বছর খানেক আগে সদা হাস্যজ্বল সারা টেইলর ক্রিকেট বিশ্বকে হতবাক করে জানিয়েছিলেন যে তিনি মানসিক সমস্যায় ভুগছেন! ইংল্যান্ড নারী দলের এই উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান নাকি মাঝে মাঝেই তীব্র প্যানিক এটাকের শিকার হতেন! সাধারণত ব্যাটিং এ নামার আগে ড্রেসিং রুমে অপেক্ষার সময়ে এটাক বেশি হত, তবে মাঝে মাঝে ফিল্ডিং করার সময়ও তিনি এই সমস্যায় ভুগেছেন! মানসিক এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাবার আশায় কিছুদিন তিনি ক্রিকেট থেকে দূরেও ছিলেন…
গত এক দশকে বেশ কয়েকজন হাই প্রোফাইল পুরুষ ক্রিকেটারের মধ্যেও বিভিন্ন মানসিক সমস্যা দেখা দিয়েছিল। মার্কাস ট্র্বেসকথিক দেশের বাইরে খেলতে গেলে ডিপ্রেশনে ভুগতেন। মন্টি পানেসার জানিয়েছেন অ্যাংজাইটি জনিত সমস্যা তার আত্মবিশ্বাস কমিয়ে দিয়েছে এবং এটি তার ব্যক্তিগত জীবনেও বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। কিউই বোলার ইয়ান ও’ব্রায়েনের পুরো ক্যারিয়ারই কেটেছে ডিপ্রেশনের সাথে লড়াই করতে করতে! অসি ফাস্ট বোলার শন টেইট ইনজুরি এবং প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থতা থেকে সৃষ্ট ডিপ্রেশনে ভুগে অনেকদিন খেলা থেকে বিরতি নিয়েছিলেন। এন্ড্রু ফ্লিনটফও একসময় ভয়ানক ডিপ্রেশনে ভুগেছেন।
ইংল্যান্ড কাউন্টি দল মিডলসেক্স ক্লাবের সাইকোলোজিস্ট স্টিভ সিল্ভেস্টারের মতে, দীর্ঘ সময় ধরে বিরাজমান স্ট্রেস থেকে নানা মানসিক সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে, বিশেষ করে ডিপ্রেশনের মত ভয়ানক অসুস্থতা দেখা দিতে পারে!
আধুনিক ক্রিকেটে বিশেষ করে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ক্রিকেটারদের প্রচণ্ড স্ট্রেস সহ্য করতে হয়। ম্যাচে জয় লাভ হবে নাকি পরাজয়, ভাল খেলার তাগিদ কিংবা খারাপ খেলার চাপ, দীর্ঘদিন ধরে দেশের বাইরে থাকা, প্রতিনিয়ত দলে টিকে থাকার লড়াই, বোর্ডের সাথে চুক্তি, বেতন ভাতা- সব মিলিয়েই স্ট্রেস তৈরি হয়। প্রতিনিয়ত প্রত্যাশার চাপ, ভ্রুকুটি কিংবা সমালোচনা শুনতে হয় সহ-খেলোয়াড় থেকে শুরু করে কোচ, নির্বাচক, বোর্ড, স্পন্সর, দর্শক এবং মিডিয়ার! আবার শুধু রান করলে বা উইকেট পেলেই হবে না, কিভাবে, কখন এবং কাদের বিরুদ্ধে পেয়েছে সেটাও দেখা হয়!! মাঝে মাঝে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যেরও সমালোচনা সহ্য করতে হয়।
সিল্ভেস্টার বিশ্বাস করেন যারা সবসময় জয়, পরাজয় কিংবা পারফরমেন্স নিয়ে বেশি চিন্তা করে তাদের মধ্যে অবধারিতভাবে মানসিক সমস্যার সৃষ্টি হয়! তিনি বলেন, ছোটবেলা থেকেই আমাদের মধ্যে একটি ধারণা ঢুকিয়ে দেয়া হয় যে হেরে যাওয়া মানেই সে খারাপ! ঠিক এই কারণেই আমরা পরাজয়কে সহজভাবে মেনে নিতে পারি না! স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, চাকুরিক্ষেত্র কিংবা খেলাধুলা সবখানে ফলাফলটাই আসল! সবমিলিয়ে যে কোন প্রতিযোগিতায় আমাদের মাত্র দু’টো পথ-হয় মর, না হয় মারো!
