দল নির্বাচনের সময় আমি কোন রিস্ক নিই না!

দল নির্বাচনের সময় আমি কোন রিস্ক নিই না। নিজের আসল অফিস থেকে সন্ধ্যাবেলা বিসিবি ফিরে দেখি কুজন, ফান্নু, জুমন, মোটকুরাম গল্প করছে। মাঝে মাঝে ওদের চাপা হাসির শব্দ ভেসে আসছে। আমি চট করে নিজের রুমে ঢুকে পড়লাম। রুমের দেয়ালের সামনে-পেছনে একে একে বঙ্গবন্ধু, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, গ্রিনিজ, হোয়াটমোর, বার্লো, সাবের হোসেন…এরকম অনেকগুলো ছবির ফ্রেম। একটু লজ্জা লাগলেও চেয়ারে বসে ড্রয়ার থেকে লম্বাটে কাচের বোতলটা বের করে ডাইরেক্ট কয়েক চুমুক মেরে দিলাম। লজ্জা ঢাকতে চোখ বন্ধ করেই চুমুক দিয়েছিলাম। এমনিতেই মুডে ছিলাম, জ্বালাধরা তরলটুকু রক্তে মেশা শুরু হতেই মুড আরও ফুরফুরে হয়ে উঠল। চোখে খুলে দেখি গ্রিনিজ দাঁত বের করে হাসছে। হাসুক। চুমুক দেয়া দেখলেই ঐ ব্যাটা সব সময় হাসা শুরু করে। সবাইকে শুনিয়ে বললাম-চিন্তা করবেন না! দল নির্বাচনের সময় আমি কোন রিস্ক নিই না…

একটা নোট প্যাড আর কলম নিয়ে নাম লেখা শুরু করলাম। ‘আচ্ছা, কোন ফরম্যাটের খেলা?! খাইছে! মনেই পড়ছে না!’ ফান্নুকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলামঃ এই তোমরা একাদশ বানিয়েছ?

ফান্নুঃ না, স্যার। এগুলো তো আপনিই করেন। তাই ভাবলাম…

ব্যাটা ফাজিল। প্ল্যানটাই নষ্ট করে দিল। নিজের ফাঁকিবাজি ঢাকতে আমার সাথে চালাকি করছে মনে হয়। যাই হোক, আমিও কম যাই না। আমার নাম…ধ্যাত! আমার নামটাও মনে পড়ছে না। চট করে পেছনে তাকিয়ে নিজের ছবিটা দেখলাম। নামটা বড় করে লেখা আছে। দেখে মনে পড়ল!

বললামঃ হ্যাঁ, আমার নাম পাপ্পু! বুঝলা?
ফান্নুঃ স্যার?!
-সব কি আমিই করবো? আমি একা মানুষ কয়দিক সামলাবো? এক কাজ কর- জলদি ১৫ জন ফুটবলারের লিস্টটা নিয়ে এসো। আমি কাট-ছাঁট করে ফার্স্ট ইয়ার ঠিক করছি।

ফান্নু বের হয়ে যেতেই ড্রয়ার থেকে বোতলটা বের করে আরও কয়েকবার গলায় ঢেলে নিলাম। আসলে কাজটা অনেক কঠিন। ১৬ কোটি মানুষের মধ্য থেকে ১১ জন…আচ্ছা, ফান্নুকে কী বলেছি? একাদশ ঠিক করব, নাকি ফার্স্ট ইয়ার? ব্যাপার না। দুটো একই জিনিস। ফুটবল খেলতে পারলেই হল! পেছনে তাকিয়ে দেখি বঙ্গবন্ধু তর্জনী উঁচিয়ে চোখ লাল করে তাকিয়ে আছেন। সে কী! চাচা রেগে আছেন মনে হচ্ছে! ওদিকে সাবের হোসেন হো হো করে হাসছে। সর্বনাশ! কোন ভুল করলাম নাকি? কিন্তু দল তো এখনও ঠিকই করি নি। তাছাড়া, দল নির্বাচনের সময় আমি কোন রিস্ক নিই না!

