ম্যালকম মার্শালের জন্ম ১৮ এপ্রিল ১৯৫৮। ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের বিখ্যাত পেস এটাকের তিনি ছিলেন সেরাদের মধ্যে অন্যতম সেরা, ভয়ংকরতম তো অবশ্যই! ১৯৯৯ সালে মাত্র ৪১ বছর বয়সে এই লিজেন্ডারি ক্রিকেটার ক্যান্সারের আক্রমণে মারা গিয়েছেন। তাঁকে স্মরণ করে এই লেখাটি লিখেছিলেন ক্রীড়া সাংবাদিক অরুনাভ সেনগুপ্ত।
সেরাদের সেরা
৭০ ও ৮০’র দশকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল আক্ষরিক অর্থেই ক্রিকেট বিশ্বকে শাসন করেছে, যা আগে কখনও কোন দল করতে পারে নি। তারা শুধু প্রতিপক্ষকে পরাজিতই করত না-তাদেরকে উড়িয়ে দিত, মনের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করত! ভিভ রিচার্ডস, গর্ডন গ্রিনিজ, ক্লাইভ লয়েড এবং অন্যান্য ব্যাটসম্যান পৃথিবীর যে কোন মাঠেই রানের তুবড়ি ছোটাতেন। অপরপক্ষে বিপক্ষের ব্যাটসম্যান-যতই দক্ষ ও সাহসী হোক না কেন, পৃথিবীর ভয়ংকরতম পেস এটাকের সামনে ভয়ে ভয়ে ব্যাট করতে নামত! এদের মধ্যে চারজন বোলার ছিলেন সবার থেকে এগিয়ে-ম্যালকম মার্শাল, জোয়েল গার্নার, মাইকেল হোল্ডিং এবং এন্ডি রবার্টস। প্রত্যেকেই ছিলেন একে অন্যের চেয়ে আলাদা-বোলিং একশন বা বৈচিত্র্যের দিক দিয়ে। তবে, একটি জায়গায় সবার মিল ছিল- প্রত্যেকেরই বলে ভয়াবহ গতি ছিল! ভয়ঙ্কর গতি! পুরো ইনিংস-জুড়েই তারা একের পর এক প্রতিপক্ষের উপর চড়াও হতেন! গতি, সঠিক লাইন-লেন্থ ও বাউন্স সম্পন্ন বুলেটের গতিতে করা বলগুলো সামলাবার মতন ব্যাটসম্যান অন্যান্য দল-গুলোয় খুব কমই ছিল!
ঐ সময়টাতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটে ফাস্ট বোলারদের যেন মেলা বসেছিল! উপরে উল্লেখ করা চারজনের পাশাপাশি আরও ছিলেন কলিন ক্রফট, প্যাট প্যাটারসন, ওয়েইন ড্যানিয়েল, সিল্ভেস্টার ক্লার্ক, ইয়ান বিশপ, কোর্টনি ওয়ালশ, কার্টলি এমব্রোস…প্রত্যেকেই গ্রেট, প্রত্যেকেই একে অন্যের চেয়ে ভয়ংকর গতি সম্পন্ন! ভাবতে অবাক লাগে এতজন লম্বা, কৃষ্ণাকার, দানবাকৃতির বোলারদের মধ্যে ভয়ঙ্করতম ছিলেন অপেক্ষাকৃত ছোট-খাটো ও নিরীহ-দর্শন মানুষটি! অন্যদের মতন ম্যালকম মার্শালের বিশাল দৈহিক গড়ন ছিল না। তাঁর উচ্চতা ছিল ‘মাত্র’ (বাকিদের তুলনায় এটা মাত্র তো বটেই!) ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি! কিন্তু, সেই বিখ্যাত ‘সাইজ ডাজন্ট ম্যাটার’ প্রবাদকে সত্য প্রমাণ করে তিনিই ছিলেন সবচেয়ে প্রাণঘাতী! উচ্চতার ঘাটতি পুষিয়ে নিতেন বিদ্যুৎ-গতির রান আপ এবং ক্ষিপ্রগতির বল রিলিজের মাধ্যমে।
বেশিরভাগ বোলারের মতন সোজা না হয়ে তাঁর রান আপ উইকেটের সাথে বেশ খানিকটা কৌণিক ছিল। বোলিং করতেন ‘ওপেন চেস্টেড’ এবং বল ডেলিভারির সময় ডান হাতটা চাবুক মারার মতন ক্ষিপ্র গতিতে চালাতেন। বোলিং একশন দেখে সুইং আন্দাজ করার কোন উপায় ছিল না। বেশিরভাগ সময় ব্যাটসম্যানই বলের সুইং এর চেয়ে গতি সামলাতেই বেশি ব্যস্ত থাকত! ছোট গড়নের কারণে বল কিছুটা স্কিডও করত, ফলে বাউন্সারগুলো বেশিরভাগ সময়ই ব্যাটসম্যান বোঝার আগেই গায়ে আঘাত করত!
