাতজুড়ে বুঝিয়েছেন তাঁকে। উজ্জীবিত করেছেন। সকালের দিকে খানিকটা স্বাভাবিক হয়েছেন এই ওপেনার।

পরের কয়েক দিন দলের সবাই শুধু একটি কথাই বারবার বলেছেন, ‘একজন বোর্ড প্রধান এভাবে বলতে পারেন!’

হ্যাঁ, নাজমুল হাসান পারেন। সেটিই প্রথম ছিল না। শেষও নয়। ক্রিকেটারদের নাম ধরে পারফরম্যান্স নিয়ে বোর্ড প্রধানের এভাবে প্রকাশ্যে বলার নজির ক্রিকেট ইতিহাসেই বিরল। কিন্তু বিসিবি প্রধান নানা সময়ে মাইক্রোফোনের সামনে অকপটে বলে দিয়েছেন, “আল আমিনের তো ফিল্ডিং হয় না” বা “অমুক তো রানই করতে পারছে না”, কিংবা “তমুকের বোলিং চলে না”। বলার অপেক্ষরা রাখে না, নাম নেওয়া ক্রিকেটার তো বটেই, সতীর্থরাও বারবার বিব্রত ও লজ্জিত হয়েছে তাদের অভিভাবকের কথায়।”
-–
দেশের ক্রিকেটে অশনি সংকেত, বিসিবি প্রধান কি শুনতে পাচ্ছেন, আরিফ রনি, বিডিনিউজ২৪, জুন ২০১৬

জনসমক্ষে ক্রিকেটারদের নাম উল্লেখ করে বিপদে ফেলা, এমন কী জাতীয় ভিলেনে পরিণত করার লিস্টটি বেশ লম্বা। তামিম, সাকিব, মুশফিক, আল আমিন, নাসির, রিয়াদ, মাশরাফি…কে নেই এই লিস্টে? এমন কী মাশরাফি’র টি-২০ ক্যারিয়ার পর্যন্ত তিনি উল্টো-পাল্টা কথা বলে শেষ করে দিয়েছিলেন!

মাইক হাতে পেলে তিনি যেন পাগল হয়ে যান!

২। আজ থেকে প্রায় ৮ বছর আগে তিনি তিন মাসের জন্য বিসিবি প্রধানের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। তার কাজ ছিল একটিই- বিসিবিতে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করে নতুন কমিটির হাতে দায়িত্ব ছেড়ে দেয়া। কিন্তু বিসিবি প্রধানের ক্ষমতা, প্রভাব ও আধিপত্য দেশে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এতটাই বেশি যে এই পদের মূল্য বুঝতে তার দেরী হয় নি। এজন্য দ্রুত গঠনতন্ত্র বদলে নিজেই প্রেসিডেন্ট হিসেবে ‘নির্বাচিত’ হয়ে জাঁকিয়ে বসলেন! আজও সেভাবেই আছেন!

এই দীর্ঘ সময়ে তার সাফল্য-

ক। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে ‘প্লেয়ার্স বাই চয়েজ’ (বিভিন্ন ক্যাটেগরিতে ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক বেঁধে দেওয়া) নামক বিতর্কিত নিয়ম চালু রাখা।

খ। বছরের পর বছর বিসিবিতে এজিএম না করা। অথচ দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা, কাজের অগ্রগতির হিসেব, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতা, আয়-ব্যয়ের হিসেবের জন্যও এজিএম হওয়া জরুরী!

গ। একই লোক দশের অধিক পদে আসীন করা। যার অধিকাংশই আবার একে অপরের সাথে সাংঘর্ষিক!

ঘ। নিজের খেয়াল খুশি মত কোচ ট্রেইনার নিয়োগ দেয়া। পাশাপাশি তাদের কাউকে (যেমন হাতুরু) ঐশ্বরিক ক্ষমতা দিয়ে দানবে পরিণত করা।

ঙ। ২য় এবং ৩য় বিভাগে দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, এমন কী ম্যাচ ফিক্সিং এর প্রশ্রয় দেয়া। প্রিমিয়ার লিগেও ভেন্যু ও আম্পায়ার নিয়ন্ত্রণ করার মত ঘৃণ্য অপরাধ করেও একটি বিশেষ দল পার পেয়ে যায়!

