”অস্ট্রেলিয়ায় তখন চলছে ২০১৫ বিশ্বকাপ। ব্রিসবেনে এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ দলকে সংবর্ধনা দিচ্ছিল স্থানীয় বাঙালিরা। নিজের বক্তৃতায় দল নিয়ে কথা বলতে গিয়ে এক পর্যায়ে বিসিবি প্রধান নাজমুল হাসান রসভরা কণ্ঠে বললেন, “আমাদের ‘বুম বুম তামিম’ তো এখন ‘ঘুম ঘুম তামিম’ হয়ে গেছে!’’
পুরো হলরুমে হাসির হুল্লোড় উঠল। ক্রিকেটাররা সবাই স্তব্ধ। তামিম ইকবাল চেষ্টা করেছেন স্বাভাবিক থাকতে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে যেন মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। সেদিন রাতে হোটেলে ফিরে হাউমাউ করে কেঁদেছেন তামিম। ঘনিষ্ঠজনদের বলেছেন, ক্রিকেট খেলার ইচ্ছাটাই মরে গিয়েছিল তাঁর। পরে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা রাতজুড়ে বুঝিয়েছেন তাঁকে। উজ্জীবিত করেছেন। সকালের দিকে খানিকটা স্বাভাবিক হয়েছেন এই ওপেনার।
পরের কয়েক দিন দলের সবাই শুধু একটি কথাই বারবার বলেছেন, ‘একজন বোর্ড প্রধান এভাবে বলতে পারেন!’
হ্যাঁ, নাজমুল হাসান পারেন। সেটিই প্রথম ছিল না। শেষও নয়। ক্রিকেটারদের নাম ধরে পারফরম্যান্স নিয়ে বোর্ড প্রধানের এভাবে প্রকাশ্যে বলার নজির ক্রিকেট ইতিহাসেই বিরল। কিন্তু বিসিবি প্রধান নানা সময়ে মাইক্রোফোনের সামনে অকপটে বলে দিয়েছেন, “আল আমিনের তো ফিল্ডিং হয় না” বা “অমুক তো রানই করতে পারছে না”, কিংবা “তমুকের বোলিং চলে না”। বলার অপেক্ষরা রাখে না, নাম নেওয়া ক্রিকেটার তো বটেই, সতীর্থরাও বারবার বিব্রত ও লজ্জিত হয়েছে তাদের অভিভাবকের কথায়।”
…
“গত এপ্রিলে বোর্ড প্রধান আচমকা জানালেন, বাংলাদেশের সঙ্গে সিরিজ খেলতে চায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। দিন-তারিখ বলেও জানালেন যে, অমুক তারিখে চূড়ান্ত জানা যাবে। এরপর আর সেটা নিয়ে কথা নেই। পরে জানা গেল, আসলে এরকম প্রস্তাবই দেয়নি ওয়েস্ট ইন্ডিজ!
নানা সময়ে হুটহাট নানা সিরিজের ঘোষণা দিয়ে পরে আর কিছুই করতে না পারার উদাহারণ আছে আরও। এরপর গত আইসিসি সভা থেকে ফিরে র্যাঙ্কিংয়ে পাঁচে ওঠার ভুল খবর দিয়ে গোটা ক্রিকেট বিশ্বের সামনে লজ্জিত করেছেন বাংলাদেশকে।”
–দেশের ক্রিকেটে অশনি সংকেত, বিসিবি প্রধান কি শুনতে পাচ্ছেন, আরিফ রনি, বিডিনিউজ২৪ (গত বছর জুনের লেখা! অথচ এখনও কতটা প্রাসঙ্গিক!)
কিছুদিন আগে এই বোর্ড প্রধানই বলেছিলেন “মুশফিকের সমস্যা আছে।” বোর্ড প্রধান হয়ে সারাবিশ্বের সামনে জাতীয় দলের ক্যাপ্টেন সম্পর্কে এভাবে মন্তব্য করলে কি দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয় না? আচ্ছা, দেশের ভাবমূর্তি না হয় বাদই দিলাম-ক্যাপ্টেনের মনোবল, দলের আত্মবিশ্বাস কতখানি টলে যায়? এগুলো কি এই অযোগ্য লোকটি বুঝতে পারেন??
২।
তাহলে দেখা যাচ্ছে বোর্ড প্রধান ফালতু কথা বললে কিংবা ভুল/মিথ্যে তথ্য দিয়ে সারাবিশ্বের সামনে হাসির খোরাক হলেও দেশের ভাবমূর্তির কোন সমস্যা হয় না। যেমন হয় না-
ক। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে ‘প্লেয়ার্স বাই চয়েজ’ (বিভিন্ন ক্যাটেগরিতে ক্রিকেটারদের পারিশ্রামিক বেঁধে দেওয়া) নামক বিতর্কিত নিয়ম চালু করলে!
খ। বছরের পর বছর বিসিবিতে এজিএম না হলে। অথচ দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা, কাজের অগ্রগতির হিসেব, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতা, আয়-ব্যয়ের হিসেবের জন্যও এজিএম হওয়া জরুরী!
গ। একই লোক দশের অধিক পদে থাকলে। যার অধিকাংশ একে অপরের সাথে সাংঘর্ষিক! আবার আত্মসম্মান রক্ষার্থে প্রধান নির্বাচক পদত্যাগ করলেও তাতে দেশের সম্মান নষ্ট হয় না!
ঘ। কোচকে ঐশ্বরিক ক্ষমতা প্রদান করলে। মজার ব্যাপার হচ্ছে নির্বাচক হবার পরও কোচকে কোন খেলা দেখতে যেতে হয় না। যেন ঘরে বসেই সবার কথা টেলিপ্যাথির মাধ্যমে জেনে যান!! অবশ্য, কোচকে দোষ দিয়ে লাভ কী! অন্যান্য নির্বাচকও ঘরোয়া সব খেলা দেখেন না। এসব ‘ফালতু’ খেলা দেখার সময় কোথায়?
ঙ। ২য় এবং ৩য় বিভাগে দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারীতায় কোন সমস্যা নেই। প্রিমিয়ার লিগে ভেন্যু ও আম্পায়ার নিয়ন্ত্রণ করার মত ঘৃণ্য অপরাধ করেও একটি বিশেষ দল পার পেয়ে যায়! দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় না!
চ। দেশে নাম কা ওয়াস্তে ঘরোয়া লিগ হয়। সকল স্টেডিয়ামে খেলা হয় না। স্টেডিয়ামগুলোর ঠিকমত রক্ষণাবেক্ষণ হয় না। টিকিট কালোবাজারীদের দৌরাত্মে লোকজন ঠিকমত খেলা দেখতে পারে না। মাঠের ভিতরে খাবার পানীয় নিয়ে চলে মনোপোলিস্টিক ব্যবসা! এবং এসব কোন কিছুতেই দেশের সম্মানের কোন সমস্যা হয় না!
ছ। মিরপুর বাদে অন্য কোন স্টেডিয়ামে জিম নেই। দেশি-বিদেশি খেলোয়াড়গণ চট্টগ্রামে গিয়ে হোটেলের জিম ব্যবহার করে। তখন কি দেশের সম্মান বেড়ে যায়?
জ। দেশের ক্রিকেট নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী কোন পরিকল্পনা নেই। বিকেএসপি বা বয়সভিত্তিক দল থেকে যা খেলোয়াড়গণ উঠে আসছে। অথচ, বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই একাধিক আধুনিক-সুবিধা সম্পন্ন ক্রিকেট একাডেমি রয়েছে। ভাল পেসারের জন্য আমাদের কত হা হুতাশ, অথচ আমাদের কোন পেস একাডেমি নেই। বিসিবির সম্ভবত এত কিছু দেখার সময় নেই, তারা দেশের ‘ভাবমূর্তি রক্ষায়’ ব্যস্ত!
ঝ। আমাদের দেশের একটি বড় জেনারেশন রফিককে দেখে বাহাতি স্পিনার হওয়ার অনুপ্রেরণা পেয়েছে। অথচ জাতীয় দলের স্পিন কোচ করা হয় সাধারণ মানের ভিন্ন দেশের, ভিন্ন ভাষাভাষী সুনীল যোশীকে!! দেশের ক্রিকেটারদের আমরা মূল্য দিই না, সুযোগও দিই না। বাইরের লোকজন ধরে আনলে কী দেশের ভাবমূর্তি বাড়ে? হবে হয়ত!
ঞ। বিপিএল নামক কৌতুক চলছে বছরের পর বছর! যে খেলাটি নবীন ও আক্রমনাত্মক দেশি খেলোয়াড় বানানোর সূতিকাগার করা যেত, এমনকি হতে পারত নবীন ধারাভাষ্যকারদের উঠে আসার প্ল্যাটফর্ম- সেটি আসলে ফিক্সিং করার আদর্শ জায়গা এবং বিদেশী বাতিল খেলোয়াড়দের (বিশেষ করে পাকি খেলোয়াড়দের) চারণক্ষেত্র! খেলোয়াড়দের বেতন-ভাতা ঠিকমত পরিশোধ করা না, দুর্বল আম্পায়ারিং, বিদেশিদের কোটা বৃদ্ধি ইতাদি নানা অভিযোগে অভিযুক্ত!
আবার, যে খেলোয়াড়টি ফিক্সিং এর দায়ে নিষিদ্ধ হয়েছিল তাকে দিয়েই নতুন সিজনের প্রচারণা চালানো হয়!! এরচেয়ে নিষ্ঠুর কৌতুক আর কী হতে পারে! অবশ্য যে দেশে খুনী, স্বৈরাচার জেল খেটে রাজনীতিতে ফিরতে পারে, ঘৃণ্য রাজাকার জননেতা হয়, খুনী-ধর্ষক নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়ায় সেই দেশে এটা কোন ব্যাপারই না!
৩।
মুশির কথায় কি দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে?
ব্যাপারটি অনেকটি এরকম যে একজন রাস্তায় মার খেয়ে হাত-পা ভেঙে পড়ে আছে। এরপর আরেকজন এসে তার গায়ে কাদা ছিটিয়ে দিল! মুশির কথায় দেশের ক্রিকেটের গায়ে খুব বেশি হলে কাদা লাগার ক্ষতি হতে পারে, কিন্তু হাত-পা ভেঙে দেয়ার ব্যবস্থাটি পাপন-সুজন-হাথুরু-নান্নু রাই করেছেন!
নিজে মানে না বা করে না, কিন্তু অন্যকে করতে বলে-এরকম লোককে মিথ্যেবাদী, নির্লজ্জ ও বেহায়া বললেও কম হয়ে যায়। সুতরাং, বিসিবি প্রধানকে আমি কোন গালি দিতে চাচ্ছি না! কারণ এই লোকের লজ্জা না থাকতে পারে, আমার তো আছে!
কারণ এই লোকের লজ্জা না থাকতে পারে, আমার তো আছে! -- তাই তো! 🙂