তবে শুধু গতিই নয় এর পাশাপাশি তাঁর ভাণ্ডারে আরও অস্ত্র ছিল! তিনি দুই দিকে বল সুইং করাতে পারতেন। শরীরে বদলে হাতের মুভমেন্ট দিয়ে সুইং করাতেন বলে এগুলো ধূর্ততম লেগ স্পিনারের লেগ-ব্রেক বা গুগলির মতন কার্যকরী ছিল! এছাড়াও তিনি ডেনিস লিলির কাছ থেকে লেগ কাটার রপ্ত করেছিলেন যা দিয়ে স্লো, ডাস্টি পিচেও ব্যাটসম্যানদের নাজেহাল করতেন। ইচ্ছে মতন বলের গতি কমাতে পারতেন-এক্সপ্রেস, বিদ্যুৎ গতির ফাস্ট এমনকি মাঝে মাঝে মিডিয়াম পেসারের গতিতেও বোলিং করতেন! দলের প্রয়োজনে রাউন্ড দ্যা উইকেট গিয়ে ব্যাটসম্যানের শরীর বরাবর বল করতেও দ্বিধা করতেন না! অনেকের মতে যা ছিল বডি লাইন বোলিং এর পর অন্যতম ভয়ানক দৃশ্য!
গাভাস্কার, মাইক গ্যাটিং থেকে শুরু করে সে আমলের প্রায় সকল নামী ব্যাটসম্যানদের প্রত্যেকের শরীরেই তাঁর আঘাতের চিহ্ন দেখতে পাওয়া যাবে! অথচ খেলা শেষে তিনিই যখন প্রিয় পানীয় হাতে নিয়ে হাসি-ঠাট্টায় মেতে উঠতেন-সকলেই তাঁকে পছন্দ করত! মাঠের বাইরে তিনি ছিলেন সকলের ভীষণ প্রিয়পাত্র!
শুরুর কথা
বার্বাডোজে জন্ম নেয়া মার্শালের আইডল ছিলেন গ্যারি সোবার্স! সত্য কথা বলতে কি, তিনি সোবার্সের এতটাই ভক্ত ছিলেন যে জাতীয় দলের খেলার সময়ে ক্লাইভ লয়েড প্রায়ই তাঁর হাতে বল দিয়ে বলতেন, ‘Come on Sobey, have a bowl!’ ১৯৭২ সালে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে কিংস্টন ওভালে করা সোবার্সের সেঞ্চুরি দেখেই ক্রিকেট খেলার প্রতি তাঁর অনুরাগ জন্মে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে সোবার্সের মতন তাঁর জীবনেও অনেক ঘাত-প্রতিঘাত সইতে হয়েছে!
মার্শালের বয়স যখন মাত্র এক বছর তখন তাঁর বাবা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। মায়ের কাছে মানুষ হলেও ক্রিকেটের ব্যাপারে প্রাথমিক তালিম পেয়েছেন নানার কাছ থেকে।
ক্যারি প্যাকার সিরিজের ধাক্কায় সারা পৃথিবীর ক্রিকেট যখন টালমাটাল ঠিক সেসময় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ম্যালকম মার্শালের যাত্রা শুরু হয়। দলের মূল বোলারদের অনুপস্থিতে তাঁকে ১৯৭৭-৭৮ মৌসুমের ভারত সফরে নেয়া হল। অথচ সে সময় তাঁর অভিজ্ঞতা বলতে ছিল বার্বাডোজের হয়ে খেলা মাত্র ১ টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ! ভারতের শক্তিশালী ব্যাটিং এর বিরুদ্ধে ৩ টেস্টে তেমন কিছু করতে না পারলেও ট্যুর ম্যাচ-গুলোয় অনেকগুলো উইকেট নেন। যার পুরষ্কারস্বরুপ পরের বছরে হ্যাম্পশায়ারের হয়ে কাউন্টি খেলার নিমন্ত্রণ পান।
১৯৮০ সালে প্রথমবারের মতন রবার্টস, হোল্ডিং এবং গার্নারের পাশাপাশি বোলিং করার সুযোগ পান। সারা পৃথিবী প্রথমবারের মতন ভয়ঙ্কর পেস কোয়ার্টেট এর সাথে পরিচিত হয়ে ওঠে! নিজের জাত চেনাতে বেশি সময় নেন না মার্শাল। ওল্ড ট্র্যাফোর্ড টেস্টে স্বল্প ব্যবধানে মাইক গ্যাটিং, ব্রায়ান রোজ ও পিটার উইলি’র উইকেট শিকার করেন। অবশ্য, তারপরও জাতীয় দলে নিয়মিত হবার জন্য তাঁকে আরও বছর দুয়েক অপেক্ষায় থাকতে হয়।
সাফল্যের চূড়ায়!
মার্শালের সেরা সময়ের শুরু হয় ১৯৮২-৮৩ সালে থেকে যখন ভারত ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে যায়। সে সময় তিনি প্রায় ২ বছর বাইরে থাকার পর দলে আবার সুযোগ পেলেন। কাউন্টিতে এক মৌসুমে ১৩৪ টি উইকেট শিকার করায় এই সুযোগটি পেয়েছিলেন। ভারত সফরে মার্শাল প্রথমবারের মতন ৫ উইকেট দখলের পাশাপাশি মোট ২১ উইকেট নেন। এরপর থেকেই দলের অন্যতম মূল বোলার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং অবসর নেয়ার আগ পর্যন্ত সেই স্থানটি ধরে রেখেছিলেন।
১৯৮৩ সালের প্রুডেনশিয়াল বিশ্বকাপে তিনি দারুণ বল করলেন। ১৪ গড় এবং ২.৫ ইকোনমির বদলে দখল করলেন ১২ উইকেট। সেমিফাইনালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আগুন ঝরানো স্পেলিং করে ২৮ রানে ৩ উইকেট নেন। তবে, দুর্ভাগ্যবশত ফাইনালে তাঁর দল ভারতের কাছে হেরে গেল। এটিকে এখন পর্যন্ত ক্রিকেটের অন্যতম অঘটন হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
সেই বছরের শেষে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল ভারত সফরে যায়। মুখে তেমন কিছু না বললেও সেটি ছিল বিশ্বকাপ ফাইনালে হারের প্রতিশোধ নেয়ার সিরিজ। ওয়েস্ট ইন্ডিজ অত্যন্ত নির্মম বদলা নিয়েছিল! এবং এই সিরিজের পর থেকেই পুরো বিশ্ব ম্যালকম মার্শালকে নতুন করে চিনল।
১ম টেস্ট ছিল কানপুর এ। শুরুতে সেখানকার স্লো, লো পিচে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ব্যাটসম্যানদের ব্যাট করতে সমস্যা হচ্ছিল। শুরুতে দ্রুত উইকেট পরার পরও ৬ষ্ঠ উইকেটে গ্রিনিজ ও ডুজন দায়িত্বের সাথে ব্যাট করে পরিস্থিতি সামাল দিলেন। এরপর মার্শাল আট নম্বরে ব্যাট করতে নেমে ৯২ রানের এক অনবদ্য ইনিংস খেললেন, এটাই শেষ পর্যন্ত তাঁর ক্যারিয়ার বেস্ট ব্যাটিং ছিল! ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৪৫৪ রানে অল আউট হবার পর ভারত যখন ব্যাট করতে নামল ২য় দিনের তখনও ১ ঘণ্টা খেলা বাকি। মার্শাল সেই মরা পিচেই ফাস্ট বোলিং এর চূড়ান্ত নিদর্শন দেখালেন! ভারত দিন শেষ করল ৩৪/৫, মার্শাল একাই নিলেন ৪ উইকেট!
ভারত অবধারিতভাবে ফলো অন করতে বাধ্য হল। মার্শাল দ্বিতীয় ইনিংসেও তাণ্ডব অব্যাহত রাখলেন। ১ম ইনিংসের মত এবারও ভারতের প্রথম ৪ জনকে আউট করলেন। ম্যাচে ৮ উইকেট নেবার পাশাপাশি ব্যাট হাতে ৯২ রান-ম্যান অব দ্যা ম্যাচ তিনিই হলেন। পুরো সিরিজ জুড়েই ওয়েস্ট ইন্ডিজের আধিপত্য বজায় থাকল, ওয়েস্ট জিতল ৩-০ ব্যবধানে। ভারতের মরা পিচে মার্শাল ১৮.৮১ গড়ে নিলেন ৩৩ উইকেট!
দেশে ফেরার কিছুদিনের মধ্যেই অস্ট্রেলিয়া সফর করতে আসল। সেই সিরিজে দখল করলেন ২১ উইকেট। সিরিজের উল্লেখযোগ্য বোলিং ছিল ব্রিজটাউনে ৫/৪২ ও কিংস্টনে ৫/৫১। খেলার বাইরে আরেকটি ঘটনা তাঁকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এল। দক্ষিণ আফ্রিকায় বিদ্রোহী সিরিজ খেলার জন্য ১ মিলিয়ন ডলার অফার পেয়েও তা প্রত্যাখ্যান করলেন!
পরের ইংল্যান্ড ট্যুরে সম্ভবত নিজের জীবনের সেরাটা উপহার দিলেন, অন্ততঃ নিজের লড়াকু মনোভাব তো অবশ্যই! বার্মিংহামের ১ম টেস্টে তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু করতে না পারলেও এন্ডি লয়েডের ক্রিকেট ক্যারিয়ার ধ্বংস করলেন। মার্শালের বলে মাথায় আঘাত পেয়ে তাকে হাসপাতালে যেতে হয়েছিল। অভিষিক্ত ম্যাচের আধা ঘণ্টার মধ্যেই বেচারার ক্যারিয়ার শেষ হয়েছিল! কেননা তিনি আর কখনও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরতে পারেন নি!
লর্ডস টেস্টের প্রথম ইনিংসে ৮৫ রানের বিনিময়ে ৬ উইকেট নিলেন। সব মিলিয়ে আট উইকেট নিলেও দলের উজ্জ্বলতম তারকা ছিলেন গর্ডন গ্রিনিজ। ৩৪২ তাড়া করতে গিয়ে দ্বিতীয় ইনিংসে অপরাজিত দ্বিশতক করলেন গ্রিনিজ। দল জিতল ৯ উইকেটে!
হেডিংলি টেস্টে ক্রিকেট বিশ্ব বুঝতে পারল ম্যালকম মার্শাল কি ধাতুতে গড়া! মাত্র ৬ ওভার শেষে ফিল্ডিং করার সময়ে হাতে ব্যথা পেয়ে মাঠে ছাড়েন তিনি। স্ক্যান করে জানা যায় বাম হাতের বুড়ো আঙ্গুলের ২ জায়গায় চিড় ধরেছে। ডাক্তার বলে দিলেন এই ম্যাচ তো বটেই, আগামী বেশ কিছুদিন ক্রিকেট খেলা চলবে না!
ইংল্যান্ডের ১ম ইনিংসে করা ২৭০ রানের জবাবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ এক পর্যায়ে ২৯০/৯ হয়ে গেল, গোমেজ অপরাজিত ৯৬ রানে! ইংরেজ ফিল্ডারগণ মাঠ ছাড়ার জন্য হাঁটা শুরু করলেও অবাক বিস্ময়ে দেখল বাম হাতে ব্যান্ডেজ নিয়ে মার্শাল ব্যাট হাতে এগিয়ে আসছেন! বিস্ময়ের তখনও আরও বাকী ছিল! উইকেটে গার্ড নিয়ে এক হাতে ব্যাট ধরে স্ট্যান্স দাঁড়ালেন! শেষ পর্যন্ত গোমেজ সেঞ্চুরি পেয়েছিলেন, শুধু তাই নয় মার্শাল এক হাতে একটি বাউন্ডারিও মেরেছিলেন! ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইনিংস শেষ হয় ৩০২ রানে।
শুধু ব্যাটিং ই নয়, ব্যান্ডেজ হাতে মার্শাল বোলিং ও করলেন! পিচে ঝড় তুলে ২৯ ওভার বল করে ৫৩ রানের বিনিময়ে নিলেন ৭ উইকেট! এরমধ্যে এক হাতে ক্যাচ নিয়ে গ্রায়েম ফাওলারকে কট এন্ড বোল্ড আউটও করেছেন! আঘাতের কারণে ৪র্থ টেস্ট খেলতে পারলেন না, তবে ৫ম টেস্টে আবার দলে ফিরলেন এবং প্রথম ইনিংসে ৩৫ রানের বিনিময়ে ৫ উইকেট দখল করলেন! দল টেস্ট জিতল ৫-০ ব্যবধানে, রচিত হল ‘ব্ল্যাক ওয়াশ’! ৫ ম্যাচ সিরিজের ৪ ম্যাচে তাঁর মোট উইকেট ছিল ২৪ টি।
এরপরের সিরিজ-গুলোয়ও তাঁর সাফল্য অব্যাহত রইল। অস্ট্রেলিয়া ট্যুরে গিয়ে ২৮ উইকেট দখল করলেন। সেবারই প্রথম এক ম্যাচে ১০ উইকেট নেয়ার স্বাদ পেলেন। দলে একাধিক ম্যাচ উইনার ফাস্ট বোলার থাকা সত্ত্বেও যা কি না অনেক বড় প্রাপ্তি! ৪ মাস পর নিউজিল্যান্ড সফর করতে এলে সেই সিরিজে নিলেন ২৭ উইকেট।
১৯৮৬ সালের শুরুতে ইংল্যান্ড সফর করতে ওয়েস্ট উইন্ডিজে গেল। প্রথম ওয়ানডেতে মাইক গ্যাটিং এর নাক ভেঙে মার্শাল জানিয়ে রাখলেন ইংরেজদের জন্য তাঁরা কি তৈরি করে রেখেছেন! ইংল্যান্ড আবারও টেস্ট সিরিজে ‘ব্ল্যাক ওয়াশ’ হল। মার্শাল একাই নিলেন ২৭ উইকেট।
পাকিস্তান সফরে গিয়ে তিনি কিছুটা ম্লান ছিলেন, নিয়েছেন মাত্র ১৬ উইকেট। তবে, কয়েক সিরিজ পরে ১৯৮৮ সালের ইংল্যান্ড সফরে গিয়ে আবারও জ্বলে উঠলেন। মাত্র ১২.৬৫ গড়ে তুলে নিলেন ৩৫ উইকেট! ততদিনে তাঁর গতি কিছুটা কমে এসেছে, বাউন্সারও আগের মতন বেশি দেন না। কিন্তু বয়সের সাথে ততদিনে তাঁর ভাণ্ডারে গতির পাশাপাশি যোগ হয়েছে আরও অনেকগুলো অস্ত্র!
শেষের শুরু
বিশ্বের ব্যাটসম্যানগণ তেমন কিছু করতে না পারলেও দেশের মধ্যেই চ্যালেঞ্জের শিকার হলেন মার্শাল। দলে ততদিনে জায়গা করে নিয়েছেন কার্টলি এমব্রোস এবং কোর্টনি ওয়ালশ! মার্শাল আগের মতন ভীতিকর থাকলেও নবীনরাও পাল্লা দিয়ে পারফর্ম করা শুরু করলেন। অস্ট্রেলিয়া সফরে মার্শাল ২৮.৭০ গড়ে নিলেন ১৭ উইকেট। ওয়ালশের উইকেট সংখ্যাও একই ছিল। তবে, সবচেয়ে উজ্জ্বল ছিলেন এমব্রোস, ২৬ উইকেট দখল করলেন তিনি।
এরপরের সিরিজে ভারত আবার ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে এল। বর্ষীয়ান মার্শাল ১৫.৬০ গড়ে নিলেন ১৯ উইকেট। তবে, দলে সে সময় আরেকজন নবীন তারকার দেখা মিলল-ইয়ান বিশপ!
নতুনদের সাথে পাল্লা দিয়ে সমানতালে পারফর্ম করলেও ধীরে ধীরে মার্শাল মূল বোলার থেকে পার্শ্ব নায়কের ভূমিকায় চলে গেলেন। অবশ্য, দলের প্রয়োজনে মার্শাল সেই ভূমিকাতেও সফল ছিলেন। এভাবে প্রায় আড়াই বছর তিনি খেলা চালিয়ে গেলেন।
মার্শাল তাঁর জীবনের শেষ সিরিজ খেললেন ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে, ১৯৯১ সালে। সিরিজটি ১-১ ব্যবধানে ড্র হয়েছিল। সিরিজের সাথে সমাপ্ত হল একটি যুগের, সমাপ্ত হল ক্রিকেটের এক উজ্জ্বল অধ্যায়ের। কেননা, এরপর একই সাথে অবসর নিলেন ম্যালকম মার্শাল এবং ভিভ রিচার্ডস!