চ। দেশে নাম কা ওয়াস্তে ঘরোয়া লিগ হয়। সকল স্টেডিয়ামে খেলা হয় না। স্টেডিয়ামগুলোর ঠিকমত রক্ষণাবেক্ষণ হয় না। টিকিট কালোবাজারিদের দৌরাত্মে লোকজন ঠিকমত খেলা দেখতে পারে না। মাঠের ভিতরে খাবার পানীয় নিয়ে চলে মনোপোলিস্টিক ব্যবসা!

ছ। মিরপুর বাদে অন্য কোন স্টেডিয়ামে জিম নেই। দেশি-বিদেশি খেলোয়াড়গণ চট্টগ্রামে গিয়ে হোটেলের জিম ব্যবহার করে। জাতীয় দলের নিয়মিত কয়েকজন বাদে অন্যরা নিজের পয়সা খরচ করে জিম করার সামর্থ্য রাখেন না। ফলে, তাদের ফিটনেস বজায় থাকে না!

জ। দেশের ক্রিকেট নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী কোন পরিকল্পনা নেই। বিকেএসপি বা বয়সভিত্তিক দল থেকে যা খেলোয়াড়গণ উঠে আসছে। অথচ, বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই একাধিক আধুনিক-সুবিধা সম্পন্ন ক্রিকেট একাডেমি রয়েছে। ভাল পেসারের জন্য আমাদের কত হা হুতাশ, অথচ আমাদের কোন পেস একাডেমি নেই।

ঝ। আমাদের দেশের একটি বড় জেনারেশন রফিককে দেখে বাহাতি স্পিনার হওয়ার অনুপ্রেরণা পেয়েছে। অথচ জাতীয় দলের স্পিন কোচ করা হয় সাধারণ মানের ভিন্ন দেশের, ভিন্ন ভাষাভাষী সুনীল যোশীকে!! দেশের সাবেক ক্রিকেটারদের মূল্য ও সুযোগ দেয়া হয় না। বিশেষ করে যারা দেশের ক্রিকেটারদের জন্য সত্যিই কিছু করতে চান। সুজন, নান্নু, আকরাম, সুমনদের মত সুযোগ সন্ধানী, চাটুকার ও মেরুদণ্ডহীন নন।

ঞ। বিপিএল নামক কৌতুক চালাচ্ছেন বছরের পর বছর! যে খেলাটি নবীন ও আক্রমণাত্মক দেশি খেলোয়াড় বানানোর সূতিকাগার করা যেত, এমনকি হতে পারত নবীন ধারাভাষ্যকারদের উঠে আসার প্ল্যাটফর্ম- সেটি আসলে ফিক্সিং করার আদর্শ জায়গা এবং বিদেশী বাতিল খেলোয়াড়দের (বিশেষ করে পাকি খেলোয়াড়দের) চারণক্ষেত্র! খেলোয়াড়দের বেতন-ভাতা ঠিকমত পরিশোধ করা না, দুর্বল আম্পায়ারিং, বিদেশিদের কোটা বৃদ্ধি, নিম্নমানের সম্প্রচার, বাজে ধারাভাষ্য ইত্যাদি নানা অভিযোগে অভিযুক্ত!

এবার এর সাথে যুক্ত হয়েছে ফ্র্যাঞ্চাইজিবিহীন খোদ বোর্ড কর্তৃক টুর্নামেন্ট পরিচালনা করার সার্কাস! কারণ, পাপন জানেন বাংলাদেশে কোন কিছুর আগে বঙ্গবন্ধু’র নাম জুড়ে দিলে সেটা নিয়ে কেউ প্রশ্ন করার সাহস পায় না। এভাবেই ওরা বঙ্গবন্ধুর নাম ভাঙিয়ে খায়…

চ। যে পাকিস্তানে কেউ যেতে চায় না সেখানে বাংলাদেশের নারী দলকে জোর করে পাঠিয়েছেন, সেটাও একাধিকবার! তাদের জীবনের কি মূল্য নেই? পাকিস্তানে ক্রিকেট ফেরানোর দায়িত্ব কি আমাদের?

