প্রকৃত অনুভূতির চরিত্র বিষয়ক

বিষাদকে একটা চরিত্র ধরা যাক। ধরা যাক তার হাত মুখ নাক চোখ গলা গ্রীবা চুল সবই আছে। তার সাথে আমার প্রায়ই দেখা হয়। পথে, ফুটপাতে, রিকশা ঠিক করার সময়ে, পাবলিক বাসে ঝুলতে ঝুলতে ঘামে ভিজভিজে হতে থাকলে। মাঝে মাঝে পরিচিত ঘরে ফিরে জুতোজামা খুলতে খুলতেও তার মুখ দেখি। সে এসে বসে থাকে বিছানার প্রান্তে। চুপচাপ। বেশি জ্বালায় না। আগে অনেক বিব্রত করতো। এখন আমিও ঘাগু হয়ে গেছি। ওকে আলটপকা চিৎপটাং করে দিতে পারি। তখন দেখা যায় সে থতমত খেয়ে বেকুব হয়ে গেছে।

হর্ষকেও আরেকটা চরিত্র দেই। সে বেশ ধুরন্ধর-গোছের। সবটুকু সময়ে আসবে না। মাঝে মাঝে দেখা দিবে। খুব অপ্রত্যাশিত কোন সময়ে একেবারে চমকে দেয়ার মতোন। মাঝেমাঝে তাকে টের পেতে সমস্যা হয়। মজার ব্যাপার, বিষাদকে আমার যতটা ভয় লাগে, যতটা আমি সন্তর্পণ সজাগ হয়ে থাকি কখন কোন চোরাগোপ্তা আক্রমণ করবে সে, ঠিক সেরকম আতিথেয়তায়, আমি হর্ষের জন্য অপেক্ষা করি। কখন সে আমাকে উন্মাতাল আবেশে মাতিয়ে দিবে। দিনের সূর্যরশ্মির মতো অকৃত্রিম প্রবাহে আমার চরাচর ভাসিয়ে দিবে।

আরেক চরিত্র দুঃখ। না, কোন সাদামাটা দুঃখ নয়, যেগুলো আমি রোজ দেখি, পাই, আত্মপীড়নের সুখের মত উপভোগ করি। তারা নয়, সেগুলো নয়। দৈনন্দিন সেসব দুঃখ খর্বাকৃতি বামনের মত অনেকটাই যাপনের অনুষঙ্গ। মাঝে মাঝে একটু’র জন্যে বাস মিস করে আধা ঘণ্টা দেরি হওয়া, অফিসে ঢোকার ঠিক আগেই ঝুপঝুপে বৃষ্টিতে ভিজে একসা হওয়া, অফিস ছুটি একটু আগে একগাদা কাজ এসে হাজির হওয়া, ফেরার পরে বাসার ইলেকট্রিসিটি না থাকা, ঘুমানোর আগে টের পাওয়া যে এমাসের বাড়ি ভাড়া দেয়া হয়নি আর সেটা কালকেই দিয়ে দিতে হবে, আর দিয়ে দিলেই অনেকগুলো টাকা বের হয়ে যাবে- এরকম ছোটখাট দুঃখেরা মশারির মাঝে গুপ্তচর মশার মত বসবাস করে।

আমার মনোযোগ অন্যরকম দুঃখের দিকে। তিনি বড়ো ভয়াবহ খদ্দের, ঝোলাভর্তি ব্রহ্মাস্ত্র নিয়ে আসেন। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই অবিবেচকের মতো একটার পর একটা বাণে আমাকে জর্জরিত করে। অশ্বত্থামা মারা গেছে শুনে দ্রোণাচার্যও এতটা রেগে ছিল না! তাঁর রুদ্ররূপে আমার কেবলই মায়ের মুখ মনে পড়ে! এরকম দুঃখের সাথে মৃত্যুসাধ আর গ্লানি আর বিষণ্ণতা মিশে থাকে। এরকম দুঃখদের তোড়ে আমি ভেঙে যেতে থাকি, দুমড়ে যেতে থাকি, ক্ষয়াটে হয়ে উঠতে থাকি, বিলীন হয়ে নামতে থাকি। আমার চেহারা আর আচরণেও তাদের গভীর ছাপ পড়ে যায়। যে কেউ, চেনা-অচেনা বা রাস্তার পেরিয়ে যাওয়া মানুষ, আমাকে দেখলেই বুঝে ওঠে আমি সেই দুঃখবোধে বুঁদ হয়ে আছি। নেশার মতোই আমার ধমনীতে তারা খোড়ল কাটছে।