একটু পর ফান্নু, জুমন, মোটকুরাম হাজির হল। লিস্ট হাতে নিয়ে গম্ভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করার ভান করা শুরু করলাম। আসল কথা হচ্ছে কাউকেই চিনতে পারছি না। কায়েস কোনটা? স্ট্রাইকার নাকি গোলকিপার? আরিফুল? এ আবার কেমন নাম? আরিফুল…আরি ফুল! আরি ফুল! আরেহ…নাহ! সিরিয়াস হতে হবে। আচ্ছা আমি কি জোরে চিন্তা করছিলাম? ওরা আমার দিকে ওভাবে তাকিয়ে আছে কেন?

মোটকুরামঃ স্যার আপনার শরীর ঠিক আছে? খারাপ লাগলে চোখে-মুখে হালকা পানি দিতে পারেন!
-আমার শরীর ঠিক আছে। তোমাকে অত চিন্তা করতে হবে না। শোন এক কাজ কর। ওদের নামের পেছনে কে কিসে ভাল তা লিখে দাও। আর হ্যাঁ, বোলারদের মধ্যে (সর্বনাশ! এতক্ষণ মনে হয় ফুটবলের কথা বলছিলাম! এইবার বুঝলাম ফ্রেমের মধ্যে ফান্নু কেন হাসছিল!) যে যেমন ব্যাট করতে পারে সেই অনুযায়ী সিরিয়াল করে দিও।

সাবের হোসেনসহ ওরা তিনজনই চলে গেল। এবার দেখি ফ্রেমে মাশরাফির ছবি দেখা যায়। ও ওখানে কী করে? ‘এই নেমে আসো!’ আজব! না নেমে এসে হে হে করে হাসছে। ওর চিন্তা বাদ দিয়ে ড্রয়ার থেকে বোতলটার আরেকবার সদ্ব্যবহার করলাম। আসলে মনের মধ্যে অনেক দুশ্চিন্তা। সামনে নির্বাচন, এই সময় ঘরের মাটিতে টেস্ট হেরে গেলে…ইয়েস! মনে পড়েছে! জিম্বাবুয়ের সাথে আমাদের টেস্ট শুরু হচ্ছে! সেটারই দল বানাতে হবে! আমি একটা জিনিয়াস! সব মনের মধ্যে গেঁথে থাকে…

দরজার ফাঁক দিয়ে ফান্নু উঁকি দিল।

-স্যার, লিস্ট এনেছি।
-টেবিলে রেখে দাও।
-স্যার, একটা কথা বলতাম!
-বল।
-ইয়ে মানে…দল নিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন এবার জুমন করলে হয় না? আমি তো বেশ কয়েকবার করেছি!
-আরে ধুর! ও তো মুখচোরা! ওকে দিয়ে হবে না। তুমিই করবে! তুমিই এই কাজে সেরা!
-কিন্তু স্যার…
-কোন কথা নয়। আচ্ছা এখনই ক্লাস ইলেভেন ঠিক করে দিচ্ছি। ইমরুল, লিটন, মুমিন, রিয়াদ, মুশি, মিরাজ…কয়জন হইছে? এগারো হইছে?
-স্যার, ছয়জন।
-বল কী! এত নাম বললাম…মাত্র ছয়জন! আচ্ছা, নতুন ছেলেটার নাম কী? পেস বোলিং করে?
-স্যার, খালেদ আহমেদ।
-ব্যাট করতে পারে না?
-নাহ, তেমন একটা না…
-তাইলে বাদ। দল হবে এমন সবাই যেন ভাল ব্যাট করতে পারে। টসে জিতে আমরা ব্যাটিং করব। প্রথম ইনিংসে ৪০০ বা ৪৫০ করলে জাম্বিয়ার সবার হাগু বের হয়ে যাবে!
-জিম্বাবুয়ে…
-জিম্বাবুয়ে কী?
-কিছু না স্যার…বাদ দেন।
-যা বলছিলাম। রানের প্রেশারে কেনিয়ার সবার…
-কিন্তু স্যার আমরা তো টসে হারতেও পারি!
-আজব কথা! টসে হারবে কেন? মাশরাফি যদি এই বয়সে তিন তিনটে টস জিততে পারে, আরিফুল পারবে না কেন?
-রিয়াদ।
-রিয়াদের কী হইছে?!
-নাহ…মানে…রিয়াদ ক্যাপ্টেন।
-তাহলে আরিফুলের কথা উঠল ক্যান?
-আপনি বলেছেন।
-ঠিক আছে। তাহলে ঐ কথাই থাকল, তুমি যখন বললে আরিফুলও খেলবে। সৌম্যকেও নিতে হবে।
-স্যার, সৌম্য ১৫ জনের মধ্যে নেই!
-সে কী! তা কেন? ও তো অনেক ভদ্র ছেলে! ওর নাম নেই কেন? দিনাজপুর টেস্টে ওকে নিবা। মনে থাকবে?
-জ্বি স্যার।
-তাহলে ফাইনাল দল কী হল?
-স্যার…কায়েস, লিটন, মুমিন, শান্ত, রিয়াদ, মুশি, আরিফুল, মিরাজ, তাইজুল, অপু, রাহী।
-পেস বোলার কয়জন হল?
-রাহীকে ০.৮ আর আরিফুলকে ০.৪ ধরলে হয় ১.২ জন।
-ওতেই চলবে। প্রথম ইনিংসে রান বেশি করলে ওদেরও লাগবে না। সাকিবই সব শেষ করে দেবে।
-স্যার, সাকিব তো…নাহ কিছু না! দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফান্নু থেমে গেল।