ছ। সম্প্রতি খেলোয়াড়দের ধর্মঘটের পর সকল ক্রিকেটারকে যেভাবে দেশের মানুষের সামনে ভিলেন বানিয়েছিলেন তা তো একেবারেই টাটকা ঘটনা। দুঃখের ব্যাপার খেলোয়াড়দের বেশিরভাগ দাবীই এখনও পুরোপুরি মেটানো হয় নি! ঘরোয়া ক্রিকেটে এখনও চলছে ম্যাচ পাতানোর উৎসব! বিসিবি প্রধানের স্বেচ্ছাচারিতাও বিন্দুমাত্র কমে নি! তার আশেপাশে সবসময় দেখা যায় বিতর্কিত, বিপদজনক ও দুর্নীতিবাজদের…এমন কী খোদ ডিরেক্টর পদেও এমন একাধিক লোক আসীন রয়েছে!

৩। পাকিস্তান সফর নিয়ে বিসিবি দীর্ঘদিন ধরেই টালবাহানা করছে। অথচ, এর কিছুই করা লাগত যদি না তারা আমাদের মেয়েদের আগে পাঠাতো। ওদের পাঠাবার পর জাতীয় পুরুষ দলকে নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে না পাঠালে সেটা ধোপে টেকে? এই পয়েন্টে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সবাই কঠোর সমালোচনা করছে! সবার একই প্রশ্ন- তাহলে কি তোমাদের মেয়েদের জীবনের মূল্য নেই?

সবচেয়ে বড় কথা গতকাল নাজমুল হাসান মুশফিকের নাম উল্লেখ করে বলেছেন সে সফরে যেতে চাইছে না। তিনি কি নাম উহ্য রেখে কথাটি বলতে পারতেন না? নাম বলার পর পাকি সমর্থকগোষ্ঠী অনলাইনে, বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যমে মুশিকে ধুয়ে দিচ্ছে। এবার না হলেও আজ থেকে কয়েক বছর মুশি যদি পাকিস্তান সফরে যায় তখন ওকে কেউ শারীরিকভাবে আক্রমণ করলে তার দায় কি পাপন নেবেন? কিংবা আরব আমিরাতে খেলতে গেলে মুশির নিরাপত্তার গ্যারান্টি তিনি দিতে পারবেন? পাকিদের এমনিতেই ভরসা নেই, তার উপর এভাবে উশকে দেয়া… এ কেমন অভিভাবক? তার কী এই ন্যুনতম সেন্স নেই?!

অবশ্য, গত আট বছরেও যার কোন ইতিবাচক পরিবর্তন হয় নি, এখন হবে কী করে?! এভাবে চললে দেশের ক্রিকেটের ভরাডুবি এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র! পাপন সাহেবের তাতে কিছুই এসে যাবে না। তখন তিনি অন্য কোন ফেডারেশন বা মন্ত্রণালয়ে চলে যাবেন কিংবা নিজের ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন। কিন্তু, দেশের মানুষ হারাবে সকল দুঃখ, দুর্দশা, হতাশা, মনের ব্যথা ভোলার একমাত্র অবলম্বনকে। কেননা, ক্রিকেট এখন শুধুমাত্র একটি খেলাই নয়-বাংলাদেশের কোটি মানুষের আবেগের জায়গা। দেশের শত সমস্যার মাঝেও একমাত্র ক্রিকেটই পারে আমাদের সবার মুখে হাসি ফোটাতে। শত বিভাজনের মাঝেও একমাত্র ক্রিকেটই পারে আমাদেরকে এক করতে। কষ্ট লাগে সেই ক্রিকেটকে তিলে তিলে ধ্বংস হতে দেখলে…

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।