ঊনত্রিশ-‘দ্যা টুয়েন্টি নাইন’: কার্ডের একটি খেলা!!

(ডিসক্লেইমারঃ যারা টুয়েন্টি নাইন খেলার নিয়ম জানেন না, তাদের কাছে এই পোষ্ট বিরক্তিকর লাগতে পারে। আগাম ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।)

-‘ট্যাঁ ট্যাঁ ট্যাঁ…’
-‘কিরে হালা, অমন করস ক্যান?’
-‘সানাই বাজাই…খিকজ…’
-‘শিট্‌, তোর কাছে ম্যারেজ আছে?’
-‘আবার জিগায়…খেলা তাইলে তেইশে এ গেল গা…’
-‘কোন ব্যাপার না, এমন টেকনিক্যাল খেলা দিমু…’
-‘মামা, এই খেলা তুলতে টেকনিক্যাল না এক্কেবারে গাবতলী টাইপ খেলা দিতে হইব…মু হা হা…’

আমি শুভর দিকে বোঝার চেষ্টা করলাম ওর হাতের কি অবস্থা, মানে খেলা তুলতে পারবে কিনা। ও আমাকে হালকা ইশারা করে আশ্বস্ত করল। কিন্তু আমি ঠিক নিশ্চিন্ত হতে পারলাম না। কেননা টুয়েন্টি নাইন খেলায় এক হাতে খেলা তোলা যদিও অনেক সময় সম্ভব, কিন্তু আমার হাতের কার্ডের যে অবস্থা, তাতে ব্যাপারটা ‘মুশকিল-ই নেহি নামোঙ্কিন’ হয়ে গেছে…তবে শুভকে যতটা চিনি ও খেলা তুলেই ছাড়বে, তা সে যেভাবেই হোক। কেননা এইবার না তুলতে পারলে আমরা কালো সেট খেয়ে যাব।

-‘কত উঠছে দেখ তো, দোস্ত?’ শুভ জিজ্ঞাসা করল।
আমি কার্ড দেখে গুনে দেখলাম দশ। শুভকে এটা বলতেই গম্ভীর হয়ে গেল। এখনো তের পয়েন্ট তুলতে হবে। ‘দেখি তো’ বলে শুভ নিজেও একবার গুনল।

হঠাৎ করে শুভ সম্পূর্ণ অন্য প্রসংগে কথা বলা শুরু করল।
-‘আচ্ছা তোদের কি মনে হয় না যুদ্ধাপরাধীদের ব্যাপারে আমরা একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করছি??’

আমি চট করে শুভর দিকে তাকালাম। ওর ভাবলেশহীন মুখ দেখেই বুঝলাম খেলা তোলার প্ল্যান ‘এ’ ফেইল করেছে অর্থাৎ এই মুহূর্ত থেকে প্ল্যান ‘বি’ শুরু হয়ে গেছে…আমি একটু অবাক হবার ভান করে ওকে জিজ্ঞাসা করলাম,
-‘তার মানে?’
-‘মানে আর কি? আমরা যুদ্ধপরাধীদের এত ঘৃণা করি, তাদের বিচার চাই…কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছি তাদের ঐ সব ঘৃণ্য কাজের জন্য অন্য কিছুও দায়ী থাকতে পারে!’

পাঠক মনে রাখবেন খেলা কিন্তু চলছে!!

আমাদের প্রতিপক্ষ শরীফ এবং আবীর যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে বরাবরই একটু বেশি আবেগপ্রবন। এ বিষয়ক একটি সংগঠনের সক্রিয় সদস্যও তারা। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ওদের প্রতিক্রিয়া হল একটু আক্রমনাত্মক।

আবীর শীতল কন্ঠে বলল,
-‘শুভ কি বলতে চাস পরিষ্কার করে বল…’
-‘না মানে, আমি বলতে চাচ্ছি-একজন মানুষ তো তার পরিবার থেকেই যাবতীয় ভাল ভাল গুণাগুণ পায়, ঠিক না? আমরা দৃঢ় বিশ্বাস রাজাকার-আলবদর পার্টির বেশিরভাগেরই পরিবার ছিল না, অর্থাৎ ওদের বাবা ছিল চির-কুমার (?) !!!’

কথাটার অন্তর্নিহিত ভাব বুঝতে কয়েক সেকেন্ড লাগল আমাদের। তারপরই সবাই একসাথে হো হো করে হেসে উঠলাম।

ইতোমধ্যে আমাদের আরো সাত পয়েন্ট উঠে গেছে। আর দরকার মাত্র ছয়। আমাদেরকে হারানোর জন্য প্রতিপক্ষেরও দরকার ছয়। শুভ আবার কথা বলা শুরু করল,

-‘তোরা কি কেউ গতকালের দৈনিক ‘সেকেন্ড হ্যান্ড দিগন্ত’ এর খবর পড়েছিস??’
-‘দূর! ঐ ‘বিপ’ ‘বিপ’ এর পত্রিকা কে পড়ে?’
-‘অনেকেই পড়ে। তাদের একজনের দেয়া লিংক থেকে জটিল এক খবর দেখলাম।‘ বলে ডাইস এর সাত খেলল।
-‘তা কি তোর সেই জটিল খবর?’ আবীর হাসিমুখে জ্যাক দিয়ে প্রশ্ন করল।
-‘রাজাকার মুজা আছে না? ওর ভাগ্নে দুই দিন আগে জলাতংক হয়ে মারা গেছে!!’