আমি জানি না ঠিক কীভাবে মানুষ দুঃখবোধ কাটিয়ে ওঠে। প্রতিনিয়ত আমরা নখের আঁচড়ের মত আক্রান্ত হই, সেই অবস্থা কী করে উপশমিত হয়, এভাবে ‘সেরে ওঠা’র প্রক্রিয়াটা কেমন তা বুঝে উঠতে চাই আমি। আশে পাশের অনেক স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়াই আমি বুঝি না। কীভাবে একটা গাছ ক্ষুদ্র চারা থেকে লকলকিয়ে বেড়ে ওঠে, কীভাবে ঋতুরা নিয়মিত বিরতিতে ফিরে ফিরে আসে, কীভাবে পিঁপড়ের সারি টের পায় যে ঝেঁপে বৃষ্টি নামবে, এরকম আরো হাজার প্রাকৃতিক নিয়মের পেছনের কারণ আমার অজানা থাকে। তাতে কিছু যায় আসে না কারণ এসব প্রক্রিয়া আমাকে ছাড়াও সুন্দর চলেছে, আমি চলে যাবার পরেও সুন্দর চলবে। আমার জীবনেও তারা নীরবে প্রচ্ছন্ন-প্রভাব খাটিয়ে যাবে অজান্তেই। তবে দুঃখবোধ কাটিয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটা আমার বুঝে নেয়া দরকার। খুব জরুরি না হলে আমি এভাবে ভাবতাম না।

বিষাদ বেশ চালাক। আজকাল আমাকে এভাবে ভেঙে পড়তে দেখে পর্যুদস্ত হতে দেখে সে ক্রূর হাসে। ঠা ঠা করে খ্যাক খ্যাক করে হো হো করে হাসে। আর মাঝে মাঝে উন্মাদের মত লাফিয়ে আমার ঘাড়ে চড়ে বসে। আমাকে গলাধাক্কা দেয়। নির্মমভাবে লাথি কষায় আমার পাঁজরে। আমি বিষাদের ওপর তীব্র ক্রোধ অনুভব করি। “শালা কুত্তার বাচ্চা! শয়তান! শুয়োরের বাচ্চা!” এরকম গালি ছিটকে ছিটকে প্রস্রাবের মত বের হতে থাকে। অধিক যন্ত্রণায় মানুষ কেমন পশু হয়ে যায়, তাই না? পাশবিক মাংশ ঢেকে রাখা সভ্য-ভব্যতার খোলশটা খসে পড়ে। গোঁ গোঁ করতে করতে আমি উঠে দাঁড়াই।

এক নাগাড়ে দুঃখ আর বিষাদের সাথে যুদ্ধ করি। মাঝে একটু হর্ষ এসে ফিক করে হেসে আমার দিন-রাত-দিগন্ত-দেহ ঝলমলিয়ে যায়। তারপরও অবিশ্রান্ত আঘাতে আমি ক্লান্ত হতে থাকি মনে মনে। এরকম লড়াইয়ের শেষ আমার মৃত্যুতেই, এই বোধটা আমার কোষের মাতৃকায় ঢুকে যায়। পেরেকের ধারে সেই চিন্তাটা আমাকে কষ্ট দিতে থাকে। নিরর্থক মনে হয় তাবৎ লড়াই, সকল ক্রোধ। বেমালুম ফাঁকিবাজি মনে হয় এই নিঃশ্বাস, এই হেসে ওঠা, এই চুমু-দীর্ঘশ্বাস-সঙ্গম-রাত্রিযাপন-দিনপালন। শূন্যতার আসল অর্থ আমরা জানি না বলেই ভ্রান্ত বিশ্বাস নিয়ে বাঁচি। একবার ঝলক দিয়ে দেখা দেয় নিরতিক্রম্য ব্যর্থ সমাপ্তি। তখনই চট করে বুঝে যাই এখানে সুখের নামে, দুঃখের নামে, বিষাদ কিংবা হর্ষের নামে আমাদের জীবনের বেচাকেনা হয়ে যায় চোখের পলকে, আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই।

ছলকে এক ফোঁটা পানি বেয়ে নামে পাপড়িমূল থেকে। এত বিষাদাক্রান্ত যাপিত জীবন আমাকে কাঁদাতে পারেনি, কিন্তু দূর্লঙ্ঘ্য এই অর্থহীনতা আমাকে উন্মূল করে দেয়। জানি, এই জীবনের মাঝে দুঃখ-বিষাদ-হর্ষ চরিত্রেরা আমাকে মনে রাখবে না। তাদের সাথে মিতালির জীবন একরকম কেটে যাচ্ছে। মৃত্যুর পরেও তারা এই নশ্বর পৃথিবীর বুকে অন্য মানুষের হৃদয় খুবলে খুবলে খাওয়ার সময়ে এক পলকের জন্যেও আমার কথা মনে করবে না।

***
২১.১.৯

৪,১৫০ বার দেখা হয়েছে

৫০ টি মন্তব্য : “প্রকৃত অনুভূতির চরিত্র বিষয়ক”

  1. তাইফুর (৯২-৯৮)

    আন্দালিব ...
    তুই লেখক বটে ...
    তুই বস
    (জুনিয়ার'রে বস কইলাম ... শুধু লেখক হিসাবে ... তারমানে কিন্তু এই না যে ... )


    পথ ভাবে 'আমি দেব', রথ ভাবে 'আমি',
    মূর্তি ভাবে 'আমি দেব', হাসে অন্তর্যামী॥

    জবাব দিন
  2. রহমান (৯২-৯৮)
    কিন্তু দূর্লঙ্ঘ্য এই অর্থহীনতা আমাকে উন্মূল করে দেয়

    কিন্তু এই দূর্বোধ্যৎন্ত্যোপাটিত শব্দযুগল (দূর্লঙ্ঘ্য ও উন্মূল) আমাকে দিগ্বিদিকহিতাহিতজ্ঞানশূন্য করে দেয় 🙁

    আন্দা, সত্যি বলতেছি উপরের কোট করা লাইন বাদে পুরাটা বুঝছি এইবার 😀

    আমি দিনদিন তোমার লেখার ফুল পাখা (মানে, পুরা ফ্যান) হই যাচ্ছি ভাই। লিখতে থাক :boss:

    জবাব দিন
    • আন্দালিব (৯৬-০২)

      মানবজীবনের অর্থহীনতার কথা বলছিলাম। আমাদের জন্মের আগে কিছু নাই, মৃত্যুর পরেও কিছু নাই। মাঝখানে দেয়াশলাইয়ের কাঠির মত দপ্‌ করে জ্বলে ওঠা, নিভে গেলেই গাঢ় অন্ধকার। এই চিন্তাটা আমাকে খুব অসহায় আর শিকড় উপড়ে ফেলা মানুষের মত করে দেয়।

      দূর্লঙ্ঘ্য= যাকে অতিক্রম বা জয় করা যায় না। যেমন- দূর্লঙ্ঘ্য দুর্গম মাউন্ট এভারেস্ট।
      উন্মূল=উৎ+মূল। মূল থেকে উপড়ে ফেলা।
      এই ফাপর দালালিটুকু ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেইখেন রহমান ভাই। 🙂

      [আমি দিন দিন আপনাদের ফ্যান হয়ে যাচ্ছি :boss: ]

      জবাব দিন
  3. তানভীর (৯৪-০০)

    আন্দালিব, তোমার লেখাগুলা বরাবরই ব্যতিক্রম হয়!
    ঈর্ষনীয় সুন্দর করে লিখ তুমি।

    দুঃখবোধটা অনেক বেশি মনে হল। আশা করি, দুঃখ-বিষাদের চেয়ে হর্ষেরা তোমার জীবনে আরো বেশি আসবে।

    জবাব দিন
    • আন্দালিব (৯৬-০২)