দুঃখের বিষয় বেশিরভাগ মানুষই নেতিবাচক ফলাফলকে ঠিকমত সামলাতে পারে না। হয় অস্বীকার করবে, নিজেকে দূরে সরিয়ে নেবে, অন্যকেউ বা অন্য কিছুকে দোষারোপ করবে কিংবা পুরো ঘটনাকে ভুলে যাবার চেষ্টা করবে। আর এভাবেই আমাদের দেহ ও মনে নেতিবাচক আবেগ বা শক্তি জমতে থাকে এবং নানা সমস্যা দেখা দেয়।
একেক মানুষ একেকভাবে এই সমস্যা মোকাবেলা করে! পানেসার ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ঔষধ খেতেন। অপরদিকে, সারা টেইলর কগনিটিভ বিহেভিরাল থেরাপি (Cognitive Behavioral Therapy)’র সাহায্য নিয়েছেন। এর বাইরে আছে ট্রেসকথিক বা জোনাথন ট্রটের মত খেলোয়াড়, যারা শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক খেলা থেকেই অবসর নিয়েছেন!
মূল ধারার চিকিৎসার ভাষ্য অনুযায়ী মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যাগুলো নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তবে পুরোপুরি সারিয়ে তোলা যায় না। সমস্যা নিয়ে কথা বললে কিংবা ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা গ্রহণ করলে সেগুলো নিয়ন্ত্রণে থাকে। অবশ্য, ‘বিকল্প ধারার’ বিশেষজ্ঞগণ এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেন! অনেকের মতে রেইকি (Reiki) বা ফেং শুই (Feng Shui) এর মত থেরাপি মানুষকে রিল্যাক্স, ডি-স্ট্রেস এবং নেতিবাচক আবেগ বা শক্তি থেকে মুক্ত হতে সহায়তা করে। কিনিশিওলোজিস্টগণ (Kiniesiologists) বিশ্বাস করে মানুষের প্রতিটি ব্যথা শরীরের নির্দিষ্ট অংশে থাকে এবং সেই স্থানটি চিহ্নিত করতে পারলে তা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। ধ্যান, ইতিবাচক আচার-ব্যবহার এবং দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে মন ও আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
চিকিৎসাবিজ্ঞান কিংবা ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানীগুলো যাই বলুক না কেন-অন্য অনেকের মত ক্রিকেটারগণও প্রায়ঃশই এই বিকল্পধারার থেরাপি গ্রহণ করেন। শ্রীলঙ্কান জাতীয় ক্রিকেটদল ইংল্যান্ডে সফরে গেলে মিল্টন কেইন্স এর ‘রঞ্জিনি উডহাউজ’ এ যান। সেখানে রাসেল আর্নল্ডের কাজিন রেইকি সেশন পরিচালনা করেন। গ্রেগ চ্যাপেল ভারতের কোচ থাকাকালীন কিনিশিওলোজিস্ট চার্লস ক্রেবস খেলোয়াড়দের থেরাপি দিতেন। গলার ক্যান্সার ধরা পড়ার পর জিওফ বয়কট নিয়মিত রেইকি থেরাপি নিতেন, এমনকি একজন ফেং শুই মাস্টার ডেকে নিজের বাসার ইন্টেরিওরও বদলে নিয়েছিলেন তিনি।
ওয়ারউইকশায়ারের সাবেক খেলোয়াড় পল স্মিথের মতে খেলোয়াড়দের মানসিক সমস্যা থেকে মুক্তি পাবার সেরা উপায় হচ্ছে শুরুতেই সমস্যাকে শনাক্ত করা এবং সেই অনুযায়ী কাজ করা। যেমনটিক করেছিলেন সারা টেইলর। স্মিথ বলেন, এখনকার খেলোয়াড়গণ দিনের বড় অংশ কাটায় অন্যান্য খেলোয়াড়, কোচ বা ফিটনেস ইনস্ট্রাক্টরদের সাথে। এর পাশাপাশি একজন পিতৃতুল্য মানুষও দরকার, যে আলাদা করে ডেকে জিজ্ঞাসা করবে ‘সব ঠিক আছে তো?’ যে কোন পরিস্থিতিতে একমাত্র তিনিই বুঝতে পারবেন কোন খেলোয়াড় মানসিক সমস্যার শিকার হয়েছে কী না।
