(এখানে বর্ণিত তথ্য ও উপাত্ত ঐতিহাসিকভাবে সত্য নাও হতে পারে)
১।
সানসিটি, ক্যালিফোর্নিয়া।
শহরের একমাত্র আন্ডারটেকার ডার্টি মরিস এক দলা থুথু ফেলে জানালো কবর খোঁড়ার কাজ শেষ। গত কিছুদিন টানা বৃষ্টি হবার কারনে মাটি নরম হলেও আঠাল ভাবের জন্য কাজটা মোটেও সহজ ছিল না। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি এখনো চলছে বলে ইতোমধ্যেই কবরের মধ্যে পানি জমা শুরু হয়ে গেছে। কনকনে ঠান্ডার মধ্যে বৃষ্টিতে ভিজে গিয়ে সে রীতিমতন ঠকঠক করে কাঁপছে। বেশিক্ষণ দেরি করলে পুরো কবর খোঁড়ার কষ্টটা নিষ্ফল হয়ে যায় কিনা- এই ভাবনায় সে একটু চিন্তিত! কথাটা নির্মম শোনা গেলেও তার কথায় যুক্তি আছে। তাছাড়া কবর খোঁড়াই যার কাজ, তার কাছে যে কোন মৃত দেহই একটি লাশ বৈ অন্য কিছু নয়। সবচেয়ে বড় কথা, মারা যাবার প্রায় তিন দিন পার হয়ে গেছে, প্রচন্ড ঠান্ডার কারনে এখনো দেহ থেকে দুর্গন্ধ না আসলেও খুব শীঘ্রই তা শুরু হয়ে যাবে। উপস্থিত সবাই পরিস্থিতি বিবেচনা করে লাশ দাফনে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তাড়াহুড়া করে কফিন নামানোর জন্য কিছুটা কাদা-মাটি ছলকে উপরে উঠে এল।
বাবা-মা এর কবরের সামনে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকা ছোট্ট ছেলেটিকে দেখে আশ-পাশে যারা ছিল, তাদের পক্ষে চোখের পানি আটকে রাখা মুশকিল হয়ে গেল। ছেলেটির বয়স এগারো-বার এর বেশি হবে না। শেরিফ এরিক আর্থারের রিপোর্ট অনুযায়ী তাদের মৃত্যু হয়েছে রেইঞ্জ ওয়্যার এর ক্রস ফায়ারে পড়ে। তবে কানাঘুষা শোনা যাচ্ছে ক্রস ফায়ারগুলো নাকি ইচ্ছাকৃতই ছিল। ছোট এবং মাঝারী আরো পাঁচ র্যাঞ্চারের মৃত্যু এই ধারনাকে বদ্ধমূল করেছে। কিন্তু প্রমানের অভাবে ক্রিস এভার্ট কিংবা হ্যারি মার্টিন-কাউকেই দোষী সাব্যস্ত করা যাচ্ছে না। এই দুই জনের নাম আসার কারন, পুরো ঘটনায় আপাত এরাই লাভবান হয়েছে। পরিত্যক্ত র্যাঞ্চগুলো এই দুইজন ইতোমধ্যে নাম মাত্র মূল্যে ক্লেইম করেছে। ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলোয় এমন কেউ বেঁচে নেই, যে আদালতের সামনে পুনঃতদন্তের জন্য আবেদন করতে পারে।
আপাতত ছোট্ট ছেলেটি শেরিফের তত্ত্বাবধানে থাকবে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর জানা গেছে ওর দুঃসম্পর্কের এক আত্মীয়া পুবে থাকেন। সম্পর্কে তিনি ছেলেটার ফুফু হন। শেরিফ তাকে টেলিগ্রাম করে দিয়েছে, ভদ্রমহিলা না আসা পর্যন্ত শেরিফ আর তার স্ত্রী রিটা আর্থার ছেলেটিকে আগলে রাখবেন। তাদের নিজেদের একটি সমবয়সি মেয়ে আছে, র্যাচেল আর্থার। সুতরাং ছেলেটার ফুফু না আসা পর্যন্ত তার যত্ন বা সঙ্গীর অভাব হবে না- তা বলাই যায়।