      তানভীর ভাই, দুঃখবোধের আঁচড় মানুষের জীবনে বেশিই পড়ে। এজন্যে এই অনুভূতিকে নিয়ে বেশি কথা বলা। আবার দুঃখের সময়ে বিষাদাক্রান্ত হওয়ার ঘটনাও ঘটে। সব মিলিয়ে একটা বাজে অবস্থা হয়ে যায়।
      সবার জীবনেই দুঃখের কষ্টের প্রকোপ কমুক। হর্ষ একটু রেগুলারলি যাতায়াত করুক। এরকম হলেই মনে হয় ভাল হবে!

      জবাব দিন
  4. সাকেব (মকক) (৯৩-৯৯)

    আন্দালিব,
    তাইফুর ভাইয়ের চোথা মাইরা আমিও বলতে চাই,

    তুই লেখক বটে …
    তুই বস

    মানুষ এতো গভীর চিন্তা কিভাবে করে?
    আবার এতো সুন্দর গুছায়ে সেইটা কিভাবে প্রকাশ করে? :-/

    তুমি সিসিবির একটা রত্ন :hatsoff:


    "আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
    আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস"

    জবাব দিন
  5. এহসান (৮৯-৯৫)

    কালকে একবার পড়েছিলাম। আজকে আবার পড়লাম।এইবারো মাথার উপর দিয়া গেছে। 🙁 কিন্তু কমেন্টগুলো পড়ে কিছুটা ভাব উদ্ধার করেছি। 🙂 বাকীটা দেশে এসে তোমার সাথে দেখা করে আবার পড়বো এবং বৃঝে নিবো।

    জবাব দিন
  6. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    বিষাদ বা দুঃখ কোনোটাই আমাকে অবসর দেয় না। আমি দুঃখবিলাসী নই। বিষাদজয়ীও নই। হর্ষকে নিয়ে আমি নিজের ভেতরে মেতে থাকি সবসময়।

    আন্দালিবের পোস্টে মন্তব্য কি করবো? :hatsoff: ব্রাদার।


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন
  7. ওবায়দুল্লাহ (১৯৮৮-১৯৯৪)

    শূণ্যতা।
    মানুষের জীবনে সে ধ্রুব
    আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত।

    কষ্ট।
    সে বাড়ে লতায় পাতায়।
    সুখ নামক মেঘ এসে
    তাকে রাখে ঢেকে
    ক্ষনিকের তরে।

    বিষন্নতা।
    সে বড্ড আহলাদী।
    একবার সুযোগ পেলে-
    হাত ধরে কাছে আসে
    এরপর উঠে ঘাড়ে
    এবং ক্লাইমেক্সে সে
    এক্কেবারে মগজে।

    :hatsoff:


    সৈয়দ সাফী

    জবাব দিন
  8. কামরুলতপু (৯৬-০২)

    দোস্ত তোর লেখাগুলা কেন যেন নিজের সাথে মিলে যায়। নাকি তুই সার্বজনীন লেখা লিখিস। বিষাদের সাথে আমার বহুদিনের বন্ধুত্ব। সে আমাকে ছাড়ে না আমার এখন হঠাৎ হঠাৎ ওর শুন্যতাকে কেমন যেন লাগে। হর্ষকে আমি প্রতিদিন চাইনা । আসুক হঠাৎ হঠাৎ ভাসিয়ে দিক আমাকে । সেই একদিনের হর্ষ আমাকে অনেক দিনের বিষাদের সাথে কাটানোর পুঁজি দিয়ে যাক।
    কিভাবে ঘাগু হইলি বিষাদকে বোকা বানাইলি এট্টু শিখাইস তো।

    জবাব দিন
  9. মুহাম্মদ (৯৯-০৫)

    একসময় অনেক বিষাদ-দুঃখ ছিল। হর্ষ ছিল কম। এই লেখাটার মতই। তখন পড়লে বোধহয় আরও ভাল লাগতো।
    এখন তো দুঃখ-বিষাদ নাই। তার জায়গা করে নিছে নির্লিপ্ততা। তাই এই লেখা পড়েও নির্লিপ্ত থাকলাম।

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।