স্মিথ যখন ওয়ারউইকশায়ারে ছিলেন বব উইলিস তার জীবনে ঠিক এমন একজন হিসেবে ছিলেন। প্রায়শই তিনি স্মিথকে বারে নিয়ে যেতেন এবং আলাদা করে ভাল-মন্দ জিজ্ঞাসা করতেন। এর কিছুদিন পর বব উলমার নতুন কোচ হিসেবে দলে যোগ দেন, তিনিও এরকম ছিলেন।
উইলিস কিংবা উলমার উভয়েই অভিজ্ঞ ও বুদ্ধিমান ছিলেন। তাঁরা জানতেন ম্যাচ, লীগ বা টুর্নামেন্ট জেতার জন্য সবার আগে জরুরী খেলোয়াড়দের শারীরিক ও মানসিকভাবে শতভাগ সুস্থ থাকা। ক্রিকেটারগণ শুধু খেলোয়াড়, এন্টারটেইনার, সেলিব্রিটি কিংবা কর্পোরেট জগতের সম্পদ নয়, তারা রক্ত মাংসের মানুষও!!
২।
স্ট্রেসের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল এটি মাপা যায় না এবং এর জন্য সত্যিকারের কোন কারণও লাগে না। অর্থাৎ, সত্যিকারের সমস্যা না থাকা সত্ত্বেও যে কারোর মনে স্ট্রেস তৈরি হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে সাকিব আল হাসানের নাম নেয়া যেতে পারে। অনেকে বলছেন সাকিব তো বিশ্বের অন্য অনেক খেলোয়াড়ের চেয়ে কম ম্যাচ খেলছে, তাহলে ওর কেন স্ট্রেস দেখা দেবে?
আসলে খেলার পরিমাণ এখানে মূখ্য নয়, সাকিবের যদি মনে হয় ওর সমস্যা হচ্ছে তাহলে কোন যুক্তি-তর্ক, উপাত্ত দিয়ে ওর মনকে আপনি বোঝাতে পারবেন না। সবচেয়ে বড় কথা- স্ট্রেস সবসময় পরিমাণের উপর নির্ভর করে না। একটি ওভার, এমনকি একটি বল খেলতে বা করতেও সারা বছরের সমান স্ট্রেস দেখা দিতে পারে। এটি এমনই এক ভয়ানক জিনিস!
৩।
এবার স্পষ্ট ভাষায় কিছু কথা বলি।
সাকিবের বিশ্রাম নেয়ার সিদ্ধান্তে আমি কি খুশি?
অবশ্যই না। কেননা, সাকিব ছাড়া বাংলাদেশ দল আমি চিন্তাই করতে চাই না, অন্ততঃ এখনই না। কিন্তু, ওর সিদ্ধান্তের প্রতি আমার পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। কারণটি ও নিজেই ব্যাখ্যা করেছে-
আগামী ২ বছর নয়, কমপক্ষে ৫-৭ বছরের জন্য সাকিবকে জাতীয় দলে (সব ফরম্যাটে) দেখতে চাই। কয়েক বছর আগে তামিম অফ ফর্মজনিত কারণে একই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গিয়েছিল। তামিমের দুর্ভাগ্য যে তখনও আমাদের দেশে ‘বিশ্রাম’ নেয়ার কোন উদাহরণ ছিল না। এ কারণেই ওর ফর্মে ফিরতে স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বেশি সময় লেগেছিল, পাশাপাশি সমালোচনার ব্যাপারটি তো ছিলই! সুতরাং, এটা বলা যায় যে সাকিবের কারণে আমাদের দেশে ইতিবাচক আরেকটি দৃষ্টান্তেরও সূচনা হল।
সাকিব আল হাসানের জন্য শুভ কামনা রইল!
(লেখার প্রথম অংশটি ক্রিকইনফো’র একটি আর্টিকেলের ভাবানুবাদ)
:thumbup: :thumbup: