৩।
ঐ দিন বিকেল বেলা।
ন্যাশ যখন হোটেল থেকে বের হল ততক্ষণে সূর্যের দাপট অনেকটাই কমে এসেছে। ওর পোশাক-পরিচ্ছদ এখন একেবারে পশ্চিমাদের মতনই। শুধু পার্থক্য হচ্ছে কোমরে কোন গানবেল্ট ঝোলানো নেই। এখন ও যে যেদিকে লক্ষ্য করে হাঁটছে শেরিফের অফিসটা সেদিকেই। শেরিফের অফিসের সুইঙ্গিং ডোর ধাক্কা দিতেই ও দেখল শেরিফ একমনে কি সব কাগজ-পত্র পড়ছে।
-হ্যালো শেরিফ।
-হ্যালো দেয়ার, শহরে নতুন মনে হচ্ছে…
-ঠিক ধরেছ, আমার নাম কেভিন ন্যাশ। আশা করি নাম শুনে আমাকে চিনতে পেরেছ…বলতে বলতে শেরিফের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল ন্যাশ।
শেরিফ হ্যান্ডশেক করে বলল,
-ওহ…হ্যাঁ…হ্যাঁ…আমি তো কয়েকদিন ধরেই তোমার উপস্থিতি আশা করছিলাম। অবশেষে তুমি এসেছ। এবার বল, কি এমন জরুরী কাজে তুমি এসেছ যে তোমাকে সাহায্য করার জন্য আমাকে উপর মহল থেকে ‘বিশেষ’ অনুরোধ করা হয়েছে?? কথাটা বলার সময় বিশেষ শব্দটির উপর একটু বেশি জোর দেয়াতে ন্যাশ বুঝতে পারল শেরিফ কিছুটা হলেও ব্যাপারটি নিয়ে অসন্তুষ্ট।
-দেখো, তোমাকে কষ্ট দিয়ে থাকলে আমি দুঃখিত, তবে আমার কাজের গুরুত্ব এবং ধরনের কারনেই এমনটি করতে হয়েছে।
-ইটস অলরাইট। এবার খোলাসা করে বল তুমি ঠিক কি ধরনের কাজে সানসিটিতে এসেছ এবং আমার কাছ থেকে কি ধরনের সহযোগিতা তোমার প্রয়োজন…
-’৪৮ সালের কুখ্যাত গোল্ডরাশের পর পুরো ক্যালিফোর্নিয়া জুড়ে যে অরাজকতার সৃষ্টি হয়েছিল তা নিশ্চয়ই তোমার মনে আছে? দলে দলে মানুষ তখন পুব থেকে পশ্চিমে এসেছিল। শুধু ’৪৯ তেই ৫৫,০০০ হাজার মানুষ এসেছিল স্থলপথে অর্থাৎ ঘোড়ায় বা স্টেজকোচে এবং আরো ২৫, ০০০ হাজার এসেছিল সমুদ্র পথে। এই বিপুল সংখ্যক স্বর্ণশিকারিদের কারনে এ অঞ্চলের ভৌগলিক এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ হয়েছিল হুমকির সম্মুখিন। এছাড়া জমির মালিকানা নিয়ে তৈরি বিরোধে মারা পড়েছে হাজার হাজার মানুষ। এখন পরিস্থিতি কিছুটা ভাল হলেও আবার নতুন করে যে ঝামেলা শুরু হবে না তা কে বলতে পারে! সবচেয়ে বড় কথা ক্যালিফোর্নিয়া আমেরিকার স্টেট হবার পর এখনো কোন ভূমি জরিপ করা হয় নি। সুতরাং কেন্দ্রীয় সরকার চাইছে এই এলাকায় নতুন করে একটি পূর্ণাংগ জরিপ করতে। এতে করে আধুনিক মানের একটি মানচিত্র তৈরি করাও সম্ভব হবে। ফলে সরকারী ও বেসরকারি জমির সীমানা খুব সহজেই পার্থক্য করা সম্ভব হবে।
এই পর্যায়ে বাধা দিয়ে শেরিফ বলে উঠল,
-এসব ব্যাপারে আমার জ্ঞান প্রায় শূণ্যের পর্যায়ে, তবুও আমার ধারনা এ ধরনের কাজ করতে বেশ বড় একটি দল অপারেট করতে হয়।
-ঠিকই বলেছ। আমাদেরও এমন একটি দলই কাজ করবে। আমাকে তুমি এডভান্স ইউনিট বলতে পার। অর্থাৎ মূল দলের আগেই আমি চলে এসেছি, অনেকটা রেকির কাজ করার জন্য। সপ্তাহ খানেকের মধ্যে আমার দলের অন্যান্য সদস্যরাও চলে আসবে আশা করি।
-হুম, বুঝলাম। তো কবে থেকে তোমার কাজ শুরু করবে?
-কাজ তো অলরেডি শুরু হয়ে গেছে…তুমি একটা উপকার করবে? একটা মিটিং ডেকে আমাকে তোমার শহরের সবার সাথে পরিচয় করে দিতে হবে। বিস্তারিত কিছু জানাবার দরকার নেই, শুধু জানাবে আগামী কিছুদিন সানসিটি এবং আশ-পাশের কিছু শহরে আমার পদচারনা থাকবে। আমি চাই না, চলার পথে অনাহূত অতিথি ভেবে কেউ আমাকে গুলি করুক…
-নো প্রবলেম! মুচকি হেসে শেরিফ উত্তর দিল। ‘তবে, তোমাকে দেখে মনে হয় নিজের দেখ-ভাল তুমি ভালই করতে পার।‘
-ভাল কথা মনে করেছ। ফায়ার আর্মস বহন করার ব্যাপারে তোমার বিশেষ কোন আইন নেই তো?
-সানসিটিতে আমি যতটা সম্ভব ভায়োলেন্সমুক্ত রাখার চেষ্টা করি। কিন্তু কিছু কিছু সময় আসে যখন ওটাকে আর এড়ানো যায় না। অবশ্য, একটা কথা আগে থেকেই জানিয়ে রাখি-অস্ত্র কোমরে নিয়ে ঘোরার আগে নিশ্চিৎ হয়ে নিও ওটা তোমার লায়াবিলিটি নয়, এসেট!
-শেরিফ, আশা করি তুমি আমাকে আন্ডারএস্টিমেট করছ না! নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে আমি পুরোপুরি সচেতন। শুধু এটুকুই বলব- বন্ধু হিসেবে আমি যতটা ভাল, শত্রু হিসেবে তার চেয়ে অনেক বেশি খারাপ!
খানিকটা হালকা চালে কথাটা বললেও ন্যাশের এই কথায় শেরিফের গলাটা কেমন জানি একটু শুকিয়ে গেল। জোর করে হেসে জানালো,
-আরে, আমি তো কিছু মিন করে কথাটা বলিনি…
চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে হ্যাট মাথায় পড়তে পড়তে ন্যাশ বলল,
-আমি জানি। আমি কিছু মনে করিনি…
দরজা ঠেলে বেরিয়ে যাবার মুহুর্তে ন্যাশ আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে শেরিফকে প্রশ্ন করল,
-আচ্ছা তোমার এখানে কি পুরনো ফাইল সংরক্ষণ করা হয়?
-কত পুরনো?
-এই ধর ১৫/১৬ বছর আগের…
-আলমারি খুঁজে দেখতে হবে। কেন, তোমার কোনটা দরকার?
-ঠিক আমার না, এক বন্ধু এখানে আসব শুনে বলেছিল সম্ভব হলে পুরনো এক ফাইল ঘেঁটে দেখতে। এখনই দরকার নেই, আছি তো কিছুদিন। সময় হলে দেখা যাবে। এখন তবে যাই, তোমার সাথে পরিচিত হয়ে ভাল লাগল।
-আমারও…!
ন্যাশ চলে যাবার পরও শেরিফ এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ দরজার দিকে তাকিয়ে থাকল। একটা কথা ও ভালোই বুঝতে পারছে ঐ লোকের সাথে শত্রুতা করা কারো জন্য মোটেই স্বস্তির ব্যাপার হবে না। কথা শুনেই বোঝা যায় কঠিন লোক!!
৪।
পরদিন সকাল বেলা।
সকালের নাস্তা খাবার জন্য ন্যাশ এসেছে ওর হোটেলের পাশের সেলুনটাতে। ‘সানশাইন ইন’ এ খাবার এর কোন সু-ব্যবস্থা না থাকার কারনেই সকালে উঠে এই ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। ন্যাশের অবশ্য খুব বেশি অসুবিধা হচ্ছে না। ফলে চুপচাপ নাস্তা খেয়ে যাচ্ছে। খুব আহামরি কিছু নয়-ডিম ভাজি, বেকন এবং টেইলর পর্ক রোল। কফি মগে চুমুক দিতে দিয়ে খেয়াল করল সেলুন মালিক ওর দিকে এগিয়ে আসছে। আগে থেকেই ন্যাশ জানে ওর নাম ম্যাথু টেইলর। ঝানু ব্যবসায়ী, মানুষ হিসেবে মন্দ নয়। অন্ততঃ যেচে পড়ে কারো ক্ষতি করে না বা কারো গলা কেটে মুনাফা লোটে না।
-হাই!
-হ্যালো।
-তুমিই তাহলে শহরের নতুন মানুষ!
-ঠিক বলেছ। কেভিন ন্যাশ!
-আমি ম্যাথু টেইলর। আমাদের এখানে নতুন লোক খুব বেশি আসে না। তোমাকে দেখে তাই ভাল লাগল। আশা করি এখানকার খাবার তোমার ভাল লেগেছে।
-তোমাদের খাবার সত্যিই খুব ভাল। তুমি কতদিন ধরে সানসিটিতে আছ?
-তা প্রায় ৮/৯ বছর ধরে।
-আমি সরকারি একটা কাজে এখানে এসেছি। তুমি এই শহর সম্পর্কে আমাকে কিছু জানাও…
-সানসিটি অন্য কোন পশ্চিমা শহর থেকে আলাদা নয়। গোল্ডরাশ এবং এরপর রেল লাইন বসানোর সময় সানসিটি জমজমাট হয়ে উঠেছিল। তবে এই এলাকায় সোনা পাওয়া যায় নি বলে জমজমাট ভাবটা বেশিদিন টেকে নি। তারপরও এখনো যা আছে একেবারে মন্দ নয়। শহরের দক্ষিণ দিকটাতে রয়েছে ডাবল এ্যারো র্যাঞ্চ, মালিক ক্রিস এভার্ট। আর উত্তর দিকে আছে হ্যারি মার্টিনের এইচএম র্যাঞ্চ। আশপাশে ছোট-খাট কিছু র্যাঞ্চ থাকলেও ওরা গরু পালতে পারে না, শুধুমাত্র কৃষি-কাজ করতে পারে। এটা এভার্ট-মার্টিনের যৌথ এক অলিখিত নিয়ম। কেউ এর প্রতিবাদ করতে পারে না। এমনকি শেরিফও ওদের কাজে নাক গলায় না।
-আজব তো! এক বনে দুই বাঘ!
