মাত্র ৩ লক্ষ ৩৫ হাজার মানুষের দেশ আইসল্যান্ড ফুটবলের দুনিয়ায় কোন মতেই ‘মিনোস’ এর চেয়ে বেশি কিছু হবার কথা নয়। একটি সময় পর্যন্ত তারা ‘পুঁচকে’ই ছিল। তবে, সব হিসেব বদলে যায় গত ইউরোতে খেলার যোগ্যতা অর্জন করার পর। স্বল্প সময়ের মধ্যেই বিশ্ব ফুটবলের অন্যতম জনপ্রিয় দল হতে তাদের বেশি সময় লাগেনি। তাদের অর্জন অনন্য উচ্চতায় পৌঁছায় লোকসংখ্যার দিক দিয়ে বিশ্বের ক্ষুদ্রতম দেশ হিসেবে এবারের রাশিয়া বিশ্বকাপ ফুটবলের চূড়ান্ত পর্বে খেলার যোগ্যতা লাভ করার পর।
দেশ ছোট হলে কী হবে, ওদের কলিজা অনেক বড়। এজন্যই ইউরোতে খেলার আগে টানা ২৩ বার সকল প্রকার আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের বাছাই পর্বে অংশ নিয়ে ব্যর্থ হবার পরও তারা হাল ছাড়ে নি! আইসল্যান্ডের ফুটবল সাফল্য কোন দৈব ঘটনা বা অলৌকিক শক্তি দিয়ে প্রাপ্ত কিছু নয়। অত্যন্ত যত্নের সাথে নেয়া দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার ফসলই হচ্ছে আইসল্যান্ড ফুটবলের বর্তমান সাফল্য। কী ছিল তাদের সেই পরিকল্পনা? এজন্য আমাদের ফিরে তাকাতে হবে দেশটির ৯০ দশকের ফুটবল ইতিহাসে…
আইসল্যান্ডে বছরের প্রায় অর্ধেকের বেশি সময় জুড়েই গড় তাপমাত্রা থাকে শূন্য ডিগ্রি অর্থাৎ যে তাপমাত্রায় পানি জমে বরফ হয়ে যায়! মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়টুকুই শুধুমাত্র ফুটবল খেলা যেত। ফলে, সে সময় ফুটবল খেলাটি মৌসুমি শখের চেয়ে বেশি কিছু ছিল না।
আইসল্যান্ড ফুটবল এসোসিয়েশন এই সমস্যা সমাধানের জন্য ২০০০ সালে তৈরি করে একটি বিশাল ফুটবল হাউজ! অর্থাৎ আস্ত একটি ইনডোর ফুটবল স্টেডিয়াম, যাতে করে তরুণ ফুটবলারগণ সারা বছর জুড়েই খেলার পাশাপাশি অনুশীলনও করতে পারে। স্বল্প সময়ের মধ্যেই দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্মিত হয় আরও ৭টি পূর্ণ আকারের ফুটবল হাউজ এবং ৪টি অর্ধ আকারের ফুটবল ফ্যাসিলিটি। শুধু তাই নয়, আরও ২২ টি আউটডোর ফুটবল হাউজের পাশাপাশি নির্মাণ করা হয় ১১১টি ছোট আকারের ফুটবল মাঠ। ফলে, ফুটবল শুধু আর গ্রীষ্মকালীন খেলা রইল না। সারা বছর জুড়েই খেলার সুযোগ তৈরি হল।
খেলার ফ্যাসিলিটি তো তৈরি হল, এরপর তারা দ্বিতীয় ধাপ হিসেবে আরও দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিলেন। বিশ্বমানের ফুটবল কোচিং! টিভি থেকে আয় করা বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করে শুরু করা হল সকলের জন্য উন্মুক্ত ফুটবল কোচিং সেশন। আইসল্যান্ডের ফুটবলপ্রেমী মানুষজন এই সুযোগটি সাদরে গ্রহণ করলেন এবং যার সুফল হল অভাবনীয়!!
৩ লক্ষ ৩৫ হাজার মানুষের দেশে বর্তমানে দক্ষ কোচের সংখ্যা প্রায় ৮০০! যার অর্ধেকেরও বেশি সংখ্যক উয়েফা বি গ্রেড লাইসেন্স! অনুপাতের হিসেবে প্রতি ৮২৫ জনের জন্য ১ জন! বোঝার সুবিধার্থে ইংল্যান্ডের উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। ইংল্যান্ডে বি গ্রেড লাইসেন্সধারী কোচের অনুপাত প্রতি ১১ হাজারে ১ জন!!
আইসল্যান্ডের গত ইউরো স্কোয়াডের প্রায় প্রত্যেক খেলোয়াড়ই তাদের কিশোর বয়সে এই ফুটবল কোচিং সিস্টেমে বড় হয়েছেন। ফুটবল কোচিং এর ব্যাপারে আইসল্যান্ড ফুটবল এসোসিয়েশনের এই পদক্ষেপ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে জনপ্রতি সর্বোচ্চ মানের কোচের হিসেবে আইসল্যান্ড বর্তমানে বিশ্বের এক নম্বর দল!!