-বাছা, কেঁদো না। ঈশ্বর তোমার বাবা-মা এর মতন ভাল মানুষের আত্মাকে নিশ্চয়ই শান্তিতে রাখবেন। বৃষ্টি জোরে পড়া শুরু হয়েছে, তোমার ঠান্ডা লেগে যাবে। এখন আমাদের যেতে হবে…’ রিটা আলতো করে ছেলেটিকে বললেন।
চোখ মুছতে মুছতে ছেলেটি রিটার সাথে রওনা হল।
ওদের যাওয়া দেখে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে শেরিফ তার অফিসের দিকে হাঁটা শুরু করল। বাইরে শান্ত দেখালেও ভেতরে ভেতরে ওর চিন্তার ঝড় চলছে। এরিক আর্থার শেরিফ হিসেবে একশ ভাগ যোগ্য না হলেও ওর সততা এবং নির্লোভ মনমানসিকতা নিয়ে কেউ কখনো প্রশ্ন তুলতে পারে নি এবং পারবেও না। সব কাজে নিজের বিবেকের কাছে সম্পূর্ণ পরিষ্কার থাকার চেষ্টা করে। কিন্তু আজ ওর মনে হচ্ছে কোথাও কোন গুরুতর ভুল করে ফেলেছে। কিন্তু কিই বা করার আছে ওর? এমনিতেই লোকবল অত্যন্ত কম, একাই পুরো শহরের আইন-শৃংখলার দায়িত্ব পালন করতে হয়। সবচেয়ে বড় কথা কোন সাক্ষী-প্রমাণ নেই। সাধারণ জ্ঞান-বুদ্ধি থেকে বুঝতে পারছে রেইঞ্জ ওয়্যার বাহানা মাত্র, পুরো ঘটনাই ক্রিস এভার্ট এবং হ্যারি মার্টিনের ঘৃণ্য এবং ধুরন্ধর পরিকল্পনার ফসল। তারপরও হাত পা গুটিয়ে দেখা ছাড়া কিচ্ছু্টি করার নেই।
দু সপ্তাহ আগে ক্রিস এভার্ট এবং হ্যারি মার্টিন ওর অফিসে এসেছিল। ওদের অভিযোগ ছিল কে বা কারা জানি ওদের র্যাঞ্চ থেকে গরু চুরি করছে। পরিষ্কার করে কিছু না বললেও ওদের অভিযোগ ছিল মূলত আশপাশের ছোট-খাট র্যাঞ্চারদের দিকেই। আর্থার ওদের কথা দিয়েছিল ঘটনার সুষ্ঠ তদন্ত করবে এবং দোষীদের শাস্তির ব্যবস্থা করবে। কিন্তু কিছু শুরু করার আগেই লড়াই শুরু হয়ে গেল। অসম এই লড়াইয়ের ফল যা হবার তাই হল, কিন্তু এতটা দুঃখজনকভাবে শেষ হবে তা কে ভেবেছিল?
অফিসে পৌঁছে দ্বিতীয় বারের মতন দীর্ঘশ্বাস ফেলে রেইঞ্জ ওয়্যারের ফাইলটা আলমারিতে তুলে রেখে শেরিফ একটি সিগারেট ধরাল। এরপর চেয়ারে বসে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে আপন মনে গভীর ভাবনার জগতে ডুবে গেল।
২।
পনের বছর পর।
কু উ উ উ…
ট্রেনের একটানা হুইসেলের শব্দে ন্যাশের ঘুম ভেঙ্গে গেল। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই চোখে পড়ল লোকালয়ের চিহ্ন, যা সামনের শহরের উপস্থিতি ঘোষণা করছে। আড়মোড়া ভেঙ্গে শরীরের জড়তা কাটাবার চেষ্টা করতেই টিকিট চেকারের হাস্যোজ্জ্বল চেহারা নজরে এল।
-স্যার, আমরা প্রায় পৌঁছে গেছি। আপনার মাল-পত্র গুছিয়ে নিন। দুই বগি পেছনে আপনার ঘোড়াটা আছে। আমাদের লোক ওটাকে নামিয়ে দেবে।
-ধন্যবাদ।
-আপনাকেও ধন্যবাদ, স্যার।
মাল-পত্র বলতেই আপনাদের মাথায় যদি বিশাল বাক্স-প্যাটরার ছবি ভেসে ওঠে তাহলে ঝেড়ে ফেলুন। কেননা ন্যাশ কখনোই সাথে বেশি জিনিসপত্র বয়ে নিয়ে বেড়ায় না। নিত্য-প্রয়োজনীয় টুকটাক জিনিসপত্র বোঝাই মাঝারি সাইজের একটি ব্যাগ। ব্যাগের ওজন সম্ভবত বেশি হবে না। অবশ্য এমনো হতে পারে ন্যাশের দীর্ঘাবয়ব এবং সুঠাম দেহের কারনে ওজন বেশি হওয়া স্বত্ত্বেও সাবলীলভাবে ও ব্যাগটি এক হাতে ধরে আছে। ট্রেন স্টেশনে থামার পর ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে প্ল্যাটফর্মে নেমে পড়ল ও।