-ঠিক বলেছ! এমন অদ্ভূত কান্ড আমি আগে কোথাও দেখি নি। ক্ষমতার এমন সুষম বণ্টন, তাও এতদিন ধরে, খুবই অস্বাভাবিক। আমার অবশ্য কোন সমস্যা হয় না। সবার জন্যই আমার সেলুনের দরজা খোলা। আয়-রোজগার যা হয়, দিব্বি চলে যায়।
টেইলরের পোশাক-আশাক, জুতো, মুখে দামি সিগার দেখে বোঝা যাচ্ছে ‘দিব্বি চলে যাবার’ চেয়েও ভালো আছে সে। ন্যাশ অবশ্য সেটা নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য করল না। ম্যাথু টেইলরের কথা-বার্তায় আন্তরিকতার ছোঁয়া পেয়ে একটি জিনিস এখন ন্যাশের কাছে পরিস্কার- ও কে এবং কি কারনে সানসিটিতে এসেছে তা জেনে নিয়েছে। অবশ্য ছোট্ট এই শহরে কথা ছড়াতে বেশি সময় লাগে না। বোঝা যাচ্ছে শেরিফ ওর কথা অনুযায়ী সবাইকে ওর সম্পর্কে জানিয়ে দিয়েছে। ‘ভালোই হয়েছে, এখন আর কেউ আমাকে অপরিচিত কিংবা বহিরাগত মনে করবে না। তবে এখনো নতুন কিছুই জানতে পারলাম না!’ মনে মনে ভাবল ও। খাবারের বিল দিয়ে, খাবারের জন্য আরেকবার ধন্যবাদ দিয়ে ন্যাশ সেলুন থেকে বের হয়ে এল।
প্রথমেই ও গেল টেলিগ্রাফ অফিসের দিকে। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকেই দেখল বিরক্তিভরা চেহারার অপারেটর বসে আছে। নিউইয়র্ক হোক, বা এই ছোট্ট শহর সানসিটি- সবখানেই সরকারী কাজে নিযুক্ত লোকগুলো সবসময় মুখ গোমড়া করে কেন যে বসে থাকে এটা ওর মাথায় ঢুকল না।
-ভাইজান, আমার নামে কি কোন টেলিগ্রাম এসেছে? আমার নাম কেভিন ন্যাশ।
অপারেটর ওর দিকে এমনভাবে তাকালো যে এই মাত্র ও ব্যাটার বউ এর মৃত্যু সংবাদ দিল!
-কি নাম বললে? কেভিন ন্যাশ, না? হুম…এই যে একটা টেলিগ্রাম আছে, প্রায় এক সপ্তাহ পুরনো। টেক্সাস থেকে ফিল কলিন্স নামে কেউ পাঠিয়েছিল।
টেলিগ্রাম পড়ে দেখল ফিল লিখেছে ওর কাজ শেষ। দু একদিনের মধ্যে সানসিটিতে আসার পরিকল্পনা করছে। ফিল কলিন্স ওর মামাতো ভাই। একসাথেই আসার কথা ছিল, কিন্তু অফিসের কিছু কাজের জন্য ও শেষ মুহুর্তে আটকে গিয়েছিল। বোঝা যাচ্ছে সেই কাজ শেষ হয়েছে এবং ইতোমধ্যে সে রওনাও দিয়েছে। তারমানে আজ-কালকের মধ্যে ও পৌঁছে যাবে।
– থ্যাঙ্কু! এবার আমার দুটো টেলিগ্রাম পাঠাতে হবে। একটা ক্যালিফোর্নিয়া আর অন্যটা নিউইয়র্ক এ।
-ঠিক আছে, এই কাগজে কোথায় কোন বার্তা পাঠাবে ঠিকানাসহ লিখে দাও। আমি এখুনি পাঠিয়ে দিচ্ছি।
কাগজ-কলম নিয়ে ন্যাশ চেয়ারে বসে লেখা শুরু করল। নিউইয়র্ক এর জন্য লিখল ‘পৌঁছে গেছি। শেরিফ যথেষ্ট আন্তরিক। কাজ শুরু করেছি। মুর এর জন্য অপেক্ষা করছি।’ ক্যালিফোর্নিয়ার জন্যও প্রায় একই রকম বার্তা লিখে শেষে ‘কাজ শুরু করে দিয়েছি, নতুন ম্যাপটা সাথে করে নিয়ে আসবে’- কথাটা জুড়ে দিল।
-এবার খেয়াল করে শোন- নিউইয়র্ক এর টা ইঞ্জিনীয়ার থিওডর জুডাহ এর জন্য। আর ক্যালিফোর্নিয়ারটা যাবে রেলওয়ে অফিস বরাবর মাইকেল মুর এর জন্য। ঠিক আছে?
-ঠিক আছে।
(এখানে বর্ণিত তথ্য ও উপাত্ত ঐতিহাসিকভাবে সত্য নাও হতে পারে)
🙂
আরেকটু কি বড় হতে পারতো?
তবে বোঝা যাচ্ছে নেক্সটে গ্যাঞ্জাম শুরু হবার ব্যাপারে এই টেলিগ্রাফ ভূমিকা রাখবে ..
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