আমার হাতের কার্ডের যে অবস্থা, তার উপর প্রতিপক্ষের জ্যাক-আমি দিলাম আট।

-‘জলাতঙ্কে?? কেম্নে কি?’ বলে শরীফ দিল নয়।
অর্থাৎ ওরা পেল মোট পাঁচ পয়েন্ট। আমাদের হারাতে ওদের দরকার আর মাত্র এক!

-‘জ্বি জলাতংক! ঘটনার আগের দিন ঐ ব্যাটা মুজা’র সাথে দেখা করতে গেছিল। কথা-বার্তা শেষে কোলাকুলি করার সময় দুর্বলতা জনিত কারনে মুজা ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। এ কারনে ভাগ্নের কাঁধে মুজার দাঁতের খোঁচা লাগে। রাতের মধ্যেই জ্বর…ডাক্তার ডায়াগনোসিস করতে না পেরে জ্বর কমানোর ট্যাবলেট দিলেও জ্বর আর কমে নি। পরের দিন বিকেলে বেচারা মারা গেছে। পোষ্ট মর্টেমে ধরা পড়ছে আসলে হয়েছিল জলাতংক!’

-‘যা ব্যাটা চাপা মারিস না? মুজা’র দাঁতের আঁচড়…জলাতংক…এও কি সম্ভব? খালি চাপা! নে তোর খেলা মাইরা দিলাম’ বলে আবীর হার্টস এর জ্যাক দিল।

লাস্ট কার্ড। আমার কাছে আছে হার্টস এর নয়। অসহায় ভাব নিয়ে তাই দিলাম। এই না দেখে ‘তিনজনের সাথে একা খেলতেছি’ বলল শুভ!

শরীফ দিল আট। অর্থাৎ তিনজনের দেয়া মোট পয়েন্ট দাঁড়ালো পাঁচ!

-‘জলাতংক কাদের থেকে হয় তুই জানস না? তাইলে মুজার দাঁত থেকে হতে সমস্যা কি??? দূর! এক দানের জন্য হল না’ বলতে বলতে নিজের কার্ডটা আলতো করে কিন্তু নাটকীয়ভাবে শুভ ছুঁড়ে দিল। দশ। তবে স্পেডের, আর এবারের দানে স্পেড-ই ট্রাম্প কার্ড!!!

আবীরকে হতভম্ব দেখালো।
-‘ট্রাম্প কার্ড মার্কেট আউট হবার কথা না?’

শরীফও অনেকটা অনিশ্চিৎ ভঙ্গিতে ‘থাকার তো কথা না…তয় সত্যি কথা কি, শালার চাপা শুনতে শুনতে আমার হিসাব আউলায়া গেছে…আমার ঠিক মনে নাই…’

-‘তোরা আমারে সন্দেহ করস??? আমারে?? যা আর খেলুমই না’
শুভর কপট রাগ দেখে আমার হাসি চেপে রাখা মুশকিল হয়ে পড়ল।

-‘চল বাইরে থেকে হেঁটে আসি’ বলে আমিও খেলা বাদ দেবার পক্ষে ভোট দিলাম।

রিস্ক নেবার কি দরকার? খেলা বাদ না দিলে ওদের যে কোন সময়ে মনে পড়ে যেতে পারে প্রথম দানে আমিই স্পেডের দশ খেলেছিলাম…মু হা হা হা…!!

৮,৩০৭ বার দেখা হয়েছে

৬৪ টি মন্তব্য : “ঊনত্রিশ-‘দ্যা টুয়েন্টি নাইন’: কার্ডের একটি খেলা!!”

  1. রকিব (০১-০৭)

    জুনাদা,
    জলাতঙ্কের কথা বললেন; কুকুররা কিন্তু মাইন্ড খাবে। রাজাকাররা উহাদেরও অধম।
    গল্প ভালো ছিল। 😀


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন
  2. কামরুলতপু (৯৬-০২)

    রাতের পর রাত জেগে ২৯ খেলতাম। হায়রে সেসব দিনগুলি।
    আমাদের মধ্যে এক দানে ১১ পয়েন্ট সর্বোচ্চ উঠেছিল সেটা রেকর্ড। প্রথম জন J দেওয়ার পর পাশের জনের এক কার্ডে ৯ পরে গিয়েছিল আর তার পার্টনার খেলা ধরে ফেলেছে ভেবে অন্য কার্ডের J দিয়ে দেওয়ার পর শেষের জন মোক্ষম সময়ে রঙ করেছিল তাও J দিয়ে। আজ পর্যন্ত ওরকম আর দেখিনি।

    জবাব দিন
  3. কামরুল হাসান (৯৪-০০)

    কিছু হয় নায়। কইষা মাইনাস।
    যা গিয়া মাস্ফুর লুঙ্গিটা নিয়া আয়, তোরে রগ্রাইতে হইবে।


    ---------------------------------------------------------------------------
    বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
    ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।