মার্শাল সর্বমোট টেস্ট উইকেট দাঁড়ায় ৮১ টেস্টে ৩৭৬ টি, সে সময়ের ক্যারিবিয় রেকর্ড। এই রেকর্ডটি ৭ বছর পর ওয়ালশ ভেঙে দেন। ম্যালকম মার্শালের বোলিং গড় ২০.৯৪, যা এখন পর্যন্ত ২০০+ উইকেটে শিকারিদের মধ্যে সর্বনিম্ন! ২০০+ উইকেট শিকারিদের মধ্যে শুধুমাত্র ডেল স্টেইন ও ও্য়াকার ইউনুসের তাঁর চেয়ে (৪৬.৭) ভাল স্ট্রাইক রেট রয়েছে। একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন ১৩৬ টি, ২৬.৯৬ গড়ে উইকেট পেয়েছেন ১৫৭ টি। ইকোনমি ৩.৫৩!
এই গ্রেট ফাস্ট বোলার ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেটেও অংশ নিয়েছেন, তবে তেমন আলো ছড়াতে পারেন নি। ৫ ম্যাচে মাত্র ২ উইকেট শিকার করেছেন। আন্তর্জাতিক খেলা ছাড়ার পর তিনি আরও দুই মৌসুম হ্যাম্পশায়ারের হয়ে কাউন্টি খেলেছেন। ক্যারিয়ার শেষ সময়েও তিনি ব্যাটসম্যানদের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে গেছেন!
শেষ কথা!
১৯৯৬ সালে ম্যালকম মার্শাল ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের কোচ হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেট চলাকালীন সময়ে হঠাৎ জানা গেল মার্শালের কোলন ক্যান্সার হয়েছে! সারা ক্রিকেট পৃথিবী যেন এই খবরে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল! এ সময় কোচিং ছেড়ে দিয়ে তিনি ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেন। কিন্তু, ক্রিকেটের ইতিহাসের অসম সাহসী ও নির্মমতম বোলার শেষ পর্যন্ত ক্যান্সারের কাছে হার মানতে বাধ্য হন। ৪ নভেম্বর ১৯৯৯, তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান।
মাত্র ৪১ বছর বয়সে এই গ্রেট বোলারের মৃত্যু ক্রিকেট বিশ্বকে শোকাভূত করেছিল। সারা পৃথিবীর সকল প্রান্ত থেকে তাঁর জন্য শ্রদ্ধাঞ্জলি পাঠানো হয়েছিল। ফুলে ফুলে হয়েছিল তাঁর চিরবিদায়! আজও পৃথিবীর ক্রিকেটারগণ তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন।
ম্যালকম মার্শালকে স্মরণ করে তাঁর নামে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ক্রিকেট টুর্নামেন্ট হয়। হ্যাম্পশায়ারের হোম গ্রাউন্ড রোজ বোওল এ ঢোকার রাস্তাটি তাঁর নামে ‘মার্শাল ড্রাইভ’ রাখা হয়েছে। তবে, সবচেয়ে বড় উদ্যোগটি সম্ভবত ইংল্যান্ড-ওয়েস্ট ইন্ডিজ বোর্ড নিয়েছে। দুই দেশের মধ্যকার অনুষ্ঠিত টেস্ট সিরিজের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারিকে দেয়া হচ্ছে ম্যালকম মার্শাল মেমোরিয়াল ট্রফি। দুই দেশের সাক্ষাতে ১৯.১৮ গড়ে ১২৭ উইকেট নেয়া বোলারের চেয়ে আর কে-ই বা এই সম্মানের যোগ্য হতে পারতেন!
আজ ১৮ এপ্রিল, এই গ্রেট বোলারের জন্মদিন।
তাঁকে গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি!
ধন্যবাদ জুনায়েদ, এই অনবদ্য লেখাটার জন্য। তথ্য উপাত্ত যা দিয়েছ, তা হয়তো যে কেউ অন্তর্জাল ঘেঁটে বের করে আনতে পারবে, কিন্তু তোমার এ লেখাটাতে একটা প্রাঞ্জল ধারা বর্ণনা আর শ্রদ্ধা মেশানো আলোচনা আছে, যা এটাকে বেশ সুখপাঠ্য করে তুলেছে। পড়ে মুগ্ধ হয়েছি।
ধন্যবাদ, খায়রুল ভাই! 😀
জবাব দিতে দেরি হয়ে গেল। শিডিউল পাবলিশ দিয়ে নেটওয়ার্ক এর বাইরে চলে গিয়েছিলাম।
ভাল থাকবেন।
ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ
এখনো মার্শাল এর বোলিং চোখে ভাসছে।
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
আপনি ভাগ্যবান ভাই।
'৯২ এর বিশ্বকাপে দেখেছিলাম। কিন্তু স্মৃতি অতটা স্পষ্ট না... 🙁
ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