সর্বশেষ ধাপ হিসেবে তারা জাতীয় দলের দায়িত্ব দিয়েছে বর্ষীয়ান সুইডিশ কোচ লার্স লাগারব্যাক এর হাতে। ২০১১ সালে তিনি যখন দায়িত্ব নেন আইসল্যান্ডের ফিফা র্যাংকিং ছিল ১৩৩। দলের দায়িত্ব নিয়েই প্রথমে তিনি তিনটি জিনিস নিয়ে কাজ শুরু করেন-খেলোয়াড়দের মনোভাব, পেশাদারিত্ব এবং দল নিয়ে সবার চিন্তা-ভাবনা। তিনি দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে ম্যাচ জেতার আত্মবিশ্বাস তৈরির ব্যাপারে জোর দেন যা তাদের মধ্যে কম ছিল।
ঝানু লাগারব্যাক বুঝতে পেরেছিলেন ছোট দেশ হবার ব্যাপারটি আসলে আইসল্যান্ডের দুর্বলতা নয়, বরং তাদের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হতে পারে। ছোট দেশ হবার কারণেই পুরো দলটি হয়ে উঠেছিল একটি একক পরিবারের। এমনকি সাধারণ দর্শকগণও হয়ে উঠল সেই পরিবারের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।
কিন্তু, ২০১৪ সালের ব্রাজিল বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের প্লে অফে ক্রোয়েশিয়ার কাছে ০-২ গোলে হেরে আইসল্যান্ডের স্বপ্নভঙ্গ হল। এতদসত্ত্বেও আইসল্যান্ড ফুটবল কর্তৃপক্ষ লাগারব্যাককে সপদে বহাল তো রাখলই পাশাপাশি সহকারী কোচ হাইমির হ্যালগ্রিমসনকেও পূর্ণ কোচ বানিয়ে দিল। অর্থাৎ একই সঙ্গে দুইজন পূর্ণ কোচ!
আইসল্যান্ড সেবারই ফ্রান্স ইউরোতে প্রথমবারের মত খেলার যোগ্যতা অর্জন করল। পাশাপাশি ক্ষুদ্রতম দেশ হিসেবে অংশ নেয়ার রেকর্ডটিও নিজের দখলে নিলো। ইউরোতে তাদেরকে আন্ডারডগের বেশি কিছু কেউ ভাবেনি। অথচ তারাই পর্তুগালের সাথে ড্র করল, ইংল্যান্ডকে হারিয়ে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় করে দিল! কোয়ার্টার ফাইনালে ফ্রান্সের কাছে হেরে গেলেও তারা বিশ্বের কোটি দর্শকের মন জয় করে নিলো। শুধু খেলাই নয় আইসল্যান্ডের দর্শকও সবার প্রিয় হয়ে উঠল। তাদের হাসিখুশি মনোভাব, বর্ণিল পোশাক এবং অনবরত চিৎকার করে দলকে অনুপ্রেরণা যোগাবার ক্ষমতা সবাইকে মুগ্ধ করল। তবে, তাদের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল ভাইকিং থান্ডারক্ল্যাপস! ম্যাচ শেষে সবাই মিলে এক তালে তালি বাজানো এবং মুখ দিয়ে ভাইকিং দের মত শব্দ করে চিৎকার-ভাইকিং থান্ডারক্ল্যাপস আইসল্যান্ডের পক্ষ থেকে ফুটবল বিশ্বের জন্য নিঃসন্দেহে একটি অনন্য উপহার!!
রাশিয়া বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে আইসল্যান্ড ছিল উয়েফা আই গ্রুপে। তাদের প্রতিপক্ষ ছিল ক্রোয়েশিয়া, ইউক্রেন, তুরস্ক, ফিনল্যান্ড এবং কসোভো। শুরুতে কেউ তাদের গণায় না ধরলেও শেষ পর্যন্ত আইসল্যান্ডই গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হিসেবেই বিশ্বকাপ খেলার যোগ্যতা অর্জন করে নেয়।
বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে আইসল্যান্ড আছে ডি গ্রুপে। তাদের প্রতিপক্ষ আর্জেন্টিনা, ক্রোয়েশিয়া এবং নাইজেরিয়া। বিশ্বকাপে তারা কতটুকু সফল হতে পারবে সেটা ভবিষ্যতের হাতেই তুলে রাখি, তবে তারা যে টুর্নামেন্টের অন্যতম জনপ্রিয় দল হয়ে থাকবে এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।
ভাল কথা, বর্তমান ফিফা র্যাংকিং অনুযায়ী আইসল্যান্ডের অবস্থা ২২ তম! আইসল্যান্ড প্রমাণ করেছে যে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ও তার প্রয়োগ, সঠিক স্থানে সঠিক লোক নিয়োগ, সরকারের পক্ষ থেকে সকল প্রকার সাহায্য ও সহযোগিতা থাকলে সকল বাঁধা পেরিয়ে ফুটবলে সফল হওয়া সম্ভব।
সরকার, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ এবং খেলোয়াড়গণ কি আইসল্যান্ডের শিক্ষা কাজে লাগিয়ে আমাদের ফুটবলের পুরনো ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনতে পারে না? অবশ্যই পারে। দরকার শুধু আন্তরিক প্রচেষ্টা!
(সিএনএন স্পোর্টস অবলম্বনে)