ওকে দেখে কেন জানি খুব মায়া হল। নরম গলায় বললাম,

-শোন পাইলট, তোমারে একটা সিক্রেট শিখাই। সাফল্য-ব্যর্থতা বিকেএসপিতে কোন ব্যাপারই না। খালি দিন শেষে কখনও নিজের ভুল স্বীকার করবা না। সবসময় ভুলটা অন্যের উপর চাপিয়ে দেবে। সাধারণ মানুষ কিচ্ছু মনে রাখে না। সফলতা পেলে আগের সব ভুলে যায়। কিন্তু ভুল করার কথা শুনলে কখনই মাফ করে না। এজন্যই, আমি দল নির্বাচনে কোন রিস্ক নিই না। আগে হার ঠেকাতে হবে, পরে জেতার চিন্তা…
-জ্বি স্যার। মনে থাকবে।
-কী মনে থাকবে?
-কিছু না স্যার। আমি সাংবাদিক সম্মেলনে গেলাম। বাইরে সবাই অপেক্ষা করছে। আপনি কি বাসায় যাবেন, নাকি এখানেই রেস্ট করবেন?
-আমার রেস্ট নেয়ার সময় আছে? এত কাজ!! টেস্টের বেস্ট ইলেভেন ঠিক করতে হবে না?
-করা তো হয়ে গেছে! এই যে লিস্ট দিলেন মাত্র!
-ওহ আচ্ছা যাও। আমি কিছুক্ষণ এখানে বসে রেস্ট করি।

ফান্নু যাওয়ার পর দেয়ালের দিকে তাকিয়ে দেখি সাংবাদিক সম্মেলন শুরু হয়ে গেছে। আজব তো! আমাকে ছাড়াই শুরু করে দিয়েছে! জোর করে সাবের হোসেনের হাত থেকে মাইক কেড়ে নিয়ে কথা বলা শুরু করলাম।

-আপনারা অনেকেই আমার নামে অনেক কিছু বলে বেড়ান। আমি নাকি স্বেচ্চাচারী, স্বৈরাচারী, আলাদিন… আমি সবই জানি, সবই শুনি। কিন্তু একটা কথা মনে রাখবেন- দল নির্বাচন করার সময় আমি কোন রিস্ক নিই না।

হাসির শব্দ শুনে থমকে গেলাম। ফাজিল গ্রিনিজটা এখন হো হো করে হাসছে…

মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে।
বঙ্গবন্ধু দিকে তাকানোর আর সাহস হল না।

(তারাপদ রায়ের লেখা অবলম্বনে)

৬ টি মন্তব্য : “দল নির্বাচনের সময় আমি কোন রিস্ক নিই না!”

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।