প্ল্যাটফর্মটা একেবারে জীর্ণ-শীর্ণ না হলেও অবস্থা সুবিধার নয়। কাঠের তৈরি কাঠামোর অনেক খানেই রঙ চটে গেছে। কোথাও কোথাও ভেঙ্গেও গেছে। কে বলবে এই প্ল্যাটফর্মটি মাত্র দুই/তিন বছরের পুরনো? একেবারে সামনে ঝুলে থাকা সাইন বোর্ডে লেখা ‘সান সিটি’ পড়তে তো রীতিমত কষ্ট হচ্ছে। ন্যাশ যদি আগে থেকেই শহরের নাম না জানত, তাহলে হয়ত ঐ লেখা পাঠোদ্ধার করতে পারত না।
ট্রেন থেকে নামতেই দুপুরের রোদ যেন এক ঝাঁক মৌমাছির মতন সারা গায়ে প্রখর তাপের কামড় বসিয়ে দিল। ভালোই হল, ঘুম ঘুম যে ভাবটা ছিল তা নিমিষেই কেটে গেল। ট্রেনের কর্মচারীর কাছ থেকে ঘোড়া বুঝে নিয়ে ওটার স্যাডেলে কাঁধের ব্যাগটা চাপিয়ে দিয়ে হেঁটে হেঁটে মূল শহরের দিকে রওনা দিল ন্যাশ।
*****************************************
তপ্ত দুপুরের সানসিটি বরাবরের মতনই সুনসান, শান্ত। মানুষের আনাগোনা নেই বললেই চলে। তবুও ঘোড়া নিয়ে কাছের হোটেলটির আস্তাবলের দিকে যেতে যেতে ন্যাশ বুঝতে পারল বেশ কিছু আগ্রহী চোখ তাকে পরখ করে দেখছে। পশ্চিমে এই ব্যাপারটি মোটেও অস্বাভাবিক নয়। তাছাড়া ন্যাশ এবং ওর ঘোড়া-দুজনেই মানুষের মনোযোগ কাড়তে অনেক পারদর্শী। ঘোড়াটা জাতে স্ট্যালিয়ন, তবে স্বাভাবিকের চেয়েও প্রায় মুঠো-দুয়েক উঁচু। গায়ের পশম ছাই রঙের হলেও পায়ের গোড়ালী পুরোটা সাদা। দেখে মনে হয় যেন সাদা মোজা পড়েছে। আর ঘোড়ার নড়াচড়া দেখেই বোঝা যায় প্রাণশক্তি অফুরান, মাইলের পর মাইল একটানা ছুটতে পারে।
ন্যাশ লম্বায় প্রায় ছ’ফুট সাড়ে পাঁচ ইঞ্চি। পেটা শরীর, গায়ে এক ছটাকও বাড়তি মেদ নেই। এই মুহুর্তে স্যুট পড়ে থাকলেও হাতের পেশি এবং মুগুরের মতন হাতজোড়া জানান দিচ্ছে-প্রতিপক্ষ হিসেবে অনেক ভয়ংকর ও। চেহারায় কঠোর ভাব থাকলেও চোখ জোড়া অনেক মায়া কাড়া, বেশ বড় বড়। বর্তমানে সে চোখ দুটি আশ-পাশের সব কিছু জরিপ করায় ব্যস্ত।
আস্তাবলে ঘোড়া রেখে ন্যাশ লম্বা লম্বা পা ফেলে হোটেলের দিকে এগোল। হোটেলের নাম ‘সানশাইন ইন’। রেজিষ্টারের জন্য যে লোকটি বসে আছে, সে নিজেই হোটেলটির মালিক। ড্যারেন কুপার। কাউন্টারের কাছে দাঁড়াতেই সে চোখ তুলে ন্যাশের দিকে তাকালো। ন্যাশ ওর মাথার হ্যাট খুলে কাউন্টারের উপর রেখে বলল,
-হাউডি, কুপার।
-হাউডি, কিন্তু তুমি আমার নাম জানলে কি করে? বেশ হচকিত হয়ে সে জিজ্ঞাসা করল।
-নতুন কোথাও গেলে আমি হোমওয়ার্ক করে প্রস্তুত হয়েই যাই। এতে করে সময় ও শ্রমের অনেক সাশ্রয় হয়।
-তা যা বলেছ, মিষ্টার…
