জর্জ উয়িহ’র লাইবেরিয়া, ইমরান খানের পাকিস্তান এবং মাশরাফীর বাংলাদেশের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য।
উয়িহ রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন লাইবেরিয়ার দ্বিতীয় গৃহযুদ্ধ (Second Liberian Civil War) সমাপ্ত হবার পর। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত একটি দেশে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সুপরিচিত এবং তুমুল জনপ্রিয় একজন ফুটবলারের পক্ষে সফলতার সাথে নতুন দল গঠন করা যতটা সহজ, একটি স্ট্যাবল দেশে সেটি মোটেও সহজ নয়। সত্যি কথা বলতে এটি প্রায় অসম্ভব একটি কাজ।
একই কথা পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আল্লাহর দুনিয়ায় (ইনশা আল্লাহ) এই দেশটি কখনও শান্তি পাবে না, কারণ ওদের স্বভাবই যে খারাপ এবং সবচেয়ে বড় কথা ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার মত বুদ্ধিও ওদের নেই! সাথে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ তো আছেই…এক অর্থে ওরাও একটি যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশ।
ইমরান খান প্রথম বার অবসর নেয়ার (১৯৮৭) পর পাকিস্তান মুসলিম লীগ এবং নওয়াজ শরীফের দলে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ পেলেও কোথাও যোগ দেন নি। ১৯৯২ সালে শেষবারের মত ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়ে শুরুতে দাতব্য চিকিৎসালয় তৈরি নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। অবশ্য সেটা রাজনৈতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে নিজের জায়গা শক্ত করার কৌশলও হতে পারে। কেননা, নানা জল্পনা-কল্পনার পর ১৯৯৪ সালে যোগ দিলেন সাবেক ইন্টেলিজেন্স চিফ হামিদ গুল এবং জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান এর ছাত্র শাখার সাবেক প্রধান মুহাম্মদ আলী দুররানী’র হাতে গড়া একটি উগ্রপন্থী দলে।
শেষ পর্যন্ত ১৯৯৬ সালে গঠন করলেন নতুন একটি দল পাকিস্তান তেহরিক এ ইনসাফ (“Pakistan Movement for Justice”)। মজার ব্যাপার হল এত জনপ্রিয়তা, এই হাইপ, এত স্বপ্ন…অথচ ১৯৯৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে দুই আসন থেকে দাঁড়িয়ে কোনটাতেই জয়লাভ করতে পারেন নি। কারণ পরিষ্কার- খেলার মাঠ এবং রাজনীতির মাঠের হিসেব সম্পূর্ণ আলাদা!
এর পরের ইতিহাস কমবেশি আমরা সবাই জানি। সত্যি কথা বলতে কী- সেনাবাহিনীর হাত-পা-মাথায় ভর না দিয়ে তিনি কোনদিনও ক্ষমতায় আসতে পারতেন না। যত বড় চ্যাম্পই হোক-পাকিস্তানে এটাই বাস্তবতা।
জর্জ উয়িহ’র পথ চলা আরও বেশি কঠিন ছিল। অসম্ভব জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও তিনি পিছিয়ে ছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার দিক দিয়ে। তাছাড়া নতুন গড়া বলে দলের বেশ কিছু সাংগঠনিক ও কৌশলগত দুর্বলতাও ছিল। যা তিনি নিজেও উপলব্ধি করেন ২০০৫ সালের সাধারণ নির্বাচনে হেরে গিয়ে।
উপায়ন্তর না দেখে যুক্তরাষ্ট্রের মায়ামি’র এক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ পড়া শুরু করেন, পাশাপাশি অব্যাহত রাখেন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডও। ২০০৯ সালে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফেরার পর শুরু হয় রাজনীতির দ্বিতীয় ইনিংস। নানা চরাই-উৎরাই পেরিয়ে অবশেষে এই বছরের ২২ জানুয়ারি লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
তাহলে দেখা যাচ্ছে- একটি স্বাধীন, সার্বভৌম এবং স্ট্যাবল দেশে নতুন দল গঠন করে রাজনীতিতে আসা মোটেও কোন বুদ্ধিমানের কাজ নয়। উদাহরণ আমাদের দেশেও আছে। দীর্ঘ ৯ বছর সামরিক শাসন, সেনাবাহিনীর ছত্রছায়া নিয়েও জাতীয় পার্টি থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বারের বেশি কিছু হতে পারেনি। বিকল্প দল, অতি বিকল্প, অতি অতি অতি বিকল্প’র কী অবস্থা তা তো বর্তমানেই দেখতে পাচ্ছি।
সেক্ষেত্রে নতুন একটি প্রশ্ন উঠতে পারে- রাজনীতিতে কেন আসতে হবে?
ম্যাশের মত দেশপ্রেমিক এবং সৎ মানুষগুলো রাজনীতিতে না আসলে এর গুণগত পরিবর্তন হবে কিভাবে? সাধারণ মানুষ হিসেবে আমাদের দায়িত্ব কি শুধু চায়ের কাপে ঝড় তোলা কিংবা ঘরে বসে রাজনীতিবিদদের গালি দেয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ? সিস্টেমে না ঢুকলে সিস্টেম কি পরিবর্তন করা যায়?
হ্যাঁ, সোহেল তাজ পারেন নি। আমাদের দেশে কোন একজন যদি এই ঘুণে ধরা সিস্টেমে পরিবর্তনের শুরু করতে পারে- সেটা পাগলা মাশরাফীই পারবে। কারণ, ও প্রয়োজনে চড় থাপ্পড় মারতেও দ্বিধা করবে না। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবে না।
আমি শুধু একটি ব্যাপারে অস্বস্তিতে আছি। টাইমিং একটু খারাপ হয়ে গেছে। আগামী বিশ্বকাপের পর খেলা থেকে অবসর নিয়ে রাজনীতিতে আসা উচিত ছিল। পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কাজের মধ্যে ব্যস্ত থেকে নিজেকে আরও পরিণত করে নিয়ে রাজনীতিতে আসতে পারত। আসলে ওর অনেক কিছু শেখার বাকি আছে…আগেই বলেছি-খেলার মাঠ এবং রাজনীতির মাঠের হিসেব সম্পূর্ণ আলাদা!
এভাবে ওর রাজনীতিতে আসাটা অনেকটা শুধু নেট প্র্যাকটিস দেখেই কাউকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নামিয়ে দেয়ার মত হয়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা- অবসর না নিয়ে রাজনীতিতে আসার জন্য অযথাই কিছু মানুষের গালি খাচ্ছে, কিছু প্রতিপক্ষ তৈরি হচ্ছে। যেটার কোন প্রয়োজনই ছিল না…
আমি জানি না ম্যাশ সফল হবে না ব্যর্থ। এটা সময়ই বলে দেবে। ও কী করবে সেটাও বলার আমি কেউ না, তাছাড়া আমি সেটা চাইও না। নিজেই নিজের সিদ্ধান্তের (সু)ফল ভোগ করুক…
পরিশেষে, ম্যাশের টাইমিং নিয়ে আমার সন্দেহ থাকলেও ওর মিশন-ভিশন নিয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই। যে মাশরাফীকে আমি চিনি, জানি, সে জেনে-শুনে দেশের ও দেশের মানুষের কোন ক্ষতি হতে দেবে না।
ঠিকই এই কারণেই, কিছুটা খচখচানি থাকলেও ম্যাশকে শুভকামনা জানাতে আমি বিন্দুমাত্র দ্বিধা করছি না। যারা দ্বিধা করছেন তারা নিজেকে প্রশ্ন করে দেখবেন দ্বিধাটি ঠিক কোন কারণে?
ওর টাইমিং?
ওর সদিচ্ছা নিয়ে সংশয়?
নাকি অন্য কিছু?
ভাল করে চিন্তা করুন।
আশা করি ভালো কিছুই হবে।
মানুষ* হতে চাই। *শর্ত প্রযোজ্য