-ন্যাশ…কেভিন ন্যাশ। বুঝতে পারছি আমি কে, কি করি, কি কারনে এসেছি- এসব জানার জন্য তোমার অতি ক্ষুদ্র মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষ চঞ্চল হয়ে পড়েছে! তোমাকে নিরাশ করতে হচ্ছে বলে আমি দুঃখিত। তবে আপাতত এটুকু জেনে রাখ আমি আইনের বিপক্ষে নেই…
-ফেয়ার এনাফ! তোমাকে সানসিটিতে স্বাগতম। এবার বল তোমার জন্য আমি কি করতে পারি?
-আমার একটি কামরা লাগবে। কতদিনের জন্য আপাতত বলতে পারছি না, তবে এই মুহুর্তে দশ দিনের জন্য এডভান্স দিয়ে রাখব। এর চেয়ে কম থাকলে টাকা ফেরৎ দেবে আশা করি, আর বেশি থাকলে চেক আউটের সময় দেব, ঠিক আছে?
-অবশ্যই ঠিক আছে।
হিসাব-নিকাশ, লেন-দেন শেষে পাঁচ মিনিটের মাথায় ন্যাশ ওর কামরায় পৌঁছল। দোতলায়, রাস্তার দিকের কামরা-ঠিক যেমনটি ও চেয়েছিল। দ্রুত জামা কাপড় ছেড়ে টাবের পানির মধ্যে নিজেকে এলিয়ে দিল। লম্বা সফরের ক্লান্তি দূর করতে গোসলের চেয়ে কার্যকরী পন্থা আর হয়-ই না।
ওয়েষ্টার্ণ ক্লাসিক আমার সবথেকে বেশি প্রিয়, মুভিগুলোও। কাজেই, তোমার এই লেখাটাও। ধন্যবাদ জুনা।
লস এঞ্জেলস ছাড়ছি এক বছরের জন্য। এর আগেই একটা কথা জানায়ে যাই- ক্যালিফোর্নিয়াতে মোট ২৩টা শহরের নাম শুরু হয়েছে 'সান' দিয়ে (সূত্রঃ উইকি) 🙂
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
মাহমুদ ভাই,
অনেক দিন পর আপনার সাথে দেখা হল- দশ বার বছর তো হবেই... 😛
শহরের না দেয়া তাহলে ভুল হয় নাই... 😀
ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ
হ, মেলা দিন বাদে।
তাত্তারি লেখা শেষ কর, মনে হচ্ছে বেশ ভালো লাগবে। তবে নায়ক যেনো হয় সেইরকম রাফ-এন্ড-টাফ, ফাইটগুলোও 🙂
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
অনেকদিন পর একখানা ওয়েস্টার্ন পড়লাম। ভালো লাগলো। কাল রাতেই, নো কান্ট্রি ফর ওল্ড ম্যান দেখলাম। বারবার মুভির সেই শেরিফের কথা মনে পরে যাচ্ছিল।
😀
ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ
ভাল লাগলো ভাই। :clap:
দেখা যাক এরপর কি হয়......
... কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!
দেখা যাক... 😀
ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ
:clap: :clap: :clap:
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
😀 😀 😀
ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ
সিরিজ শেষ হবে তো?
কাহিনীর সময়কাল?
নূপুরদা, আমার কিছুটা হলেও এ ব্যাপারে সুনাম আছে... 😀
কাহিনীর সময় কাল - ১৮৫৯-৬০...
ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ
:thumbup: :thumbup:
:teacup:
ভালো হইছে।
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
ভাই, ধন্যবাদ... 😀
ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